তুরস্কের পপুলিস্ট কর্তৃত্ববাদী নেতা হলেন রিসেপ তায়েপ এরদোয়ান। দীর্ঘদিন পর তিনি এখন তার রাজনৈতিক ক্যারিয়ারের অস্তিত্ব রক্ষায় লড়াই করছেন। আর এই সঙ্কট সম্পূর্ণরূপে তার নিজের সৃষ্টি।
এরদোয়ান ইস্তাম্বুলের জনপ্রিয় মেয়র একরেম ইমামওগলুর বাড়িতে গত ১৯ মার্চের ভোররাতে অভিযান চালানোর নির্দেশ দেন। এতে প্রায় ২০০ পুলিশ সদস্য অংশ নেয়। ইমামোগলু একজন জনপ্রিয় রাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বী ও ভবিষ্যতের প্রেসিডেন্ট পদপ্রার্থী হিসেবে বিবেচিত। তাকে দুর্নীতি এবং সন্ত্রাসবাদসহ নানা ভিত্তিহীন অভিযোগে গ্রেপ্তার করা হয়।
রাজপথে জনসমাবেশে নিষেধাজ্ঞা থাকা সত্ত্বেও, এই গ্রেপ্তারের ফলে তুরস্কে এক দশকেরও বেশি সময়ের মধ্যে সবচেয়ে বড় সরকারবিরোধী বিক্ষোভ শুরু হয়। আন্দোলন দেশের অধিকাংশ প্রদেশে ছড়িয়ে পড়ে। ইস্তাম্বুলে কিছু বিক্ষোভে অংশগ্রহণকারী মানুষের সংখ্যা ১০ লাখ ছাড়িয়ে গিয়েছিল। আর এদের বড় একটি অংশ ছিল তরুণ।
ইমামোগলু একজন ক্যারিশমাটিক ও দক্ষ নেতা। তিনি এরদোয়ানের জন্য বিশেষ হুমকি হয়ে উঠতে পারেন। তবে এই সঙ্কট ইমামোগলুকে গ্রেপ্তার করায় তৈরি হয়নি। এটি বরং এরদোয়ানের ক্রমবর্ধমান দুর্বলতাকে প্রকাশ করেছে। জনগণ তার নেতৃত্বে ক্লান্ত হয়ে পড়েছে। এরদোয়ানের অহংকার ও কর্তৃত্ববাদী আচরণ পূর্বের জনপ্রিয়তা ক্ষয়ে দিয়েছে। এখন তিনি মানুষের অসন্তোষকে দমন করতে মরিয়া হয়ে উঠেছেন।

পিউ রিসার্চ সেন্টার ২০২৪ সালের মার্চে একটি জরিপ চালায়। এতে দেখা যায়, ৫৫ শতাংশ তুর্কি নাগরিক এরদোয়ানকে অপছন্দ করেন। তার দল ২০২৪ সালের পৌরসভা নির্বাচনে হেরে যায়।
সাম্প্রতিক আন্দোলনের গভীরতা, ব্যাপ্তি ও স্থায়িত্ব নতুন ধরনের। আন্দোলনকারীরা শুধু রাস্তায় নামেনি, তারা এরদোয়ানপন্থী ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে বয়কট করেছে, অনলাইনে সক্রিয় থেকেছে এবং অসহযোগ আন্দোলন করেছে। ইমামোগলুর গ্রেপ্তার তুরস্কের দুর্বল অর্থনীতিতেও নতুন করে অস্থিরতা এনেছে।
এরদোয়ান এর জবাবে কঠোর পদক্ষেপ নিয়েছেন। তিনি ধারাবাহিকভাবে ইমামোগলুর শত শত ঘনিষ্ঠ সহযোগীকে গ্রেপ্তার করছেন। এর মধ্যে রয়েছেন তার সহকর্মী, বন্ধু, ব্যবসায়ী অংশীদার, তুর্কি ব্যবসায়ীদের সদস্য এবং পরিবারের লোকজন। তবে এসব দমন-পীড়ন এখন শক্তিশালী কর্তৃত্ববাদের নিদর্শন নয়। বরং এটি একজন আতঙ্কিত, অনিশ্চিত ও বিপন্ন নেতার দিশেহারা প্রতিক্রিয়ার মতো মনে হচ্ছে।
