শুল্ক যেভাবে বদলে দিচ্ছে বৈশ্বিক সরবরাহ ব্যবস্থার চিত্র

ট্রাম্পের শুল্ক আরোপের পরিকল্পনা গত তিন মাসে অনেকটাই বদলে দিয়েছে বিশ্ব বাণিজ্যের সরবরাহ ব্যবস্থার চালচিত্র।
ট্রাম্পের শুল্ক আরোপের পরিকল্পনা গত তিন মাসে অনেকটাই বদলে দিয়েছে বিশ্ব বাণিজ্যের সরবরাহ ব্যবস্থার চালচিত্র।

চীনা পণ্যের উপর ডোনাল্ড ট্রাম্পের প্রস্তাবিত উচ্চহারে শুল্ক আরোপের ৯০ দিনের বিরতি শেষ হবে বুধবার। এরপর কী হবে তা এখনও স্পষ্ট করেনি মার্কিন প্রশাসন। তবে বিশ্লেষকদের ধারণা সব ঠিকঠাক না হলে বরং যুক্তরাষ্ট্রের বৈশ্বিক বাণিজ্যিক সম্পর্ক বিশৃঙ্খলার মুখে পড়ে যেতে পারে।

গত কয়েক মাসের অনিশ্চয়তা ইতোমধ্যে অনেক কোম্পানিকে তাদের সরবরাহ ব্যবস্থায় ব্যাপক পরিবর্তন আনতে বাধ্য করেছে।

ইলিনয়ের একটি খেলনা নির্মাতা কোম্পানির মালিক যখন শুনলেন যে ট্রাম্প চীনা পণ্যের ওপর শুল্ক আরোপ করতে যাচ্ছেন, তখন তিনি এতটাই ক্ষুব্ধ হয়েছিলেন যে তিনি যুক্তরাষ্ট্র সরকারকে আদালতে নেওয়ার সিদ্ধান্ত নেন।

“আমার কোম্পানি যদি সত্যিকারের ঝুঁকির মধ্যে পড়ে, তাহলে আমি নিশ্চয়ই দাঁড়িয়ে প্রতিবাদ জানাব,” বলেন রিক ওয়োলডেনবার্গ, যিনি শিক্ষামূলক খেলনা প্রস্তুতকারী প্রতিষ্ঠান লার্নিং রিসোর্সেসের প্রধান নির্বাহী।

তার কোম্পানির বেশিরভাগ পণ্য চীনে তৈরি হয়, তাই এই শুল্ক চীনা রপ্তানিকারকদের নয়, বরং আমেরিকান আমদানিকারকদের দিতে হয়, যা তার জন্য বিশাল ব্যয়সাপেক্ষ হয়ে দাঁড়িয়েছে।

তিনি বলেন, বছরে প্রায় ২৫ লাখ ডলার আমদানি কর শোধ করতে হত তার কোম্পানিকে, কিন্তু ২০২৪ সালের এপ্রিলে যখন ট্রাম্প অস্থায়ীভাবে চীনা পণ্যের ওপর শুল্ক ১৪৫% বসিয়ে দেন, তখন তা বেড়ে দাঁড়ায় ১০ কোটি ডলারেরও বেশি। এটা কোম্পানির জন্য “ধ্বংসাত্মক” হতো বলে জানান তিনি।

“এমন প্রভাব আমার ব্যবসার ওপর পড়বে- এটা ভাবলেই মাথা ঘুরে যায়,” বলেন তিনি।

লার্নিং রিসোর্সেসের মতো অনেক কোম্পানিকে নতুন করে পণ্য আমদানির জন্য ভিন্ন কোনো দেশের দিকে ঝুঁকতে হচ্ছে।

বর্তমানে চীনা পণ্যের ওপর যুক্তরাষ্ট্রের শুল্ক হার ৩০%, যা এখনও অনেক আমেরিকান কোম্পানির জন্য, যেমন লার্নিং রিসোর্সেস, সহনীয় নয়।

