ইউরোপ কীভাবে নিজেকে রক্ষা করতে পারে

Europe

ইউরোপের অন্যতম শক্তিশালী মিত্র যুক্তরাষ্ট্র। অন্তত এতদিন পর্যন্ত তাই ছিল। কিন্তু দেশটির প্রেসিডেন্ট হিসেবে ডোনাল্ড ট্রাম্প দায়িত্ব নেওয়ার পর সেই মিত্রতা আর আগের মতো নেই। ইউরোপকে নিজের দায়িত্ব নিজে নিতে বলে দিয়েছেন ট্রাম্প।

গত শনিবার মিউনিখ নিরাপত্তা সম্মেলনে যুক্তরাষ্ট্রের ভাইস প্রেসিডেন্ট জেডি ভান্স কঠোর ভাষায় ইউরোপের সমালোচনা করেন। মূলত তিনি ট্রাম্পের বক্তব্যই নিজের বয়ানে বলেন।

ইউরোপ যে ভয়াবহ সঙ্কটে তা ভালোই বুঝতে পারছেন ফরাসি প্রেসিডেন্ট ইমানুয়েল ম্যাক্রোঁ। মিউনিখ নিরাপত্তা সম্মেলনে জেডি ভান্সের বক্তব্যের পরপরই প্যারিসে ইউরোপের গুরুত্বপূর্ণ নেতাদের নিয়ে জরুরি বৈঠক ডাকেন। এই বৈঠকের উদ্দেশ্য ছিল ইউরোপের প্রতিক্রিয়া সমন্বয় করা।

চিন্তার দিক দিয়ে ম্যাক্রোঁ আংশিকভাবে সঠিক ছিলেন। তিনি বুঝেছিলেন, এই মুহূর্তে নতুন প্রতিষ্ঠান গঠনের চেয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়া বেশি জরুরি। বৈঠকে ইউরোপীয় কমিশনের প্রেসিডেন্ট উরসুলা ভন ডার লিয়েন, ইউরোপীয় কাউন্সিলের প্রেসিডেন্ট আন্তোনিও কস্তা এবং ন্যাটো মহাসচিব মার্ক রুটে উপস্থিত ছিলেন। তবে এটি কোনো ইউরোপীয় ইউনিয়নের আনুষ্ঠানিক বৈঠক ছিল না। কারণ সেক্ষেত্রে হাঙ্গেরি ও স্লোভাকিয়ার ভেটোর কারণে সিদ্ধান্ত নেওয়া বাধাগ্রস্ত হতে পারত। কারণ এই দেশ দুইটি মস্কোর প্রতি অণুরক্ত।

বৈঠকে যুক্তরাজ্য, পোল্যান্ড, স্পেন ও নেদারল্যান্ডসও উপস্থিত ছিল। এছাড়া নর্ডিক-বাল্টিক এইট (এনবিটি) – স্ক্যান্ডিনাভিয়া, ফিনল্যান্ড এবং বাল্টিক রাষ্ট্রগুলোও ছিল। এই রাষ্ট্রগুলোর রাশিয়ার সঙ্গে স্থল ও সমুদ্র সীমা আছে এবং তারা ক্রেমলিনের হুমকি স্পষ্টভাবে উপলব্ধি করছে।

তবে বৈঠক থেকে কোনো সুরাহা কিন্তু আসেনি। যুক্তরাজ্য একটি কল্পিত চুক্তি কার্যকরে ইউক্রেনে শান্তিরক্ষী পাঠানোর প্রস্তাব দিয়েছে। যুক্তরাজ্য এমন প্রস্তাব দিয়েছে যাতে ট্রাম্প প্রশাসন ও রাশিয়া সৌদি আরবে বিষয়টি নিয়ে আলোচনা করতে পারে। পাশাপাশি যাতে এও বোঝানো যায়, শান্তিরক্ষী বাহিনী পাঠানোর কোনো কিছুতে ইউরোপের কোনো সম্পর্ক নেই।

বিশেষজ্ঞরা ইউক্রেন নিয়ে ট্রাম্পের উদ্যোগকে ১৯৪৫ সালের ইয়ালতা চুক্তির প্রতিধ্বনি মনে করছেন। সেই চুক্তিতে যুক্তরাষ্ট্রের তৎকালীন প্রেসিডেন্ট ফ্রাঙ্কলিন ডি. রুজভেল্ট ও সোভিয়েত নেতা জোসেফ স্ট্যালিন পূর্ব ইউরোপকে সোভিয়েত ইউনিয়নের প্রভাবের আওতায় দেওয়ার বিষয়ে সমঝোতা করেছিলেন।

