গোপালগঞ্জে তড়িঘড়ি দাফন, হয়নি ময়নাতদন্ত- নিহত কত?

গোপালগঞ্জে আহত এক যুবককে টেনেহেঁচড়ে নিয়ে যাচ্ছেন বাংলাদেশের সেনা সদস্যরা।
গোপালগঞ্জে আহত এক যুবককে টেনেহেঁচড়ে নিয়ে যাচ্ছেন বাংলাদেশের সেনা সদস্যরা।

গোপালগঞ্জে জাতীয় নাগরিক পার্টির সমাবেশকে ঘিরে সেনাবাহিনী ও পুলিশের গুলিতে ঠিক কতজনের প্রাণ গেল সে হিসেব যেমন মিলছে না, তেমনি মিলছে না গুলিতে নিহতদের মরদেহ ময়নাতদন্ত ছাড়াই বা কেন তড়িঘড়ি করে সমাহিত করতে হলো স্বজনদের! আর এর সঙ্গে কারফিউর মেয়াদ বৃদ্ধির যোগসূত্র আছে কিনা সে প্রশ্নও স্মরণ করিয়ে দিচ্ছেন কেউ কেউ।

আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে দাবি করা হয়েছে, এখন পর্যন্ত সাতজন গুলিবিদ্ধ হয়ে নিহত হয়েছেন; গুলিবিদ্ধ হয়েছেন আরও অন্তত অর্ধশতাধিক, যাদের মধ্যে কয়েকজনের অবস্থা আশঙ্কাজনক।

স্থানীয় কয়েকজনের সঙ্গে যোগাযোগ করে দ্য সান ২৪ জানতে পেরেছে, ঘটনার একদিন পেরিয়ে গেলেও অনেকে এখনও ফিরে আসেননি। তাদের শঙ্কা, গুলিতে নিহতদের কারো কারো লাশ সরিয়ে নেওয়া হয়েছে।

এ পর্যন্ত চারজন নিহত হওয়ার খবর সরকারিভাবে নিশ্চিত হওয়া গেছে। গুলিবিদ্ধ অবস্থায় তিন জনকে পাঠানো হয়েছে ঢাকায়।  

নিহত (বা থেকে) রমজান কাজী, দীপ্ত সাহা, ইমন ও সোহেল মোল্লা। 

বুধবারের ঘটনা নিয়ে তৈরি পুলিশের প্রতিবেদনেও ওই চারজন নিহত হওয়ার তথ্য উঠে এসেছে। পাশাপাশি প্রায় ৪৫ জন পুলিশ সদস্য ও সাংবাদিকসহ প্রায় অর্ধশত আহত হওয়ার কথা বলা হয়েছে। আর হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ আনুমানিক ২০ জন আহতকে সদর হাসপাতালে চিকিৎসা দেওয়ার তথ্য দিয়েছে।

পুলিশের এই তথ্য নিয়ে একটি অনলাইন পোর্টালের গোপালগঞ্জ প্রতিনিধির কাছে জানতে চেয়েছিল দ্য সান ২৪

ওই সাংবাদিক নাম প্রকাশ না করার শর্তে জানিয়েছেন, তিনি ঘটনাস্থলে ছিলেন; বুধবার দিনভর তার হেড অফিসেও খবর পাঠিয়েছেন। গুলিবিদ্ধের সংখ্যা কয়েক ডজন হবে, আহতদের মধ্যে কয়েকজন সাংবাদিকও রয়েছেন।

নিহতের সংখ্যা নিয়ে তিনি বলেন, “আমরা তো চার জনের মৃত্যুর খবরই লিখছি, যাদের গুলিবিদ্ধ মরদেহ হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল। শুনতে পাচ্ছি সবাইকে হাসপাতালে নেওয়া হয়নি। আমরাও নিশ্চিত হতে পারছি না। এমন অনেকের নাম শোনা যাচ্ছে যাদের হদিস মিলছে না, যাদের লাশ আইনশৃঙ্খলা বাহিনী গুম করেছে বলে স্থানীয়দের ধারণা।”

“কারফিউর কারণে সব তথ্য যাচাই করা সম্ভব হচ্ছে না, তাছাড়া অভিযানের কারণে বাড়িঘরও জনমানবশূন্য,” যোগ করেন ওই সাংবাদিক।

