ব্লুমবার্গ নিউজের জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদক কার্ট ওয়াগনার ২০২৪ সালে ‘ব্যাটল ফর দ্য বার্ড : জ্যাক ডরসি, ইলন মাস্ক, অ্যান্ড দ্য $৪৪ বিলিয়ন ফাইট ফর টুইটারস সোল’ নামে একটি বই লেখেন। সেখানে তিনি ইলন মাস্কের টুইটার (বর্তমানে এক্স) কেনার পুরো ঘটনা বিস্তারিতভাবে আলোচনা করেছেন।
বই প্রকাশের পরও মাস্ক ও এক্স নিয়ে নানা ঘটনা ঘটেছে। ‘নেক্সট চ্যাপ্টার’ শিরোনামে ওয়াগনার এখন আবারও এক্সের ব্যবসায়িক কাঠামো এবং নতুন মালিকের অধীনে প্ল্যাটফর্মটি কীভাবে পরিচালিত হচ্ছে, তা পর্যালোচনা করেছেন।
২০২২ সালের এপ্রিলে ইলন মাস্ক টুইটার কিনতে ৪৪ বিলিয়ন ডলারের প্রস্তাব দিলে বিষয়টি প্রথমবারের মতো সামনে আসে। একই সময়ে তিনি ভ্যাঙ্কুভারে টেড কনফারেন্সে বক্তব্য দেন। সেখানে তিনি বলেন, “টুইটার কেনা আমার জন্য টাকা রোজগারের কোনো উপায় না। আমার মনে হয়, এমন একটি ওপেন প্ল্যাটফর্ম থাকা খুব গুরুত্বপূর্ণ, যা সবাই বিশ্বাস করে এবং যেখানে সবাই অংশ নিতে পারে। আমি অর্থনৈতিক দিক নিয়ে চিন্তা করছি না।”
কিন্তু ছয় মাস পর চুক্তির মধ্য দিয়ে মাস্ক টুইটারের মালিক হলে দেখা যায় বাস্তবতা কিছুটা ভিন্ন। শুরুতেই তিনি যেসব সিদ্ধান্ত নেন, তা দেখে বোঝা যায় অর্থনৈতিক বিষয় তার জন্য বেশ গুরুত্বপূর্ণ। কয়েক সপ্তাহের মধ্যে তিনি টুইটারের প্রায় ৮০ শতাংশ কর্মী ছাঁটাই করেন। অফিস ভাড়া, আইনজীবী ও সেবা প্রদানকারী প্রতিষ্ঠানের বিল পরিশোধ বন্ধ করে দেন।
এমনকি কর্মীদের তিনি বলেন, কোম্পানি দেউলিয়া হতে পারে। তার এই বিশৃঙ্খল ও আক্রমণাত্মক সিদ্ধান্তগুলো ওয়াগনারের ব্যাটল ফর দ্য বার্ড বইয়ে বিস্তারিতভাবে এসেছে।

টুইটার (বর্তমানে এক্স) অধিগ্রহণের পর গত দুই বছরে ইলন মাস্ক যেভাবে খরচ কমাতে ও কর্মী ছাঁটাই করেছেন, তা ছিল অনেক দ্রুত ও রূঢ়। তবে সময়ের সঙ্গে সঙ্গে এটা স্পষ্ট হয়েছে যে, তিনি এক্স থেকে আর্থিক দিক দিয়ে বড় আশা না রেখে বাস্তব সিদ্ধান্তই নিয়েছিলেন।
এক্সের আয় মূলত বিজ্ঞাপন থেকেই আসে। কিন্তু অধিকাংশ বিজ্ঞাপনদাতা এখন সেই খাতে ব্যয় কমিয়ে দিয়েছে বা একেবারে সরে গেছে। মাস্ক যে সাবস্ক্রিপশনভিত্তিক আয়ের পরিকল্পনার ওপর নির্ভর করেছিলেন, সেটিও প্রত্যাশা পূরণ করতে পারেনি। এছাড়া এক্সকে একটি পেমেন্ট ও ব্যাংকিং সেবাদানকারী প্ল্যাটফর্মে পরিণত করার পরিকল্পনাও বাস্তবায়িত হয়নি।
