যেভাবে শাস্তি এড়িয়ে পাচার হচ্ছে কাড়ি কাড়ি অর্থ

প্রতীকী ছবি।
প্রতীকী ছবি।

কয়েক সপ্তাহ পর পর কম্বোডিয়ার রাতের আকাশে হঠাৎ করে আতশবাজি জ্বলে উঠতে দেখলে এখন আর স্থানীয়রা তেমনভাবে অবাক হন না। তারা জানেন পেছনে রয়েছে অন্ধকার জগতের ভিন্ন কোনো ‘সফলতার’ গল্প। সাধারণত বড় ধরনের প্রতারণা সফল হওয়ার আনন্দ এভাবেই উদযাপন করে প্রতারকেরা।  

এই আতশবাজির ঝলকানিতে যখন চারদিক উজ্জ্বল ঠিক সেই সময়েই কারও না কারও সারা জীবনের সঞ্চয় নষ্ট হয়ে যায়। হতে পারে তারা অনলাইনে প্রেমের প্রতারণার শিকার হয়েছে বা কোনো জাল ক্রিপ্টোকারেন্সি এক্সচেঞ্জে বিনিয়োগ করেছে। যেভাবেই হোক, তাদের টাকা চলে গেছে। আর এর পেছনে আছে জটিল এক মানি লন্ডারিং নেটওয়ার্ক। এর মাধ্যমে দ্রুতগতিতে বিলিয়ন বিলিয়ন ডলার স্থানান্তরিত হয়।

এফবিআই, চীনের জননিরাপত্তা মন্ত্রণালয়, ইন্টারপোলসহ বিভিন্ন সংস্থা প্রতারকদের দমনের চেষ্টা করেছে। এই প্রতারকেরা সাধারণত সোশাল মিডিয়া ও ডেটিং অ্যাপে লুকিয়ে থেকে মানুষকে ভুয়া বিনিয়োগ বা অন্যান্য প্রতারণার ফাঁদে ফেলে।

টেলিকম কোম্পানিগুলো প্রতিনিয়ত সন্দেহজনক নম্বর ব্লক করেছে। ব্যাংকগুলো বারবার সতর্কবার্তাও দিয়ে যাচ্ছে।

তবুও এই প্রতারণা বন্ধ হয়নি। কারণ অর্থ পাচার ব্যবস্থা অত্যন্ত জটিল এক প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে হয়। বিশ্বজুড়ে প্রতারণার শিকার ব্যক্তিরা প্রতি বছর কয়েক বিলিয়ন ডলার হারান। এই অর্থ বৈধ খাতে প্রবাহিত করার জন্য এর অপরাধমূলক উৎস মুছে ফেলা হয়। অর্থ পাচার নেটওয়ার্ক এতটাই বিস্তৃত যে, সরকার এক জায়গায় আঘাত করলেই এটি অন্য কোথাও গড়ে ওঠে।

অর্থ পাচারের এই অবৈধ জগতের অস্তিত্ব আছে কম্বোডিয়ার রাজধানী নম পেনে। শহরটি বিশ্বব্যাপী মানি লন্ডারিং কার্যক্রমের একটি কেন্দ্রস্থল। এ ছাড়াও প্রতারকদের জন্য কুখ্যাত একটি আশ্রয়স্থল হল দেশটির উপকূলীয় শহর সিহানুকভিল। 

প্রতারকেরা কল সেন্টার থেকে তাদের অবৈধ কাজ চালায়। আর এই সেন্টারগুলো প্রায়শই সুরক্ষিত কম্পাউন্ড বা অর্ধনির্মিত উচ্চাভিলাষী ভবনের উপরের তলায় অবস্থিত। সমুদ্রতীরবর্তী রেস্তোরাঁগুলোতে চলে অর্থ পাচারকারী এবং অন্য অপরাধীদের আনাগোনা। মসলাদার চীনা খাবারের আড়ালে চলে অবৈধ লেনদেন।

নিউ ইয়র্ক টাইমসের দাবি, মানি লন্ডারিংয়ের নির্দেশিকা হিসেবে কাজ করে, এমন কিছু গোপন নথি তাদের কাছে আছে। আর এই দাবির সঙ্গে ছয়জন প্রতারক এবং তাদের অর্থ পাচারকারীদের বক্তব্য নেওয়ার বিষয়টিও জানিয়েছে পত্রিকাটি।