তাই কোম্পানিটি আইনি লড়াই চালিয়ে যাওয়ার পাশাপাশি তাদের বৈশ্বিক সরবরাহ শৃঙ্খল পরিবর্তন করছে- চীন থেকে উৎপাদন সরিয়ে নেওয়া হচ্ছে ভিয়েতনাম ও ভারতে।

এই দুই দেশ, বিশ্বের অধিকাংশ দেশের মতো, যুক্তরাষ্ট্র থেকে ১০% সাধারণ শুল্কের মুখোমুখি হচ্ছে, যা চীনের ওপর আরোপিত শুল্কের তুলনায় দুই-তৃতীয়াংশ কম। যদিও এই ১০% শুল্ক ৯ জুলাই, বুধবার শেষ হওয়ার কথা, তবে এরপর কী আসবে তা নিয়ে এখনও অনিশ্চয়তা রয়ে গেছে।

এদিকে, অনেক কানাডিয়ান কোম্পানি, যারা নিজ দেশ এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে ব্যবসা করে, তারা এখন দ্বিগুণ চাপের মুখে।

এই চাপে রয়েছে- ট্রাম্পের কানাডার অনেক পণ্যের ওপর আরোপিত ২৫% শুল্ক এবং কানাডার পাল্টা ব্যবস্থা হিসেবে যুক্তরাষ্ট্রের অনেক পণ্যের ওপর আরোপিত একই হারে শুল্ক।

বিশ্বের আরও অনেক ব্যবসা প্রতিষ্ঠান যুক্তরাষ্ট্রে রপ্তানি কমিয়ে দেওয়ার কথা ভাবছে, কারণ মার্কিন আমদানিকারকরা এখন অতিরিক্ত শুল্ক বহনের কারণে পণ্যের দাম বাড়াতে বাধ্য হচ্ছে, যার ফলে সেই পণ্যগুলো মার্কিন বাজারে অনেক বেশি দামে বিকোচ্ছে।

লার্নিং রিসোর্সেসের ওয়োলডেনবার্গ এখন প্রায় ১৬% উৎপাদন ভারতে ও ভিয়েতনামে সরিয়ে নিয়েছেন।

“আমরা নতুন কারখানাগুলো যাচাই-বাছাই করেছি, তাদের আমাদের প্রয়োজনীয়তা অনুযায়ী প্রশিক্ষণ দিয়েছি, উৎপাদন প্রক্রিয়া নির্বিঘ্নে চালানো যায় কিনা তা নিশ্চিত করেছি, এবং সম্পর্ক গড়ে তুলেছি,” তিনি বলেন।

তবে তিনি স্বীকার করেন, এখনও বেশ কিছু অনিশ্চয়তা রয়ে গেছে।

রিক ওয়োলডেনবার্গ।

“আমরা জানি না তারা আমাদের ব্যবসার পুরো উৎপাদন ক্ষমতা সামলাতে পারবে কিনা—যা আরও কঠিন হলো এই কারণে যে, একসাথে সারা দুনিয়ার অনেক কোম্পানিই সেখানে যাচ্ছে।”

তিনি আরও জানান, উৎপাদন অন্য দেশে স্থানান্তর করা খুব ব্যয়বহুল ও জটিল প্রক্রিয়া।

এদিকে তার কোম্পানির যুক্তরাষ্ট্র সরকারের বিরুদ্ধে শুল্কবিরোধী মামলাটি এখনও যুক্তরাষ্ট্রের আদালতে চলমান।

গত মে মাসে ওয়াশিংটন ডিসির ইউএস ডিস্ট্রিক্ট কোর্টের এক বিচারক রায় দেন যে, এই শুল্ক আরোপ অবৈধ। তবে যুক্তরাষ্ট্র সরকার সঙ্গে সঙ্গেই এই রায়ের বিরুদ্ধে আপিল করে, এবং এখনো পর্যন্ত লার্নিং রিসোর্সেসকে সেই শুল্ক গুনতে হচ্ছে।

