জুলাই অভ্যুত্থানের পর বাংলাদেশের অনেক কিছুই বদলেছে, কিন্তু এই বদলের মধ্যেও আগের মতোই মাথা ঠুকে মরতে হচ্ছে দেশের অর্থনীতির প্রাণ, তৈরি পোশাক শিল্পের শ্রমিকদের।
বেতন-বোনাসের দাবিতে বরাবরের মতোই ঈদের আগে শ্রমিকদের বিক্ষোভ দেখা যাচ্ছে। আার শ্রম ভবনে সেই বিক্ষোভে অংশ নিতে গিয়ে আক্ষরিক অর্থেই একজন শ্রমিক মারা গেছেন।
অভ্যুত্থানের পর রাষ্ট্র সংস্কারসহ বড় বড় বিষয়ে মনোযোগী রাজনৈতিক দলগুলোর দৃষ্টি এই শ্রমিকদের দিকে পড়েনি। কিছু বাম দল তাতে সংহতি জানাতে গিয়ে পুলিশের মারধরের শিকারও হয়েছে।
অভ্যুত্থানের নেতারা রাজনৈতিক দল গঠন করে অনেকটা প্রাক নির্বাচনী সফরে ব্যস্ত; সেই প্রচারে অর্থ ব্যয় নিয়ে প্রশ্নও উঠেছে। তাদের মনোযোগও পায়নি পোশাক শ্রমিকরা; অথচ জুলাই অভ্যুত্থানে শতাধিক গার্মেন্টকর্মীর নিহত হওয়ার তথ্য রয়েছে।
বাংলাদেশে বরাবরই ঈদের আগে তৈরি পোশাক শিল্পের অর্ধ কোটির মতো শ্রমিকের অনেককে পাওনার দাবিতে সড়কে নামতে হয়।
এবার রোজার ঈদের আগে তিন মাসের বকেয়া বেতন, ঈদের বোনাস ও অন্যান্য সুবিধার দাবিতে ঢাকার বিজয়নগরে শ্রম ভবনের সামনে অবস্থান নিয়ে আছেন কয়েকটি কারখানার শ্রমিক। বৃহস্পতিবার ছিল তাদের অবস্থানের পঞ্চম দিন।
অ্যাপারেল প্লাস ইকো লিমিটেড, স্টাইল ক্রাফট, টি অ্যান্ড জেড অ্যাপারেলস লিমিটেড ও অ্যাপারেল আর্ট লিমিটেডের কয়েকশ শ্রমিক এই আন্দোলনে রয়েছেন।

শ্রম ভবনের সামনে অবস্থান কর্মসূচির প্রথম দিন রোববার রাম প্রসাদ সিং (৪০) নামে এক শ্রমিক অসুস্থ হয়ে মারা যান। তিনি গাজীপুরের স্টাইল ক্রাফট লিমিটেড ও ইয়াং ওয়ান্স (বিডি) লিমিটেডের সহকারী প্রোডাকশন ম্যানেজার ছিলেন।
এই শ্রমিকরা মঙ্গলবার সচিবালয়ের দিকে যেতে চাইলে তাদের ছত্রভঙ্গ করে দেয় পুলিশ। বাম আন্দোলনের কর্মী দিলীপ রায়কে পুলিশ বেধড়ক পিটুনির পর গ্রেপ্তার করে।
তবে ঈদের দিন আগেও শ্রম ভবনের সামনে শ্রমিকরা অবস্থান নিয়েই আছে। তারা বলছেন, দাবি পূরণ না হলে আরও কঠোর কর্মসূচিতে যাবেন তারা।
অ্যাপারেল আর্ট লিমিটেডের রিয়াজুল হক নামে এক শ্রমিক প্রথম আলোকে বলেন, বকেয়া বেতন, বোনাস ও ছুটির টাকা-কিছুই দেওয়া হয়নি। নারী-পুরুষ সবাই এখানেই আটকে আছেন।
টি অ্যান্ড জেড অ্যাপারেলসের শহিদুল ইসলাম বলেন, বকেয়া বেতন ও বোনাস না পেলে তারা ঈদ শ্রম ভবনের সামনেই করবেন।
অবস্থান কর্মসূচিতে থাকা নারী শ্রমিকরা নানা সমস্যায় পড়ছেন। স্টাইল ক্রাফটের সুইং অপারেটর সালমা আক্তার অভিযোগ করেন, শ্রম ভবন তালা লাগানো থাকায় টয়লেট ব্যবহারের সুবিধা নেই। রাতে আলো বন্ধ করে দেওয়া হয়। একই পোশাকে দিন কাটাতে হচ্ছে তাদের।
শ্রমিকদের এই দুরবস্থা দেখে অধিকারকর্মী মারজিয়া প্রভা এক কলামে লিখেছেন, “এই ঈদটি ভিন্নতর হওয়ার কথা ছিল। পুরোনো ফ্যাসিবাদী কায়দা থেকে ভিন্ন কোনো ব্যবস্থার ঈদ হওয়ার কথা ছিল। ১১২ জন শ্রমিকের জীবনের ওপর দাঁড়িয়ে এক নতুন নয়া রাজনৈতিককল্পের উত্থান হওয়ার কথা ছিল!
