তুরস্ক কীভাবে যুক্তরাষ্ট্রের অস্ত্র বাজারের দখল নিচ্ছে

turkey 01

ঘটনা ২০২২ সালের ২৯ জানুয়ারিতে যুক্তরাষ্ট্রের ওকলাহোমার তুলসা শহরের। মুসকোগি নেশনের ১৮ বছর বয়সী সদস্য স্যার মাইকেল মরগান জুনিয়র ১৮ বছর বয়সী আইজায়া জোনসকে গুলি করে হত্যা করেন। 

যুক্তরাষ্ট্রের আইনে মরগান বৈধভাবে একটি হ্যান্ডগানের মালিক হতে পারতেন না। তাই তিনি অন্য একজনের কাছ থেকে ধার নিয়েছিলেন একটি ৯ মিমি সেমি-অটোমেটিক কানিক পিস্তল। সেটির ১৯ রাউন্ড গুলি ধারণের ক্ষমতা ছিল।

যুক্তরাষ্ট্রে যখন কোভিড-১৯ মহামারি চূড়ান্ত পর্যায়ে পৌঁছেছিল, তখনই এসব ঘটছিল। তখন আমেরিকানরা রেকর্ড সংখ্যায় আগ্নেয়াস্ত্র কিনছিল। আর সেই অস্ত্রগুলো ব্যাপক হারে অপরাধস্থলে পাওয়া যাচ্ছিল। 

মূল্যস্ফীতি বেড়ে গিয়েছিল এবং মহামারি মোকাবিলায় যুক্তরাষ্ট্রের কিছু কারখানা বন্ধ হয়ে পড়েছিল। ফলে অস্ত্র আমদানি ক্রমেই বেড়ে গিয়েছিল। বিশেষ করে সেসব দেশ থেকে যেগুলোতে উৎপাদন ব্যয় কম এবং উৎপাদন চলমান ছিল।

ওই সময় তুরস্ক হয়ে ওঠে যুক্তরাষ্ট্রের সর্ববৃহৎ অস্ত্র রপ্তানিকারক দেশ। ২০২১ সাল থেকে তুরস্ক এই স্থান ধরে রেখেছে। তুরস্কের ব্র্যান্ডগুলোর মধ্যে শীর্ষে রয়েছে কানিক। এর মূল কোম্পানি হলো সামসুন ইউর্ট সাভুনমা (এসওয়াইসি)।

আঙ্কারার একটি গুলি উৎপাদন কারখানা।

আইজায়া জোনস যখন নিহত হন, তখন কানিক পিস্তল যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে অত্যন্ত জনপ্রিয় হয়ে উঠেছিল। পিস্তলটি বিশেষভাবে নতুন ব্যবহারকারীদের জন্য তৈরি করা হয়েছিল। অস্ত্র নির্মাতা ও বিপণনকারী প্রতিষ্ঠানগুলো নারীদের, কিশোরদের ও কৃষ্ণাঙ্গ ক্রেতাদের লক্ষ্য করে বাজার সম্প্রসারণে কাজ করছিল।

মরগান ও জোনস ছিলেন ঠিক সেই শ্রেণির মানুষ। ছোট আকারের হাতের জন্য উপযোগী, সহজ ট্রিগার সিস্টেম এবং হালকা কাঠামোর কারণে কানিক পিস্তল ছিল নতুন ব্যবহারকারীদের জন্য আদর্শ। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো, এই পিস্তল ছিল সস্তা। সাধারণত ৪০০ ডলারেরও কম দামে পাওয়া যেত।

রিকয়েল ম্যাগাজিনের সম্পাদক ও স্নাইপার ইয়ান হ্যারিসন ‘ফরেন পলিসি’কে বলেন, “তুরস্ক একাই একটি আলাদা অবস্থান দখল করে নিয়েছে। তুর্কি অস্ত্রের দাম অপেক্ষাকৃত কম হলেও তাদের মান ইউরোপীয় অস্ত্রের সমতুল্য।”

২০২০ সালের পর যুক্তরাষ্ট্রে অস্ত্র বিক্রির হার কমে গেছে। আর এসওয়াইএস এর প্রতিদ্বন্দ্বী প্রতিষ্ঠানগুলোর বিক্রি কমেছে। তবে এসওয়াইএস এর ব্র্যান্ডগুলোর বিক্রি মহামারির আগের তুলনায়ও বেড়েছে। 

