যুদ্ধবিরতিতে গাজা-ইসরায়েল, স্থায়ী সমাধান কবে?  

সব ঠিকঠাক থাকলে রোববার সকালটা অন্যরকম হতে পারে গাজার অধিবাসীদের জন্য। স্থানীয় সময় সকাল সাড়ে ৮টা থেকে  কার্যকর হচ্ছে যুদ্ধবিরতি চুক্তি।
সব ঠিকঠাক থাকলে রোববার সকালটা অন্যরকম হতে পারে গাজার অধিবাসীদের জন্য। স্থানীয় সময় সকাল সাড়ে ৮টা থেকে কার্যকর হচ্ছে যুদ্ধবিরতি চুক্তি।

দীর্ঘ ১৫ মাসের ইসরায়েলি হামলায় গাজা এখন রীতিমতো ধ্বংসস্তূপ, বিধ্বস্ত এক নগরী। খাদ্য সংকটে হাজারো মানুষ। না খেয়ে মরছে শিশুরা। স্বাস্থ্যসেবা ভেঙে পড়েছে, যেন মৃত একটি গোটা জনপদ।

ইসরায়েলের আক্রমণে নারী ও শিশুসহ ৪৬ হাজার ৭শ’র বেশি মানুষ নিহত হয়েছেন এই সময়ে, যাদের বেশিরভাগই ছিলেন সাধারণ নাগরিক।

গাজায় হামাসের সঙ্গে যে যুদ্ধবিরতি চুক্তিতে যাচ্ছে ইসরায়েল সরকার, তার আওতায় জিম্মিদের বিনিময়ে ফিলিস্তিনি বন্দিদের মুক্তি দেবে তারা।

সব ঠিকঠাক থাকলে রোববার সকালটা অন্যরকম হতে পারে গাজার অধিবাসীদের জন্য। স্থানীয় সময় সকাল সাড়ে ৮টা থেকে (জিএমটি সাড়ে ৬টা) কার্যকর হচ্ছে যুদ্ধবিরতি চুক্তি।

এই যুদ্ধবিরতি স্থায়ী কোনো সমাধান না হতে পারে, অন্তত ১৫ মাসের যুদ্ধাবস্থার একটি সাময়িক সমাধান পেতে যাচ্ছে গাজাবাসী, যার সূত্রপাত ‘কয়েক দশক ধরে নিপীড়নের শিকার’ ফিলিস্তিনিদের হামলাকে কেন্দ্র করে। ২০২৩ সালের ৭ অক্টোবর ইসরায়েলের অভ্যন্তরে হামলা চালিয়েছিল তারা।

অবশ্য বিরতিতে যাওয়ার ঘণ্টা কয়েক আগে ইসরায়েলের প্রেসিডেন্ট সতর্ক করে দিয়েছেন এই বলে যে, তার দেশ এই যুদ্ধবিরতি থেকে যেকোনো সময় বেরিয়ে আসার অধিকার রাখে।

যা আছে যুদ্ধবিরতি চুক্তিতে

কাতার বুধবার চুক্তির একটি বিস্তৃত রূপরেখা ঘোষণা করে; যার মধ্যস্থতায় রয়েছে যুক্তরাষ্ট্র এবং মিশর। তবে ইসরায়েলি এবং হামাসের আলোচকরা চূড়ান্তভাবে কী কী বিষয়ে সম্মত হয়েছেন তার পুরো বিবরণের এখনও আনুষ্ঠানিক ঘোষণা আসেনি।

তবে মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন বলেছেন, “এই চুক্তি গাজায় লড়াই বন্ধ করবে, ফিলিস্তিনি বেসামরিক নাগরিকদের প্রয়োজনীয় মানবিক সহায়তা বাড়াবে এবং ১৫ মাসেরও বেশি সময় ধরে বন্দি থাকা ব্যক্তিরা তাদের পরিবারের কাছে ফিরে যেতে পারেবন।”

২০২৩ সালের অক্টোবরে হামাস হামলার পাশাপাশি ২৫১ জন ইসরায়েলিকে জিম্মি করে নিয়ে যায় গাজায়। তাদের হাতে এখনও ৯৪ ইসরায়েলি জিম্মি বন্দি অবস্থায় রয়েছে।