প্যারিসের বৈঠকে যোগ দেওয়া নিয়ে দ্বিধাগ্রস্ত ছিলেন ইতালির প্রধানমন্ত্রী জর্জিয়া মেলোনি। তিনি একদিকে ইউরোপের পক্ষে রাশিয়ার কঠোর সমালোচক হতে চাচ্ছেন, অন্যদিকে হোয়াইট হাউসের সঙ্গে সুসম্পর্ক বজায় রাখতে চাইছেন। তবে এই ভারসাম্য রক্ষা করা তার জন্য ক্রমেই কঠিন হয়ে যাচ্ছে।

জার্মান চ্যান্সেলর ওলাফ শলৎস আরও সৈন্য বা অতিরিক্ত অর্থ দেওয়ার প্রস্তাব নিয়ে ভাবতেও রাজি হননি। পোল্যান্ডও সৈন্য পাঠানোর বিষয়ে অনাগ্রহ দেখিয়েছে। বিশেষ করে পশ্চিম ইউক্রেনের বিষয়টি পোল্যান্ডের জন্য ঐতিহাসিকভাবে সংবেদনশীল। এটি অনেকটা এমন, যেন যুক্তরাজ্য আয়ারল্যান্ডে শান্তিরক্ষী বাহিনী পাঠায়।

বৈঠকে উপস্থিত প্রত্যেক দেশই একক নেতৃত্ব না নেওয়ার জন্য নিজস্ব কারণ দেখিয়েছে। ফলে বৈঠক কোনো কার্যকর সিদ্ধান্ত ছাড়াই শেষ হয়। সাধারণত এমন ক্ষেত্রে সহায়ক ভূমিকা নিয়ে যুক্তরাষ্ট্র ইউরোপীয় নেতাদের ঐক্যবদ্ধ করে এবং অগ্রগতির জন্য চাপ দিত। কিন্তু এবার ইউরোপীয় দেশগুলোকে নিজেদের পথ নিজেই খুঁজে নিতে হলো।

ভান্সের ভাষণ এবং রিয়াদে ইয়ালতা ২.০ চুক্তির মাধ্যমে ইউরোপে যুক্তরাষ্ট্রের প্রভাব কমানোর ট্রাম্পের অবিবেচক পরিকল্পনা ইউরোপের স্বার্থ ও নিরাপত্তার ওপর গুরুতর আঘাত। তবে ইউরোপ চাইলে যথেষ্ট শক্তিশালীভাবে প্রতিক্রিয়া জানাতে সক্ষম। এমনকি যুক্তরাষ্ট্রের বিরুদ্ধে সরাসরি উত্তেজনা সৃষ্টি না করেও প্রতিক্রিয়া জানাতে পারে বলেও ভূরাজনৈতিক বিশ্লেষকরা মনে করেন।

ট্রাম্প প্রশাসন ও যুক্তরাষ্ট্র এক নয়। এই পার্থক্যটা গুরুত্বপূর্ণ। ইউরোপের উচিত ট্রাম্পের বিরোধীদের সঙ্গে কাজ করা এবং যুক্তরাষ্ট্রের রিপাবলিকান দলের যুক্তিসঙ্গত নেতাদের সঙ্গে সম্পর্ক বজায় রাখা। এর মধ্যে আছেন পররাষ্ট্রমন্ত্রী মার্কো রুবিও এবং কংগ্রেসের রিপাবলিকান সদস্যরা, যেখানে দলের সংখ্যাগরিষ্ঠতা খুবই সামান্য।

তবে হোয়াইট হাউস এখন স্পষ্টতই চাপ প্রয়োগের নীতি অনুসরণ করছে। এর একটি উদাহরণ হলো তথাকথিত রাশিয়া-ইউক্রেন শান্তি আলোচনা, যা ট্রাম্পের পক্ষ থেকে ইউক্রেনের খনিজ সম্পদের ৫০ শতাংশ দাবি করার পর শুরু হয়।