এই বছর এক্সের আয় কিছুটা বাড়তে পারে বলে ধারণা করা হলেও, বিজ্ঞাপন থেকে আসা আয়ের পরিমাণ এখনও মাস্কের দায়িত্ব গ্রহণের আগের তুলনায় প্রায় অর্ধেক।
৪৪ বিলিয়ন ডলার খরচ করে টুইটার কেনাটা অর্থনৈতিক দিক থেকে একটা ভুল সিদ্ধান্ত বলে মনে হতে পারে, বিশেষ করে এমন একজন মানুষের জন্য যিনি শুধু ভবিষ্যতের জন্য প্রস্তুতি নেন না, বরং নিজেই ভবিষ্যৎ গড়েন। তবে ২০২৪ সালের যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট নির্বাচন ও ফেডারেল সরকারে মাস্কের নতুন ভূমিকা দেখলে বোঝা যায়, এক্সের মূল্য তার কাছে শুধুই আর্থিক হিসাবে সীমাবদ্ধ নয়।
২০২৫ সালের মার্চে মাস্ক তার কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা প্রতিষ্ঠান এক্সএআই এর সঙ্গে এক্সকে একীভূত করেন। তখন এটি আরও পরিষ্কার হয়ে যায় যে, এক্সকে প্রচলিত কোনো সোশাল মিডিয়ার ব্যবসার মতো মূল্যায়ন করা ভুল হবে। তাহলে এক্স কী ধরনের ব্যবসা? একে আদৌ কি ব্যবসা বলা ঠিক হবে?
বর্তমানে এ নিয়ে দুটি গ্রহণযোগ্য ব্যাখ্যা আছে। প্রথমটি হলো, এক্স একটি ডেটাভিত্তিক ব্যবসা। এক্সএআই অধিগ্রহণ সেই ধারণাকে জোরালো করে। এর মূল উদ্দেশ্য হতে পারে ব্যবহারকারীদের তৈরি করা পোস্ট সংগ্রহ করা, যা বড় ভাষার মডেল প্রশিক্ষণের জন্য ব্যবহৃত হবে।
দ্বিতীয় ধারণাটি অনেক পুরনো। এটি বলে, এক্স আসলে একটি লাভজনক ব্যবসার চেয়ে রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক প্রভাব বিস্তারের একটি মাধ্যম। এই দিক থেকে এর প্রকৃত মূল্য নির্ধারণ প্রায় অসম্ভব।
এক্স এ বিষয়ে কোনো মন্তব্য করেনি। তবে এই দুটি ব্যাখ্যা বুঝতে হলে আগে জানতে হবে, এক্স এখন পর্যন্ত কী কী ব্যবসায়িক মডেল চেষ্টা করেছে এবং কেন সেগুলো সফল হয়নি।
‘বীমা কেনা’
আজকের দিনে দাড়িয়ে এক্স কী, তা বোঝার আগে আমাদের জানতে হবে—২০২২ সালের শেষের দিকে যখন ইলন মাস্ক কোম্পানিটি কিনেছিলেন, তখন এক্স (সাবেক টুইটার) আসলে কেমন ছিল।
এক্স প্রতিষ্ঠার শুরু থেকেই মূলত বিজ্ঞাপন আয়ের ওপর নির্ভর করত। এই আয় একেবারে সামান্য না হলেও কখনোই খুব বড় বা চিত্তাকর্ষক কিছু ছিল না। মাস্কের আগমনের আগে বছরে টুইটারের বিজ্ঞাপন থেকে আয় ছিল প্রায় ৪ দশমিক ৫ বিলিয়ন ডলার। এটি ছিল কোম্পানির মোট আয়ের ৮৯ শতাংশ।