কোম্পানিটি জানিয়েছে, তারা বছরে প্রায় ৪ লাখ ৬০ হাজার ৯ মিমি পিস্তল তৈরি করতে পারে। এই হারে তারা জার্মান অস্ত্র নির্মাতা সিগ সাউয়ারের পর দ্বিতীয় বৃহৎ উৎপাদক। তবে এসওয়াইএস এর পণ্যের দাম সিগ সাউয়ারের চেয়ে অর্ধেক।

তুরস্কের অস্ত্র কোম্পানিগুলোর যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে সফলতার অন্যতম কারণ হলো, তারা আধা-স্বয়ংক্রিয় ৯ মিমি পিস্তল উৎপাদনে মনোযোগ দিয়েছে। এই ধরনের অস্ত্রই সাধারণত বন্দুক-সংক্রান্ত সহিংসতায় বেশি ব্যবহৃত হয়। এই সহিংসতা দরিদ্র এলাকাগুলোতেই বেশি দেখা যায়। 

২০২৩ সালে যুক্তরাষ্ট্রের ব্যুরো অব অ্যালকোহল, টোবাকো, ফায়ারআর্মস অ্যান্ড এক্সপ্লোসিভস (এটিএফ) জানিয়েছে, অপরাধস্থলে উদ্ধারকৃত আগ্নেয়াস্ত্রের মধ্যে ৭৪ শতাংশ ছিল পিস্তল। এর প্রায় অর্ধেকই ছিল ৯ মিমি পিস্তল। 

অস্ত্রের ব্র্যান্ড সম্পর্কিত তথ্য অনেক সময় অস্পষ্ট থাকলেও ‘এভরিটাউন ফর গান সেফটি’ নামক একটি সংগঠন ৩৪টি শহরের তথ্য বিশ্লেষণ করে দেখেছে, ২০২৩ সালে অপরাধস্থলে পাওয়া ১০টি শীর্ষ ব্র্যান্ডের মধ্যে চারটি বিদেশি। আর এর মধ্যে কানিক আমদানিকারক ‘সেঞ্চুরি আর্মস’ এর অস্ত্রও ছিল।

‘এভরিটাউন ফর গান সেফটি’র সাবেক গবেষণা পরিচালক সারা বার্ড-শার্পস বলেন, “এটা খুবই সরল; অর্থনৈতিক অবস্থা আগ্নেয়াস্ত্র কেনার সিদ্ধান্তে প্রভাব ফেলে। খুব সস্তায় আগ্নেয়াস্ত্রের সহজলভ্যতা মানেই বেশি ক্ষতির সম্ভাবনা।”

যুক্তরাষ্ট্রে এর আগেও সস্তা বিদেশি অস্ত্র স্থানীয় অস্ত্রকে ছাড়িয়ে গিয়েছিল। তবে এবারই প্রথম কম খরচে উৎপাদনকারী দেশ হিসেবে তুরস্ক এতটা ভালো করেছে। তাছাড়া যুক্তরাষ্ট্রে শুল্ক বৃদ্ধির কারণে যখন বেশিরভাগ অস্ত্রের দাম বাড়তে পারে, তখন তুর্কি অস্ত্র এই মূল্যবৃদ্ধির ধাক্কা থেকে রেহাই পেতে পারে।

আগ্নেয়াস্ত্র মালিকানাকে যারা আত্মরক্ষার অধিকার বলে মনে করেন, তাদের কাছে তুর্কি অস্ত্রের জনপ্রিয়তা মানে আরও বেশি মানুষের জন্য সুযোগ সৃষ্টি ও বিকল্প বাড়ানো। তবে যারা মনে করেন অস্ত্রের সরবরাহ বাড়া মানেই সহিংসতা বাড়া, তাদের কাছে এটি হতে পারে শুধু যুক্তরাষ্ট্রেই নয়, বিশ্বজুড়েই সহিংসতা বৃদ্ধির কারণ।

তুরস্ক ১৯৯০-এর দশকের আগে ছোট অস্ত্র উৎপাদন আধুনিকায়নে খুব একটা বিনিয়োগ করেনি। তখন কুর্দি গেরিলাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ তীব্রতর হলে উন্নতমানের অস্ত্রের চাহিদা তৈরি হয়। এরপর রাষ্ট্র-মালিকানাধীন মেকানিক্যাল অ্যান্ড কেমিক্যাল ইন্ডাস্ট্রি কর্পোরেশন (এমকেই) বিভিন্ন কারখানাকে অস্ত্র উৎপাদনের লাইসেন্স দেয়। এতে করে গৃহ-শিল্পভিত্তিক অস্ত্র উৎপাদন ব্যবস্থা আনুষ্ঠানিক রূপ পায়।