“ঈদ আসার আগমুহূর্তে দেখলাম— ‘কই! সব তো পুরোনো কায়দাতে চলছে’। জুলাই অভ্যুত্থানে এত শ্রমিকের মৃত্যুও তাদের ভাগ্যে নতুন করে কিছু লিখতে পারেনি।”
বাংলাদেশে পোশাক শ্রমিকদের হয়রানি ভারতের ইউটিউবার অর্ক ভাদুড়ীর নজরেও পড়েছে। তিনি ফেইসবুকে লিখেছেন- “হাসিনার পুলিশ দিলীপ রায়দের পেটাত, এখন পেটাচ্ছে ইউনুসের পুলিশ। গণঅভ্যুত্থান হয়েছে। শেখ হাসিনা পালিয়ে গিয়েছেন। অথচ শ্রমিকরা বকেয়া মজুরি পাচ্ছেন না৷ সরকার বদলায়, গণআন্দোলনে পুলিশের নির্যাতন বদলায় না।”
শ্রম ভবনে শ্রমিকদের অবস্থানের মধ্যে সচিবালয়ে সংবাদ সম্মেলনে এসে শ্রম উপদেষ্টা এম সাখাওয়াত হোসেন বলেন,
টিএনজেড অ্যাপারেলের শ্রমিকদের বেতন-ভাতা ওই কারখানার গাড়ি বিক্রি করে পরিশোধ করা হয়েছে। আরও তিনটি কারখানার শ্রমিকদের বেতন পরিশোধের জন্য ১২ কোটি ২৩ লাখ টাকা বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে।
শিল্প পুলিশের প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, প্রায় ৩ হাজার তৈরি পোশাক কারখানার ১২২টি এখনও তাদের শ্রমিকদের ফেব্রুয়ারি মাসের বেতন পরিশোধ করেনি।
তবে অ্যাপারেল প্লাস ইকো লিমিটেড ও অ্যাপারেল আর্ট লিমিটেডের কিছু শ্রমিককে আংশিক বোনাস দেওয়া হয়েছে বলে তারা সাংবাদিকদের জানিয়েছেন। তারা সম্পূর্ণ বকেয়ার দাবিতে আন্দোলনে থাকার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন।

উপদেষ্টা সাখাওয়াত বলেন, “আমরা সর্বোচ্চ চেষ্টা করছি যাতে সবাই তাদের প্রাপ্য বেতন-ভাতা পায়। আজ বা আগামীকাল সকাল থেকে যারা বেতন দিচ্ছে না, তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া শুরু করব।”
শ্রমিকদের কাছ থেকে জানা গেছে, প্রায় ৩৩০০ শ্রমিকের মধ্যে মাত্র ৬৫০-৭৫০ শ্রমিককে ৭ থেকে ৮ হাজার করে টাকা দেওয়া হয়েছে, যা তাদের এক মাসের বেতনের ৭০/৮০ ভাগ। আর তাদের পাওনা ৩/৪ মাসের বেতন।
লেখক-গবেষক কল্লোল মোস্তফা শ্রমিকদের পাওনা নিয়ে ফেইসবুকে লিখেছেন- “টিএনজেড গ্রুপের দুই কারখানার ৩ হাজার ৪০০ শ্রমিকের বকেয়া মজুরি ও বোনাস দিতে কত হাজার কোটি টাকা লাগবে জানেন? ১৬ কোটি টাকা। টিএনজেড অ্যাপারেলসের ২ হাজার ৬০০ শ্রমিকের ২ মাসের মজুরি ও বোনাসের জন্য ১১ কোটি টাকা। অ্যাপারেল প্লাস ইকো লিমিটেডে ৮০০ শ্রমিকের ৩ মাসের মজুরি ও বোনাসের জন্য ৫ কোটি টাকা।