তুরস্কের বিরোধীদল এখন আগের চেয়ে বেশি আত্মবিশ্বাসী। বহু বছর পর তারা নতুন ও গতিশীল নেতৃত্ব পেয়েছে। এবার তারা সরকারের বিরুদ্ধে প্রতিবাদের নেতৃত্ব নিচ্ছে, এমনকি ক্ষমতাসীন দলের ঘাঁটিতেও বিক্ষোভ সংগঠিত করছে।
ইমামোগলু এখনও কারাগারে আছেন। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে বন্দি হয়ে আছেন এরদোয়ান নিজেই। সংবিধান অনুযায়ী, তিনি সর্বোচ্চ দুটি মেয়াদে প্রেসিডেন্ট থাকতে পারেন এবং তার মেয়াদ ২০২৮ সালে শেষ হবে। কিন্তু তার জনপ্রিয়তা হ্রাস পাওয়ায় তিনি আর সংবিধান পরিবর্তনের ক্ষমতা রাখেন না এবং আগাম নির্বাচনও দিতে পারছেন না।
চার বছরের মধ্যে প্রায় নিশ্চিতভাবেই এরদোয়ান আর প্রেসিডেন্ট থাকবেন না। তরুণ নাগরিকদের এত বড় আকারে তার বিরুদ্ধে রাজপথে নামা এর প্রমাণ যে, তিনি তার জনপ্রিয়তা স্থায়ীভাবে হারিয়েছেন। এই তরুণদের জীবনে এরদোয়ানই ছিলেন একমাত্র নেতা। একসময় মনে হতো, তিনি চিরকাল ক্ষমতায় থাকবেন। কিন্তু এখন পরিস্থিতি পাল্টে গেছে। নিজের ভুলেই তিনি পতনের দিকে এগিয়ে যাচ্ছেন।
তুরস্কে এখন নির্বাচন হলে এরদোয়ান জয়ী হবেন না—জরিপগুলো সেটাই বলছে। ভবিষ্যতে যা-ই হোক না কেন, তার রাজনৈতিক উত্তরাধিকার নির্ধারিত হবে তার নেওয়া একটি চরম সিদ্ধান্ত দিয়ে—প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বীকে কারাগারে পাঠানো। এটি ভবিষ্যতে উদাহরণ হয়ে থাকবে, কীভাবে একজন কর্তৃত্ববাদী নেতা অতিরিক্ত শক্তি প্রয়োগ করে নিজের পতনের পথ তৈরি করে।
কঠোর নিয়ন্ত্রণের হাতে
ইমামোগলু প্রথম রাজনীতিক নন, যাকে এরদোয়ান জেলে পাঠিয়েছেন। ২০১৬ সাল থেকে কুর্দি বিরোধী নেতা সেলাহাত্তিন দেমিরতাস কারাবন্দি আছেন। তাকে “রাষ্ট্রের ঐক্য বিনষ্ট” করার দায়ে ৪২ বছরের কারাদণ্ড ও এরদোয়ানকে “অপমান” করার দায়ে অতিরিক্ত তিন বছরের সাজা দেওয়া হয়। তার আসল অপরাধ ছিল কুর্দিদের মধ্যে তার ব্যাপক জনপ্রিয়তা। আর এই জনপ্রিয়তাই এরদোয়ানের রাজনৈতিক পরিকল্পনার জন্য হুমকি হয়ে দাঁড়িয়েছিল।
তবে ইমামোগলুর আগমনের আগ পর্যন্ত এরদোয়ান প্রতিপক্ষের উদয়কে নিজের ক্ষমতা বাড়ানোর সুযোগ হিসেবে ব্যবহার করেছেন। ২০০৩ সালে ক্ষমতায় এসে তিনি তুরস্কের রাজনীতিতে সামরিক বাহিনীর প্রভাব হ্রাস করার প্রতিশ্রুতি দেন। সামরিক বাহিনী রাজনীতি থেকে সরে দাঁড়ানোর পর তার সামনে আর বড় কোনও বাধা থাকেনি।