এসওয়াইএস ছিল তুরস্কের এই নতুন শিল্পের সবচেয়ে উচ্চাকাঙ্ক্ষী প্রতিষ্ঠানগুলোর একটি। কোম্পানিটির প্রতিষ্ঠাতা হুসেইন কাহিত আরাল একজন সফল শিল্পপতি ছিলেন। তিনি তুরস্কে প্রথম ফলের রস ও হিমায়িত খাদ্য প্রস্তুতকারক প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলেন। তার ছেলে জাফের ১৯৯৮ সালে একটি ছোট অস্ত্র ওয়ার্কশপ কিনে তা জাতীয় ও আন্তর্জাতিক প্রতিরক্ষা কোম্পানির সহযোগিতায় একটি বহু ক্যাম্পাস বিশিষ্ট উচ্চ-প্রযুক্তি প্রতিষ্ঠান হিসেবে গড়ে তোলেন।

অবশ্য এই রূপান্তর সম্ভব হয়েছিল ২০০৪ সাল থেকে শুরু হওয়া তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী রিসেপ তায়েপ এরদোয়ানের সংস্কারের কারণে। তিনি চেয়েছিলেন তুর্কি প্রতিরক্ষা শিল্প যেন পশ্চিমা প্রতিষ্ঠানের ওপর নির্ভরতা কমায়। এই উদ্দেশ্যে তিনি অনেকটাই সফল হন। 

এখন তুরস্কের প্রতিরক্ষা ও বাণিজ্য মন্ত্রণালয় উদ্যোগী প্রতিষ্ঠানগুলোকে ভর্তুকি, বিপণন সহায়তা ও সহজ ঋণ দেয়। সেইসঙ্গে দেশীয় সেনাবাহিনী ও পুলিশ বাহিনীকে অস্ত্র সরবরাহের বড় বড় চুক্তিও দেয়।

২০১০-এর দশকে তুরস্কের অভ্যন্তরে আগ্রহী আগ্নেয়াস্ত্র মালিকানা বাড়ায় দেশটির অস্ত্র নির্মাতা কোম্পানিগুলো যুক্তরাষ্ট্রের বাজারের দিকে নজর দিতে শুরু করে। ২০১২ সালে তুরস্কের কোম্পানি এসওয়াইএস এর প্রতিনিধিরা লাস ভেগাসে আয়োজিত ‘শট’ শো-তে অংশ নেন। 

সেখানে তারা যুক্তরাষ্ট্রের সবচেয়ে বড় পুরোনো আগ্নেয়াস্ত্র আমদানিকারক কোম্পানি সেঞ্চুরি ইন্টারন্যাশনাল আর্মসের সঙ্গে দেখা করেন। দুই পক্ষের মধ্যে একটি পরীক্ষামূলক অংশীদারত্বের চুক্তি হয়। এর আওতায় সেঞ্চুরি আর্ম আমেরিকান ক্রেতাদের রুচি বোঝাতে ও যুক্তরাষ্ট্রের আগ্নেয়াস্ত্র আইন বুঝে চলতে সহায়তা করবে এসওয়াইএসকে।

প্রথম ধাপে সেঞ্চুরি আর্মসের নির্বাহীরা এসওয়াইএসের প্রকৌশলীদের একটি চাহিদার তালিকা পাঠান, যেখানে কী ধরনের পিস্তল আমেরিকান ক্রেতাদের কাছে জনপ্রিয় হতে পারে, তা উল্লেখ করা হয়। সেই অনুযায়ী তৈরি পিস্তলগুলো বাজারে ভালো বিক্রি হয় এবং সেই লাভ আবার উন্নত প্রযুক্তিতে বিনিয়োগ করা হয়।