তবে সমস্যার একটি বড় দিক ছিল টুইটারের বিজ্ঞাপন কৌশল। এটি মূলত “ব্র্যান্ড অ্যাডভার্টাইজিং” বা ব্র্যান্ড প্রচারের ওপর জোর দিত—যেমন টিভি বিজ্ঞাপন বা বিলবোর্ডে দেখা যায়। সেখানে একটি পণ্যের সঙ্গে একটি অনুভূতির সম্পর্ক গড়ে তোলা হয়।
উদাহরণস্বরূপ, গ্রীষ্মের ছুটি মানেই যেন বরফ ঠান্ডা কোকা-কোলা। যখন মাস্ক কোম্পানিটি অধিগ্রহণ করেন, তখন টুইটারের প্রায় ৮৫ শতাংশ বিজ্ঞাপন আয় এই ধরনের ব্র্যান্ড মার্কেটিং থেকে আসত।

এই কৌশল ব্যবহার করে টুইটার দুটি বড় সমস্যার সম্মুখীন হয়:
প্রথমত, গুগল ও মেটার মতো প্রযুক্তি প্রতিষ্ঠানগুলো প্রমাণ করেছে যে, অনলাইনে বিজ্ঞাপন আরও কার্যকর হয় যখন তা নির্দিষ্ট লক্ষ্য অনুযায়ী প্রচার করা হয়—যাকে বলা হয় “ডাইরেক্ট রেসপন্স” অ্যাডভার্টাইজিং। এই বিজ্ঞাপনগুলো খুব নির্দিষ্ট গ্রাহকদের লক্ষ্য করে তৈরি হয় এবং তাদের কাছ থেকে একটি নির্দিষ্ট প্রতিক্রিয়া পাওয়ার লক্ষ্য থাকে। যেমন ওয়েবসাইট ভিজিট, অ্যাপ ডাউনলোড বা কোনো পণ্য কেনা। এই ধরনের বিজ্ঞাপন কোম্পানির জন্য লাভজনক এবং বিজ্ঞাপনদাতার জন্য ব্যয়বহুল হলেও ফলপ্রসূ।
কিন্তু টুইটার কখনোই এই ধরনের বিজ্ঞাপনের জন্য প্রয়োজনীয় প্রযুক্তিতে পর্যাপ্ত বিনিয়োগ করেনি। বরং তারা সেই পুরনো কোকা-কোলা ধরনের বিজ্ঞাপনেই নির্ভরশীল থেকেছে, যা খারাপ না হলেও খুব লাভজনক ছিল না। এর ফলে টুইটারের বিজ্ঞাপন কখনোই মার্কেটারদের কাছে গুগল বা মেটার বিজ্ঞাপনের মতো “অবশ্যই কিনতে হবে” এমন কিছু হয়ে উঠতে পারেনি।
দ্বিতীয়ত, যদি কোনো কোম্পানি চায় যে, তার পণ্য গ্রাহকের মনে ভালো অনুভূতি জাগাবে, তাহলে সেই বিজ্ঞাপন এমন কনটেন্টের পাশে রাখা যাবে না, যা মানুষকে বিরক্ত বা ক্ষুব্ধ করে। যেমন, ঠান্ডা কোকা-কোলা দেখলেই যেন সমুদ্রসৈকতের কথা মনে পড়ে—কিন্তু যদি সেই বিজ্ঞাপনের পাশেই বর্ণবাদী বা অশালীন কোনো পোস্ট থাকে, তাহলে সেটি বিজ্ঞাপনদাতার উদ্দেশ্য নষ্ট করে দেয়।
এই দুটি কারণেই টুইটারের প্রচলিত বিজ্ঞাপন মডেল টেকসই হয়ে উঠতে পারেনি।
ইলন মাস্ক এক্সের নিয়ন্ত্রণ নিয়েই প্ল্যাটফর্মটির বহু ভাষাবিষয়ক নীতিমালা ও নির্দেশিকা বাতিল করে দেন। এর ফলে অনেক বিজ্ঞাপনদাতা মনে করেন, এক্স আর তাদের ব্র্যান্ড প্রচারের জন্য নিরাপদ জায়গা নয়।
টুইটার যেহেতু কখনোই বিজ্ঞাপনদাতাদের জন্য “অবশ্যই বিনিয়োগযোগ্য” প্ল্যাটফর্ম ছিল না, তাই তারা সহজেই এক্স থেকে সরে দাঁড়ায়। এর ফলে এক রাতের মধ্যে প্রায় ৫০ শতাংশ বিজ্ঞাপন আয় কমে যায়। কারণ অনেক কোম্পানি তাদের ব্যয় স্থগিত বা প্রত্যাহার করে।
