বাস্তবে আগা খানের ক্ষমতা কতটা

Aga Khan

২০২৪ সালের ১৭ মার্চ ইউরোপীয় কমিশনের সিরিয়া বিষয়ক এক সম্মেলনে আন্তর্জাতিক প্রতিনিধিদের সঙ্গে যোগ দেন প্রিন্স রহিম আল-হুসেইনি। তিনি আগা খান পঞ্চম নামেও পরিচিত।

ওই সম্মেলনে তিনি বক্তৃতা দেন। সেখানে তিনি সিরিয়ায় ইসমাইলি সম্প্রদায়ের হাজার বছরের বেশি পুরনো ইতিহাসের কথা তুলে ধরেন। তিনি সিরিয়ার জনগণের প্রতি ইসমাইলি ইমামাত ও এর উন্নয়ন সংস্থা আগা খান ডেভেলপমেন্ট নেটওয়ার্কের (একেডিএন) “নিরবচ্ছিন্ন ও স্থায়ী সহযোগিতার” প্রতিশ্রুতি পুনর্ব্যক্ত করেন।

তিনি আরও বলেন, এই সহায়তার লক্ষ্য হলো “শান্তি, আশাবাদ ও উন্নয়নের মাধ্যমে একটি উন্নত ভবিষ্যৎ গড়ে তোলা।”

এই সম্মেলন ও প্রিন্স রহিমের এই ঘোষণা ছিল তার অন্যতম প্রথম বড় ধরনের প্রকাশ্য পদক্ষেপ। তার বাবা আগা খান চতুর্থ প্রিন্স করিম আগা খানের মৃত্যু হয় ২০২৪ সালের ৪ ফেব্রুয়ারি। এরপর আগা খানের পদবি পান প্রিন্স রহিম।

আগা খান চতুর্থ ১৯৫৭ সাল থেকে ইসমাইলি সম্প্রদায়ের নেতৃত্ব দিয়ে আসছিলেন। এটি শিয়া মুসলিমদের দ্বিতীয় বৃহত্তম শাখা। এখন প্রিন্স রহিম বিশ্বজুড়ে ৩৫টিরও বেশি দেশে ছড়িয়ে থাকা প্রায় ১ দশমিক ২ থেকে ১ দশমিক ৫ কোটি ইসমাইলি মুসলমানের নেতা।

আগা খানকে নবী মুহাম্মদের সরাসরি বংশধর হিসেবে বিবেচনা করা হয়। তিনি মূলত একজন ধর্মীয় নেতা। তবে গত শতাব্দীতে আগা খানের ভূমিকা শুধুমাত্র ধর্মের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকেনি। তিনি বৈশ্বিক রাজনীতি ও উন্নয়ন অঙ্গনেও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখে এসেছেন।

ইসমাইলি সম্প্রদায় মোট মুসলিম জনসংখ্যার ১ শতাংশেরও কম। তবু তাদের রয়েছে উল্লেখযোগ্য রাজনৈতিক প্রভাব এবং তারা বুদ্ধিবৃত্তিকভাবে অত্যন্ত সক্রিয়।

ধর্মতত্ত্ববিদ খালিল আন্দানি ‘ফরেন পলিসি’কে বলেন, ইসলামের প্রাথমিক বিকাশের প্রায় প্রতিটি স্তরেই ইসমাইলিদের কোনও না কোনও অবদান রয়েছে। তিনি ইরানি-আমেরিকান পণ্ডিত সাইয়্যেদ হোসেইন নাসরের কথার উদ্ধৃতি দিয়ে বলেন, “ইসলামের এমন কোনও দিক নেই, বিশেষ করে প্রারম্ভিক যুগে, যেটিতে ইসমাইলিদের প্রভাব পড়েনি।”

বিশ্বের মোট মুসলিম জনসংখ্যার প্রায় ১০ শতাংশ শিয়া মুসলমানরা বিশ্বাস করেন, নবী মুহাম্মদের পরিবারই ইসলাম ধর্মের প্রকৃত ব্যাখ্যাতা।

