মনযোগের কেন্দ্রে গ্রিনল্যান্ড, কী আছে বরফের আড়ালে?

Greenland_1

গ্রিনল্যান্ড খনিজ সম্পদের জন্য আন্তর্জাতিক মনোযোগের কেন্দ্রে থাকলেও আসলে কী আছে বিশ্বের সবচেয়ে বড় এই দ্বীপের বরফের গভীরে? শতাব্দীরও বেশি সময় ধরে দ্বীপটির ভূস্তরের গভীরে মূল্যবান খনিজ থাকার সম্ভাবনা মানুষকে আকৃষ্ট করলেও এই সম্পদ পাওয়া কতটা সহজ বা জলবায়ুর পরিবর্তনে কী প্রভাব ফেলবে?

পৃথিবীর সবচেয়ে বড় এ দ্বীপের আকর্ষণ অস্বীকার করার উপায় নেই। হাজার বছর আগে প্রথম বসতি স্থাপনকারী এরিক দ্য রেড বা হালের পর্যটক সবাইকে মুগ্ধ করছে এই দ্বীপ। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় এর এক বিচ্ছিন্ন তীরে এসে পৌঁছানো মিত্র বাহিনীও আকর্ষণ অনুভবব করেছিলে দ্বীপের মনোমুগ্ধকর দৃশ্যে।

সেই গ্রিনল্যান্ড আবারও বিশ্বজুড়ে মনোযোগের কেন্দ্রে চলে এসেছে, বিশেষকরে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডনাল্ড ট্রাম্পের চোখ পড়ার পর।

হ্যাঁ, এটি সত্যি, শতাব্দীরও বেশি সময় ধরে বিশদ অনুসন্ধানে গ্রিনল্যান্ডে ‘গুরুত্বপূর্ণ’ খনিজ সম্পদ থাকার প্রমাণ মিলেছে। যার মধ্যে রয়েছে সবুজ শক্তি প্রযুক্তিতে (গ্রিন এনার্জি টেকনোলজি) ব্যবহৃত বিরল মাটির উপাদান এবং গুরুত্বপূর্ণ খনিজ; সেইসঙ্গে জীবাশ্ম জ্বালানির মজুদ রয়েছে বলে ধারণা করা হচ্ছে।

এ সম্পদের ভাণ্ডার নিয়ে সীমাহীন উত্তেজনা তৈরি হলেও  এসব খনিজ ও জীবাশ্ম জ্বালানি খুঁজে বের করে উত্তোলন এবং পরিবহন প্রক্রিয়া শুধু কঠিনই নয়, রীতিমত চ্যালেঞ্জও বটে।

কবে থেকে দ্বীপটির ওপর নজর?

কথা হলো, ডনাল্ড ট্রাম্প প্রথম কোনো প্রেসিডেন্ট নন, যিনি দ্বীপটির দিকে প্রথমবারের মতো হাত বড়িয়েছেন! ডেনমার্কের অধীনস্থ স্বায়ত্ত্বশাসিত গ্রিনল্যান্ড এর আগেও যুক্তরাষ্ট্র অধিগ্রহণ করেছিল।

ইতিহাস ঘেঁটে দেখা যায়, ১৮৬৭ সালে যুক্তরাষ্ট্রে পররাষ্ট্রমন্ত্রী উইলিয়াম সিয়ওয়ার্ড গ্রিনল্যান্ড এবং আইসল্যান্ড নিয়ন্ত্রণে নেওয়ার দাবি উত্থাপন করেছিলেন।

এরপর ১৯১০ সালে ডেনমার্কে নিযুক্ত মার্কিন রাষ্ট্রদূত মরিস ফ্রান্সিস ইগান্স ডাচ অ্যান্টিলিস এবং ফিলিপাইনের মিন্ডানা দ্বীপের পরিবর্তে গ্রিনল্যান্ডকে পাওয়ার খায়েশ দেখিয়েছিলেন।

প্রায় তিন যুগ পর ১৯৪৬ সালে মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী জেমস বার্নেস ১০০ মিলিয়ন স্বর্ণ মুদ্রায় দ্বীপটি কিনে নেওয়ার প্রস্তাব দেন।

নিকট অতীতে ডনাল্ড ট্রাম্প তার প্রথম মেয়াদে দ্বীপটি কেনার আগ্রহ দেখালেও ডেনিশ প্রধানমন্ত্রী মেটে ফেডরিকসেন ‘অযৌক্তিক’ আখ্যা দিয়ে তা নাকচ করে দেন।

গ্রিনল্যান্ড কত বড়, বয়স কত?

