এটি সত্যিই মাথায় ঘোরপাক খাওয়ার মতো প্রশ্ন, পরিযায়ী পাখিরা কিভাবে সিদ্ধান্ত নেয় কখন তাদের জায়গা পরিবর্তন করতে হবে? কিভাবে তারা যাত্রার জন্য প্রস্তুতি নেয়? কিংবা কিভাবে তারা মনস্থির করে গন্তব্য কোথায়? পথ চেনার উপায়ই বা কি?
পাখিরা মূলত প্রতি বছরই একটি নির্দিষ্ট সময়ে উত্তর থেকে দক্ষিণ গোলার্ধে যাতায়াত করে।
এর মধ্যে সাইবেরিয়া বা রাশিয়ার ওয়েডার্স ও ডাক যেমন আছে, তেমনি আছে ইউরোপের ইউরোপিয়ান ফ্লাইক্যাচার, ব্রাউন-ব্রেস্টেড ফ্লাইক্যাচার, বার্ন সোয়ালের মতো পাখি!
গবেষণায় দেখা গেছে, পরিযায়ী পাখিদের এই স্থানান্তরের অন্যতম কারণ, খাবারের চাহিদা ও অনুকূল আবহাওয়ার খোঁজ।
অ্যামেরিকান বার্ডস কনজারভেন্সি এক প্রতিবেদনে জানায়, বিভিন্ন প্রজাতির অল্পবয়সী পাখিরা মূলত তাদের ‘জেনেটিক প্রোগ্রামিংয়ের’ সাহায্যে পূর্বাভাস পেয়ে যায় ঋতু পরিবর্তনের সময় তাদের কোথায় যেতে হবে।
কোনো কোনো ক্ষেত্রে পূর্ব অভিজ্ঞতা ছাড়াও একটি পাখি তার প্রথম স্থানান্তর সেরে ফেলতে পারে। অবশ্য নির্ভুল স্থানান্তর নির্ভর করে সময় ও অভিজ্ঞতার উপর।
পাখিরা সঠিক পথ নিশ্চিতে দিনের আলোয় উড়ে যাওয়ার সময় নিচের মাঠঘাটের দৃশ্যগুলো স্মৃতিতে ধারণ করে। যাকে বলে ‘ল্যান্ডমার্ক’ সক্ষমতা।
কোনো কোনো পাখিবিদের ধারণা, পরিযায়ী পাখিরা নদী কিংবা পাহাড়ের অবস্থানের উপর নজর রাখে, এবং সে অনুযায়ী তাদের পরিকল্পনা সাজায়। এমনও প্রমাণ রয়েছে, রাতের পরিযায়ী পাখিরা নদীর অবস্থানের উপর ভিত্তি করে তাদের গতিপথ ঠিক করে।
প্রশ্ন আসতে পারে যেসব পাখির এই সক্ষমতা নেই তাদের কী হবে? কখনও কখনও দেখা যায় সামুদ্রিক পাখি নির্দিষ্ট ‘বৈশিষ্ট্যহীন’ সাগরের উপর দিয়ে দীর্ঘ দূরত্ব উড়ে যাচ্ছে। এর উত্তর হল যে কিছু কিছু পাখি ঘ্রাণের মাধ্যমে গতিপথ নির্ধারণ করতে পারে।
২০১৭ সালে একটি গবেষণায় ‘জিঙ্ক সালফেট’ দিয়ে এই ঘ্রাণের অনুভূতি রুদ্ধ করে দেন গবেষকরা। এরপর তারা ওই পাখিদের গতিপথ অনুসরণ করেন ‘জিপিএস ডিভাইসের’ সাহায্যে। পরীক্ষায় দেখা যায়, পাখিরা যখন সমুদ্রের দিকে রওনা হলো তখন দিকভ্রান্ত হয়ে পড়ছে। এ থেকে প্রমাণিত হয়, ‘ল্যান্ডমার্ক’ অক্ষম পাখিরা মূলত ঘ্রাণের অনুভূতি দিয়ে পথ চিনে নেয়।
অবশ্য সব পরিযায়ী পাখির যে ঘ্রাণ অনুভূতি রয়েছে এমনটি নয়!
ষাটের দশকে, জন এবং স্টিফেন এমলেন নামে বাবা-ছেলের গবেষক দল পরীক্ষা চালিয়ে নিশ্চিত হয় যে পাখিরা নক্ষত্রের অবস্থানকে কেন্দ্র করে তাদের গতিপথ নির্ধারণ করে।
উদীয়মান কিংবা অস্তগামী সূর্যও পাখিদের গতিপথ নির্ধারণে কার্যকর ভূমিকা রাখে। ২০০১ সালে এক গবেষণায় উত্তর মেরু থেকে দক্ষিণে আসা পাখিদের পরিবর্তনশীল গতিপথ পর্যালোচনার জন্য ‘রাডার’ ব্যবহার করা হয়েছিল। তাতে দেখা যায়, পাখিদের গতি পথের বৈশিষ্ট্য ব্যাখ্যা করার একমাত্র উপায় হল তারা একটি ‘সূর্য কম্পাস’ অনুসরণ করছে।
এছাড়াও মনে করা হয় পাখিরা তাদের ষষ্ঠ ইন্দ্রিয়ের সাহায্যে চৌম্বক ক্ষেত্রকে কাজে লাগিয়ে গতিপত চিনে নেয়। গবেষণায় দেখা গেছে, পাখিদের চোখের ‘কোয়ান্টাম এফেক্টস’ চৌম্বকক্ষেত্রের রেখাগুলিকে চিনে রাখতে সাহায্য করে।
আর এই সনাক্ত করার ক্ষমতা নির্ভর করে আলোর উপর। এমনও হতে পারে এটি ‘ক্রিপ্টোক্রোম’ নামক নীল আলো সংবেদনশীল প্রোটিনের মাধ্যমেই কাজ করতে পারে।
পরিযায়ী পাখি কিভাবে গতিপথ নির্ধারণ করে তা না হয় জানা গেল, তারা কিভাবে জানতে পারে কোন অঞ্চল কখন তাদের জন্য উপযুক্ত!
মূলত তারা স্থানান্তরিত হবে কিনা এবং শীতকালে কোথায় যাবে সে সিদ্ধান্ত শুধু বিভিন্ন প্রজাতির মধ্যেই নয়, একই জাতের দুটি পাখির মধ্যেও আলাদা হতে পারে।
স্ত্রী লিঙ্গ ও অল্পবয়সী পাখিরা প্রায়ই প্রাপ্তবয়স্ক পুরুষদের তুলনায় অনেক বেশি পথ পাড়ি দিয়ে দক্ষিণে ভ্রমণ করে। আবার এমন পাখিও আছে যারা এক শীতে যুক্তরাজ্যকে বেছে নিলেও পরের শীতে চলে যেতে পারে দক্ষিণের কোনো অঞ্চলে।
শুধু গতিপথ নয়, কোথায় বিশ্রাম নেবে তাও তারা ভেবে নেয় অগ্রিম।