গোপালগঞ্জে সেনাবাহিনীর টহল। ছবি: বিবিসি।

বুধবারের ঘটনায় যে চার জনের নিহতের নিশ্চিত তথ্য মিলেছে তারা হলেন, শহরের উদয়ন রোডের সন্তোষ সাহার ছেলে দীপ্ত সাহা (৩০), কোটালিপাড়ার হরিণাহাটি গ্রামের কামরুল কাজীর ছেলে রমজান কাজী (১৯), শহরের শানাপাড়ার সোহেল রানা (৩৫) এবং সদর উপজেলার ভেড়ার বাজার এলাকার ইমন তালুকদার (২৪)।

তাদের স্বজনরা অভিযোগ করেছেন, আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যদের গুলিতে তারা নিহত হয়েছেন। গুলিবিদ্ধ হওয়ার কথা হাসপাতাল কর্তৃপক্ষও নিশ্চিত করেছে।

এছাড়া গুলিবিদ্ধ সুমন বিশ্বাস (২৫), রমজান মুন্সী (২৮) ও আব্বাস আলী সরকারকে (৩০) ঢাকায় পাঠানো হয়েছে।

নিহতের সংখ্যা নিয়ে ‘লুকোচুরির’ মধ্যে ভারতীয় সাংবাদিক চন্দন নন্দী একটি সূত্রের বরাতে সেনাবাহিনীর গুলিতে নিহতের সংখ্যা ১৯ জনের কথা উল্লেখ করেছেন নর্থইস্ট নিউজের এক প্রতিবেদনে।

এছাড়া গুলিবিদ্ধ অন্তত নয়জন এখনো গোপালগঞ্জ জেনারেল হাসপাতালে চিকিৎসাধীন বলেও উল্লেখ করেছেন তিনি।

দ্য সান ২৪ নানাভাবে নিহতের সঠিক সংখ্যা জানার চেষ্টা করলেও, কোনো সূত্র থেকে নিশ্চিত তথ্য মেলেনি। তবে বিভিন্ন সূত্রের খবর অনুযায়ী, আশঙ্কা করা হচ্ছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর গুলিতে নিহতের সংখ্যা হয়তো চার জনের বেশি হবে।

সংখ্যাটি চার ও ১৯-এর মাঝামাঝি যেটিই হোক, কোনো মরদেহেরই সুরতহাল প্রতিবেদন তৈরি করা হয়নি, করা হয়নি ময়নাতদন্তও।

গোপালগঞ্জ জেনারেল হাসপাতালে মর্গ ও ময়নাতদন্তের সুবিধা থাকলেও সেনা কর্মকর্তারা চারটি মরদেহের ময়নাতদন্ত করতে দেননি বলে অভিযোগ ওঠেছে। চিকিৎসা ও আইনি দিক থেকে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ এই প্রক্রিয়া বাদ দিয়ে মরদেহগুলো তড়িঘড়ি করে দাফন করতে চাপ দেওয়ারও অভিযোগ পাওয়া গেছে।

বিক্ষুব্ধ জনতাকে লক্ষ্য করে গুলি ছুঁড়ছে সেনা সদস্যরা।

গুলিবিদ্ধ হয়ে নিহত রমজান মুন্সীর বাবা ও মামার ভাষ্যেও মিলেছে এর সত্যতা। টিবিএস নিউজকে তারা জানিয়েছেন, লাশ ময়নাতদন্ত ছাড়াই দ্রুত সরিয়ে নিতে তাদের চাপ দেওয়া হয়েছিল।

নিহতের মামা কলিম মুন্সী বলেন, হাসপাতালে দায়িত্বরত ডাক্তার ও নার্সরা তাদেরকে দ্রুত লাশ নিয়ে চলে বাধ্য করেছেন। তারা এও বলেছিলেন- লাশ দ্রুত না নিয়ে গেলে ঝামেলা হবে। সেজন্য ময়নাতদন্ত ছাড়াই তারা লাশ নিয়ে হাসপাতাল ছাড়তে বাধ্য হন।