এই সংকটের মুখে মাস্ক সমস্যাটি বুঝে প্ল্যাটফর্মের কনটেন্ট নীতিতে পরিবর্তন আনতেন, অথবা অন্তত বিজ্ঞাপনদাতাদের আশ্বস্ত করতেন যে তিনি তাদের উদ্বেগ বুঝতে পেরেছেন, তাহলে পরিস্থিতি কিছুটা সামলানো যেত। কিন্তু তিনি উল্টো পথে হাঁটেন।
মাস্ক ব্যক্তিগতভাবে তখন বিজ্ঞাপনদাতাদের সঙ্গে ‘যুদ্ধ’ করার আগ্রহ প্রকাশ করেন। অথচ প্রকাশ্যে তার আচরণ ছিল আরও কঠোর। ২০২৩ সালের শেষ দিকে এক সম্মেলনে তিনি প্রকাশ্যে মার্কেটারদের উদ্দেশে বলেন, “তোমরা গিয়ে নিজেদের দেখো।”
এখনও এক্স এই অবস্থান থেকে ঘুরে দাঁড়াতে পারেনি। ইমার্কেটিয়ারের তথ্য অনুযায়ী, ২০২৫ সালে এক্সের বিজ্ঞাপন আয় বিশ্বব্যাপী প্রায় ১৬ দশমিক ৫ শতাংশ বাড়বে বলে আশা করা হচ্ছে। কিন্তু তা এখনও মাস্ক অধিগ্রহণের আগের তুলনায় অর্ধেকের মতো এবং যুক্তরাষ্ট্রের ডিজিটাল বিজ্ঞাপন ব্যয়ের মাত্র শূন্য দশমিক ৪ শতাংশ। এই সামান্য প্রবৃদ্ধি কিছুটা ইতিবাচক বলে মনে হলেও এতে একটি বড় সমস্যা রয়েছে।
অনেক বিজ্ঞাপনদাতা আবার এক্সে বিজ্ঞাপন দিচ্ছে শুধুমাত্র মাস্ককে রাগানো এড়াতে। কারণ তিনি এখন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক উপদেষ্টাদের একজন হিসেবে বিবেচিত হচ্ছেন। আর তার প্রভাব অত্যন্ত বেশি।
এছাড়া এক্স কিছু মার্কেটারের বিরুদ্ধে মামলা দায়েরও শুরু করেছে, যারা প্ল্যাটফর্মটিতে বিজ্ঞাপন দিচ্ছে না। এতে ব্র্যান্ডগুলোর মধ্যে আরও ভয় ও উদ্বেগ তৈরি হয়েছে।
বিজ্ঞাপন শিল্পের অভিজ্ঞ ব্যক্তি এবং পরামর্শ প্রতিষ্ঠান এজেএল অ্যাডভাইজরির প্রধান নির্বাহী লু পাসকালিস বলেন, “অনেকে এখন এক্সে আসলে বিজ্ঞাপন নয়, এক ধরনের ‘বীমা’ কিনছে।” অর্থাৎ আদালতে যাওয়ার ঝুঁকি না নিয়ে নামমাত্র অর্থ ব্যয় করেই মাস্ককে খুশি রাখার চেষ্টা করছে।
তবে এই ধরনের ‘ব্ল্যাকমেইলভিত্তিক’ কৌশল কোনো দীর্ঘমেয়াদি ব্যবসায়িক সমাধান নয়। বরং এটি বোঝা যাচ্ছে, এক্স এখনো সঠিক পথে ফিরতে পারেনি।

‘আরেক ব্যবসার সন্ধানে’
এক্স এখন আর একটি নির্ভরযোগ্য বিজ্ঞাপনভিত্তিক ব্যবসা না হলে, এটি কী ধরনের ব্যবসা? সংক্ষিপ্ত উত্তর হলো: এখনো তা নিশ্চিতভাবে জানা সম্ভব হয়নি। কারণ বিজ্ঞাপনের শূন্যস্থান পূরণের মতো আর কোনো আয়ের ধারা এখনও গড়ে ওঠেনি।
