সাইবার আইন: অভ্যুত্থানের সরকারও দিল নতুন বোতলে পুরনো মদ

Protest Against Cyber Security Law

ছিল তথ্য প্রযুক্তি আইন, তারপর হয়েছিল ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন, তারপর নাম বদলে হলো সাইবার নিরাপত্তা আইন; পরিবর্তনে নিরাপত্তার কথা এলেও আওয়ামী লীগের শাসনামলে বিতর্কিত এই আইনই হয়ে উঠেছিল নিরাপত্তাহীনতার কারণ।

গত দেড় দশকে সাইবার স্পেস বা অন্তর্জালে মানুষের মত প্রকাশের অধিকার খর্ব করতে সরকারের হাতিয়ার হয়ে উঠেছিল এই আইনটি। তার বিরুদ্ধে অধিকারকর্মীরা সোচ্চার ছিল, প্রতিবাদ করেছিল সাংবাদিকরা, সমালোচনা ছিল অন্য সব রাজনৈতিক দলেরও। এমনকি জুলাই আন্দোলনেও মত প্রকাশের স্বাধীনতার দাবি ছিল ব্যানারে, স্লোগানে, দেয়াল লিখনে।

সেই অভ্যুত্থানে শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর অন্তর্বর্তীকালীন সরকার সেই আইন সংশোধন করেছে। তা উপদেষ্টা পরিষদের সভায় পাস হয়েছে একদিন আগে। এখন সংসদ নেই বলে অধ্যাদেশ আকারে কার্যকর হবে এই আইন।

কিন্তু নতুন আইনে নাম বদলে ‘নিরাপত্তা’র জায়গায় ‘সুরক্ষা’ বসলেও অন্য সব কিছু আগের মতোই রয়েছে। পুলিশের গ্রেপ্তারি ক্ষমতা আগের মতোই রয়েছে। সামান্য এদিক-সেদিক করে শুধু বাদ দেওয়া হয়েছে মুক্তিযুদ্ধ, মুক্তিযুদ্ধের চেতনা, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, জাতীয় সংগীত বা জাতীয় পতাকা সম্পর্কে বিদ্বেষ, বিভ্রান্তি ও কুৎসামূলক প্রচারণার দণ্ডের অংশটুকু।

গত বছর অর্থাৎ ২০২৩ সালে আগের আইন বদলে সাইবার নিরাপত্তা আইন করার পর জ্যেষ্ঠ সাংবাদিক মনজুরুল আহসান বুলবুল এক কলামে লিখেছিলেন- “বারবার রূপ বদল হচ্ছে কিন্তু নর্তকীর নাচে বদল আসছে না।” নতুন আইনেও রূপ আসলে একই থাকছে।

যদি আমরা উৎসের দিকে তাকাই, তাহলে দেখব আইনটি হয়েছে ২০০৬ সালে। বিএনপি নেতৃত্বাধীন চারদলীয় জোট বিদায় বেলায় তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি আইন নামে ৯০টি ধারা সম্বলিত এই আইন করেছিল। আইসিটি আইন নামেই পরিচিতি পেয়েছিল এটি।

জরুরি অবস্থার দুই বছর পেরিয়ে ২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় যাওয়ার পর আইনটি সংশোধন করে। তবে তখন থেকেই আইনটির অপপ্রয়োগ ঘটতে থাকে। আর তাতে সরকারের সুরক্ষা কবজ হয়ে দাঁড়ায় ৫৭ নম্বর ধারা।

বিতর্কিত ৫৭ নম্বর ধারায় লেখা ছিল- “এই আইনের অধীন দায়িত্ব পালনকালে সরল বিশ্বাসে কৃত কোনো কার্যের ফলে কোনো ব্যক্তি ক্ষতিগ্রস্ত হইলে বা ক্ষতিগ্রস্ত হইবার সম্ভাবনা থাকিলে, তজ্জন্য দায়িত্বপ্রাপ্ত কোনো কর্মচারী বা ব্যক্তির বিরুদ্ধে কোনো দেওয়ানি বা ফৌজদারি মামলা বা অন্য কোনো আইনগত কার্যক্রম গ্রহণ করা যাইবে না।”