অবশ্য ইসরায়েলের ধারণা এদের মধ্যে মাত্র ৬০ জন জীবিত আছে।

এদের বিনিময়ে ইসরায়েল প্রায় এক হাজার ফিলিস্তিনিকে মুক্তি দেওয়ার আশ্বাস দিয়েছে, যাদের মধ্যে অনেকেই আছেন যারা কয়েক দশক ধরে কারাবন্দি রয়েছেন।

যেভাবে যুদ্ধবিরতি বাস্তবায়ন

কাতারের প্রধানমন্ত্রী শেখ মোহাম্মদ বিন আবদুল রহমান আল থানি বলেছেন, ইসরায়েল এবং হামাস তিন ধাপের চুক্তিতে সম্মত হয়েছে। চুক্তি যেমনটি হতে পারে বলে ধারণা করা হচ্ছে-

প্রথম ধাপ

প্রথম ধাপটি ৪২ দিন বা ছয় সপ্তাহ স্থায়ী হবে। এ সময় ‘একটি পরিপূর্ণ যুদ্ধবিরতি’ থাকবে।

শেখ মোহাম্মদ জানিয়েছেন, হামাস ৩৩ জন ইসরায়েলি জিম্মিকে মুক্তি দেবে, যাদের মধ্যে ‘নারী, শিশু, বৃদ্ধ অসুস্থ, আহত এবং নারী সেনা’ রয়েছে।

বিনিময়ে ইসরায়েলও তাদের কারাগারে থাকা ‘কিছু’ ফিলিস্তিনি বন্দিকে মুক্তি দেবে বলে জানালেও নির্দিষ্ট কোনো সংখ্যা জানাননি তিনি।

এরআগে ইসরায়েল সরকারের মুখপাত্র ডেভিড মেনসার বলেছিলেন, শিশুসহ ৩৩ জিম্মির সবাই না হলেও বেশিরভাগ এখনও জীবিত রয়েছে বলে ধারণা করা হচ্ছে।

ফিলিস্তিনি কর্মকর্তারা এরআগে বিবিসিকে বলেছিলেন, প্রথমদিন তিনজন জিম্মিকে মুক্তি দেওয়া হবে। বাকি বন্দি বিনিময় নির্দিষ্ট বিরতিতে ছয় সপ্তাহের মধ্যে করা হবে।

প্রথম ধাপে ইসরায়েলি সেনারা গাজার ‘সকল’ জনবহুল এলাকা থেকে বেরিয়ে যাবে এবং ফিলিস্তিনিরাও গাজায় তাদের আবাসস্থলে ফিরে যেতে পারবে।

ইসরায়েলের ক্রমাগত হামলা এবং গাজা খালি করে দেওয়ার নির্দেশে শহরটির ২৩ লাখ মানুষের প্রায় সবাই নিজ বাড়িঘর ছেড়ে যেতে বাধ্য হয়েছে।

কাতারের প্রধানমন্ত্রী জানান, প্রতিদিন শত শত লরি প্রবেশের অনুমতি দেওয়া হবে ফলে গাজায় মানবিক সহায়তা বাড়বে; পাশাপাশি হাসপাতাল, ক্লিনিক এবং খাবারের দোকানগুরো পুনর্নির্মাণ করা হবে।

চুক্তির দ্বিতীয় ও তৃতীয় ধাপের আলোচনা যুদ্ধবিরতির ১৬তম দিন থেকে শুরু হবে বলে প্রাথমিকভাবে ফিলিস্তিনি কর্মকর্তারা জানিয়েছেন।

বাইডেন বলেছেন, ‘যতক্ষণ আলোচনা চলবে’ ততক্ষণ যুদ্ধবিরতি অব্যাহত থাকবে।

দ্বিতীয় ধাপ

মার্কিন প্রেসিডেন্টে বাইডেনের মতে, দ্বিতীয় ধাপ হবে ‘যুদ্ধের স্থায়ী সমাপ্তি’।

পুরুষসহ বাকি জীবিত জিম্মিদের আরও ফিলিস্তিনি বন্দির বিনিময়ে ছাড়া হবে।

ইসরায়েল যে এক হাজার ফিলিস্তিনি বন্দিকে মুক্তি দিতে সম্মত হয়েছে তাদের মধ্যে প্রায় ১৯০ জন ১৫ বছরের বেশি সাজা ভোগ করেছে বলে ধারণা করা হচ্ছে।

এর আগে এক ইসরায়েলি কর্মকর্তা বিবিসিকে জানিয়েছিল, যারা হত্যা মামলায় দণ্ডিত তাদেরকে অধিকৃত পশ্চিম তীরে মুক্তি দেওয়া হবে না।তবে গাজা থেকে ইসরায়েলি সেনাদের পূর্ণ প্রত্যাহার হবে।

