সাম্প্রতিক ইতিহাসের ভয়াবহ এবং ধ্বংসাত্মক দাবানলের সঙ্গে লড়ছে লস অ্যাঞ্জেলেসের অগ্নিনির্বাপক দল; বিশাল এ দাবানলে পুড়ে ছাড়খাড় শহরটি।
ক্যালিফোর্নিয়া বন ও অগ্নিপ্রতিরোধ বিভাগ (ক্যাল ফায়ার) জানিয়েছে, পরিস্থিতি যখনই অনুকূলে থাকে ক্যালিফোর্নিয়ার বিভিন্ন স্থান থেকে বহু অগ্নি নির্বাপণ ট্যাঙ্কার বিমান আগুন নেভানোর কাজে অংশ নিচ্ছে।
বিশেষভাবে নির্মিত বিমান আগুনের পরিধি নিয়ন্ত্রণ বা এক জায়গায় সীমাবদ্ধ করে নিচে থাকা দমকল কর্মীদের সহায়তা করে। তবে এখানে আমরা দেখিয়েছি যে বিভিন্ন ধরনের বিমান এবং তাদের আলাদা আলাদা ভূমিকা রয়েছে, যেমন বিশেষভাবে বানানো যাত্রীবাহী জেট থেকে শুরু করে বিমান যা হ্রদ থেকে পানি তুলে আনতে পারে।
ক্যাল ফায়ারের নিজস্ব বিমান বহর রয়েছে, যা রাজ্যের ১৪টি বিমানঘাঁটি এবং ১১টি হেলিকপ্টার ঘাঁটি থেকে পরিচালিত হয়। এগুলি প্রায় ২০ মিনিটের মধ্যে বেশিরভাগ আগুন কবলিত স্থানে পৌঁছাতে পারে। বহরে ট্যাকটিক্যাল প্লেন, এয়ারট্যাঙ্কার এবং হেলিকপ্টারের ভূমিকাই মুখ্য। প্রত্যেকটির নির্দিষ্ট ভূমিকা থাকলেও একটি ইউনিট হিসেবে আগুন নিয়ন্ত্রণে একসাথে কাজ করে।
ক্যাল ফায়ারের ওয়েবসাইট অনুযায়ী, তাদের বহরের ৬০টিরও বেশি বিমান ও হেলিকপ্টার রয়েছে, যা তাদেরকে আকাশ থেকে অগ্নি নির্বাপণ সরঞ্জামের সবচেয়ে বড় বহর করে তুলেছে। এতেও যদি সম্ভব না হয় তবে তারা চুক্তিভিত্তিক বিমান ভাড়া করবে এবং পরিস্থিতি আরও চরম হলে সামরিক বাহিনীর সহায়তা চাইতে পারে।

গত ৮ জানুয়ারি গভর্নর গেভিন নিউজমের কার্যালয় থেকে পাঠানো এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে জানানো হয়েছে যে, বর্তমানে বেশ কয়েকটি হেলিকপ্টার ও এয়ার ট্যাঙ্কার আগুন নিয়ন্ত্রণে কাজ করছে।
ট্যাক্টিক্যাল প্লেন
এই বিমানগুলি দাবানল নিয়ন্ত্রণে আকাশ থেকে নির্দেশনা এবং নিয়ন্ত্রণের ভূমিকা পালন করে থাকে। এছাড়া মাটিতে থাকা কমান্ডার ও অন্যান্য বিমানের সঙ্গে কৌশলগত সমন্বয়কের দায়িত্ব পালন করে। ক্যাল ফায়ারের অধিকাংশ ট্যাক্টিক্যাল প্লেনই নর্থ আমেরিকান রকওয়েল ওভি-টেন বিমান।

