যুক্তরাষ্ট্রের হামলায় যে সুবিধা হলো ইরানের

‘বি-টু স্টেলথ’ যুদ্ধবিমান দিয়ে ইরানে হামলা চালায় যুক্তরাষ্ট্র, যেগুলোতে ছিল জিবিইউ-৫৭ নামে পরিচিত ‘ম্যাসিভ অর্ডন্যান্স পেনিট্রেটর’ বোমা। ছবি: ফেইসবুক থেকে নেওয়া।
‘বি-টু স্টেলথ’ যুদ্ধবিমান দিয়ে ইরানে হামলা চালায় যুক্তরাষ্ট্র, যেগুলোতে ছিল জিবিইউ-৫৭ নামে পরিচিত ‘ম্যাসিভ অর্ডন্যান্স পেনিট্রেটর’ বোমা। ছবি: ফেইসবুক থেকে নেওয়া।

ইরানের পরমাণু প্রকল্প নিয়ে যুক্তরাষ্ট্র ও পশ্চিমা দেশগুলোর মাথাব্যথা বহু বছরের। তেল আবিবের সঙ্গে তেহরানের চলমান যুদ্ধের মধ্যেই সেই মাথাব্যথা কমাতে ইরানের তিনটি শীর্ষ পরমাণু কেন্দ্রে বোমা হামলা করল যুক্তরাষ্ট্র।

যদিও মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প এই হামলাকে ‘সফল’ বলে আখ্যা দিয়েছেন, তবে এখন নতুন চ্যালেঞ্জ তৈরি হয়েছে, আর সেটি হলো, ইরানের হাতে কী আছে এবং কোথায় আছে, তা বোঝা এখন আগের চেয়ে কঠিন হয়ে পড়েছে।

ট্রাম্প জানিয়েছেন, শনিবার গভীর রাত থেকে শুরু করে রোববার ভোরে সুরক্ষিত তিনটি স্থাপনায় হামলা চালিয়ে সেগুলো সম্পূর্ণ ধ্বংস করা হয়েছে। তবে এই দাবির পক্ষে এখনও নিরপেক্ষ কোনও বিশ্লেষণ পাওয়া যায়নি।

ইরানের পারমাণবিক কর্মসূচি পর্যবেক্ষণকারী তিনজন বিশেষজ্ঞের মতে, যুক্তরাষ্ট্রের আঘাত দ্রুত কোনও সাফল্য এনে না দিয়ে বরং ইউরেনিয়াম পর্যবেক্ষণের কাজ আরও জটিল করে তুলেছে। ফলে নিশ্চিত করা কঠিন হয়ে পড়েছে যে ইরান গোপনে পারমাণবিক অস্ত্র তৈরি করছে কি না।

আন্তর্জাতিক পারমাণবিক শক্তি সংস্থার (আইএইএ) পর্যবেক্ষকেরা এখনও ইরানে রয়েছেন। ১৩ জুন ইসরায়েল বোমা হামলা শুরুর আগের দিন তারা একাধিক স্থাপনা পরিদর্শন করছিলেন। হামলার পর তারা এখনও ক্ষয়ক্ষতির মাত্রা নির্ধারণের চেষ্টা করছেন।

যুক্তরাষ্ট্রের হামলার পর জ্বলছে ইরানের পারমাণবিক স্থাপনা। ছবি সোশাল মিডিয়ায় ছড়িয়ে পড়া ভিডিও থেকে নেওয়া।

সামরিক অভিযান ইরানের ঘোষিত স্থাপনাগুলো ধ্বংস করতে পারলেও এটি এমন একটি পরিস্থিতি তৈরি করেছে, যেখানে ইরান তার কর্মসূচি আরও গোপনভাবে পরিচালনার দিকে যেতে পারে।