এই নথিগুলো কোনো নির্দিষ্ট প্রতারণা বা শিকারের সঙ্গে সরাসরি যুক্ত নয়। তবে এগুলো অবৈধ অর্থ স্থানান্তরের একটি পদ্ধতি প্রকাশ করে। এটি বন্ধ করা প্রায় অসম্ভব বলে প্রমাণিত হয়েছে।

অর্থ পাচারকারীরা অপরাধীদের জন্য ততটাই গুরুত্বপূর্ণ, যতটা ব্যাংক ডাকাতদের জন্য পালানোর গাড়িচালক। তাদের ছাড়া অপরাধীরা অর্থ হাতিয়ে নিতে পারত না।

প্রতারকরা যখন কারও সঞ্চিত অর্থ হাতিয়ে নেয়, তখন তারা দ্রুত সেই টাকা একাধিক অ্যাকাউন্ট ও দেশের মধ্যে স্থানান্তর করে। এতে ভুক্তভোগীরা প্রতারণা বোঝার আগেই ব্যাংক বা পুলিশের কাছে অভিযোগ করার সুযোগ হারায়।

অবশেষে, সেই অর্থ “হোয়াইট” হয়ে যায়। প্রতারণার কোনো প্রাথমিক প্রমাণ আর দেখা যায় না।

কিন্তু অর্থ পাচার কীভাবে হয়? এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে গিয়ে ব্যাপক অনুসন্ধানের ফলে কিছু বিস্ময়কর তথ্য পাওয়া যায়। 

অনুসন্ধানে কম্বোডিয়ার একটি সুপরিচিত আর্থিক প্রতিষ্ঠান, হুইওন গ্রুপের নাম সামনে আসে। হুইওন কোনো অবৈধ লেনদেনকারী ছোট প্রতিষ্ঠান নয়। এটি দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় বৈধ ব্যবসা প্রতিষ্ঠান হিসেবে স্বীকৃত একটি বড় কোম্পানি। বিশ্বের বিভিন্ন স্থানে এর শাখা প্রতিষ্ঠানও রয়েছে।

কম্বোডিয়ায় হুইওনের কিউআর কোড সর্বত্র দেখা যায়। হোটেল, রেস্টুরেন্ট ও সুপারমার্কেটে মানুষ এসব কোড স্ক্যান করে বিল পরিশোধ করে। দেশটির বড় বড় সড়কের পাশে হুইওনের বিজ্ঞাপনও দেখা যায়। প্রতিষ্ঠানটি ব্যাংকিং ও বিমাসহ বিভিন্ন আর্থিক সেবা দেয়।

তবে হুইওন (উচ্চারণ: হু-ওয়ে-ওয়ান) মূলত একাধিক সহযোগী প্রতিষ্ঠানের একটি নেটওয়ার্ক। এর সব শাখা বৈধ নয়। 

কিছু শাখা অবৈধ লেনদেনের সঙ্গে জড়িত। কোম্পানির নিজস্ব নথি এবং সংশ্লিষ্ট দুই ব্যক্তির সাক্ষাৎকার থেকে জানা যায়, এর একটি শাখা অর্থপাচারের বিশেষ সেবা দেয়। তবে নিরাপত্তার কারণে ওই দুই ব্যক্তি নাম প্রকাশ করতে রাজি হননি। হুইওন এ বিষয়ে কোনো মন্তব্য করেনি।

আরেকটি সহযোগী প্রতিষ্ঠান একটি অনলাইন মার্কেট পরিচালনা করে। সেখানে অপরাধীরা অর্থপাচারের জন্য লোক খুঁজে নেয়। এর সঠিক পরিমাণ জানা কঠিন। তবে গবেষণা প্রতিষ্ঠান এলিপটিক জানিয়েছে, ২০২১ সাল থেকে এটির মাধ্যমে ২৬ দশমিক ৮ বিলিয়ন ডলারের ক্রিপ্টোকারেন্সি লেনদেন হয়েছে। এই খাতটি এতটাই গোপনীয় যে লেনদেন বৈধ বা অবৈধ আলাদা করা কঠিন। তবু এলিপটিক মনে করে, এটি বিশ্বের সবচেয়ে বড় অবৈধ অনলাইন মার্কেট।