ব্যাপক অপপ্রয়োগের পর তুমুল সমালোচনার মুখে ২০১৮ সালে ওই ৫৭ ধারা বাদ দেওয়ার পাশাপাশি আইনটি নামসহ বদলে ফেলে আওয়ামী লীগ সরকার। নতুন নাম দেওয়া হয় ‘ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন’। কিন্তু তাতেও দমন-পীড়নের বাধা ছিল না। ফলে সমলোচনা থেকেই যায়।

ব্যাপক বিরোধিতার পর ২০২৩ সালে নাম আবার বদলায়; কিছু ধারাও সংশোধন হয়। ৬০টি ধারা নিয়ে নতুন আইনের নাম হয় ‘সাইবার নিরাপত্তা আইন’। কিন্তু তাতেও এই আইন দিয়ে মত প্রকাশ রুদ্ধ করা সরকারের ভালোভাবেই চলছিল।

বরাবরই বলা হচ্ছিল, অন্তর্জালের বাংলাদেশের মানুষের বিচরণ নির্বিঘ্ন করতেই এই আইনের প্রয়োজন। কিন্তু এর ব্যবহার তার বিপরীত ইঙ্গিতই দিচ্ছিল।

এরপর গত আগস্টে অভ্যুত্থানের পর গঠিত মুহাম্মদ ইউনূস নেতৃত্বাধীন অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের কাছে নানা মহল থেকে সাইবার নিরাপত্তা আইনসহ যাবতীয় কালা কানুন বাতিলের দাবি তোলা হয়। সরকারের উপদেষ্টাদের কাছ থেকে তা বাতিলের প্রতিশ্রুতিও আসে।

গত ৩ অক্টোবর আইন উপদেষ্টা আসিফ নজরুল এক সভায় বলেন, “বাংলাদেশের জনগণকে মুক্ত করতে পর্যায়ক্রমে সব কালো আইন বাতিল করা হবে। আইন সংস্কারের মাধ্যমে জনগণ এর প্রতিফলন দেখতে পাবে।”

সেই অনুষ্ঠানে তথ্য উপদেষ্টা নাহিদ ইসলাম সাইবার নিরাপত্তা আইন বাতিলের কথাই বলেছিলেন, যিনি বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের একজন সমন্বয়ক ছিলেন।

নাহিদ বলেছিলেন, “মানুষের মনের ভয়ের কারণেই সাইবার নিরাপত্তা আইন বাতিল করা দরকার।”

এরপর সোমবার তাদের দুজনের উপস্থিতিতে এবং ড. মুহাম্মদ ইউনূসের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত উপদেষ্টা পরিষদের সভায়ই নতুন সাইবার ‍সুরক্ষা আইনের খসড়া পাস হয়।

তফাৎ কতটা?

সাইবার নিরাপত্তা আইন ও সাইবার সুরক্ষা আইনের তুলনা করলে প্রথমেই দেখা যায় নাম পরিবর্তনের বিষয়টি। তবে নতুন আইনে যে ভাষায় সাইবার নিরাপত্তা আইন রহিত বা বাতিল করে সাইবার সুরক্ষা আইন প্রণয়নের উদ্দেশ্য লেখা হয়েছে, তার সঙ্গে আগের আইনেরও হুবহু মিল।

২০২৩ সালে সাইবার নিরাপত্তা আইনের শুরুতেও লেখা ছিল- “ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন, ২০১৮ রহিতক্রমে সাইবার নিরাপত্তা নিশ্চিতকরণ এবং ডিজিটাল বা ইলেকট্রনিক মাধ্যমে সংঘাত, অপরাধ শনাক্তকরণ, প্রতিরোধ, দমন ও উক্ত অপরাধের বিচার এবং আনুষঙ্গিক বিষয়ে প্রণীত আইন।”