তাই কোম্পানিটি চীন থেকে উৎপাদন সরিয়ে নেওয়ার কাজ চালিয়ে যাচ্ছে।

বিশ্বব্যাপী সরবরাহ শৃঙ্খল বিশেষজ্ঞ লেস ব্র্যান্ড বলছেন, উৎপাদন অন্য দেশে সরিয়ে নেওয়া কোম্পানিগুলোর জন্য একদিকে যেমন ব্যয়বহুল, অন্যদিকে তা বাস্তবায়ন করাও কঠিন।

“আপনার যেকোনো পণ্যের গুরুত্বপূর্ণ উপাদানের জন্য নতুন উৎস খুঁজে পাওয়া- এটা একটা বিশাল গবেষণার বিষয়,” বলেন লেস ব্র্যান্ড, যিনি পরামর্শদাতা প্রতিষ্ঠান সাপ্লাই চেইন লজিস্টিকস-এর প্রধান নির্বাহী।

“সঠিকভাবে কাজটি করতে প্রচুর মান পরীক্ষা করতে হয়। সময় দিতে হয়, আর সেটাই মূল ব্যবসার ফোকাস থেকে মনোযোগ সরিয়ে দেয়।”

তিনি আরও যোগ করেন, “নতুন একটি দলকে আপনার পণ্য তৈরি করার প্রক্রিয়া শেখাতে যে জ্ঞান স্থানান্তর করতে হয়, সেটাও সময় ও অর্থ সাপেক্ষ। আর এটি এমন সময়ে হচ্ছে যখন ব্যবসাগুলোর লাভের মার্জিন এমনিতেই খুবই কম।”

কানাডার ফ্রায়েড চিকেন চেইন ক্লাক ক্লাকস-এর সরবরাহ ব্যবস্থাও ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে যুক্তরাষ্ট্র থেকে আমদানির ওপর কানাডার প্রতিশোধমূলক শুল্কের কারণে। কারণ, যদিও তাদের মুরগি কানাডীয়, তারা যুক্তরাষ্ট্র থেকে বিশেষ ধরনের রান্নার ফ্রিজ এবং প্রেসার ফ্রায়ার আমদানি করে।

ফ্রিজ ছাড়া তারা চলতে পারছে না, কিন্তু নতুন করে আর কোনো প্রেসার ফ্রায়ার কেনা বন্ধ করেছে। তবে কোনো কানাডীয় কোম্পানি এই ধরনের বিকল্প ফ্রায়ার তৈরি না করায়, নতুন শাখাগুলোর মেনু সীমিত রাখতে হচ্ছে।

কারণ, হাড়সহ মুরগির টুকরো রান্না করতে এই ফ্রায়ারগুলো অপরিহার্য। তাই নতুন শাখাগুলোতে কেবল হাড়ছাড়া (বোনলেস) চিকেন পরিবেশন করা সম্ভব হচ্ছে, যেটি অন্যভাবে রান্না করা হয়।

“এটা আমাদের জন্য একটি বড় সিদ্ধান্ত ছিল, তবে আমরা মনে করি এটি কৌশলগতভাবে সঠিক সিদ্ধান্ত,” বলেন ক্লাক ক্লাকস-এর সিইও রাজা হাশিম।

তিনি আরও বলেন, “এটি বলার প্রয়োজন যে আমরা নতুন শাখাগুলোর রান্নাঘরে পর্যাপ্ত জায়গা রেখে দিচ্ছি, যাতে ভবিষ্যতে যদি শুল্ক-সংক্রান্ত অনিশ্চয়তা দূর হয়, তাহলে ওই ফ্রায়ারগুলো আবার চালু করা যায়।”