এরপর থেকে তার সংস্কারমূলক দর্শন ধীরে ধীরে কর্তৃত্ববাদী শাসনে পরিণত হয়। তিনি সরকার ও সমাজের প্রায় সব কিছুর উপর নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করেন। অনেক কর্তৃত্ববাদী নেতার মতো, এরদোয়ানও রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলো নিয়ন্ত্রণে রাখতে অনিশ্চয়তা ও অপ্রত্যাশিত সিদ্ধান্তকে হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করেন। যখন স্থানীয় নির্বাচনের ফলাফল তার পক্ষে যায়, তখন তিনি সেগুলোকে মেনে নেন। আর যখন বিপক্ষে যায়, তখন তিনি উপেক্ষা করেন।
২০১৩ সালে ইস্তাম্বুলের গেজি পার্ক ভেঙে ফেলার পরিকল্পনার প্রতিবাদে বড় আন্দোলন শুরু হয়। গেজি পার্ক ছিল শহরের শেষ দিকের কয়েকটি সবুজ জায়গার একটি। এরদোয়ান ভয় পান, এসব প্রতিবাদ আরব বসন্তের মতো গণআন্দোলনে রূপ নিতে পারে। ফলে তিনি কঠোর দমন নীতি গ্রহণ করেন।
তিনি এই বিক্ষোভে অংশগ্রহণের (প্রায়ই মিথ্যা) অভিযোগে বহু ব্যক্তিকে গ্রেপ্তার করেন। নাগরিক সমাজের নেতা ওসমান কাভালাকে আন্দোলন সংগঠিত ও অর্থায়নের অভিযোগে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেওয়া হয়। এখনও তিনি কারাগারে আছেন।

এক দশকের বেশি সময় পরেও, এরদোয়ান গেজি পার্ক আন্দোলনকে অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করছেন। ২০২৫ সালের জানুয়ারিতে আয়শে বারিম নামে এক উন্নয়ন সংস্থার মালিককে গ্রেপ্তার করা হয়। তার বিরুদ্ধে অভিযোগ আনা হয়, তিনি ওই আন্দোলনের মাধ্যমে সরকার উৎখাতের ষড়যন্ত্র করেছিলেন। যদিও অনেকে মনে করেন, তাকে অন্য কোনও কারণে টার্গেট করা হয়েছিল।
এরদোয়ানের শুরুর সংস্কারমুখী দৃষ্টিভঙ্গি ধীরে ধীরে এক কর্তৃত্ববাদী শাসনে রূপ নিয়েছে। ২০১৬ সালে তুরস্কের সেনাবাহিনীর একটি অংশ ব্যর্থভাবে অভ্যুত্থানের চেষ্টা করে। এই ঘটনার সুযোগে এরদোয়ান জরুরি অবস্থা জারি করেন।
জরুরি শাসনের ফলে তিনি সংসদ ও আদালতের ক্ষমতা উপেক্ষা করে শাসন চালাতে সক্ষম হন। এরপর তিনি সরকারের ভেতর থেকে আনুগত্যহীনতার অভিযোগে ১ লাখ ২৫ হাজারেরও বেশি সরকারি কর্মচারী, সামরিক কর্মকর্তা, শিক্ষক, বিচারক এবং সরকারি আইনজীবীকে বরখাস্ত করেন। এদের অনেকেই অভ্যুত্থানচেষ্টার এক সপ্তাহের মধ্যেই বরখাস্ত হন। এতে ধারণা করা হয়, এরদোয়ান আগে থেকেই তাদের একটি তালিকা প্রস্তুত রেখেছিলেন।
এই ব্যর্থ অভ্যুত্থানের পর জনসমর্থন কাজে লাগিয়ে এরদোয়ান ২০১৭ সালে একটি সাংবিধানিক গণভোট আয়োজন করেন। এতে তুরস্কের সংসদীয় ব্যবস্থা বিলুপ্ত হয়ে একটি কেন্দ্রীভূত প্রেসিডেনশিয়াল শাসনে রূপ নেয়। ফলে ক্ষমতার বিভাজন ও আইনের শাসন কার্যত বাতিল হয়ে যায়। সংসদ শুধু আনুষ্ঠানিক অনুমোদনদাতা হিসেবে পরিণত হয়।