তবে এটা কোনো নতুন ধারণার অভাবে হয়নি। মাস্ক বেশ কয়েকটি পণ্য ও ফিচারের পরিকল্পনা করেছেন, যেগুলো কোম্পানির জন্য নতুন আয়ের উৎস হতে পারত। কিন্তু সেগুলোর বেশিরভাগই হয় কাজ করেনি, নয়তো এখনো বাস্তবায়িত হয়নি।
সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য উদ্যোগ ছিল প্রিমিয়াম সাবস্ক্রিপশন চালুর পরিকল্পনা। এটা মাস্কের নেতৃত্বের প্রথম দিকেই একটি গুরুত্বপূর্ণ অগ্রাধিকার ছিল। এই কৌশল প্রথম দৃষ্টিতে যুক্তিযুক্ত মনে হয়—কারণ এক্সে এমন কিছু নিবেদিত ব্যবহারকারী আছে, যারা অতিরিক্ত সুবিধার জন্য অর্থ দিতে প্রস্তুত।
মাস্ক এই সাবস্ক্রিপশন মডেলকে কেন্দ্র করে “নীল টিক” বা ভেরিফিকেশন ব্যাজ বিক্রির সিদ্ধান্ত নেন। এটা আগে টুইটারে একজন গুরুত্বপূর্ণ বা বিখ্যাত ব্যক্তি হিসেবে স্বীকৃতি পাওয়ার প্রতীক ছিল। তিনি ধরে নেন, সবাই এই মর্যাদা পেতে চাইবে। তাই তিনি এটি মাসিক ৮ ডলারে বিক্রি শুরু করেন।
কিন্তু বাস্তবে দেখা গেছে, যে কেউ অর্থ দিয়ে এই টিক কিনতে পারে, তখন এর মর্যাদা অনেকটাই হ্রাস পায়। ফলে সাবস্ক্রিপশন মডেলটি এখন পর্যন্ত খুব একটা সফল হয়নি। ২০২২ সালের শেষ দিকে, মাস্ক আশা করেছিলেন, এক্স প্রতিবছর সাবস্ক্রিপশন থেকে এক বিলিয়ন ডলার আয় করবে। কিন্তু সেই লক্ষ্যের ধারেকাছেও পৌঁছানো যায়নি।
২০২৪ সালের শেষ নাগাদ অনুমান করা হয় যে, এক্স অ্যাপের মাধ্যমে মোট ২০০ মিলিয়ন ডলার আয় করেছে। সেটিও তিন বছরের সময়জুড়ে, যা শুরু হয়েছিল ২০২১ সালের মাঝামাঝি, মাস্কের অধিগ্রহণের অনেক আগেই। এর মধ্যে অ্যাপল ও গুগলের কমিশন কাটা হয়নি।
নিশ্চিতভাবে বলতে গেলে, এই অনুমান কিছু সীমাবদ্ধতা নিয়ে তৈরি হয়েছে। উদাহরণস্বরূপ, সবাই অ্যাপের মাধ্যমে সাবস্ক্রিপশন কেনে না। তবুও যদি ধরে নেওয়া হয় প্রকৃত আয় তার দ্বিগুণ এবং তা এক বছরে হয়েছে, তাহলেও সেটি মাস্কের নিজের প্রত্যাশার তুলনায় অনেক কম।
সুতরাং বলা যায়, সাবস্ক্রিপশন মডেলও এক্সের জন্য এখন পর্যন্ত উল্লেখযোগ্য কোনো আয়ের উৎস হয়ে উঠতে পারেনি।
ফলে এক্স এখন আর একটি গুরুত্বপূর্ণ বিজ্ঞাপনভিত্তিক ব্যবসা নয়। এটি সাবস্ক্রিপশনভিত্তিক ব্যবসাও নয়। এটি পেমেন্টস ব্যবসাও নয়। কারণ এখনও এক্স কোনো অর্থ লেনদেন–সংক্রান্ত পণ্য চালু করেনি। তবে মাস্ক ভবিষ্যতে এক্সকে পেমেন্টস প্ল্যাটফর্মে রূপান্তর করার ইচ্ছা প্রকাশ করেছেন। আর এ জন্য তিনি বিভিন্ন পেমেন্ট লাইসেন্সের আবেদন করছেন।
