ব্রিটিশ এমপি টিউলিপ সিদ্দিকের বিরুদ্ধে পূর্বাচল নতুন শহর প্রকল্পে প্লট বরাদ্দে জালিয়াতির মামলার বিচার প্রক্রিয়া নিয়ে তীব্র সমালোচনা করেছেন যুক্তরাজ্যের পাঁচজন শীর্ষস্থানীয় আইনজীবী।
ওই মামলাকে ‘সাজানো’ এবং ‘অন্যায্য’ হিসেবে বর্ণনা করে যুক্তরাজ্যে বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূতকে চিঠি দিয়েছেন তারা।
ওই আইনজীবীদের মধ্যে আছেন রবার্ট বাকল্যান্ড, যিনি বরিস জনসনের কনজারভেটিভ সরকারের আমলে যুক্তরাজ্যের বিচার মন্ত্রী ছিলেন।
এছাড়া ব্রিটেনের সাবেক প্রধানমন্ত্রী টনি ব্লেয়ারের স্ত্রী শেরি ব্লেয়ার, ডমিনিক গ্রিভ, ফিলিপ স্যান্ডস, জিওফ্রি রবার্টসনের নাম রয়েছে বলে ব্রিটিশ সংবাদমাধ্যম গার্ডিয়ানের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে।
চিঠিতে তারা বলেছেন, সাবেক প্রতিমন্ত্রী টিউলিপ সিদ্দিক এই মামলা লড়ার “ন্যূনতম অধিকারও পাননি”; অভিযোগ সম্পর্কে যথাযথ ধারণা বা আইনজীবীর নিয়োগের সুযোগ–“কিছুই তিনি পাননি।”
লন্ডনের হ্যাম্পস্টেড অ্যান্ড হাইগেটের আসনের লেবার এমপি টিউলিপ বাংলাদেশের সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ভাগ্নি।
জুলাই আন্দোলন দমনে ‘মানবতাবিরোধী অপরাধের’ অভিযোগে গত সপ্তাহে শেখ হাসিনার অনুপস্থিতিতে তাকে মৃত্যুদণ্ডের রায় শোনানো হয়েছে, যাকে সাজানো আদালতে প্রতিহিংসার রায় হিসেবে আখ্যায়িত করেছেন তিনি।
বিভিন্ন আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থাও ওই রায় ও বিচার প্রক্রিয়া নিয়ে প্রশ্ন তুলেছে।
শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে ওই রায়ের পর এবার প্লট জালিয়াতি চার মামলার রায়ের তারিখ ঘোষণা করেছে আদালত, যেগুলোর মধ্যে একটিতে তার বোন শেখ রেহানা, রেহানার মেয়ে টিউলিপ সিদ্দিকও আসামি।
দুদকের দায়ের করা ওই মামলার রায়ের জন্য ১ ডিসেম্বর দিন রেখেছে আদালত। হাসিনা, রেহানা এবং ব্রিটিশ এমপি টিউলিপকে ‘পলাতক’ দেখিয়ে এ মামলাটির বিচার কাজ এগিয়ে নেওয়া হয়।
পলাতক দেখানোয় তাদের পক্ষে কোনো আইনজীবী মামলা লড়ার সুযোগ পাননি। দুদক সর্বোচ্চ শাস্তি হিসেবে তাদের বিরুদ্ধে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড চেয়েছে।
টিউলিপ বরাবরই তার বিরুদ্ধে ওঠা অভিযোগ অস্বীকার করে আসছেন।
তার ঘনিষ্ঠ একজন বলেছেন, “এটি ব্যক্তিগত প্রতিহিংসার মামলা। এমনকি তার (টিউলিপ) নিজের দলের বাইরের খ্যাতনামা রাজনীতিবিদরাও এ অসঙ্গতিপূর্ণ বিচার নিয়ে প্রশ্ন তুলছেন। ড. ইউনূসের জন্যও বিষয়টি লজ্জাজনক।”
যুক্তরাজ্যে বাংলাদেশের হাই কমিশনার আবিদা ইসলামকে লেখা চিঠিতে আইনজীবীরা দাবি করেছেন, বাংলাদেশে টিউলিপ যাকে আইনজীবীকে হিসেবে নিয়োগ দিতে চেয়েছিলেন, তাকে “সরে যেতে বাধ্য করার পাশাপাশি গৃহবন্দি করা হয় এবং তার মেয়েকে হুমকিও দেওয়া হয়।”
চিঠিতে তারা লিখেছেন, “এই বিচার প্রক্রিয়া সাজানো এবং অন্যায্য উপায়ে মামলা পরিচালনার উদাহরণ।”
মামলায় অভিযোগ করা হয়েছে, টিউলিপ তার খালা, সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে ‘প্রভাবিত’ করে ঢাকার পূর্বাচলে তার মায়ের (রেহানা) জন্য একটি প্লট বরাদ্দ করাতে সহায়তা করেছিলেন।
অভিযোগ অস্বীকার করে টিউলিপ বলে আসছেন, এসব অভিযোগ ‘রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত।”