ওভি-টেন বিমান ব্রঙ্কো টুইন-টার্বোপ্রপ, যা গত শতকের ৯০এর দশক পর্যন্ত মার্কিন নৌবাহিনী, মেরিন কর্পস এবং বিমান বাহিনীতে ব্যবহার করা হতো। প্রতিরক্ষা বিভাগ থেকে অবসরের পর ১৯৯৩ সালে ক্যাল ফায়ার ১৫টি বিমান নেয়। পরে সেগুলোকে অগ্নি নির্বাপণের রূপ দেয়।
এ বিমানগুলো দীর্ঘ সময় ধরে আগুনের চারপাশে চক্কর দিতে থাকে। এয়ার ট্যাঙ্কারের মতো পানি বা অগ্নি প্রতিরোধক ফেলে আবার ভর্তি করার বারবার ফিরে আসে না; বিমানগুলো কয়েক ঘণ্টা ধরে আকাশে থাকতে পারে এবং প্রয়োজনে বড় ট্যাঙ্কারগুলো গাইড হিসেবে কাজ করতে পারে।
ট্যাঙ্কার প্লেন
তবে ক্যাল ফায়ার বহরের প্রধান ভরসা হলো গ্রুমম্যান এস-টুটি ট্যাঙ্কার। এই বিমানটি প্রায় সাড়ে চার হাজার লিটার (১২০০ গ্যালন) অগ্নি-প্রতিরোধক পদার্থ বহন করতে পারে, যা আগুনের এগিয়ে যাওয়ার পথের উপর ফেলে তা নিয়ন্ত্রণে সাহায্য করে। অন্য এয়ার ট্যাঙ্কারের তুলনায় ছোট এ ট্যাঙ্কারটি প্রাথমিক পর্যায়ে খুব দ্রুত আগুন মোকাবিলায় ব্যবহৃত হয়। ৭০-এর দশকে এ বিমানগুলো সামরিক বাহিনীতে সাবমেরিন ট্র্যাক করার কাজে ব্যবহৃত হতো।

গ্রুম্যান এস-টুটি এর লেজে একটি ফিল স্পাউট রয়েছে, যার ফলে ইঞ্জিন বন্ধ না করেই অগ্নি-প্রতিরোধক দিয়ে ‘হট লোডেড’ করা যায়। আর এ জন্যই এটি কয়েক মিনিটের মধ্যে আবার আকাশে ফিরে যেতে পারে। পুনরায় জ্বালানি নেওয়া এবং বন্ধ করার প্রয়োজন না হওয়া এইভাবে এস-টুটি একাধিক বার উড়ে যেতে পারে।
ট্যাঙ্কারগুলি সাধারণত আগুনের উপর সরাসরি অগ্নি-প্রতিরোধক ফেলার কাজ করে না। এর বদলে তারা আগুনের চলার পথে অগ্নি-প্রতিরোধক ফেলে আগুনের গতি ধীর করে ভূমিতে থাকা কর্মীদের তা নিয়ন্ত্রণে বা নেভানোর সুযোগ করে দেয়।
মেগা ট্যাঙ্কারস


ক্যাল ফায়ার বড় সি-১৩০ ‘হারকিউলিস’ ট্যাঙ্কার পরিচালনা করে এবং বড় আগুন নিয়ন্ত্রণে সহায়তা করার জন্য তারা লার্জ এয়ার ট্যাঙ্কার (এলএটিএস) এবং ভেরি লার্জ এয়ার ট্যাঙ্কার (ভিএলএটিএস) নিয়ে আসতে পারে। এই বিমানগুলি সাধারণত যাত্রীবাহী জেট যা ট্যাঙ্কারে রূপান্তরিত হয়েছে। বড় এয়ার ট্যাঙ্কারগুলো ক্যাল ফায়ার ট্যাঙ্কারগুলোর তুলনায় অনেক বেশি লোড বহন করতে পারে।
বোয়িং ৭৪৭ সুপারট্যাঙ্কার