এক্স ভিডিওভিত্তিক ব্যবসাও নয়। ২০২৪ সালে এক্স বেশ কয়েকটি উচ্চমানের ভিডিও শো চালুর চেষ্টা করেছিল, যাতে এক্সকে একটি “মোবাইলে টিভি দেখার অভিজ্ঞতা” দেওয়ার মতো প্ল্যাটফর্মে রূপান্তর করা যায়। কিন্তু এই উদ্যোগগুলো সফল হয়নি। বরং সিএনএনের সাবেক উপস্থাপক ডন লেমনের অনুষ্ঠানের ব্যর্থতা এক্সের বিরুদ্ধে একটি কদর্য মামলার সূচনা করেছে।
বর্তমানে ২০২৫ সালে এক্সের সবচেয়ে মূল্যবান সম্পদ হতে পারে এর তথ্যভাণ্ডার বা ডেটা। সোশাল মিডিয়ার তথ্য — যেমন পোস্ট, মন্তব্য, ভিডিও, প্রোফাইল — এখন খুবই গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে। কারণ এগুলো বড় ভাষা মডেল বা এলএলএম প্রশিক্ষণের জন্য কাঁচামাল হিসেবে ব্যবহৃত হয়। এই মডেলগুলোই চ্যাটবটের মতো কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তাভিত্তিক সেবাগুলো চালায়, যেমন মাস্কের প্রতিষ্ঠান এক্সএআইয়ের ‘গোর্ক’।
এখনও প্রতিদিন লাখ লাখ মানুষ এক্সে বিভিন্ন বিষয়ে পোস্ট করছেন — বিশেষ করে রাজনীতি, খেলাধুলা ও ব্যবসার মতো বিষয় নিয়ে। ভেঞ্চার ক্যাপিটালিস্ট ও মাস্কের ঘনিষ্ঠ বন্ধু চামাথ পলিহাপিতিয়া একে ইন্টারনেটের “সবচেয়ে সম্পূর্ণ, বাস্তব-সময়ে আপডেট হওয়া তথ্যভিত্তিক ডেটাসেট” হিসেবে উল্লেখ করেছেন।
তবে প্রশ্ন হলো: এই ডেটাসেটের আসল মূল্য কত? সেটাও নিশ্চিতভাবে বলা কঠিন। তুলনামূলকভাবে রেডডিটেরও একটি বড় আকারের তথ্যভাণ্ডার রয়েছে। রেডডিট এই তথ্য ব্যবহার করতে গুগল ও ওপেনএআইয়ের সঙ্গে কনটেন্ট লাইসেন্সিং চুক্তি করেছে। গুগলের সঙ্গে এই চুক্তির মূল্য বছরে আনুমানিক ৬০ মিলিয়ন ডলার। আর ওপেনএআইয়ের সঙ্গে নিউজ কর্পোরেশনের একটি চুক্তির মূল্য বছরে প্রায় ৫০ মিলিয়ন ডলার।
সুতরাং এক্সের ডেটাসেট যে মূল্যবান — সে বিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই। কিন্তু এখনো এক্সের এই তথ্যভাণ্ডার থেকে আয়ের পরিমাণ তাদের বিজ্ঞাপন আয়ের চেয়ে বেশি হবে — এমনটি বলা কঠিন।

‘মূল চরিত্র’
২০২৪ সালের যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনই এক্সের বর্তমান চরিত্র বোঝার জন্য একটি স্পষ্ট উদাহরণ। এর আগে বহু ধনী ব্যক্তি যুক্তরাষ্ট্রের নির্বাচনে প্রভাব বিস্তার করার চেষ্টা করেছেন। কিন্তু ইলন মাস্কের ভূমিকা ছিল অন্য রকম। কারণ তিনি শুধু ধনী ও প্রভাবশালী নন, একই সঙ্গে একটি বৈশ্বিক সোশাল মিডিয়া মালিক। একে তিনি নিজের মতামত প্রচার এবং সমর্থকদের মতাদর্শ ছড়িয়ে দিতে ব্যবহার করেছেন।