তবে তিনি সতর্ক করে দেন যে যুক্তরাষ্ট্র থেকে আমদানিকৃত ফ্রিজ এখন অনেক বেশি দামে পড়ছে, যার ফলে খাবারের দাম বাড়ানোর সম্ভাবনা রয়েছে।

রাজা হাশিম।

“কিছু খরচ আছে যা ব্র্যান্ড হিসেবে আমাদের পক্ষে বহন করা সম্ভব নয়, তাই কিছু খরচ গ্রাহকের ওপর চাপিয়ে দিতে হতে পারে। এটা অবশ্যই আমরা করতে চাই না।”

রাজা হাশিম আরও জানান, তারা যুক্তরাষ্ট্রে ব্যবসা সম্প্রসারণের পরিকল্পনা চালিয়ে যাচ্ছেন, এবং ইতোমধ্যে সেখানকার স্থানীয় চেইনের মাধ্যমে মার্কিন মুরগি সংগ্রহের ব্যবস্থা করেছে। বর্তমানে তাদের একটি মার্কিন শাখা রয়েছে, টেক্সাসের হিউস্টনে।

স্পেনে, অলিভ অয়েল উৎপাদক প্রতিষ্ঠান অর্ডো ডেল ডেসিয়ের্তো বর্তমানে তাদের ৮% পণ্য যুক্তরাষ্ট্রে রপ্তানি করে।

প্রতিষ্ঠানটি বলছে, ইউরোপীয় পণ্যের ওপর যুক্তরাষ্ট্রের ১০% শুল্ক এখন সরাসরি মার্কিন ভোক্তার ওপর চাপিয়ে দিতে হচ্ছে।
“এই শুল্ক সরাসরি মার্কিন গ্রাহকদের প্রভাবিত করছে,” বলেন কোম্পানির রপ্তানি ব্যবস্থাপক রাফায়েল আলোনসো বাররাউ।

তিনি আরও বলেন, যদি এই শুল্ক তাদের জন্য যুক্তরাষ্ট্রে ব্যবসা কম লাভজনক করে তোলে, তাহলে তারা সেখানে রপ্তানি কমিয়ে অন্য বাজারে বেশি পরিমাণে পণ্য রপ্তানির কথা ভাবছে।

“আমাদের হাতে বিকল্প বাজার রয়েছে,” বলেন বাররাউ। “আমরা আরও ৩৩টি বাজারে পণ্য বিক্রি করি, এবং সেগুলোর সাথে স্থানীয় বাজার মিলে আমরা যুক্তরাষ্ট্রে যে ক্ষতি হতে পারে তা সামলিয়ে নিতে পারবো।”

ব্র্যান্ড বলেন, যদি ট্রাম্প একটু ধীরে এগোতেন, তাহলে বিশ্বের কোম্পানিগুলো এতটা ক্ষতিগ্রস্ত হতো না।

“এই সিদ্ধান্তগুলোর গতি এবং তীব্রতাই আসলে পরিস্থিতিকে আরও খারাপ করে তুলেছে। প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প যদি একটু ধীরে ও আরও বিবেচনার সাথে এগোতেন, তাহলে ভালো হতো।”

ইলিনয়ে ফিরে ওয়োলডেনবার্গও উদ্বিগ্ন ট্রাম্পের ভবিষ্যতে বাণিজ্য লড়াইয়ের শঙ্কায়।

“আমরা কেবল আমাদের হাতে থাকা তথ্য অনুযায়ী যতটা সম্ভব ভালো সিদ্ধান্ত নেওয়ার চেষ্টা করছি, এরপর দেখা যাক কী হয়,” বলেন তিনি।

“আমি বলতে চাই না, ‘ভালো কিছুর আশা করছি’, কারণ আমি মনে করি না যে আশা কোনো কার্যকর কৌশল।”

তথ্যসূত্র: বিবিসি

এ সম্পর্কিত আরও খবর:

আরও পড়ুন

সর্বশেষ

ads