কম্বোডিয়ার প্রধানমন্ত্রীর চাচাতো ভাই ‘হুন তো’ হুইওনের একটি প্রতিষ্ঠানের পরিচালক।

এক প্রতারক, এক অর্থপাচারকারী এবং গবেষণা প্রতিষ্ঠান এলিপটিক ও চায়নাএনালাইসিসের অনুসন্ধান বলছে, হুইওনের গ্রাহকদের মধ্যে বড় অপরাধচক্রও রয়েছে। একটি চক্র মিয়ানমারে মানব পাচারের শিকার ব্যক্তিদের ব্যবহার করে প্রতারণা চালায়। 

অর্থপাচারের এই নেটওয়ার্কটি অবাধে কাজ চালিয়ে যাচ্ছে। এখন পর্যন্ত কোনো সরকার তাদের বিরুদ্ধে নিষেধাজ্ঞা দেয়নি। আইন প্রয়োগকারী সংস্থার অনুরোধে ক্রিপ্টোকারেন্সি প্রতিষ্ঠান থেটার কিছু অ্যাকাউন্ট বন্ধ করেছে। টেলিগ্রামও তাদের কিছু চ্যানেল বন্ধ করেছে। তবে এসব পদক্ষেপ স্থায়ী কোনো প্রভাব ফেলেনি।

হুইওন প্রতিটি ধাপে লাভ করে। প্রথমে এর একটি সহযোগী প্রতিষ্ঠান—যা আগে হুইওন গ্যারান্টি নামে পরিচিত ছিল—একটি অনলাইন মার্কেট পরিচালনা করে। এখানে প্রতারকরা মধ্যস্থতাকারীদের খুঁজে পায়।

কম্বোডিয়ার অর্থপাচার চক্র নিয়ে গবেষণা করা নৃতাত্ত্বিক ইয়ানইউ চেনের মতে, এই মধ্যস্থতাকারীরা পুরো ব্যবস্থার গুরুত্বপূর্ণ অংশ। তাদের কাজ এতটাই একঘেয়ে যে চীনা ভাষায় এটি “ইট সরানো” নামে পরিচিত। এই অনলাইন বাজার মূলত টেলিগ্রামের হাজারো চ্যাট গ্রুপ নিয়ে গঠিত।

টেলিগ্রামের ওই চ্যানেলগুলোতে গোপন ভাষায় অর্থপাচারের বিজ্ঞাপন দেওয়া হয়। ভাষা আড়াল করা হলেও তা সহজেই বোঝা যায়। পোস্টগুলো সবার জন্য উন্মুক্ত। যে কেউ টেলিগ্রাম অ্যাপে গিয়ে এগুলো দেখতে পারে। কিছু বিক্রেতা চুরি হওয়া ব্যক্তিগত তথ্য, পরিচয় জাল করার অ্যাপ এবং প্রতারকদের জন্য প্রয়োজনীয় অন্যান্য সেবাও বিক্রি করে।

একটি চ্যানেলের নাম ছিল “ডিমান্ড অ্যান্ড সাপ্লাই”। এতে ৪ লাখের বেশি ব্যবহারকারী ছিল এবং প্রতিদিন শত শত বার্তা দেওয়া হতো। এর মধ্যে অর্থপাচারের বিজ্ঞাপনও ছিল।

ফেব্রুয়ারির শেষের দিকে নিউ ইয়র্ক টাইমস হুইওন গ্রুপ ও অন্যান্য সংস্থার কাছে এ বিষয়ে প্রশ্ন করলে টেলিগ্রাম চ্যানেলটি সরিয়ে ফেলা হয়। তবে কিছুদিনের মধ্যেই আরেকটি নতুন চ্যানেল তৈরি হয়। আর যেখানে এক সপ্তাহের মধ্যে আড়াই লাখ লাখ সদস্য যোগ দেয়।

হুইওন গ্যারান্টি বারবার যোগাযোগের পরও কোনো মন্তব্য করেনি। তবে প্রতিষ্ঠানটি হুইওন গ্রুপের সঙ্গে সম্পর্ক থাকার বিষয়টি অস্বীকার করেছে।

অক্টোবরে তারা নিজেদের নাম পরিবর্তন করে হুইওন শব্দটি বাদ দেয়। কিন্তু টেলিগ্রামে গ্রাহকদের জানায়, হুইওন গ্রুপ এখনো তাদের “কৌশলগত অংশীদার ও শেয়ারহোল্ডার” হিসেবে রয়েছে।