মাস্ক নিজেকে পুরো নির্বাচনের কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত করেছিলেন। এর ফলে এক্সও সরাসরি সেই নির্বাচনের একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ হয়ে ওঠে। শেষ পর্যন্ত এই কৌশল সফল হয়েছে। কারণ ডোনাল্ড ট্রাম্প হোয়াইট হাউস পুনরায় দখল করেছেন এবং মাস্ক এখন তার প্রশাসনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছেন।
যতদিন মাস্ক প্রাসঙ্গিক থাকবেন — অর্থাৎ ধনী, ক্ষমতাধর ও বিতর্কিত — ততদিন এক্সও একটি শক্তিশালী প্রভাব বিস্তারকারী মাধ্যম হিসেবে টিকে থাকবে। অবশ্য সেই প্রভাব অনেক সময় নেতিবাচক হতে পারে।
তবে একজন ব্যক্তিকে ঘিরে পুরো সোশাল মিডিয়া তৈরি করার মধ্যে সমস্যা রয়েছে। বিশেষ করে সেই ব্যক্তি যদি মাস্কের মতো বিতর্কিত হন। বর্তমানে এক্স অনেকাংশে মাস্কের ব্যক্তিত্ব ও বক্তব্যের ওপর নির্ভরশীল হয়ে পড়েছে। কিন্তু এটি দীর্ঘমেয়াদে টেকসই কৌশল নয়।
ইতোমধ্যেই মাস্কের কিছু সিদ্ধান্ত ও আচরণ লক্ষ লক্ষ ব্যবহারকারীকে এক্স ছেড়ে প্রতিদ্বন্দ্বী প্ল্যাটফর্মে চলে যেতে বাধ্য করেছে। ইউগভ এর জরিপ অনুসারে মাস্কের জনপ্রিয়তাও দ্রুত হ্রাস পাচ্ছে। কিছু সমালোচক কৌতূহলবশত এক্সে রয়ে গেলেও, সময়ের সঙ্গে তারাও এক সময় মুখ ফিরিয়ে নেবে।
মাস্ক একবার টেড কনফারেন্সে বলেছিলেন, এক্সের অর্থনৈতিক অবস্থা তার কাছে গুরুত্বপূর্ণ নয়। বাস্তবে সেটিই সত্যি হতে পারে। এক্স একটি আর্থিকভাবে দুর্বল, এমনকি অলাভজনক প্রতিষ্ঠান হয়েও চালু থাকতে পারে, যদি মাস্ক এটিকে বিশ্বজুড়ে তার মতামত প্রকাশের মাধ্যম হিসেবে ধরে রাখতে চান। তার পর্যাপ্ত অর্থ আছে। তাই ব্যবসায়িক ক্ষতি সত্ত্বেও প্ল্যাটফর্মটি চালিয়ে যেতে তার সমস্যা হবে না।
তবে আমরা ইতোমধ্যে দেখেছি, শুধু একজন ব্যক্তি এবং একটি রাজনৈতিক দলের ওপর নির্ভর করে গড়ে ওঠা সোশাল মিডিয়া কেমন হয় — যেমন ট্রুথ সোশ্যাল। এই প্ল্যাটফর্মের ব্যবহার সীমিত এবং এর ব্যবসায়িক গুরুত্ব খুবই সামান্য।
মাস্ক এক সময় বলেছিলেন, তিনি চান এক্স একটি “সবচেয়ে বিশ্বাসযোগ্য ও সকলের জন্য অন্তর্ভুক্তিমূলক” প্ল্যাটফর্ম হোক। কিন্তু এখন পর্যন্ত এক্স সেই লক্ষ্য অর্জনে ব্যর্থ হয়েছে।
তথ্যসূত্র : ব্লুমবার্গ নিউজ।