অর্থাৎ এখানে বাক্যে শুধু ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন, ২০১৮ এর জায়গায় সাইবার নিরাপত্তা আইন, ২০২৩ বসেছে।

প্রথম অধ্যায়ে আইনের সংজ্ঞায় শুধু ‘মুক্তিযুদ্ধের চেতনা’র ব্যাখ্যার অংশটুকু বাদ পড়েছে। সংজ্ঞার পর আইনের প্রয়োগ, আইনের অতিরাষ্ট্রিক প্রয়োগে কোনও পরিবর্তন আসেনি।

দ্বিতীয় অধ্যায়ে সাইবার নিরাপত্তা এজেন্সির জায়গায় সাইবার সুরক্ষা এজেন্সি শুধু বদলেছে। কাউন্সিল গঠন ও জনবলের ধারা অবিকলই রয়েছে।

তৃতীয় অধ্যায়ে প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থাদিতেও দুই আইনে কোনও পরিবর্তন চোখে পড়ে না। দুই আইনেই একই রকমভাবে বলা আছে, কাউন্সিলের মহাপরিচালক কোনও তথ্য উপাত্ত অপসারণ বা ব্লক করার জন্য বিটিআরসিতে অনুরোধ করতে পারবেন।

যদি আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী কোনো তথ্য দেশের সংহতি নষ্ট করে, অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড, নিরাপত্তা, প্রতিরক্ষা, ধর্মীয় মূলবোধ বা জনশৃঙ্খলা ক্ষুণ্ন করে, জাতিগত বিদ্বেষ বা ঘৃণার সঞ্চার করে, তাহলে আগের আইনের মতো নতুন আইনেও আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী কাউন্সিলের মহাপরিচালকের মাধ্যমে ওই সব তথ্য উপাত্ত অপসারণের অনুরোধ করতে পারবে।

চতুর্থ অধ্যায়ে গিয়ে জাতীয় সাইবার নিরাপত্তা কাউন্সিল হয়েছে জাতীয় সাইবার সুরক্ষা কাউন্সিল। এই কাউন্সিল গঠনের অন্য সব প্রক্রিয়া আগের আইনের মতোই রয়েছে।

পঞ্চম অধ্যায়ে গুরুত্বপূর্ণ তথ্য পরিকাঠামো অংশটিও আগের আইনের হুবহু। নতুন আইনেও সরকার যে কোনো তথ্য পরিকাঠামোকে গুরুত্বপূর্ণ তথ্য পরিকাঠামো ঘোষণা করতে পারবে।

মুহাম্মদ ইউনূসের উপদেষ্টা পরিষদের বৈঠক।

ষষ্ঠ অধ্যায়ে গুরুত্বপূর্ণ তথ্য পরিকাঠামোতে অনুপ্রবেশের ক্ষেত্রে দণ্ড আগের আইনে ছিল ৩ বছর কারাদণ্ড বা ২৫ লাখ টাকা জরিমানা। নতুন আইনে কারাদণ্ড ঠিক থাকলেও জরিমানা কমিয়ে করা হয়েছে ২০ লাখ টাকা। আর গুরুত্বপূর্ণ তথ্য পরিকাঠামোতে অনুপ্রবেশ করে ক্ষতি করলে তার শাস্তি আগেছিল ৬ বছর কারাদণ্ড বা ১ কোটি টাকা। নতুন আইনে অর্থদণ্ড ১ কোটি টাকা রেখে কারাদণ্ড ৫ বছর করা হয়েছে।

কম্পিউটার, ডিজিটাল ডিভাইস, কম্পিউটার সিস্টেমে বেআইনি প্রবেশের সাজা আগের আইনের মতোই রয়েছে।

এভাবে ১৯ ধারা পর্যন্ত দুই আইনে তেমন কোনও পার্থক্য ধরা পড়ে না। ধারাগুলো সব আগের মতোই রয়েছে।

