কতটা সামাজিক হতে পেরেছে ইউরোপ?

প্রতীকী ছবি
প্রতীকী ছবি

সামাজিক ইউরোপ- ধারণাটা কী? অর্থনীতির প্রবৃদ্ধি নিয়ে যখন গোটা ইউরোপ চ্যালেঞ্জের মুখে, তখন সামাজিক অধিকারগুলো কতটুকু ভালো রাখতে পারছে ইউরোপের জনগণকে?

এসব প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে রোমানিয়া থেকে ফ্রান্স পর্যন্ত ঘুরে মানুষের সঙ্গে কথা বলে জানা গেল, বিভিন্ন সহায়তা প্রকল্পের বদৌলতে তাদের জীবনের মোড় আজ ঘুরে গেছে।

ভ্যালেন্টাইন এবং গ্যাবরিয়েলা অ্যালেক্সি তাদের দুই মেয়েকে নিয়ে বুখারেস্টের উত্তরে বারসেনির বাসায় বেশ ভালোই আছেন। অথচ একটা সময় ছিলো যখন আর্থিক অনটনের কারণে তাদেরকে বা-মায়ের সাথে বেশ আঁটসাঁট জীবন ধারণ করতে হয়েছে।

“তারা আমাদেরকে বের করে দেওয়ার পর একটা বাসা ভাড়া নেওয়ার আগে তিন দিন আমাকে স্ত্রী ও মেয়েকে নিয়ে গাড়িতে ঘুমাতে হয়েছে। এরপর যখন বাসা ভাড়া নিলাম, তখন আমার হাতে খুব বেশি অর্থ অবশিষ্ট ছিল না, কারণ (বাসা) খুব ব্যয়বহুল ছিল। সেই অর্থ খাবারের জন্য যথেষ্ট ছিল, কিন্তু অন্যকিছু, যেমন কাপড় কেনার জন্য ছিল না। কিন্তু উপায়ও ছিল না,” বলেন ভ্যালেনটাইন।

আর ভাড়া নেওয়া সেই বাসার অবস্থা সম্পর্কে গ্যাবরিয়েলার ভাষ্য, “জীবন ক্রমেই কঠিন হয়ে যাচ্ছিল। পরিস্থিতি দিন দিন খারাপ হতে শুরু করেছিল। মেয়েকে হাসপাতালে যেতে হয়েছিল, আমাকেও হাসপাতালে থাকতে হয়েছে, কারণ বাসাটি খুবই নোংরা ছিল।”

ভ্যালেন্টাইন-গ্যাবরিয়েলার মতো অনেক নিম্নআয়ের মানুষের জন্য আশির্বাদ হয়ে আসে এনজিও ‘হ্যাবিটেট ফর হিউম্যানিটি’। বেসরকারি এই সংস্থাটি স্বোচ্ছাসেবীদের সহায়তায় অংশীদারত্বের মাধ্যমে নিম্নআয়ের মানুষের জন্য বাড়ি তৈরি করে।

ভ্যালেন্টাইন-গ্যাবরিয়েলাও এখন একটি বাড়ির মালিক হয়েছে স্বেচ্ছাসেবী হিসেবে সময় দিয়ে এবং ২০ বছরে এর মূল্য পরিশোধের সহজ শর্তে।

“এখনো বিশ্বাস হয় না যে এটি (বাড়ি) আমাদের, এই বাড়ি আমাদের জীবনটাই বদলে দিয়েছে,” বলেন গ্যাবরিয়েলা। 

বেসরকারি এবং ইউরোপিয়ান তহবিলে এই প্রকল্পটি বাস্তবায়ন হচ্ছে বারসেনি নগর কর্তৃপক্ষের সহায়তায়। কর্তৃপক্ষ প্রকল্পে জমি এবং বিভিন্ন ইউটিলিটি সেবা দিচ্ছে। ইতিমধ্যে সেখানে তিনটি ভবন তৈরি হয়েছে, যেখানে ১২টি পরিবারের বাসস্থানের ব্যবস্থা হয়েছে।

বারসেনির মেয়র কসমিনা পান্ডেলের ভাষ্য, মানুষের জন্য স্বাভাবিক একটি নাগরিক জীবনের ব্যবস্থা করাই এই প্রকল্পের লক্ষ্য।

শুধু তাই নয়, এসব পরিবারে জন্ম দেওয়া ভবিষ্যৎ প্রজন্মের কথা চিন্তা করেও এই প্রকল্প বলে মেয়র জানান। 

বর্তমানে ইউরোপীয় ইউনিয়নে দুই কোটি শিশু দারিদ্র্যের ঝুঁকির মধ্যে আছে। ইইউর লক্ষ্য হচ্ছে ২০৩০ সালের মধ্যে সংখ্যাটি এক চতুর্থাংশে নামিয়ে আনা। এছাড়া ইউরোপিয়ান চাইল্ড গ্যারান্টির লক্ষ্য হচ্ছে সব শিশুর জন্য শিক্ষা, স্বাস্থ্যসেবা, স্বাস্থ্যকর খাবার এবং উপযুক্ত বাসস্থানের ব্যবস্থা করা। 

সামাজিক ন্যায্যতার ইউরোপ

প্রশ্ন হচ্ছে, সামাজিক লক্ষ্যগুলো অর্জনে ইউরোপীয় ইউনিয়নের পরিকল্পনা কী?