“জ্বি, ৩৬ বিলিয়ন ডলার বা ৪ লক্ষ ৩২ হাজার কোটি টাকার গার্মেন্ট ইন্ডাস্ট্রির মালিক গোষ্ঠির জন্য ১১ কোটি টাকা বকেয়া মজুরি জোগার করা এত কঠিন! বছরে ৪ লক্ষ ৩২ হাজার কোটি টাকা রপ্তানি আয় করা মালিক গোষ্ঠিকে হাজার হাজার কোটি টাকা রপ্তানি প্রণোদনা প্রদানকারী সরকারের পক্ষে মালিকগোষ্ঠির উপর চাপ প্রয়োগ করা এত কঠিন! এতই কঠিন যে, শ্রমিকরা দিনের পর দিন আন্দোলন করবার পরও আংশিক মজুরি দিয়ে সরকার ও মালিক পক্ষের যৌথ প্রযোজনায় সমস্ত বকেয়া পরিশোধের নাটক সাজাতে হয়!”
সাহিত্যিক জাকির তালুকদার পোশাক শ্রমিকদের বঞ্চনার দীর্ঘ ইতিহাসের দিকে আলোকপাত করে লিখেছেন, “বছরের পর বছর ধরে এমন কোনো ঈদ দেখলাম না যার আগে গার্মেন্ট শ্রমিকরা পুলিশ এবং মালিকের মাস্তানদের হাতে মার খায়নি। নিজেদের রক্ত-ঘামের পাওনা আদায় করার জন্য রাস্তায় নামতে হয় শ্রমিকদের। গার্মেন্ট মালিক নামক সরকারের মদদপুষ্ট দুর্বৃত্তরা এমন অত্যাচার চালিয়ে আসছে বছরের পর বছর।”
গণঅভ্যুত্থানের সরকারের সময়ও কেন শ্রমিকদের পাওনার দাবিতে রাজপথে নামতে হবে? এই প্রশ্ন তুলে তিনি বলেন, “গণঅভ্যুত্থানের সরকার সেই একই ধারায় প্রশ্রয় এবং সর্বাত্মক সহযোগিতা দিয়ে যাচ্ছে দুর্বৃত্ত মালিকদের। শেখ হাসিনার আমলে শতাধিক গার্মেন্ট মালিক ছিল এমপি। কেউ কেউ মন্ত্রী। তাই তারাই ছিল নীতি-নির্ধারক। কিন্তু এখন ইউনূস সাহেব কেন তাদের নির্যাতন চালিয়ে যেতে দিচ্ছেন?”
এই শ্রমিকদের পাশে না দেখে সমালোচনা চলছে অভ্যুত্থানের তরুণদের গড়া দল জাতীয় নাগরিক পার্টিরও। তবে দলটির যুগ্ম সমন্বয়ক অনিক রায় শ্রমিকদের পাওনা পরিশোধের দাবি জানিয়ে ফেইসবুকে লিখেছেন।
তিনি সরকারকে হুঁশিয়ার করে বলেছেন, “সরকার বাহাদুরকে স্মরণ করিয়ে দিতে চাই, যে গণঅভ্যুত্থানের ওপর ভিত্তি করে আপনারা ক্ষমতায় এসেছেন, সেই অভ্যুত্থানে বাংলাদেশের শ্রমজীবী মানুষের অবদান অনস্বীকার্য। গণঅভ্যুত্থানের পরেও যদি শ্রমিকদের তাদের ন্যায্য বেতনের জন্য রাস্তায় নামতে হয়, তবে তা অত্যন্ত লজ্জাজনক।”