তৃতীয় ধাপ

তৃতীয় এবং চূড়ান্ত ধাপ হচ্ছে গাজা পুনর্গঠন। যার জন্য বছরের পর বছর লেগে যেতে পারে। এছাড়া যদি জিম্মিদের দেহ থাকে তা ফিরিয়ে দেওয়া।

নিরুত্তর প্রশ্নগুলো

হামাস এবং ইসরায়েল পরস্পরকে অবিশ্বাস করায় এ পর্যন্ত পৌঁছাতে মাসের পর মাস পরোক্ষ আলোচনা চেষ্টার প্রয়োজন হয়েছে।

হামাস জিম্মিদের মুক্তি দেওয়ার আগে যুদ্ধের সম্পূর্ণ অবসান চাইছিল; যা ইসরায়েলের কাছে ছিল অগ্রহণযোগ্য।

চুক্তির বাকি শর্তগুলো পূরণ হওয়ার সময় যুদ্ধবিরতি কার্যকর থাকবে। তবে এর মানে যুদ্ধ চিরতরে বন্ধ হবে কিনা সে বিষয়টিও স্পষ্ট নয়।

যুদ্ধ ইসরায়েলের মূল লক্ষ্য ছিল হামাসের সামরিক ও শাসনক্ষমতা ধ্বংস করা। তারা হামাসকে মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করতে সক্ষম হলেও এখনও কাজ করতে বা পুনরায় সংগঠিত হওয়ার ক্ষমতা রয়েছে হামাসের।

এছাড়া কোন কোন জিম্মি জীবিত বা মৃত এবং হামাস কি সমস্ত নিখোঁজ জিম্মিদের অবস্থান জানে কিনা সে বিষয়টিও স্পষ্ট নয়।

চুক্তির অংশ হিসেবে হামাস কিছু বন্দিকে মুক্তি দেওয়ার দাবি করে যাদের ইসরায়েল মুক্তি দিতে অস্বীকার করেছে। ধারণা করা হয় যে এর মধ্যে ৭ অক্টোবর হামলার সাথে জড়িতরাও রয়েছেন।

এছাড়া ইসরায়েল ও গাজার বাফার জোন থেকে ইসরায়েলি সেনা প্রত্যাহার করতে রাজি হবে কিনা বা সেখানে তাদের অবাধ গতিবিধি থাকবে কিনা সেটিও এখনও জানা যায়নি।

এমন অবস্থায় যেকোনো যুদ্ধবিরতি নাজুক হওয়ার সম্ভবতা বেশি।

এরআগেও ইসরায়েল এবং হামাসের মধ্যে যে যুদ্ধবিরতিগুলো হয়েছিল তা সংঘর্ষের কারণে তা শেষ পর্যন্ত ভেস্তে যায়।

এই যুদ্ধবিরতির সময়সূচি এবং জটিলতা এমন যে ছোট একটি কারণও বড় হুমকি হিসেবে সামনে আসতে পারে।

৭ অক্টোবর, ২০২৩

হামাস নেতৃত্বাধীন শত শত বন্দুকধারী দক্ষিণ ইসরায়েলে হামলা চালিয়েছিল। তারা সীমান্ত বেড়া ভেঙে ফেলে লোকালয়ে পুলিশ স্টেশন এবং সেনা ঘাঁটিতে হামলা চালায়।

ওই হামলায় অন্তত ১২শ’ লোক নিহত হয় এবং ২৫০ জনকে জিম্মি করে গাজার যোদ্ধারা। এছাড়া ইসরায়েলে হাজার হাজার রকেট ছোড়ে হামাস।

এর জবাবে ব্যাপক সামরিক হামলা চালায় ইসরায়ে। প্রথমে আকাশ থেকে এবং পরে স্থল আক্রমণ শুরু করে তারা। তারপর থেকে ইসরায়েল গাজায় সর্বাত্মক হামলা শুরু করে। আর হামাস ইসরায়েলে রকেট হামলা চালায়।

গাজা স্বাস্থ্য বিভাগের মতে, ইসরায়েলের আক্রমণে নারী ও শিশুসহ ৪৬ হাজার ৭শ’র বেশি মানুষ নিহত হয়েছেন, যাদের বেশিরভাগই বেসামরিক নাগরিক।

আরও পড়ুন