এরদোয়ান সরকার বহু নির্বাচিত মেয়রকে বরখাস্ত করে তাদের জায়গায় অন্যদের বসিয়েছে। বিশেষ করে কুর্দি সংখ্যাগরিষ্ঠ অঞ্চলের মেয়রদের সরিয়ে দেওয়া হয়েছে। এমনকি তিনি সংবিধানিক আদালতের সিদ্ধান্তও উপেক্ষা করেছেন। এই আদালত এখনও কিছুটা স্বাধীনভাবে কাজ করে থাকে।
তিনি নিজেকে শক্তিশালী ও নির্ভুল নেতা হিসেবে উপস্থাপন করলেও এরদোয়ান অত্যন্ত স্পর্শকাতর। তুরস্কের কারাগারগুলো এখন এমন সাংবাদিক, রাজনীতিবিদ, শিক্ষক ও সাধারণ নাগরিকদের দিয়ে পূর্ণ, যাদের কথা বা আচরণ সরকারের দৃষ্টিতে অপমানজনক বা বিরোধী বলে বিবেচিত হয়েছে। অনেকেই শুধু কয়েক বছর আগে করা সোশাল মিডিয়ার একটি পোস্টের কারণে মাসের পর মাস জেলে আটক থাকেন।
২০১৪ থেকে ২০২০ সালের মধ্যে প্রায় ১ লাখ ৬০ হাজার তুর্কির বিরুদ্ধে প্রেসিডেন্ট অবমাননার অভিযোগে তদন্ত হয়েছে এবং ৩৫ হাজার জনকে বিচারের মুখোমুখি করা হয়েছে।
অপমানের পর অপমান
এরদোয়ান যেভাবে তার ক্ষমতা কুক্ষিগত করে বিরোধীদের দমন করেছেন, তা বাইরের দৃষ্টিতে সফল মনে হলেও বাস্তবে এই শক্তির ভেতর দুর্বলতা ছিল। ইমামোগলুর গ্রেপ্তার সেই দুর্বলতার প্রথম ইঙ্গিত নয়। এর আগেই ২০২৪ সালের শুরুতে, তুরস্কের শিল্প ও বাণিজ্য সংগঠনের সভাপতি ও প্রেসিডেন্ট উভয়েই এক সমালোচনামূলক বক্তব্য দেন।
তারা বলেন, সরকার যেসব ব্যক্তিকে অপরাধে অভিযুক্ত করে, তাদের দোষ প্রমাণিত হওয়ার আগেই তাদের ব্যবসা ও সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করে নেওয়া হচ্ছে। এরদোয়ান এই মন্তব্যের পাল্টা প্রতিক্রিয়ায় সংগঠনের নেতাদের বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করে বলেন, তারা এমন বিষয়ের ওপর মন্তব্য করেছেন, যা সম্পর্কে তারা অবগত ছিলেন না। এর ফলে তারা বিভ্রান্তিকর তথ্য ছড়িয়েছেন।
ইমামোগলুর মার্চ মাসের গ্রেপ্তারের সময় পর্যন্ত এসে তিনি এরদোয়ানের জন্য একটি প্রকৃত হুমকি হয়ে উঠেছিলেন। এরদোয়ানের রাজনৈতিক যাত্রাপথের মতোই ইমামোগলুও একজন দক্ষ ও জনপ্রিয় মেয়র হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেন। ২০১৯ সালে তিনি ইস্তাম্বুলের মেয়র নির্বাচনে বিজয়ী হন।
এরদোয়ান তখন তার জয় বাতিল করে ভোট পুনরায় আয়োজন করেন। কিন্তু তাতেও ইমামোগলু আবার বিজয়ী হন। তিনি প্রশাসনিক দক্ষতা, সাধারণ মানুষের সঙ্গে সহজভাষায় যোগাযোগ ও গণতান্ত্রিক মূল্যবোধের প্রতি অঙ্গীকারের মাধ্যমে নিজের জনপ্রিয়তা বাড়ান। এরদোয়ানের দিন দিন একনায়কতান্ত্রিক হয়ে ওঠা শাসনের বিরোধী হিসেবে নিজেকে তুলে ধরেন। এতে বহু তুর্কি নাগরিকের মধ্যে তার প্রতি সমর্থন জন্ম নেয়।