আইনজীবীরা তাদের চিঠিতে লিখেছেন, অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা মুহাম্মদ ইউনূস আইনের শাসন ও ন্যায়বিচারের গুরুত্ব নিয়ে বারবার কথা বলে এলেও বাংলাদেশে এমন বিচার প্রক্রিয়া নিয়ে তাদের ‘গভীর উদ্বেগ’ রয়েছে।
“তিনি (টিউলিপ সিদ্দিক) যুক্তরাজ্যে থাকেন এবং যুক্তরাজ্যের নাগরিক, তিনি পলাতক কেউ নন। তিনি নির্বাচিত এমপি; হাউস অব কমন্সে তার সঙ্গে যোগাযোগ করা যায়, আর অভিযোগের যথাযথ ভিত্তি থাকলে তাকে বিচারের মুখোমুখি করতে বাংলাদেশে প্রত্যর্পণ করাও সম্ভব।
“সিদ্দিককে অভিযোগপত্র বা প্রমাণ কিছুই দেখানো হয়নি; তিনি আইনজীবীও পাননি। বাংলাদেশে যে আইনজীবীকে তিনি নিয়োগ দিয়েছিলেন, তাকে দায়িত্ব ছাড়তে বাধ্য করা হয়েছে। তিনি (আইনজীবী) জানিয়েছেন, তাকে গৃহবন্দি রাখা হয়েছিল এবং তার মেয়েকে হুমকি দেওয়া হয়েছিল।”
চিঠিতে বলা হয়, “অন্তর্বর্তী সরকার ক্ষমতায় আসার পর বিচারব্যবস্থায় হস্তক্ষেপ ও ভয়ভীতি প্রদর্শনের যে অভিযোগ উঠছে, তার সঙ্গে এটি পুরোপুরি মিলে যায়।”
ব্রিটিশ আইনজীবীরা বলেছেন, প্লট দুর্নীতির ওই মামলার বাদী ও তদন্তের দায়িত্বে থাকা দুর্নীতি দমন কমিশনের কর্মকর্তারা টিউলিপের দায়-দায়িত্ব নিয়ে গণমাধ্যমে বারবার মন্তব্য করছেন, অধ্যাপক ইউনূসও এ বিষয়ে মন্তব্য করে আসছেন।
“ক্ষমতাসীনদের এ ধরনের বক্তব্য–যেখানে সিদ্দিককে অপরাধী হিসেবে অভিযুক্ত করা হচ্ছে–এটা কীভাবে নিরপেক্ষ ও হস্তক্ষেপমুক্ত বিচার নিশ্চিত করবে আমরা তা বুঝতে পারছি না।”
চিঠিতে বলা হয়, “সবকিছু বিবেচনায় আমরা উদ্বিগ্ন। সিদ্দিকের অনুপস্থিতিতে এই বিচার প্রক্রিয়া সম্পূর্ণই অন্যায্য, তিনি আত্মপক্ষ সমর্থনের সুযোগ পাচ্ছেন না, কোনো সুযোগই পাচ্ছেন না। যুক্তিসঙ্গত কারণ ছাড়াই তার অনুপস্থিতিতে বিচার চলছে এবং এই প্রক্রিয়ায় আন্তর্জাতিক মানদণ্ড রক্ষা করা হচ্ছে না।”
এসব সমস্যার ‘সমাধান’ করে ‘ন্যায়সঙ্গত বিচার’ নিশ্চিত করতে বাংলাদেশ সরকারের প্রতি আহ্বান জানানো হয় চিঠিতে।
২০২৪ সালের ৫ অগাস্ট শেখ হাসিনার সরকার পতনের পরপর রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুত প্রকল্পে দুর্নীতির অভিযোগে টিউলিপেরও নাম আসে। বিষয়টি নিয়ে সে সময় ব্রিটিশ সংবাদমাধ্যমে তোলপাড় শুরু হয়। এরপর টিউলিপ ও তার বোনোর পাওয়া ‘উপহারের’ ফ্ল্যাট নিয়ে শুরু হয় তুমুল আলোচনা।
শেখ হাসিনা ও তার দল আওয়ামী লীগের ঘনিষ্ঠ এক ডেভেলপারের কাছ থেকে লন্ডনে ৭ লাখ পাউন্ড দামের একটি ফ্ল্যাট ‘উপহার’ পাওয়ার খবর নিয়ে সমালোচনার মধ্যে গত জানুয়ারিতে সিটি মিনিস্টারের পদ থেকে ইস্তফা দেন টিউলিপ সিদ্দিক।
যুক্তরাজ্যের প্রধানমন্ত্রী কিয়ার স্টারমার অবশ্য পদত্যাগের সিদ্ধান্ত নেওয়ার পর টিউলিপের প্রশংসাই করেছিলেন; বলেছিলেন, টিউলিপের জন্য তার দরজা খোলা থাকবে।
টিউলিপ যুক্তরাজ্যের মন্ত্রীদের আচরণবিধি ভঙ্গ করেছেন কি না, সে বিষয়ে তদন্ত করে ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রীর নৈতিকতা বিষয়ক উপদেষ্টা স্যার লরি ম্যাগনাস তাকে অভিযোগ থেকে অব্যাহতি দিয়েছিলেন।
তবে তিনি বলেছিলেন,টিউলিপ যদি তার পরিবারের বাংলাদেশি রাজনৈতিক যোগাযোগ থেকে উদ্ভূত সম্ভাব্য ‘সম্পদের ঝুঁকি’ সম্পর্কে আরও সচেতন হতেন, সেটা তার জন্য ভালো হত।