এ থেকে ধারণা করা হচ্ছে, ডাক্তার ও নার্সদের দিয়ে চাপ প্রয়োগ করে ময়নাতদন্ত ছাড়া লাশ নিয়ে যেতে বাধ্য করেছে আইনশৃ্ঙ্খলা বাহিনী।

গোপালগঞ্জ জেনারেল হাসপাতালের তত্ত্বাবধায়ক জীবিতেষ বিশ্বাস অবশ্য সমকালকে বলেছেন, “চারজনকে মৃত অবস্থায় হাসপাতালে আনা হয়। এ ধরনের ঘটনায় সাধারণত পুলিশ ময়নাতদন্তের আবেদন জানায়। তবে বুধবার ওই পরিস্থিতিতে পুলিশ আসেনি বা কিছু বলেনি। তাছাড়া আমরা যে ময়নাতদন্তের উদ্যোগ নেব সেই সুযোগ ছিল না। কারণ নিহতদের স্বজন ছিলেন ক্ষুব্ধ ও উচ্ছৃঙ্খল। তারা ময়নাতদন্ত করাতে রাজি ছিলেন না।” 

নিহতদের সবাই গুলিতে নিহত হয়েছেন বলে নিশ্চিত করেছেন জীবিতেষ বিশ্বাস।

এছাড়া সংঘর্ষে আহত ১৮ জনকে গোপালগঞ্জ জেনারেল হাসপাতালে চিকিৎসা দেওয়া হয়েছে বলে জানিয়েছেন হাসপাতালের জেনারেল সার্জারি ওয়ার্ডের ইনচার্জ তৃপ্তি বিশ্বাস।

তিনি বলেন, তারা চিকিৎসা নিয়ে ফিরে গেছেন; কারও আঘাত গুরুতর ছিল না। 

সুরতহাল প্রতিবেদন না হয় না হলো, ময়নাতদন্ত না হয় না করেই লাশ নিয়ে যেতে স্বজনদের বাধ্য করা হলো, কিন্তু কেন তড়িঘড়ি করে লাশ দাফন করে ফেলতে হলো স্বজনদের- সে প্রশ্নের উত্তর মিলছে না, যেমন উত্তর মিলছে না কারফিউ দীর্ঘায়িত করার পেছনের কারণ।

নিহত চার জনের মধ্যে দীপ্ত সাহাকে বুধবার রাতে পৌর শ্মশানে সৎকার করা হয়। টাইলস মিস্ত্রির সহকারী রমজান কাজীকেও বুধবার রাতে এশার নামাজের পর এবং মোবাইল ফোন ব্যবসায়ী সোহেল মোল্লা ও ক্রোকারিজ দোকানের কর্মচারী ইমন তালুকদারের দাফন বৃহস্পতিবার সকালে সম্পন্ন করা হয়।

আইনজীবী জ্যোতির্ময়ের সন্দেহ, এটা তড়িঘড়ি করে কোনো অপরাধ চাপা দেওয়ার চেষ্টাও তো হতে পারে।

বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে তিনি বলেন, “পোস্টমর্টেম হলে না হয় বোঝা যেত কোন ধরনের গুলি বা কোন ধরনের আঘাত পাওয়া গেল। ব্যালাস্টিক টেস্টের প্রশ্ন আছে, যেখানে জানা যাবে কোন ধরনের গুলি নিহতদের শরীরে রয়েছে।এরকম ঘটনায় ময়নাতদন্তটা খুব জরুরি। ময়নাতদন্ত না হওয়াটা আইনের বাত্যয়।

বুধবার জনতার প্রতিরোধের মুখে সাঁজোয়া যানে করে গোপালগঞ্জ ছাড়েন এনসিপি নেতারা।

“পরিবার নিশ্চয় ন্যায়বিচার চাইবে। তাদের এই মৃতদেহগুলোকে কোনো রকম আইনি প্রক্রিয়া অনুসরণ না করে যেটা করল, এখন যদি পরিবার মামলা করে, তাহলে কিন্তু আবারও লাশ উত্তোলন করে ময়নাতদন্তের প্রশ্ন আসবে।”