ট্রাম্প ‘বি-টু স্টেলথ’ যুদ্ধবিমান পাঠিয়েছিলেন ইরানের পারমাণাবিক স্থাপনা ধ্বংস করার অভিপ্রায়ে। এসব বিমানে ছিল জিবিইউ-৫৭ নামে পরিচিত ‘ম্যাসিভ অর্ডন্যান্স পেনিট্রেটর’ বোমা। এগুলো ইরানের ভূগর্ভস্থ ইউরেনিয়াম সমৃদ্ধকরণ কেন্দ্র নাতানজ ও ফোরদো ধ্বংস করতে ব্যবহার করা হয়।

রোববারের স্যাটেলাইট ছবিতে দেখা গেছে, ফোরদো স্থাপনায় নতুন গর্ত তৈরি হয়েছে। কিছু টানেলের প্রবেশপথ ধসে পড়েছে এবং একটি পর্বতের শীর্ষভাগে ফুটো দেখা যাচ্ছে। ছবিগুলো প্রকাশ করেছে ম্যাক্সার টেকনোলজিস। তবে ছবিতে দেখা গেছে, ফোরদোর একটি বড় সহায়ক ভবন, যেটি সম্ভবত ভূগর্ভস্থ ইউরেনিয়াম সমৃদ্ধকরণ হলের বায়ুপ্রবাহ নিয়ন্ত্রণের জন্য ব্যবহৃত হয়, সেটি অক্ষত রয়েছে।

আইএইএ জানিয়েছে, সেখানে কোনও তেজস্ক্রিয়তা ছড়ানোর ঘটনা ঘটেনি। নাতানজের নতুন ছবিতে দেখা গেছে, সেখানে প্রায় সাড়ে ৫ মিটার বা ১৮ ফুট চওড়া একটি নতুন গর্ত তৈরি হয়েছে।

ম্যাক্সার বলেছে, গর্তটি তৈরি হয়েছে ভূগর্ভস্থ সমৃদ্ধকরণ স্থাপনার ওপরেই। তবে ছবি থেকে নিশ্চিত হওয়া যায়নি যে, হামলায় ৪০ মিটার গভীরে অবস্থিত ও ৮ মিটার পুরু কংক্রিট ও স্টিল দিয়ে সুরক্ষিত সেই স্থাপনাটি ধ্বংস হয়েছে কি না।

রোববার সকালে এক সংবাদ সম্মেলনে যুক্তরাষ্ট্রের বিমানবাহিনীর জেনারেল ড্যান কেইন বলেন, “চূড়ান্ত ক্ষয়ক্ষতির মূল্যায়ন করতে কিছুটা সময় লাগবে।”

ছবিতে ফোরদো টানেল কমপ্লেক্স।

অন্যদিকে আইএইএ’র পরিদর্শকেরা প্রায় এক সপ্তাহ ধরে ইরানের পারমাণবিক কর্মসূচির আওতাভুক্ত সামরিক গ্রেডের ইউরেনিয়ামের মজুদের অবস্থান নির্ধারণ করতে পারেননি। ইরানের কর্মকর্তারা স্বীকার করেছেন, তারা আইএইএ’র সিল ভেঙে ইউরেনিয়ামের মজুদ অজানা একটি জায়গায় সরিয়ে নিয়েছেন।

লন্ডনভিত্তিক গবেষণা প্রতিষ্ঠান রয়্যাল ইউনাইটেড সার্ভিসেস ইনস্টিটিউটের (আরইউএসআই) জ্যেষ্ঠ গবেষক ডারিয়া ডলজিকোভা বলেন, যুদ্ধ শুরু হওয়াতে ইরান আইএইএ’র সঙ্গে আরও সহযোগিতা করবে—এই সম্ভাবনা খুবই ক্ষীণ।

তিনি বলেন, “এর চেয়ে বরং বেশি সম্ভাবনা হচ্ছে, ইরান মনে করবে যে স্বচ্ছতা ও সহযোগিতায় কোনও লাভ নেই। উল্টো ভবিষ্যতে এ ধরনের হামলা এড়াতে আরও গভীর ও গোপন স্থাপনা নির্মাণই অধিক যুক্তিযুক্ত।”