বেশিরভাগ মানচিত্রে গ্রিনল্যান্ডকে বিশাল দেখা গেলেও বাস্তবে গ্রিনল্যান্ডের আয়তন প্রায় ২০ লাখ বর্গকিলোমিটার  বা ৭ লাখ ৭০ বর্গমাইল; যা প্রায় কঙ্গোর সমান।

পৃথিবীর সর্বত্রই ভূতত্ত্বে দীর্ঘ সময়ের দাগ এবং স্বাক্ষর রয়েছে। আগ্নেয়গিরির অগ্নুৎপাত এবং শীতল আগ্নেয় শিলা, বিশাল মহাদেশীয় সংঘর্ষ এবং টাফি-সদৃশ ফাটল নতুন মহাসাগরের জন্ম। আর এ সমস্ত ভূতাত্ত্বিক কর্মকাণ্ডের প্রমাণ মেলে প্রাচীন শিলা পর্যালোচনায়।

ব্রিটিশ জিওলজিক্যাল সার্ভের প্রধান ভূতত্ত্ববিদ ক্যাথরিন বলেন,“গ্রিনল্যান্ডের ইতিহাস পৃথিবীর যেকোনো কিছুর ইতিহাসের মতোই প্রাচীন।”

তিনি বলেন, এক সময় গ্রিনল্যান্ড একটি বৃহত্তর মহাদেশের অংশ ছিল, যার মধ্যে আজকের উত্তর ইউরোপ এবং উত্তর আমেরিকার কিছু অংশ অন্তর্ভুক্ত ছিল। প্রায় ৫০ কোটি বছর আগে গ্রিনল্যান্ড একটি সুপারকন্টিনেন্টের অংশ ছিল, যা ছিল ইউরোপ এবং উত্তর আমেরিকার মধ্যভাগ জুড়ে।

বিবর্তনের মধ্য দিয়ে প্রায় ৬০ থেকে ৬৫ মিলিয়ন বছর আগে সুপারকন্টিনেন্টটি আলাদা হতে শুরু করে। সেখানে একটি ফাটল তৈরি হয় যা থেকে আজকের দিনের উত্তর আটলান্টিক মহাসাগরের জন্ম।

বিজ্ঞানীদের অনুমান, গ্রিনল্যান্ডে খনির সম্পদ ছাড়াও তেল এবং প্রাকৃতিক গ্যাসও রয়েছে। গত শতকের ৭০ এর দশক থেকে গ্রিনল্যান্ডের উপকূলে, তেল এবং গ্যাস কোম্পানিগুলি তা খুঁজে বের করার চেষ্টা করলেও সফলতার মুখ দেখেনি কেউ। তারপর্র গ্রিনল্যান্ডের মহাদেশীয় শেল্ফ ভূত্ত্ব আর্কটিকের অন্যান্য জীবাশ্ম জ্বালানি সাইটগুলোর সাথে মিলে যায়।

মূল্যবান খনিজ আছে?

দ্বীপটির বেশিরভাগ অংশ ধীরে ধীরে প্রবাহিত বরফে ঢাকা। হিমবাহগুলো সাগরের দিকে এগিয়ে চলছে। মাত্র ২০ শতাংশ অঞ্চল বরফমুক্ত, যেখানে খাড়া পর্বত, সমুদ্র এবং মাঝে মাঝে শহর রয়েছে। রয়েছে নজর কাড়া রঙিন বাড়িঘর।

ডেনমার্ক ও গ্রিনল্যান্ডের ভূতাত্ত্বিক জরিপের (জিইইউএস) জ্যেষ্ঠ গবেষক থমাস ফাইন্ড ককফেল্ট বলেন, ১২০/১৩০ বছর আগে গ্রিনল্যান্ডে বিশেষ করে উত্তর-পূর্বাঞ্চলে অনুসন্ধান আলোচনার বিষয় ছিল। সেখানে বিভিন্ন খনিজের সন্ধান পাওয়া যায় এবং খনি আহরণও শুরু হয়েছিল।

১৮৫০ সালে গ্রিনল্যান্ডের দক্ষিণ-পশ্চিম অংশে ক্রায়োলাইট খনিজটি পাওয়া যায়। বেকিং সোডা তৈরিতে ব্যবহার হতে দেখে স্থানীয়রা ক্রায়োলাইট খনন শুরু করে।

এছাড়া দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় ক্রায়োলাইট সরবরাহ আসে এখান থেকেই।

গ্রিনল্যান্ডে ভূতাত্ত্বিক মানচিত্র তৈরি হয় প্রকৃতপক্ষে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর, জানান ককফেল্ট।

ডেনমার্কের আলবর্গ বিশ্ববিদ্যালয়ের টেকসই উন্নয়ন এবং পরিকল্পনা বিষয়ক প্রধান আন্নে মেরিল্ড বলেন, “অন্য অঞ্চলের খনিগুলো শূন্য হয়ে যাওয়ায় মেরু অঞ্চলের খনি আগ্রহের কেন্দ্রবিন্দু হয়ে উঠছে।”

অবশ্য গ্রিনল্যান্ডে গুরুত্বপূর্ণ খনিজ পাওয়ার সম্ভাবনা থাকলেও তা উত্তোলন লাভজনক কিনা তা অস্পষ্ট।