তুরস্কের বিরোধীদল দীর্ঘদিন ধরে অনুপ্রেরণাদায়ী নেতা কিংবা কার্যকর রাজনৈতিক কৌশল খুঁজে পায়নি। সেই প্রেক্ষাপটে ইমামোগলুর মতো একজন কার্যকর ও গণমুখী নেতা বিরোধীদের পক্ষে বড় একটি সম্বল হয়ে দাঁড়ান।
২০২২ সালে ইমামোগলুর বিরুদ্ধে দেশটির নির্বাচন পরিষদের কয়েকজন কর্মকর্তাকে অপমান করার অভিযোগে মামলা হয়। তাকে কারাদণ্ড দেওয়া হয় এবং রাজনীতিতে অংশগ্রহণে নিষেধাজ্ঞা জারি করা হয়। সরকারপন্থী গণমাধ্যম তখন নিয়মিতভাবে তার বিরুদ্ধে অপপ্রচার চালাতে থাকে। তবুও ইমামোগলুর জনপ্রিয়তা কমেনি। তিনি আদালতে আপিল করেন, এবং তার শাস্তির কার্যকারিতা আপাতত স্থগিত থাকে।
ইমামোগলু বহু বছর পর এরদোয়ানের ক্ষমতার ওপর প্রকৃত হুমকি তৈরি করা প্রথম রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব। তাই এরদোয়ান তার সব ধরনের রাজনৈতিক কৌশল প্রয়োগ করতে থাকেন। ইমামোগলুর গ্রেপ্তারের এক দিন আগে ইস্তাম্বুল বিশ্ববিদ্যালয় তার ৩১ বছর আগের স্নাতক ডিগ্রি বাতিল করে। এটি ছিল রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার এক চূড়ান্ত কৌশল।
তুর্কি সংবিধান অনুযায়ী, রাষ্ট্রপতি প্রার্থী হওয়ার জন্য স্নাতক ডিগ্রি আবশ্যক। তাই ডিগ্রিটি বাতিল করে ভবিষ্যতে তার প্রার্থিতা ঠেকানোর পথ তৈরি করা হয়।

ইমামোগলুর দল তখন প্রেসিডেন্ট পদে প্রার্থী নির্ধারণের জন্য একটি প্রাথমিক নির্বাচন আয়োজন করছিল। গ্রেপ্তারের চার দিন পর এই নির্বাচন অনুষ্ঠিত হওয়ার কথা ছিল। তুরস্কে সাধারণত এমন প্রাথমিক নির্বাচন হয় না। ইমামোগলুই ছিলেন একমাত্র প্রার্থী।
এরদোয়ান জানতেন, ইমামোগলু নির্বাচিত হলে আগামী সাধারণ নির্বাচন পর্যন্ত তিনি এরদোয়ানের সমপর্যায়ের একজন জাতীয় নেতা হয়ে উঠবেন। আর এই নির্বাচনের সময় হয়তো ২০২৮ সাল পর্যন্ত আসবে না।
২০১৩ সালের গেজি পার্ক আন্দোলনের মতোই, এরদোয়ান এই সঙ্কট থেকেও কঠোর বলপ্রয়োগের মাধ্যমে বেরিয়ে আসার চেষ্টা করছেন। কিন্তু এবার তার চরম সিদ্ধান্ত রাজনৈতিক বিরোধীদের একত্রিত ও উদ্দীপ্ত করেছে। এরদোয়ান প্রতিবাদ, বিক্ষোভ বা অর্থনৈতিক অবরোধকে “সন্ত্রাসবাদ” বা “রাষ্ট্রদ্রোহ” বলে দমন করতে চাইলে তা আগের মতো কাজ করছে না। কারণ এখন বিরোধীদের কাছে একজন জনপ্রিয় নেতা আছেন—ইমামোগলু। তার নেতৃত্বে বিরোধীরা এখন এক শক্তিশালী ধারণায় ঐক্যবদ্ধ: “তুরস্কের গণতন্ত্রের নতুন সুযোগ পাওয়া উচিত।”