ইসমাইলিরা ১,৪০০ বছরের পুরনো ইমামদের একটি নির্দিষ্ট ধারাবাহিকতায় বিশ্বাস করে। তারা মনে করেন, এই ইমামরাই আল্লাহর পক্ষ থেকে নিযুক্ত এবং তাদের কাছ থেকেই আত্মিক দিকনির্দেশনা পাওয়া যায়।

“আগা খান” অর্থ “নেতাদের নেতা” বা “প্রধান সেনাপতি”। এই উপাধি প্রথম দেওয়া হয় ৪৬তম ইমাম প্রিন্স হাসান আলি শাহকে। ১৮১৭ সালে পারস্যের শাহ তাকে এই উপাধি দেন। সেই থেকে আগা খান পদবিধারী ইমাম ইসমাইলিদের ধর্মীয় ও সামাজিক জীবনের সর্বোচ্চ কর্তৃপক্ষ হিসেবে বিবেচিত হন।

ইমাম তার অনুসারীদের—যাদের ‘মুরিদ’ বলা হয়—ব্যক্তিগত ও পারিবারিক বিষয় যেমন বিবাহ, তালাক, নেতৃত্ব ও অনুদানের ক্ষেত্রে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত দেন।

প্রথম আগা খান এই উপাধি পাওয়ার পর ইরানের কেরমান প্রদেশের গভর্নর নিযুক্ত হন। এরপর ব্রিটিশদের সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা তৈরি করে তিনি আফগানিস্তান ও পাকিস্তানের সিন্ধু অঞ্চলে প্রভাব বিস্তার করেন। ১৮৪৩ সালে সিন্ধু দখলে ব্রিটিশদের সহযোগিতার মাধ্যমে তিনি ব্রিটিশদের দৃষ্টি আকর্ষণ করেন।

১৮৬৬ সালে ব্রিটিশ রাজ “আগা খান কেস”-এর মাধ্যমে তার কর্তৃত্ব স্বীকার করে। তার বড় ছেলে আকা আলি শাহ পরে আগা খান দ্বিতীয় হন। তিনি ইরানের রাজপরিবারে বিবাহসূত্রে যুক্ত ছিলেন এবং ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক প্রশাসনের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক বজায় রেখেছিলেন। তিনি গোটা ভারত উপমহাদেশে মুসলমানদের একজন প্রভাবশালী নেতা হয়ে উঠেছিলেন।

১৮৮৫ সালে মাত্র সাত বছর বয়সে আগা খান তৃতীয় সুলতান মোহাম্মদ শাহ তার বাবার কাছ থেকে ইমামাত উত্তরাধিকারসূত্রে পান। তিনি ব্রিটেনের নামকরা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে পড়াশোনা করেন। এরপর তিনি রাজপরিবার, বুদ্ধিজীবী মহল ও বৈশ্বিক অভিজাতদের সঙ্গে সহজে মিশে যান। ইউরোপের অভিজাত পরিবারে বিয়ে করে তিনি ইউরোপের অভিজাত সমাজেও প্রবেশ করেন।

তাকে এক সময় “মুসলমানদের পোপ” বলা হতো। ১৯০৬ সালে তিনি অল ইন্ডিয়া মুসলিম লিগ প্রতিষ্ঠা করেন। এই দল ব্রিটিশ ভারতের প্রায় ৮ কোটি মুসলমানের অধিকার রক্ষায় কাজ করত। তিনি ১৯১২ সাল পর্যন্ত এর প্রথম সভাপতি ছিলেন। পরে তিনি ১৯৩২ সালে লীগ অব নেশনের ভারতের প্রতিনিধি হন এবং ১৯৩৭-৩৮ সালে এর ১৮তম অধিবেশনের সভাপতিত্ব করেন।