বর্তমান পরিস্থিতি সামাল দিতে আইএইএ সংঘর্ষ বন্ধ করার আহ্বান জানিয়েছে। সংস্থাটির মহাপরিচালক রাফায়েল মারিয়ানো গ্রোসি জানিয়েছেন, ৩৫ সদস্যদেশ নিয়ে গঠিত বোর্ড সোমবার ভিয়েনায় বৈঠকে বসবে।

যুক্তরাষ্ট্রের হস্তক্ষেপের আগেই স্যাটেলাইট ছবিতে দেখা যায়, বোমা হামলা শুরুর চারদিন পরও ইসরায়েলি বাহিনীর সাফল্য সীমিত ছিল। তেহরান থেকে ৩০০ কিলোমিটার দক্ষিণে অবস্থিত নাতাঞ্জের কেন্দ্রীয় স্থাপনায় ক্ষয়ক্ষতি মূলত বিদ্যুৎ সরবরাহ ব্যবস্থা ও ট্রান্সফরমারে সীমাবদ্ধ ছিল।

পরবর্তীতে যুক্তরাষ্ট্রও হামলায় যোগ দেয়। তারা তেহরান থেকে ৪৫০ কিলোমিটার দক্ষিণে অবস্থিত ইস্পাহান পরমাণু প্রযুক্তি ও গবেষণা কেন্দ্রে হামলা চালায়। এর আগে ইসরায়েলি হামলায় ওই কেন্দ্রে ঠিক কতটা ক্ষতি হয়েছে তা পুনর্মূল্যায়ন আইএইএ।

স্যাটেলাইট ছবি ও ইরানি কর্মকর্তাদের সঙ্গে যোগাযোগের ভিত্তিতে আইএইএ শনিবার রাতে জানায়, ইস্পাহান কেন্দ্রে “ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি” হয়েছে।

এখনকার ছবিতে দেখা যাচ্ছে, যুক্তরাষ্ট্রের হামলার পর আরও বড় ধরনের ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। এর মধ্যে রয়েছে একাধিক বিশালাকার ভবন।

যুক্তরাষ্ট্রের হামলার পর ইসরায়েলিরা সোশাল মিডিয়ায় এই ছবিটি ছড়িয়ে দেন।

আইএইএ আগে জানিয়েছিল, এই ধ্বংসযজ্ঞের ফলে “তেজস্ক্রিয় ও রাসায়নিক দূষণ ঘটতে পারে, বিশেষ করে যেসব স্থাপনায় হামলা হয়েছে সেগুলোর ভেতরে।”

সংস্থাটির মূল দায়িত্ব হচ্ছে বিশ্বব্যাপী ইউরেনিয়ামের হিসাব রাখা এবং সেগুলো যাতে পারমাণবিক অস্ত্র তৈরিতে ব্যবহৃত না হয় তা নিশ্চিত করা। তবে সাম্প্রতিক এই বোমা হামলা ইরানের ইউরেনিয়ামের গতিপথ শনাক্ত করার কাজকে আরও জটিল করে তুলেছে বলে মন্তব্য করেছেন সংস্থাটির পরমাণু যাচাইকরণ নীতির সাবেক প্রধান তারিক রউফ।

তিনি বলেন, “এখন আইএইএ’র পক্ষে প্রায় ৯ হাজার কেজি সমৃদ্ধ ইউরেনিয়ামের সঠিক হিসাব নির্ধারণ করা অত্যন্ত কঠিন হয়ে পড়েছে। বিশেষ করে এর মধ্যে যে প্রায় ৪১০ কেজি ৬০ শতাংশ মাত্রায় সমৃদ্ধ ইউরেনিয়াম রয়েছে তা নিয়ে।”

আইএইএ’র পরিদর্শকরা গত সপ্তাহেই স্বীকার করেছিলেন, ইসরায়েলি বাহিনীর লাগাতার সামরিক অভিযানের কারণে তারা ইরানের উচ্চমাত্রায় সমৃদ্ধ ইউরেনিয়ামের অবস্থান শনাক্ত করতে পারছেন না।