বছরের পর বছর অসফল হওয়ার পর বিরোধী দল নিজেদের নতুন করে গঠিত করেছে। নতুন নেতৃত্বে তারা আরও সংগঠিত ও কৌশলী হয়েছে। ইমামোগলুর গ্রেপ্তারের পর দেশজুড়ে বিক্ষোভ দেখা দেয়। তখন বিরোধী দল ২৩ মার্চের প্রাথমিক নির্বাচনে দেশের সব নাগরিককে অংশগ্রহণের আহ্বান জানায়, যাতে তারা নিজেদের সমর্থন প্রদর্শন করতে পারে।
ফলাফল ছিল বিস্ময়কর। ১ কোটি ৫০ লাখেরও বেশি মানুষ ঘণ্টার পর ঘণ্টা লাইনে দাঁড়িয়ে কারাবন্দি এক প্রার্থীকে ভোট দেন।
এরদোয়ানের দমনমূলক নীতিই ইমামোগলুকে বিরোধীদের প্রধান নেতা করে তুলেছে। কারাগার থেকেই ইমামোগলু দেশের মানুষের সঙ্গে যোগাযোগ রাখছেন। এতে জনমনে ধারণা তৈরি হয়েছে, এরদোয়ান এখন আর সবকিছুর নিয়ন্ত্রণে নেই।
তুরস্কের জনমত জরিপকারী প্রতিষ্ঠান কনডার সাম্প্রতিক এক জরিপে দেখা গেছে, ৬৭ শতাংশ মানুষ মনে করে এরদোয়ানের পুনঃনির্বাচন তুরস্কের জন্য খারাপ হবে। ২০২৩ সালে এই হার ছিল ৪৯ শতাংশ।
একই জরিপে দেখা গেছে, তুর্কিদের ৬০ শতাংশের বেশি মানুষ বিশ্বাস করে না যে ইমামোগলুর বিরুদ্ধে আনা অভিযোগ সত্য। ইমামোগলু যতদিন কারাগারে থাকবেন, তার রাজনৈতিক ও জনসম্পৃক্ততা ততই বাড়বে। এখন শুধু সময়ের অপেক্ষা, কখন তাকে মালয়েশিয়ার প্রধানমন্ত্রী আনোয়ার ইব্রাহিম বা চেক লেখক ভ্যাকলাভ হ্যাভেলের মতো ঐতিহাসিক ব্যক্তিত্বদের সঙ্গে তুলনা করা শুরু হয়।
দ্বৈত সঙ্কটে এরদোয়ান
সম্প্রতি রিসেপ তায়েপ এরদোয়ানের কার্যকলাপ দেখে মনে হয়, তুরস্ক এখন এক ধরণের কর্তৃত্ববাদী রাষ্ট্রে পরিণত হয়েছে, যেখানে নির্বাচন শুধু ক্ষমতাসীন ব্যক্তির আধিপত্য ধরে রাখার মাধ্যম হিসেবে ব্যবহৃত হয়। তবে একইসঙ্গে এরদোয়ান এখন আর নিজের অবস্থান ও জনসমর্থনের উপর পূর্ণ আস্থা রাখতে পারছেন না।
ইমামোগলুর বিরুদ্ধে চলমান মামলাকে বৈধতা দেওয়ার জন্য এরদোয়ান যে পরিমাণ সময় ও শ্রম ব্যয় করছেন, তা তার অসহায়তা ও উদ্বেগের পরিচায়ক। অতীতে তার রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত গ্রেপ্তারগুলো অনেক সময় প্রতিশোধপরায়ণতার বহিঃপ্রকাশ ছিল। কিন্তু ইমামোগলুর গ্রেপ্তার আরও স্পষ্টভাবে ভয় ও আশঙ্কার প্রকাশ।
সবচেয়ে অবাক করা বিষয় হলো, ইমামোগলুর ওপর এরদোয়ানের দমন-পীড়নের ধরণ তার নিজের অতীত অভিজ্ঞতার সঙ্গে মিলে যায়। এরদোয়ান ইস্তাম্বুলের মেয়র থাকাকালীন তিনিও একবার অন্যায়ভাবে জেলে গিয়েছিলেন। সে ঘটনাই তাকে জাতীয় রাজনীতির কেন্দ্রবিন্দুতে নিয়ে আসে এবং ভবিষ্যতের পথ মসৃণ করে দেয়।