আগা খান তৃতীয় ছিলেন একাধারে ধর্মীয় নেতা, ভোগবিলাসপ্রিয় ব্যক্তি ও রাজনীতিতে সক্রিয় আন্তর্জাতিক ব্যক্তিত্ব। তিনি কোনও একটি দেশের সঙ্গে নিজেকে বাঁধেননি। এই বহুমাত্রিক পরিচয় তিনি তার নাতি ও উত্তরসূরি আগা খান চতুর্থের মধ্যে দিয়ে বজায় রাখেন।

আগা খান চতুর্থ ছিলেন একজন আন্তর্জাতিক নেতা। তিনি বিভিন্ন দেশে ভ্রমণ করতেন এবং বৈশ্বিক রাজনীতিতে ভূমিকা রাখতেন। তবে একই সঙ্গে তিনি ছিলেন বিলাসী জীবনযাপনকারী একজন ধনকুবের। তার ছিল প্রায় ২৫ মিলিয়ন ডলারের একটি সুপার-ইয়ট ও বাহামায় ব্যক্তিগত দ্বীপ। তার এই জীবনযাত্রা তাকে “আন্তর্জাতিক প্লেবয়” হিসেবে পরিচিত করে তোলে। তবু তার নেতৃত্বে আগা খান ডেভেলপমেন্ট নেটওয়ার্ক বিশ্বব্যাপী শিক্ষা, স্বাস্থ্য, সংস্কৃতি ও মানব উন্নয়নে অসামান্য ভূমিকা রেখেছে।

আগা খান পরিবারের সম্পদের পরিমাণ অনুমান করা হয় ৮০০ মিলিয়ন ডলার থেকে ১৩ বিলিয়ন ডলারের মধ্যে। এই সম্পদের উৎস হলো পৈত্রিক অর্থ, রিয়েল এস্টেট ও পর্যটন খাতে বিনিয়োগ ও বিশ্ববিখ্যাত ঘোড়া প্রজনন ব্যবসা।

ইসমাইলি ইমামত জোর দিয়ে বলেছে যে, আগা খানের ব্যক্তিগত সম্পদ বিশ্বের ইসমাইলি অনুসারীদের জাকাত থেকে আসে না। যদিও জাকাত ইসলাম ধর্মের পাঁচটি স্তম্ভের একটি এবং বছরে আড়াই শতাংশ সম্পদ দান করার বিধান রয়েছে। ইসমাইলিরা ‘দাসোন্দ’ নামক এক ভিন্ন অনুদান দেয়, যা তাদের বার্ষিক নিট আয়ের ১০ থেকে ১২ দশমিক ৫ শতাংশের মধ্যে হয়ে থাকে। ইমামতের দাবি অনুযায়ী, এই দাসোন্দ শুধুমাত্র সম্প্রদায়ের প্রয়োজনে, বিনিয়োগ ও ব্যয়ের জন্য ব্যবহার করা হয়।

ধর্মতত্ত্ববিদ খালিল আন্দানি বলেন, আগা খান চতুর্থ তার ব্যক্তিগত অর্থ ও প্রভাব ব্যবহার করেছেন নিজের সম্প্রদায়ের কল্যাণে। যদিও তিনি পূর্ববর্তী আগা খানের তুলনায় রাজনীতিতে সরাসরি সম্পৃক্ত ছিলেন না, তবুও তিনি বারবার বলেছেন, তার দায়িত্ব শুধু আধ্যাত্মিক কল্যাণ নয়, বরং শারীরিক সুস্থতা ও নিরাপত্তাও নিশ্চিত করা।

এই দায়িত্ব পালনে তিনি বিশ্বজুড়ে উন্নয়ন, শিক্ষা ও স্বাস্থ্যসেবায় অবদান রেখেছেন। এসব কাজ মূলত আগা খান ডেভেলপমেন্ট নেটওয়ার্ক বা একেডিএন-এর মাধ্যমে সম্পন্ন হয়েছে। এটি বিভিন্ন উন্নয়নমূলক কাজ পরিচালনা করে।