ইউক্রেন লড়াই বন্ধ করবে না, কারণ বিকল্প হিসেবে তাদের পুতিনের সরকারের হাতে গণহত্যা ও জোরপূর্বক বিতাড়নের শিকার হতে হবে। পরিস্থিতি আরও খারাপ হবে যদি রাশিয়া ইউক্রেন দখল করে। সেক্ষেত্রে, তারা ইউক্রেনের সম্পদ লুট করে নিজের সামরিক শক্তি পুনর্গঠন করবে এবং দেশটির জনগণকে সৈন্য হিসেবে ব্যবহার করে আরও আগ্রাসন চালাবে, যেমন সোভিয়েত আমলে হয়েছিল। আর এমন অবস্থায় পোল্যান্ড এবং নর্ডিক-বাল্টিক আট দেশগুলোর কাছে ইউক্রেনকে সমর্থন করা ছাড়া আর কোনো বিকল্প নেই।

ব্রিটিশ প্রতিরক্ষামন্ত্রী জন হিলি গত মঙ্গলবার বলেন, রাশিয়াকে প্রতিহত করতে কার্যকর নিরাপত্তা নিশ্চয়তা দরকার, যা যুক্তরাষ্ট্রের সহায়তায় সম্ভব। তবে যুক্তরাষ্ট্রের বর্তমান প্রশাসন এতটাই অনির্ভরযোগ্য যে তারা এ ধরনের নিশ্চয়তা দিতে পারবে না। তাই ইউরোপীয় দেশগুলোর নিজেদের শক্তির ওপর নির্ভর করাই গুরুত্বপূর্ণ।

এমন অবস্থায় ইউরোপের কি করা উচিত, তা নিয়ে বিভিন্ন ফোরামে আলোচনা হচ্ছে। কেউ ইউরোপকে নিরাপত্তার ক্ষেত্রে স্বনির্ভর হতে বলছেন। কেউবা যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলতে বলছেন। আবার অনেকে সাপও মরবে, লাঠিও ভাঙবে না, এমন পন্থার দিকে ঝুঁকতে বলছে ইউরোপের নেতৃত্বকে।

ইউরোপের উচিত প্যারিসের মতো সম্মেলনে ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জেলেনস্কিকে অন্তর্ভুক্ত করা। কারণ, আন্তর্জাতিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে প্রতীকী উপস্থিতি গুরুত্বপূর্ণ। তারা ২৪ ফেব্রুয়ারি আরেকটি সম্মেলন আয়োজন করছে, যখন তারা যুদ্ধের তৃতীয় বার্ষিকীতে কিয়েভ সফর করবে। এটি দেখাবে যে জেলেনস্কি ইউরোপের একটি গুরুত্বপূর্ণ দেশের নেতা, শীর্ষ নেতৃত্বে তার থাকার অধিকার আছে এবং তাকে ইউরোপ ছাড়বে না।

ইউরোপীয় সরকারগুলো অবিলম্বে ইউরোপীয় ব্যাংকে জব্দ করা ১৫০ বিলিয়ন ডলার মূল্যের রুশ সম্পদ বাজেয়াপ্ত করতে পারে। আন্তর্জাতিক আইন অনুযায়ী, এই অর্থ ইউক্রেনের প্রাপ্য, কারণ এটি রাশিয়ার যুদ্ধক্ষতির জন্য ক্ষতিপূরণ। ইউক্রেন এ অর্থ তার প্রতিরক্ষা শিল্প ও ইউরোপের নিরাপত্তার জন্য কার্যকরভাবে ব্যবহার করতে পারে।

ইউরোপের প্রধান দেশগুলো এখন তাদের প্রতিরক্ষা ব্যয় জিডিপির ৩ শতাংশে উন্নীত করতে পারে। এছাড়া আগামী তিন বছরের মধ্যে এটি ৫ শতাংশে বাড়ানোর পরিকল্পনা গ্রহণ করতেও পারে। এটি বাস্তবায়নে তাদের একটি ব্যাংক প্রতিষ্ঠা করতে হবে। সম্প্রতি ব্রিটিশ জেনারেল নিকোলাস কার্টার, সাংবাদিক এড লুকাস ও গাই দে সেলিয়ার্স এই ধারণা প্রস্তাব করেছেন। পোল্যান্ডের পররাষ্ট্রমন্ত্রী রাদোসল সিকোর্সকিও এটি সমর্থন করেছেন।