ইমামোগলুর গ্রেপ্তার, অন্যান্য সরকারি কর্মকর্তাদের আটক এবং ব্যক্তিমালিকানাধীন প্রতিষ্ঠানের সম্পদ বাজেয়াপ্ত করার ঘটনা তুরস্কের আর্থিক বাজারে বড় ধরনের প্রভাব ফেলেছে। এই ঘটনাগুলো দেশের অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা বজায় রাখার জন্য গৃহীত দুই বছর মেয়াদি পরিকল্পনায় আস্থা নষ্ট করেছে। এই পরিকল্পনার সফলতা নির্ভর করে বিদেশি বিনিয়োগের উপর। কিন্তু আইন-শৃঙ্খলা ব্যবস্থার আরও অবনতি বিদেশি বিনিয়োগকারীদের নিরুৎসাহিত করছে।
ইমামোগলুর গ্রেপ্তারের মাত্র দুই দিন পর তুর্কি লিরা সর্বনিম্ন পর্যায়ে পৌঁছে যায়। পরিস্থিতি সামাল দিতে কেন্দ্রীয় ব্যাংক ৪৬ বিলিয়ন ডলার রিজার্ভ থেকে খরচ করে। তুরস্কের স্টক মার্কেটও ভয়াবহ ধসের মুখে পড়ে, যেটি ঠেকাতে একাধিকবার ‘সার্কিট ব্রেকার’ চালু করতে হয়।

এরদোয়ান হয়তো নিজেকে সৌভাগ্যবান মনে করছেন যে বর্তমানে হোয়াইট হাউজে ডোনাল্ড ট্রাম্প রয়েছেন। কারণ পূর্ববর্তী প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন এরদোয়ানকে এড়িয়ে চলতেন। কিন্তু ট্রাম্প তাকে বারবার প্রশংসা করেছেন এবং নতুন আমেরিকান নীতির ইঙ্গিত দিয়েছেন। ইমামোগলুর গ্রেপ্তারের পর যুক্তরাষ্ট্রের পক্ষ থেকে কোনও নিন্দা প্রকাশ না করাও এরদোয়ানের জন্য স্বস্তির বিষয়।
তবে এই সম্পর্কের খেসারতও রয়েছে। এতদিন এরদোয়ান নিজের সমর্থকদের কাছে বারবার যুক্তরাষ্ট্রকে তুরস্কের শত্রু বলে উপস্থাপন করেছেন এবং অভ্যন্তরীণ সমস্যার জন্য আমেরিকান নীতিকে দোষারোপ করেছেন। এখন ট্রাম্পের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক রাখার ফলে তিনি সেই পুরনো অভিযোগগুলো আর ব্যবহার করতে পারবেন না।
একদিকে ইমামোগলু সঙ্কট ও অন্যদিকে একটি সম্ভাব্য শান্তি প্রক্রিয়ার সূচনা—এই দুই বিষয় হয়তো মিলে এরদোয়ানের ক্ষমতাকে দুর্বল করে দিতে পারে।
২০২৪ সালের অক্টোবরে এরদোয়ানের দীর্ঘদিনের জোটসঙ্গী এবং তুরস্কের কট্টর জাতীয়তাবাদী নেতা ডেভলেট বাহচেলি আশ্চর্যজনকভাবে কুর্দি সংখ্যাগরিষ্ঠ এলাকাগুলোর প্রতিনিধিত্বকারী রাজনৈতিক দল ও কুর্দিস্তান ওয়ার্কার্স পার্টির (পিকেকে) কারাবন্দী নেতা আবদুল্লাহ ওজালানের সঙ্গে সংলাপ শুরু করেন।
২০২৫ সালের মে মাসে এই সংলাপের ফলস্বরূপ পিকেকে তাদের ৪০ বছরের সশস্ত্র সংগ্রাম পরিত্যাগ করে এবং দল ভেঙে দেয়। বাহচেলির এই পদক্ষেপ হয়তো এরদোয়ানের সম্মতিতে শুরু হয়। তবে তিনি শান্তি প্রক্রিয়া নিয়ে খুব একটা উৎসাহী ছিলেন না। এরদোয়ানের ভাষণ ছিল নিরাপত্তা কেন্দ্রিক, শাস্তিমূলক এবং ভবিষ্যৎ রোডম্যাপ নিয়ে নীরব।