দ্বিতীয়ত এই অনলাইন মার্কেট অর্থপাচারের লেনদেন নিশ্চিত করে। কারণ প্রতারকদের মধ্যেও বিশ্বাসের অভাব থাকে। আর অনেক সময় প্রতারকরাও প্রতারিত হয়। বিশ্বাসযোগ্যতা প্রমাণের জন্য, মধ্যস্থতাকারী ও অর্থ পরিবহনকারীরা হুইওন গ্যারান্টিতে একটি অগ্রিম জমা রাখে। প্রতিষ্ঠানটি এটি এস্ক্রো অ্যাকাউন্টে ধরে রাখে। ফলে প্রতারকরা নিশ্চিত হয় যে কেউ টাকা নিয়ে পালিয়ে যেতে পারবে না। আর যদি কেউ প্রতারণা করে, তাহলে নিজের টাকাও হারাবে।

এস্ক্রো অ্যাকাউন্ট হলো একটি আর্থিক ব্যবস্থা। এতে তৃতীয় পক্ষ কোনো লেনদেনের অর্থ বা সম্পদ সাময়িকভাবে ধরে রাখে, যতক্ষণ না লেনদেনের শর্ত পূরণ হয়।

অর্থপাচারের মূল্য নির্ধারিত হয় ওই অর্থ কীভাবে অর্জিত হয়েছে তার ওপর ভিত্তি করে। যেসব প্রতারণায় সরকারি কর্মকর্তার পরিচয় ব্যবহার করা হয়, সেগুলোর খরচ বেশি। কারণ এসব ক্ষেত্রে ভুক্তভোগীরা দ্রুত পুলিশের কাছে অভিযোগ করতে পারে বা ব্যাংককে সতর্ক করতে পারে।

অবস্থানের ওপরেও মূল্য নির্ভর করে। চীনে অর্থপাচারের জন্য ৬০ শতাংশ পর্যন্ত কমিশন নেওয়া হয়। কারণ ২০২০ সালের পর দেশটি নিয়ন্ত্রণ কঠোর করেছে। তারা হাজারো অপরাধীকে গ্রেপ্তার করেছে এবং বিশাল পরিমাণ অর্থ জব্দ করেছে।

চীন ও কম্বোডিয়া যৌথভাবে আইন প্রয়োগ কার্যক্রম চালানোর সিদ্ধান্ত নেয়। এতে বেশ কয়েকজন নিম্নস্তরের অপরাধী গ্রেপ্তার হয়। তবে প্রতারণা ও অর্থপাচার শিল্পে এর তেমন কোনো প্রভাব পড়েনি।

মধ্যস্থতাকারীদের লেনদেন ব্যক্তিগতভাবে হলেও এই অনলাইন মার্কেট আয় করে। এটি পাবলিক গ্রুপে বিজ্ঞাপন বিক্রি করে, প্রাইভেট গ্রুপ পরিচালনার জন্য ফি নেয় এবং লেনদেনের একটি অংশ কমিশন হিসেবে কেটে নেয়। বেশিরভাগ লেনদেন থেটার ক্রিপ্টোকারেন্সিতে হয়। তবে কিছু লেনদেন নগদ অর্থ, স্বর্ণ বা ব্যাংক ট্রান্সফারের মাধ্যমে সম্পন্ন হয়। এমনকি গত বছর মার্কেটটি নিজস্ব ক্রিপ্টোকারেন্সিও চালু করেছিল।

তবে এই মার্কেট অপরাধের সঙ্গে যুক্ত নয় বলে দাবি করে। তাদের ওয়েবসাইট ও টেলিগ্রাম চ্যানেলে পোস্ট করা বার্তায় বলা হয়, “পাবলিক গ্রুপের সব লেনদেন তৃতীয় পক্ষের ব্যবসায়ীদের মাধ্যমে পরিচালিত হয়। এর সঙ্গে হুইওন গ্যারান্টির সম্পর্ক নেই।”

তৃতীয়ত, হুইওনের আরেকটি সহযোগী প্রতিষ্ঠান হুইওন ইন্টারন্যাশনাল পে সরাসরি অর্থপাচারের সঙ্গে যুক্ত। কোম্পানির অভ্যন্তরীণ নথি এবং সংশ্লিষ্ট দুই ব্যক্তির মতে, এটি নিজেই এক ধরনের মধ্যস্থতাকারী হিসেবে কাজ করে।