২০ নম্বর ধারায় নতুন আইনে যুক্ত হয়েছে সাইবার স্পেসে জুয়া খেলার অপরাধ ও দণ্ড অংশটুকু। আগের আইনে এই ধারায় ছিল কম্পিউটারের সোর্স কোড পরিবর্তন সংক্রান্ত অপরাধ ও দণ্ডের বিষয়টি।

২১ নম্বর ধারায় আগের আইনে মুক্তিযুদ্ধ, মুক্তিযুদ্ধের চেতনা, জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, জাতীয় সংগীত, জাতীয় পতাকা নিয়ে বিদ্বেষ, কুৎসা ও বিভ্রান্তি ছড়ানোর জন্য ৬ বছর কারাদণ্ড বা ১ কোটি টাকার শাস্তির বিধান ছিল। নতুন আইনে এই ধারাটি নেই।

এখানে ২১ নম্বর ধারায় আছে সাইবার স্পেসে জালিয়াতির দণ্ডের বিধানটি। তবে জালিয়াতির শাস্তি আগের মতোই আছে। এরপর ডিজিটাল প্রতারণার ধারাটিও আগের অনুরূপ।

সাইবার সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড দমনের বিধান দুই আইনেই রয়েছে একই রকমভাবে, শুধু অবস্থান বদলেছে।

আগের আইনে একটি ধারা ছিল পরিচয় প্রতারণা ও ছদ্মবেশ ধারণ নিয়ে। নতুন আইনে তা নেই। মানহানিকর তথ্য প্রকাশের শাস্তির বিধানটিও নতুন আইনে রাখা হয়নি। আইন-শৃঙ্খলার অবনতি ঘটানোর প্রয়াসের শাস্তির বিধানটিও বাদ পড়েছে। নতুন আইনে নেই হ্যাকিংয়ের শাস্তির ধারাটিও।

আগের আইনে একটি ধারা ছিল আক্রমণাত্মক, মিথ্যা ও ভীতি প্রদর্শক তথ্য উপাত্ত প্রেরণের শাস্তি নিয়ে। নতুন আইনে তা প্রতিস্থাপিত হয়েছে ব্ল্যাকমেইলিং ও অশ্লীল বিষয়বস্তু অপরাধের দণ্ডের বিধান দিয়ে।

ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত হানার শাস্তি আগের মতোই ৫ বছর কারাদণ্ড বা ২ লাখ টাকা জরিমানাই রয়েছে নতুন আইনে।

সাইবার অপরাধের তদন্ত ও পুলিশের গ্রেপ্তারের ক্ষমতা সংক্রান্ত বিধানটি আগের মতোই রয়েছে নতুন আইনে।

আগের আইনের ৪২ ধারায় এই আইনে কোনও অপরাধ সংঘটন হবে বলে সংশ্লিষ্ট পুলিশ কর্মকর্তার মনে হলে কাউকে গ্রেপ্তার, তল্লাশি ও জব্দের ক্ষমতা দেওয়া ছিল। নতুন আইনেও ৩৬ ধারায় ঠিক একইভাবে বিনা পরোয়ানায় পুলিশকে গ্রেপ্তার, তল্লাশি ও জব্দের ক্ষমতা দেওয়া হয়েছে।

নতুন আইনে বলা হয়েছে, সরাসরি সংক্ষুব্ধ ব্যক্তি, তার কর্তৃক লিখিত ক্ষমতাপ্রাপ্ত ব্যক্তি ও আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্য ছাড়া কেউ এই আইনে মামলা করতে পারবে না। এমন কোনো বিধান আগের আইনে ছিল না।

আর সব বিধান মোটামুটি একই রকমই রয়েছে। আগের আইনের মতোই কয়েকটি ধারা অ-জামিনযোগ্য রয়েছে। সব মিলিয়ে নতুন আইনে ধারা রয়েছে ৫২টি, যেখানে আগে আইনে ৬০টি ধারা ছিল।

আরও পড়ুন