তারা বলেছিলেন, এই মজুদ ইস্পাহান কেন্দ্রে ছিল। আর এটি এতটাই পরিমাণে ছিল যে গোপনে দশটি পারমাণবিক বোমা তৈরি সম্ভব। তবে এই ইউরেনিয়াম এত ছোট ছোট পাত্রে রাখা ছিল—মাত্র ১৬টি ছোট কন্টেইনারেই পুরোটা রাখা সম্ভব—যা হয়তো ইতোমধ্যেই ওই স্থান থেকে সরিয়ে নেওয়া হয়েছে।

রয়্যাল ইউনাইটেড সার্ভিসেস ইনস্টিটিউটের গবেষক ডারিয়া ডলজিকোভা বলেন, “প্রশ্ন থেকেই যায়- ইরান তার সমৃদ্ধ ইউরেনিয়ামের মজুদ এখন কোথায় রাখছে? সম্ভাবনা অনেক বেশি যে এসব উপাদান এখন এমন গোপন জায়গায় সরিয়ে নেওয়া হয়েছে, যেগুলো ইসরায়েল বা যুক্তরাষ্ট্রের হামলার নাগালের বাইরে।”

ইরান তার বিদ্যুৎ উৎপাদন ও পারমাণবিক অস্ত্র তৈরির সক্ষমতা অর্জনের লক্ষ্যে দেশব্যাপী ব্যাপক পরিকাঠামো তৈরি করেছে। এসব স্থাপনায় হাজার হাজার বিজ্ঞানী ও প্রকৌশলী কাজ করছেন। এর সংখ্যা কয়েক ডজন কেন্দ্রজুড়ে বিস্তৃত।

সামরিক বিশ্লেষকেরা এখনও স্যাটেলাইট ছবির ওপর নির্ভর করে ট্রাম্পের এই অভিযানের সফলতা নির্ধারণের অপেক্ষায় আছেন। আর পরমাণু নিরাপত্তা বিশ্লেষকেরা একমত হয়েছেন যে, তাদের কাজ এখন অনেক বেশি কঠিন হয়ে পড়ছে

আইএইএ’র সাবেক পরিচালক রবার্ট কেলি ইরাক ও লিবিয়ায় পরিদর্শন পরিচালনা করেছিলেন। তিনি বলেন, “ইসরায়েল ও যুক্তরাষ্ট্র ইরানের স্থাপনাগুলোতে হামলা চালিয়ে শুধু আইএইএ’র ইউরেনিয়াম হিসাব রাখার প্রক্রিয়াই ব্যাহত করেনি, বরং এমন অনেক প্রযুক্তিগত সরঞ্জামও ধ্বংস করে ফেলেছে যা পর্যবেক্ষকেরা ব্যবহার করতেন।

“এর মধ্যে অন্যতম হলো ফরেনসিক নমুনা বিশ্লেষণ পদ্ধতি। এটি দিয়ে ইউরেনিয়ামের গোপন প্রবাহ শনাক্ত করা হতো। এখন যেহেতু স্থাপনাগুলোতে বোমা পড়েছে এবং বিভিন্ন ধরনের পদার্থ চারদিকে ছড়িয়ে পড়েছে, তাই আইএইএ আর কখনও পরিবেশগত নমুনা গ্রহণ পদ্ধতি ব্যবহার করতে পারবে না। প্রতিটি আইসোটোপের কণা এখন অসীমকাল টিকে থাকবে ফরেনসিক বিশ্লেষণের জন্য। কিন্তু এসবের উৎস আলাদা করে চিহ্নিত করা একেবারেই অসম্ভব হয়ে যাবে।”

তথ্যসূত্র : ব্লুমবার্গ, নিউ ইয়র্ক টাইমস ও ম্যাক্সার

এ সম্পর্কিত আরও খবর:

আরও পড়ুন