প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী, হুইওন ইন্টারন্যাশনাল পে দক্ষতার সঙ্গে একটি পেশাদার ব্যাংকের মতো কার্যক্রম পরিচালনা করে। এটি নম পেনে হুইওন গ্রুপের প্রধান কার্যালয়ে অবস্থিত। ভবনটি কাচ ও কংক্রিটের তৈরি, এবং প্রবেশপথে দুটি পান্ডার মূর্তি স্থাপন করা রয়েছে।

কম্বোডিয়ার কেন্দ্রীয় দ্য ন্যাশনাল ব্যাংক অব কম্বোডিয়া জানিয়েছে, সরকার আর্থিক লেনদেন নিরাপদ ও স্বচ্ছ রাখতে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। তারা আন্তর্জাতিক অর্থপাচার বিরোধী সুপারিশ অনুসারে কাজ করছে বলে জানিয়েছে।

কেন্দ্রীয় ব্যাংকটি আরও জানিয়েছে, হুইওনের পেমেন্ট সার্ভিস (যার কিউআর কোড রয়েছে) কম্বোডিয়ায় কার্যক্রম চালানোর লাইসেন্স নবায়ন করা হয়নি। কারণ এটি নবায়ন শর্ত পূরণ করেনি। এর পরপরই হুইওন তাদের ব্যবসা জাপান ও কানাডায় নিবন্ধন করার পরিকল্পনা ঘোষণা করেছে।

অর্থ পরিবহনকারী হলো সেই ব্যক্তিরা যারা ব্যাংক অ্যাকাউন্ট ও ওয়ালেট পরিচালনা করে। চায়নাএনালাইসিসের গবেষক এলাদ ফুকসের মতে, কিছু অর্থ পরিবহনকারী ভুয়া পরিচয় ব্যবহার করে ব্যাংক অ্যাকাউন্ট খোলে। এখন কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার (এআই) মাধ্যমে অ্যাকাউন্ট খোলা অনেক সহজ হয়ে গেছে।

অর্থ পরিবহনকারীরা ডিপোজিট ও উত্তোলন ছড়িয়ে ছিটিয়ে করে। কারণ এর ফলে ব্যাংকগুলোর মনিটরিংয়ের আওতার বাইরে থাকে অ্যাকাউন্টগুলো। উদাহরণস্বরূপ, ১০ হাজার ডলারের নিচে লেনদেন সহজে নজরে আসে না।

অর্থপাচারের জন্য ব্যবহৃত অধিকাংশ অ্যাকাউন্ট ও ভার্চুয়াল ওয়ালেট সাধারণত কেবল কয়েক সপ্তাহ বা মাস সক্রিয় থাকে।

তবে অর্থ পরিবহনকারীরা, মধ্যস্থতাকারী বা প্রতারকরা ধরা পড়ার ক্ষেত্রে সর্বোচ্চ ঝুঁকিতে থাকে না।

যুক্তরাষ্ট্রের এক আদালতের মামলায় এই ধরনের কার্যক্রমের বিস্তারিত বর্ণনা দেওয়া হয়েছে। প্রধান আসামী ড্যারেন লি একটি অর্থ পরিবহনকারী সিন্ডিকেট চালাতো। এটি যুক্তরাষ্ট্রের ৭৪টি শেল কোম্পানি নিবন্ধন করে প্রায় ৮০ মিলিয়ন ডলার অর্থপাচার করেছিল। এই কোম্পানিগুলো ব্যাংক অফ আমেরিকা ও অন্যান্য ব্যাংকে অ্যাকাউন্ট খুলেছিল।

ভুক্তভোগীরা এই অ্যাকাউন্টে টাকা পাঠালে তা দ্রুত বাহামাসের একটি ব্যাংকে চলে যেত। সেখান থেকে সেই টাকা বাইন্যান্স এক্সচেঞ্জে থেটার ক্রিপ্টোকারেন্সি কেনার জন্য ব্যবহার করা হতো। কয়েক দিনের মধ্যে, ওই টাকা আরেকটি ভার্চুয়াল ওয়ালেটে চলে যেত।