পিকেকের নেতারা বুঝতে পেরেছেন যে, সশস্ত্র সংগ্রামের পথ আর বাস্তবসম্মত নয়। তাই তারা তাদের দাবি এক জায়গায় কেন্দ্রীভূত করেন—তারা চায় একটি সত্যিকারের গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র যেখানে আইনের শাসন ও ক্ষমতার পৃথকীকরণ থাকবে। এ ধরনের রাষ্ট্র কুর্দিদের ভাষার অধিকার নিশ্চিত করতে পারে।
কিন্তু এরদোয়ানের জন্য এটি একটি বড় দোটানা। কারণ এরকম গণতান্ত্রিক সংস্কার আনতে গেলে তাকে সেই কর্তৃত্ববাদী রাষ্ট্র কাঠামো ভেঙে ফেলতে হবে, যা তিনি এতদিন ধরে গড়ে তুলেছেন। তিনি যেভাবে ইমামোগলু ও তার সহযোগীদের জেলে রাখার চেষ্টা করছেন, তাতে বোঝা যায়, তিনি সেই পথ বেছে নিতে চান না।
কিন্তু তিনি শান্তি প্রক্রিয়াটিকে বাধাগ্রস্ত করলে জোটসঙ্গী বাহচেলিকে বিচ্ছিন্ন করার ঝুঁকি থাকবে। বাহচেলির বয়স এখন ৭৭। তিনি চান তার রাজনৈতিক জীবন একটি ঐতিহাসিক শান্তি চুক্তি দিয়ে শেষ করতে।
ক্ষমতায় থাকতে হলে এরদোয়ানের সামনে দুটি পথ খোলা। হয় তাকে সংবিধান সংশোধন করতে হবে, নয়তো পার্লামেন্টকে আগাম নির্বাচন ডাকার জন্য রাজি করাতে হবে যাতে তিনি আবার প্রার্থী হতে পারেন। তবে আগাম নির্বাচন হলেও, জনগণের মধ্যে দৃশ্যমান মত পরিবর্তনের কারণে বিজয় নিশ্চিত নয়।
ক্রমশ একঘরে হয়ে পড়া এরদোয়ান এখন চাটুকার পরিবেষ্টিত। তিনি হয়তো আগের মতোই চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় দমন-পীড়নের পথ বেছে নেবেন। কিন্তু কতজনকে গ্রেপ্তার, নিষিদ্ধ বা পদচ্যুত করা যাবে তারও একটা সীমা রয়েছে। তিনি এভাবে চলতে থাকলে তুরস্ক ধীরে ধীরে একদলীয় রাষ্ট্রে পরিণত হতে পারে।
বাস্তবতা হলো—দীর্ঘ সময় ধরে একক আধিপত্য বজায় রাখা এরদোয়ান এখন আর নতুন কিছু করার জায়গায় নেই। তিনি তার বিদায়ের সময় ও কৌশল নিজে নির্ধারণ করলে তবে একটি শান্তিপূর্ণ ক্ষমতা হস্তান্তর সম্ভব হবে এবং তিনি তার উত্তরাধিকার রক্ষা করতে পারবেন। এখনও তার হাতে নিজের রাজনৈতিক পরিণতি নিয়ন্ত্রণ করার সুযোগ আছে।
কিন্তু তার স্বভাব ও অতীত রেকর্ড বলছে, তিনি হয়তো সেই পথ বেছে নেবেন না। তিনি নিজের পুরনো পথেই অটল থাকলে তুর্কি জনগণ শেষ পর্যন্ত তার বিরুদ্ধে মুখ ফিরিয়ে নিতে পারে। তখন এরদোয়ানের দীর্ঘ রাজনৈতিক অধ্যায় শুধুমাত্র একনায়কত্বের একটি অধ্যায় হিসেবেই ইতিহাসে লেখা থাকবে।
তথ্যসূত্র : ফরেন পলিসি।