নেভাদা বিশ্ববিদ্যালয়ের রালফ জে রবার্টস রিসার্চ অ্যান্ড ইকোনমিক জিওলজি সেন্টারের পরিচালক সাইমন জোয়াইট বলেন, খনিজ অনুসন্ধান খনির সাথে সম্পর্কিত যে কোনো উদ্যোগের মধ্যে সবচেয়ে চ্যালেঞ্জিং এবং ঝুঁকিপূর্ণ।

“১০০টি অনুসন্ধান প্রকল্পের মধ্যে হয়তো একটি সফল খনি হয়ে উঠতে পারে।”

তিনি বলেন, “অনুসন্ধান থেকে উৎপাদন শুরু পর্যন্ত প্রায় ১০ বছর সময় নেয়। তা সম্পূর্ণভাবে নির্ভর করে স্থান, অবকাঠামো কী, এবং আপনি যে অনুমোদন এবং অন্যান্য প্রক্রিয়া অনুসরণ করবেন তার ওপর।”

গ্রিনল্যান্ডে শহরের বাইরে কোনো রাস্তা বা রেলপথ নেই। গাড়ি দিয়ে এক জায়গা থেকে আরেক জায়গায় যাওয়া যায় না; নৌকা বা বিমান ব্যবহার করতে হয়।

প্রতিষ্ঠিত অবকাঠামোর অভাব খনিজ আহরণনের জন্য চ্যালেঞ্জ হতে পারে বলেও মনে করেন তিনি।

এছাড়া কোনো খনিতে যদি রেডিওঅ্যাকটিভ পদার্থ থাকে সেক্ষেত্রে ২০২১ সালে গ্রিনল্যান্ড পাস হওয়া এক আইন অনুযায়ী তা খননের ওপর সীমাবদ্ধতা রয়েছে।

খনিজ উত্তোলনের প্রভাব

এদিকে খনিজ উত্তোলনের দীর্ঘস্থায়ী প্রভাব নিয়ে উদ্বেগ জানিয়েছি গ্রিনল্যান্ডের বর্তমান সংসদ। গ্রিনল্যান্ডে তিনটি পুরানো খনি পরিবেশগত ক্ষতি করেছে, বিশেষ করে দ্বীপের চারপাশের পানির ওপর।

দ্বীপের বাসিন্দা মেরিল্ড বলেন, কিছু বর্জ্য শিলায় ভারী ধাতুর পরিমাণ প্রয়োজনের অতিরিক্ত পাওয়া গেছে, যা বিজ্ঞানীরা খনির আশেপাশে মাকড়সা, মস, মাছ এবং শামুকের মতো জীবজন্তুর মধ্যে পরীক্ষা চালিয়ে প্রমাণ পেয়েছেন।

গ্রিনল্যান্ডের তাপমাত্রা এবং নিম্ন লবণাক্ততার কারণে পরিবেশগত পুনরুদ্ধার অত্যন্ত ধীর হয়। ৫০ বছর পরেও ওই প্রভাব দেখা যায় বলে জানান তিনি।

মেরিল্ড বলেন, “পানি ক্ষতিগ্রস্ত হলে তা আসলে গ্রিনল্যান্ডবাসীর খাদ্য সরবরাহ এবং মৎসশিকার ও শিকার ভিত্তিক জীবনযাপকে ক্ষতিগ্রস্ত করবে।”

জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে মেরু অঞ্চলের তাপমাত্রা পৃথিবীর বাকি অংশের তুলনায় প্রায় চারগুণ দ্রুত বৃদ্ধি পাচ্ছে। গ্রিনল্যান্ডের তুষারাবরণ প্রতি ঘণ্টায় ৩০ মিলিয়ন টন বরফ হারাচ্ছে বলে ধারণা করা হচ্ছে।

মেরিল্ড বলেন, গ্রিনল্যান্ডবাসীরা খনি কার্যকলাপের বিরুদ্ধে নয়, তবে তাদের কিছু উদ্বেগ রয়েছে। তা হলো ভূমি সম্পর্কিত।

তিনি জানান, সরকার বাসিন্দাদের জন্য ভূমি মালিকানা ও প্রশাসন পরিচালনা করে। এই অর্থ, সবারই ভূমি রয়েছে এবং কারোই নেই।

গ্রিনল্যান্ড কি পরবর্তী ওয়াইল্ড ওয়েস্টে পরিণত হতে চলেছে এমন প্রশ্নের জবাবে ডেনমার্কের প্রধানমন্ত্রী মেটে ফ্রেডরিকসেন বলেন, সেটা গ্রিনল্যান্ডের মানুষের ওপরই নির্ভর করছে।

তবে তাদের দ্বীপের প্রতি আন্তর্জাতিক আগ্রহ শিগগির কমার সম্ভাবনা নেই বলেও মনে করেন তিনি।

আরও পড়ুন