পর্যালোচিত নথি অনুযায়ী, হুইওন ইন্টারন্যাশনাল পে-এর সঙ্গে অর্থপাচার করেছিল ড্যরেন লি। তবে এফবিআই ও সিক্রেট সার্ভিস এই সংযোগ নিশ্চিত করতে অস্বীকৃতি জানিয়েছে। লি গত নভেম্বরে অর্থপাচারের ষড়যন্ত্রের জন্য দোষী সাব্যস্ত হন।

অর্থ পরিবহনকারী গ্রেপ্তার, তার ব্যাংক অ্যাকাউন্ট জব্দ বা সে টাকা নিয়ে পালিয়ে গেলে বিষয়টির বিরোধ নিষ্পত্তি করে একজন মধ্যস্থতাকারী।

অর্থ পরিবহনকারী দায়ী হলে মধ্যস্থতাকারী এস্ক্রো থেকে জমা টাকা ফেরত এনে দেয়। তবে যদি কেউ দায়ী না হয়, তাহলে ক্ষতিটা ব্যবসার খরচ হিসেবে গণ্য হয়।

তবে সবকিছু যদি ঠিকঠাক থাকলে পেমেন্ট পাওয়া যায়। সাধারণত থেটার যুক্তরাষ্ট্রের ডলারে রূপান্তর করা যায়।

এখনকার প্রতারণা কার্যক্রমগুলো পেশাদার প্রতিষ্ঠানগুলোর মতো দেখতে। সেখানে বাজারজাতকরণ, বিক্রয় ও মানবসম্পদ বিভাগে হাজার হাজার কর্মী কাজ করে।

অনেক কর্মী মানব পাচারের শিকার হয়ে অন্যদের সঙ্গে প্রতারণা করতে বাধ্য হয়। কিছু প্রতারক তাদের প্রতিষ্ঠানগুলোর কাঠামো ১৯ শতকের কোম্পানি শহরের মতো তৈরি করে। সেখানে কর্মীরা এক মৌসুমের কাজ শেষ না হওয়া পর্যন্ত বেতন পায় না। এর পরিবর্তে তারা কোম্পানি ক্রেডিট পায়।

এই বেতন রেস্টুরেন্ট, ক্যাসিনো ও দেহব্যবসা প্রতিষ্ঠানগুলোর মুনাফা বাড়ায়। তারা বন্দী কর্মীদের থেকে বিপুল অর্থ উপার্জন করে। এছাড়া প্রতারণাকারীদের পে-রোলে আকর্ষণীয় মডেলরাও থাকে। তারা ভিডিও কলগুলোতে যোগ দিয়ে ভুক্তভোগীদের টাকা ছাড়াতে সাহায্য করে। কিছু মডেল তাদের মুখ এআই ব্যবহার করে পরিবর্তন করে।

অন্যদের মতো প্রতারকদেরও তাদের মালিকদের কাছে ভাড়া দিতে হয়—বাসস্থানের এবং তাদের ক্ষেত্রে রক্ষণের জন্যও।

এছাড়া পেছনের সার্ভিসগুলোর জন্যও টাকা দিতে হয়। এর অধিকাংশই হুইওনের অনলাইন মার্কেট থেকে কেনা যায়। প্রতারকরা সফটওয়্যার ডেভেলপারদের টাকা দেয় ইনভেস্টমেন্ট প্ল্যাটফর্মের মত ওয়েবসাইট তৈরি করার জন্য। কারণ তাদের ইন্টারনেট ও কম্পিউটার অবকাঠামো প্রয়োজন। তারা চোরদেরও টাকা দেয় ভুক্তভোগীদের ব্যক্তিগত তথ্য চুরি করতে: জাতীয় পরিচয় নম্বর, ক্রেডিট কার্ডের তথ্য, অবস্থান তথ্য, এমনকি আগের হোটেল অবস্থানের বিবরণ।

এখান থেকে কিছু টাকা প্রিমিয়াম গাড়ি বিক্রেতাদের কাছে চলে যায়। কিছু টাকা লন্ডন ও দুবাইর মতো জায়গায় সম্পত্তি কিনতে ব্যবহার হয়। আর হ্যা অবশ্যই, কিছু টাকা আতশবাজিতে ব্যয় হয়।

তথ্যসূত্র : নিউ ইয়র্ক টাইমস।

আরও পড়ুন

সর্বশেষ

ads