এ বছর ইউরোব্যারোমিটারের এক সমীক্ষার তথ্য বলছে, প্রতি ১০ জন ইউরোপিয়ানের মধ্যে প্রায় নয়জনই বলেছেন, তারা ন্যায্য কাজের পরিবেশ, অন্তর্ভূক্তিমূলক ব্যবস্থা এবং সমান সুযোগ থাকবে, এমন শক্তিশালী সামাজিক ইউরোপ চান।

ইউরোপিয়ান পিলার অব সোশাল রাইটসের ২০টি নীতি এই লক্ষ্য অর্জনের দিকনির্দেশনা হিসেবে কাজ করে। ২০৩০ সালের মধ্যে লক্ষ্য অর্জনের জন্য ইউরোপিয় ইউনিয়ন একটি কর্মপরিকল্পনা তৈরি করেছে। এর আওতায় ২০ থেকে ৬৪ বছর বয়সী ৭৮ শতাংশ মানুষকে কাজে যুক্ত করেছে। প্রতিবছর ৬০ শতাংশ প্রাপ্তবয়স্ককে তারা প্রশিক্ষণ দিচ্ছে এবং ৫০ লাখ শিশুসহ মোট দেড় কোটি মানুষকে দারিদ্র্যমুক্ত করার পরিবল্পনা নিয়েছে।

মানুষের ওপর বিনিয়োগ

ইউরোপীয় ইউনিয়নের অগ্রাধিকারের মূলে রয়েছে দক্ষতা বৃদ্ধি, যা প্রাপ্তবয়স্কদেরও শিক্ষায় বিনিয়োগে উৎসাহী করে তোলে।

যেমন বুখারেস্টের একটি স্কুলের ৪৯ বছর বয়সী ইংরেজির শিক্ষক রদিকা ইয়োনাসের ইচ্ছা ছিল কমপিউটার প্রযুক্তি শেখার। এজন্য তিনি পলিটেকনিক ইউনিভার্সিটি অব বুখারেস্টে দুই বছর মেয়াদী প্রশিক্ষণে অংশ নেন। এটি বিশ্ব ব্যাংকের সঙ্গে অংশীদারত্বে পরিচালিত হয়। এই প্রশিক্ষণ কার্যক্রমের উদ্দেশ্য হচ্ছে স্কুল শিক্ষার্থীদের ঝরে পড়া ঠেকানোর পাশাপাশি শিক্ষকদের দক্ষতা বৃদ্ধি।

রদিকার ভাষ্য, তার পাঠদান পদ্ধতির উন্নতির ফলে শিক্ষার্থীরাও এখন ক্লাস করতে পছন্দ করছে। ক্লাসে পাঠদানও আগের চেয়ে আকর্ষণীয় হয়ে উঠেছে শিক্ষার্থীদের কাছে।

‘ইউরোপিয়ান ইয়ার অব স্কিলস’ উদ্যোগের মতো এমন অংশীদারত্বমূলক কার্যক্রমকে উৎসাহ দিচ্ছে ইউরোপীয় ইউনিয়ন। ‘ইউরোপিয়ান ইয়ার অব স্কিলস’ ২০২৩ সালে এমন ২০০ কার্যক্রমে সহায়তা দিয়েছে।

বেকারত্ব শূন্যে নামানোর লক্ষ্য

ইউরোপের অন্যপ্রান্তে ফ্রান্সে আরেকটি বড় ধরনের সংকট কাটানোর উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। সেটি হচ্ছে ‘জিরো লং টার্ম আনএমপ্লয়মেন্ট টেরিটোরিজ’ গড়ে তোলা। ২০১৬ সালে শুরু হওয়া এই কর্যক্রমের লক্ষ্য হচ্ছে গ্রামীণ এলাকায় কর্মস্থান তৈরি করা। যেমনটা করা হয়েছে পিরিয়াকে, সেখানে ‘টিজি’ কোম্পানি ৬০ জনের বেশি লোককে কাজ দিয়েছে।  

‘জিরো লং টার্ম আনএমপ্লয়মেন্ট টেরিটোরিজ’ প্রকল্পটিতে সহায়তা দিচ্ছে ইউরোপীয়ান সোশাল ফান্ড প্লাস। ইউরোপে সামাজিক অধিকার প্রতিষ্ঠায় মূল অর্থায়নই আসে ১৪ হাজার ২৭০ কোটি ইউরোর এই তহবিল থেকে।

ইউরো নিউজ অবলম্বনে

আরও পড়ুন