একেডিএনের আওতায় রয়েছে হাসপাতাল, কৃষি প্রকল্প, স্কুল, ক্লিনিক, জাদুঘর, সাংস্কৃতিক কেন্দ্র ও আগা খান বিশ্ববিদ্যালয়। একেডিএন বর্তমানে ৯৬ হাজার কর্মচারী নিয়ে ৩০টির বেশি দেশে ১ হাজারের বেশি প্রকল্প ও পরিষেবা পরিচালনা করছে। আগা খান আনুষ্ঠানিকভাবে রাজনীতি থেকে দূরে থাকলেও তার ‘সফট পাওয়ার’ ছিল অত্যন্ত শক্তিশালী।

ইন্ডিয়ানা ইউনিভার্সিটির মুসলিম ফিলানথ্রপি ইনিশিয়েটিভের পরিচালক শারিক সিদ্দিকি বলেন, আগা খানের সম্পদ তার একটি অনন্য উপস্থিতি তৈরি করে। তার ভাষায়, “সব ধরনের দানই একধরনের প্রভাব বিস্তার। যখন আপনি পৃথিবীকে ভালো করতে চান, তখন আপনি নিজের সম্পদ ব্যবহার করে বোঝান যে আপনি সমাজের জন্য কল্যাণের প্রতীক।”

এই কারণে আগা খান পৃথিবীর অল্প কয়েকজন নেতার একজন, যিনি কোনও দেশের শাসক না হয়েও রাষ্ট্রীয় সম্মান পান। ইসমাইলি ইমামতকেও একাধিক দেশে আইনি সত্তা হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া হয়েছে। খালিল আন্দানি বলেন, এই ভূমিকা একধরনের “নীরব, বাস্তব কূটনৈতিকতা।”

আর শারিক সিদ্দিকি বলেন, একেডিএন-এর বিশেষত্ব হলো, বিশ্বজুড়ে ইসমাইলিদের দেওয়া দান এক কেন্দ্রীভূত, সুশৃঙ্খল পদ্ধতিতে কাজে লাগানো। এর মাধ্যমে ইসলামিক নীতিকে আধুনিক উদারনৈতিক বিশ্বব্যবস্থায় রূপান্তর করা সম্ভব হয়েছে।

প্রাচীন বিশ্বাস আর আধুনিক সময়ের মিলনই আজকের ইসমাইলি প্রভাবের মূল ভিত্তি। এ কারণে আগা খানকে বিভিন্ন দেশের উন্নয়ন কর্মকাণ্ডে অংশগ্রহণ করতে আমন্ত্রণ জানানো হয়।

কানাডিয়ান গবেষক মোহাম্মদ এন. মিরালি তার ‘ফেইথ অ্যান্ড ওয়ার্ল্ড: কনটেমপোরারি ইসমাইলি সোশাল অ্যান্ড পলিটিক্যাল থটস’ বইয়ে বলেছেন, সমসাময়িক ইসমাইলি দর্শন গণতন্ত্র, বহুত্ববাদ, দানশীলতা ও শিক্ষাকে কোরআনের চিরন্তন মূল্যবোধ ও শিয়া ইমামদের শিক্ষার আধুনিক প্রকাশ হিসেবে ব্যাখ্যা করে।

প্রায় সাত দশক ধরে আগা খান চতুর্থ নিয়মিতভাবে বলেছেন, আধুনিক উদারনৈতিক বহুত্ববাদই এমন একটি পথ, যার মাধ্যমে তিনি তার দ্বৈত দায়িত্ব—আধ্যাত্মিক ও পার্থিব—পালন করেন। তিনি বিশ্বাস করতেন, ইমামত ও একেডিএনের মধ্যে আধুনিক উদারনৈতিক মূল্যবোধ প্রাতিষ্ঠানিকভাবে প্রতিষ্ঠা করাই ছিল আধুনিক যুগে একটি নৈতিক ইসলামিক জীবনের অংশ।