বোয়িং ৭৪৭ অন্যান্য ট্যাঙ্কারের তুলনায় পানিতে পূর্ণ করতে প্রায় ৩০ মিনিট সময় বেশি লাগত, যা এস-টুটি এর তুলনায় অনেক বেশি। তবে এগুলো একবার পূর্ণ করা হলে অনেক বেশি সময় আকাশে থাকতে পারে, যা অন্যান্য ট্যাঙ্কারের চেয়ে অনেক বেশি কার্যকর।
ফেলার পথনির্দেশনা
কিছু ট্যাঙ্কারের জন্য “নির্দেশক” বিমান প্রয়োজন, যা তাদের গাইড করে এবং সঠিক স্থানে অগ্নি-প্রতিরোধক নির্দেশ দেয়। কিছু বড় ট্যাঙ্কার তাদের নিজস্ব নির্দেশক বিমান এবং দল নিয়ে আসে, অথবা ক্যাল ফায়ারের ট্যাক্টিক্যাল ওভি-টেন বিমান নির্দেশক হিসেবে কাজ করতে পারে।
আগুন নেভানোর জন্য সব বিমান একসঙ্গে কাজ করে। এরমধ্যে অনেকগুলো দিনভর একাধিক ফ্লাইট পরিচালনা করে যার সমন্বয় করে ক্যাল ফায়ারের ওভি-টেন ব্রঙ্কো বিমান যা ঘণ্টার পর ঘণ্টা আকাশে উড়ে থাকতে পারে।
সুপার স্কুপারস
অগ্নিনির্বাপক ‘সুপার স্কুপার’ প্লেনগুলি তাদের উপসাগর ও হ্রদগুলির শান্ত পানিতে নেমে ট্যাংক ভরে নেয়। এরপর তারা পানি ছেড়ে আগুন নেভায় এবং একইভাবে পানির সংগ্রহ করতে থাকে যতক্ষণ না তাদের জ্বালানির প্রয়োজন হয়।

ফ্লাইট ট্র্যাকিং ডেটা অনুযায়ী দুটি কানাডীয় সুপার স্কুপার বিমান প্যালিসেডস ফায়ার নিয়ন্ত্রণে কয়েক দফায় পানি সংগ্রহ করেছে।
হেলিকপ্টারস
ক্যাল ফায়ারের হেলিকপ্টার বহরে বেশ কিছু বেল ইউএইচ-১এইচ ‘সুপার হিউয়েস’ রয়েছে, যার প্রতিটি নিচে ঝুলানো একটি বাকেটে প্রায় ১২০০ লিটার (৩২০ গ্যালন) পানি বহন করতে পারে। ছোট দাবানলে দ্রুত ব্যবস্থা নেয়ার জন্য দ্রুত কাজ করতে পারে।

তাদের সিকর্সকি এস৭০আই ব্ল্যাক হক হেলিকপ্টারওে আগুনে পানি ও অগ্নিনির্বাপণ পদার্থ ফেলতে সক্ষম। পাশাপাশি তারা রাতেও অভিযান পরিচালনা করতে সক্ষম।
এই হেলিকপ্টারগুলো আগুন নেভানো, দমকলকর্মীদের উদ্ধার এবং সরিয়ে নেওয়ার কাজে গুরুত্বপূর্ণ প্রমাণিত হয়েছে।
ক্যাল ফায়ারের হেলিকপ্টার কর্মীরা ‘স্বল্প দূরত্বে’ উদ্ধার পরিচালনা করতে প্রশিক্ষিত, যার মধ্যে প্রায় কর্মীরা হ্যারনেস বা বাস্কেটে ঝুলিয়ে অল্প দূরত্বের নিরাপদ স্থানে নিয়ে যায়।
বৃহস্পতিবার বাতাসের গতিবেগ কমে যাওয়ায় মাটিতে কাজ করা দলগুলোকে আকাশপথে সহায়তা সম্ভব হয়।
তবে কর্মকর্তারা বলেছেন, রাতের বেলা বাতাস আবার তীব্র হয়ে ওঠায় শুক্রবার বিকাল পর্যন্ত সতর্কতামূলক পরিস্থিতি জারি থাকে।
রয়টার্স অবলম্বনে