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক স্থানীয় রাজনীতিতে সক্রিয় একজন আওয়ামী লীগ নেতা বলেন, “নিহতদের মধ্যে একজন আমার প্রতিবেশী। আমরা যে পরবর্তীতে তার বিচার চাইবো সে পথও এখন আর থাকলো না। আমার তো ধারণা, কারফিউ বাড়িয়ে তারা লাশ দাফন করা আর গুম করার সুযোগটা নিল।”

এসব হত্যাকাণ্ড নিয়ে যেন কোনো ধরনের প্রতিবাদ সমাবেশ না হয় সেটিও কারফিউর একটি কারণ বলে মনে করছেন তিনি।

এদিকে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ ও স্বজনরা গুলিবিদ্ধ হয়ে মৃত্যুর কথা বললেও পুলিশ মহাপরিদর্শক বাহারুল আলম বুধবার দাবি করেছিলেন গোপালগঞ্জের সংঘাত দমনে পুলিশ কোনো ‘প্রাণঘাতী অস্ত্র’ ব্যবহার করেনি।

সেনাবাহিনীর পক্ষ থেকে বৃহস্পতিবার যে সংবাদ বিজ্ঞপ্তি দেওয়া হয়েছে তাতে যেমন নিহত হওয়ার কথা উল্লেখ নেই, তেমনি গুলি করার মতো কোনো বাক্য খুঁজে পাওয়া যায়নি। বরং তাতে বলা হয়েছে, গোপালগঞ্জে বার বার মাইকে ঘোষণা দিয়েও হামলাকারীদের নিবৃত্ত করতে না পেরে সেনাবাহিনী ‘আত্মরক্ষার্থে বলপ্রয়োগে বাধ্য হয়’।

প্রশ্ন উঠছে, এই যে গুলিবিদ্ধ হয়ে চার জন নিহত হওয়ার কথা বলা হচ্ছে, এবং যারা গুলিবিদ্ধ হয়ে চিকিৎসাধীন, তাদের ওপর গুলি তাহলে কে ছুঁড়লো?

নর্থইস্ট নিউজ এক প্রতিবেদনে অবশ্য পাঁচজন সেনা কর্মকর্তার নাম প্রকাশ করেছে, যারা ১৬ জুলাই নিরস্ত্র বেসামরিক নাগরিক ও আওয়ামী লীগ কর্মীদের ওপর গুলি চালানোর ঘটনায় সরাসরি জড়িত ছিলেন বলে দাবি করা হয়েছে।

তাদের মধ্যে রয়েছেন ৫৫তম ইনফ্যান্ট্রি ডিভিশনের জিওসি (জেনারেল অফিসার কমান্ডিং) মেজর জেনারেল জে এম ইমদাদুল ইসলাম (BA-4288, 26 BMA LC), যিনি গুলি চালানোর অনুমতি দেন; ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মোহাম্মদ মিজানুর রহমান (BA-5594, 37 BMA LC); ঘটনাস্থলে দায়িত্বরত স্থানীয় ইউনিটের কমান্ডিং অফিসার লেফটেন্যান্ট কর্নেল মাবরুর হাসান; মেজর আহসানুল হক এবং মেজর শহীদুল্লাহ।

মানবাধিকার সংগঠন আইন ও সালিশ কেন্দ্রও গুলির ঘটনা নিয়ে প্রশ্ন রেখে এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে বলেছে, “এ ঘটনা নিয়ে পুলিশের মহাপরিদর্শক গণমাধ্যমে দেওয়া বক্তব্যে জানিয়েছেন, পুলিশ গোপালগঞ্জের ঘটনায় প্রাণঘাতী অস্ত্র ব্যবহার করেনি। অথচ সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়া ভিডিওচিত্রে আগ্নেয়াস্ত্র ব্যবহার এবং গুলির শব্দ স্পষ্টভাবে শোনা যাচ্ছে। তাহলে কারা এই আগ্নেয়াস্ত্র ব্যবহার করল?”

এদিকে গোপালগঞ্জে হামলা ও সংঘর্ষের ঘটনা তদন্তে তিন সদস্যের একটি কমিটি করেছে সরকার। তবে নিহতের ঘটনায় এখনও কোনো মামলা হয়নি।

এ সংক্রান্ত আরও খবর:

আরও পড়ুন

সর্বশেষ

ads