তিনি বারবার বলেছেন, ইসলামের বিশ্বজনীন নৈতিকতা তার কাজের মূল ভিত্তি। তাই একেডিএন একটি প্রাতিষ্ঠানিক বাহন হয়ে উঠেছে, যার মাধ্যমে ইসমাইলিদের বিশ্বাস ও ইসলামের নৈতিক আদর্শ—সহানুভূতি, দানশীলতা, অন্তর্ভুক্তি, সুস্থ বিবেক, জ্ঞান ও অনুসন্ধান—বাস্তবে প্রয়োগ করা হয়।

এই দৃষ্টিভঙ্গি থেকেই আগা খান উগ্রপন্থা ও অসহিষ্ণুতার বিরুদ্ধে কথা বলেছেন এবং ২০১৭ সালে কানাডার অটোয়ায় ‘গ্লোবাল সেন্টার ফর প্লুরালিজম’ প্রতিষ্ঠা করেছেন। এটি বহুত্ববাদকে উৎসাহিত করে।

তবুও আগা খান ও একেডিএন বিভিন্ন পটভূমি থেকে আসা মানুষের সঙ্গে কাজ করে ইসমাইলি সম্প্রদায়ের নিরাপত্তা নিশ্চিত করার চেষ্টা চালায়। কেনিয়া ও মধ্য এশিয়ায় একেডিএনের হয়ে কাজ করা আয়সো মিলিকবেকভ বলেন, “সরকার গণতান্ত্রিক হোক বা কর্তৃত্ববাদী—তা গুরুত্বপূর্ণ নয়।”

উদাহরণস্বরূপ, ২০২১ সালে তালেবান আফগানিস্তানের ক্ষমতা দখলের পরেও একেডিএন ছিল খুব অল্প কয়েকটি আন্তর্জাতিক সংস্থার একটি যারা সেখানকার কার্যক্রম বন্ধ করেনি।

আফগানিস্তানে ইসমাইলিরা সংখ্যালঘু হলেও ২০০২ সাল থেকে একেডিএন সেখানে কোটি কোটি টাকা বিনিয়োগ করেছে গ্রামীণ উন্নয়নে। মিলিকবেকভ বলেন, “আমাদের লক্ষ্য প্রথমে শান্তি প্রতিষ্ঠা করা। তারপরই চরমপন্থা, অর্থনীতি, রাজনীতি ও সংস্কৃতির মতো বিষয়ের দিকে যাওয়া সম্ভব।”

তাজিকিস্তানে ১৯৯২ সালে গর্নো-বাদাখশান অঞ্চলের ইসমাইলি জনগণ স্বাধীনতা ঘোষণা করলে গৃহযুদ্ধ শুরু হয়, সেখানে আগা খান খাদ্য ও সহায়তা দিয়েছেন এবং নিজের প্রভাব ও সম্পদ ব্যবহার করে সংঘাতের অবসান ঘটাতে ভূমিকা রেখেছেন।

জর্জটাউন বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষক শেনিলা খোজা-মুলজির গবেষণা অনুযায়ী, আগা খানের নেতৃত্বে বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তের ইসমাইলিরা বিতাড়ন, জোরপূর্বক স্থানান্তর ও নির্যাতনের পর আবারও নিজেদের জীবন ও সমাজ গড়ে তুলতে উদ্বুদ্ধ হন।

এই প্রেক্ষাপটে আগা খান কিছুটা ব্যতিক্রমধর্মী একজন নেতা হয়ে ওঠেন। কারণ যখন ধর্ম ও ধর্মভিত্তিক মানুষদের অনেক সময় সমাজে রক্ষণশীল ও অসহিষ্ণু হিসেবে দেখা হয়, তখন আগা খান বিশ্ব কল্যাণে কাজ করে ‘ধর্মনিরপেক্ষ’ ভালো কাজের প্রতীক হয়ে ওঠেন।

একই সঙ্গে আধুনিক বিশ্বায়নের প্রেক্ষাপট ও উদারনৈতিক রাষ্ট্রব্যবস্থা ইসমাইলিদের ইসলামের ব্যাখ্যা প্রকাশের জন্য একটি আদর্শ পরিবেশ সৃষ্টি করেছে।