রাশিয়ার ওপর চাপ বাড়াতে ইউরোপীয় দেশগুলো পারমাণবিক অস্ত্র উৎপাদন বাড়াতে পারে। ফ্রান্স ও ব্রিটেনের এই অস্ত্র ও প্রযুক্তি রয়েছে। যদিও তারা একা নিজেদের অস্ত্রভাণ্ডার বাড়ানোর সক্ষমতা রাখে না। তাই অন্য বড় দেশগুলোর আর্থিকভাবে সহায়তা করা দরকার। এর একটি অংশ কৌশলগত অস্ত্র তৈরিতে ব্যবহার করা যায়। ফ্রান্সের এ ধরনের অস্ত্র রয়েছে, যা বিমান থেকে উৎক্ষেপণযোগ্য ক্রুজ মিসাইল হিসেবে ব্যবহৃত হয়।

রাশিয়া এখনো পশ্চিম ইউরোপ ও পূর্ব ইউরোপকে বিভক্ত করার চেষ্টা করতে পারে, যেমনটি তারা স্নায়ু যুদ্ধের সময় ইউরোপ ও যুক্তরাষ্ট্রকে বিভক্ত করার চেষ্টা করেছিল। তাই, নর্ডিক-বাল্টিক আট দেশ ও পোল্যান্ডকে প্রতিরোধ ব্যবস্থার অংশগ্রহণের উপায় খুঁজে বের করতে হবে।

সুইডেন ইউক্রেনকে তার প্রায় ১০০টি গ্রিপেন যুদ্ধবিমান সরবরাহ করতে পারে। এই বিমানের রক্ষণাবেক্ষণের প্রয়োজনীয়তা এফ-১৬ এর তুলনায় কম। এছাড়াও, সুইডেনকে হাঙ্গেরির জন্য যে গ্রিপেন বিমানের অর্ডার রয়েছে, তা ইউক্রেনকে দেওয়া যেতে পারে। হাঙ্গেরির প্রধানমন্ত্রী ভিক্টর অরবানকে বুঝতে হবে যে পক্ষ পরিবর্তনের পরিণতি আছে। এদিকে যুক্তরাজ্য —সম্ভবত ফ্রান্স, স্পেন এবং ইতালির সহায়তায়—সুইডেনের আকাশসীমা রক্ষার করতে বিমান পাঠাতে পারে।

নরওয়ে তার তেল বিক্রির মুনাফা যুদ্ধের প্রয়োজনে ভাগ করতে পারে। ইউরোপের বর্তমান ১৫৫ মিমি আর্টিলারি উৎপাদন বাড়ানোর জন্য এই অর্থের কিছু অংশ ব্যবহার করা যেতে পারে। নর্ডিক দেশগুলো ও জার্মানির কয়েকটি স্থানে এই অতিরিক্ত উৎপাদনের সক্ষমতা রয়েছে।

যুক্তরাজ্য বড় আকারের আর্টিলারি শেল উৎপাদন প্ল্যান্ট পুনরায় চালু করতে পারে। অনেকদিন ধরেই প্ল্যান্টটি বন্ধ অবস্থায় আছে।

রাশিয়ার সঙ্গে যেসব আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠান এখনও ব্যবসা করছে, সেগুলোর ওপর সম্মিলিত নিষেধাজ্ঞা দেওয়ার মতো সিদ্ধান্তও নেওয়া যেতে পারে। আর এসব কিছুর সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের সহায়তা ছাড়াই রাশিয়ার বিরুদ্ধে যুদ্ধের জন্য পর‌্যাপ্ত সৈন্য সংগ্রহ ও প্রয়োজনে একটি সেনাবাহিনী তৈরি করার মতো বিষয়গুলোও বিবেচনায় আসতে পারে।

বিশেষ করে জার্মানির জন্য অপেক্ষা করার সময় কম। কারণ দেশটিতে নতুন জোট সরকার গঠনে অন্তত একমাস সময় লাগবে। অনেকেই মনে করেন, জার্মানির বিদায়ী তত্ত্বাবধায়ক প্রশাসনের প্রতিনিধিদের এবং নির্বাচনে বিজয়ীদের উচিত এক্সেপশনাল ভিত্তিতে যৌথ ইউরোপীয় দায়িত্বে জার্মানির অংশগ্রহণে সম্মত হওয়া।

আরও পড়ুন

সর্বশেষ

ads