নৃতত্ত্ববিদ জোনা স্টেইনবার্গ একে “ফিনিক্স পাখির মতো পুনর্জাগরণ” বলেছেন, যা গত ১০০ বছরে ঘটেছে।

উদাহরণস্বরূপ, কানাডায় প্রায় ৮০ হাজার ইসমাইলি বাস করেন এবং সেখানে ধর্মটি সফলভাবে বিস্তার লাভ করেছে। ইসমাইলিরা এখন কানাডার ব্যবসা, সংস্কৃতি ও রাজনীতির শীর্ষ পর্যায়ে অবস্থান করছেন। ২০০৮ সালে আগা খান কানাডার রাজধানীতে ইসমাইলি ইমামতের প্রতিনিধিত্বমূলক দপ্তর বা ‘দ্য ডেলিগেশন অব দ্য ইসমাইলি ইমামদ’ স্থাপন করেন, যা কার্যত একটি দূতাবাসের মতো।

২০০৯ সালে আগা খান কানাডার সম্মানসূচক নাগরিকত্ব লাভ করেন। সেটি ছিল মাত্র পঞ্চমবারের মতো কোনও ব্যক্তির প্রতি দেওয়া এই বিরল সম্মান।

আন্তর্জাতিক কাঠামো, বিভিন্ন দেশের ও স্থানীয় পরিষদ এবং ২০১৫ সাল থেকে পর্তুগালের লিসবনে আনুষ্ঠানিক আসন স্থাপনের মাধ্যমে ইসমাইলি ইমামত কখনও কখনও একটি আন্তর্জাতিক কর্পোরেশনের মতো কাজ করে। এটি কোনও রাষ্ট্র বা কেবল একটি ধর্মীয় সম্প্রদায়ের মতো কাজ করে না।

একেডিএন বিশ্বব্যাপী সদস্যদের কল্যাণে কাজ করে। এটি কোনও নির্দিষ্ট সরকারের অধীনে নয় এবং রাজনৈতিক ফলাফলের ভিত্তিতে কাজ নির্ধারণ করে না।

এই কারণে আগা খানের রাজনৈতিক ভূমিকা অনেক সময় একজন অভিজাত ও সম্মানিত ব্যবসায়ীর মতো মনে হয়। তিনি যেন একজন জাতীয় নেতা বা আন্তঃসরকারি সংস্থার প্রধান নন।

তবে ঠিক এই বৈশিষ্ট্যই হয়তো ইসমাইলি মতবাদ ও আগা খানকে এতটা শক্তিশালী করে তোলে। অনেকের মতে, আগা খান সেই ভবিষ্যতের প্রতীক, যেখানে রাষ্ট্রের গণ্ডির বাইরের সংস্থা ও সংগঠনগুলো আন্তর্জাতিক বিষয়াদিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে।

এখন আগা খানের ছেলে প্রিন্স রহিম ধীরে ধীরে তার বাবার শূন্যস্থান পূরণ করছেন। প্রশ্ন উঠেছে, তিনি কীভাবে তার পিতার মতো এই “গভীর উপস্থিতি” ধরে রাখতে পারবেন?

ব্রাসেলসে তার সাম্প্রতিক উপস্থিতি হয়তো শুধুই একটি সূচনা। তবে এটিও শত বছরের ঐতিহ্যের ধারাবাহিকতা, বলছেন গবেষক আন্দানি।

তিনি বলেন, “আমরা আশা করি, নতুন আগা খান তার পিতার পথ অনুসরণ করবেন। আশা করি, তিনি দেখিয়ে দেবেন কীভাবে প্রাচীন ধর্মতাত্ত্বিক ধারণা ও দার্শনিক নীতিগুলোকে আধুনিক পৃথিবীতে মানুষের কল্যাণে প্রয়োগ করা যায়।”

তথ্যসূত্র : ফরেন পলিসি

আরও পড়ুন

সর্বশেষ

ads