বর্তমানে কানিক পিস্তল হচ্ছে সেঞ্চুরি আর্মসের সবচেয়ে বেশি বিক্রিত আগ্নেয়াস্ত্র। আগে যে তুর্কি ব্র্যান্ডগুলো ছিল পেছনের সারির, এখন তারা একাধিক শিল্প সম্মাননা পেয়েছে। এসব ব্র্যান্ডের নিজস্ব অনুরাগী গোষ্ঠী ও ফোরাম রয়েছে, আর অস্ত্র প্রদর্শনীতে তাদের স্টলে দেখা যায় অনুগতদের ভিড়।

সেঞ্চুরি আর্মসের বাজারজাতকরণ ও ব্যবসা উন্নয়ন বিভাগের ভাইস প্রেসিডেন্ট অ্যাডাম রুয়োনালা বলেন, “আমি মনে করি এটি একটি দারুণ উদাহরণ পারস্পরিক সহায়ক সম্পর্কের।”

১৯৬৮ সালে প্রেসিডেন্ট জন এফ. কেনেডির হত্যাকাণ্ডে ব্যবহৃত একটি ইতালিয়ান কারকানো রাইফেলকে কেন্দ্র করে যুক্তরাষ্ট্রে আগ্নেয়াস্ত্র আমদানির ওপর সাধারণ নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হয়। তবে সেই নিষেধাজ্ঞার পর মাত্র দুটি বড় পরিবর্তন এসেছে। এখনও ‘খেলাধুলার উদ্দেশ্যে’ ব্যবহৃত অস্ত্র আমদানির সুযোগ রয়েছে—এবং এই সংজ্ঞাকে বিস্তৃত ও চালাকিভাবে ব্যবহার করে কিছু সামরিক ঘরানার আগ্নেয়াস্ত্রকেও এর আওতায় আনা হয়েছে।

যুক্তরাষ্ট্রের জটিল ও বিচিত্র আগ্নেয়াস্ত্র আইনের কারণে কিছু মডেল আমদানি করা গেলেও সব অঙ্গরাজ্যে বিক্রি করা যায় না। কিছু তুর্কি সেমি-অটোমেটিক পিস্তল বড় ম্যাগাজিন ধারণক্ষমতার কারণে কয়েকটি রাজ্যে নিষিদ্ধ। তবে ডিলাররা সেই একই মডেল ছোট ম্যাগাজিন দিয়ে ওইসব রাজ্যে বিক্রি করেন।

যেসব অস্ত্র ‘খেলাধুলার উদ্দেশ্যে’ ব্যবহারের শর্তে আমদানির যোগ্যতা পায় না, সেগুলোও একসময় যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে বিক্রি হয়। এর উপায় হলো—অস্ত্রের অংশগুলো আমদানি করে যুক্তরাষ্ট্রে একটি নির্দিষ্ট পরিমাণ স্থানীয় যন্ত্রাংশসহ তা সংযোজন করা। আরেক উপায় হলো—বিদেশি কোম্পানিগুলো যুক্তরাষ্ট্রে নিজস্ব কারখানা খুলে নেয়। এতে পুরো আমদানি প্রক্রিয়াকেই বাইপাস করা সম্ভব।

২০২২ সালে এসওয়াইএসের একটি নতুন পিস্তল আমদানি পরীক্ষায় উত্তীর্ণ না হওয়ায়, এর অধীনস্থ কোম্পানি কানিক ইউএসএ সিদ্ধান্ত নেয় যুক্তরাষ্ট্রে তাদের প্রথম কারখানা তৈরি করার। ফ্লোরিডায় ডিসেম্বর মাসে চালু হওয়া সেই কারখানায় বর্তমানে এই নতুন কানিক পিস্তল তৈরি হচ্ছে এবং ভবিষ্যতে সেখান থেকে ভারী মেশিনগান ও মাঝারি ক্যালিবারের কামানও উৎপাদনের পরিকল্পনা রয়েছে।

এই পদক্ষেপের মাধ্যমে এসওয়াইএস জার্মানির সিগ সাউয়ার, অস্ট্রিয়ার গ্লোক, ইসরায়েলের আইডব্লিউআই ও ব্রাজিলের তাউরুসের মতো বিদেশি কোম্পানিগুলোর কাতারে যোগ দিলো। ওই কোম্পানিগুলো ইতোমধ্যেই যুক্তরাষ্ট্রে নিজস্ব উৎপাদন কেন্দ্র গড়ে তুলেছে। যুক্তরাষ্ট্রের মাটিতে কারখানা স্থাপনের ফলে এই কোম্পানিগুলোর পক্ষে সরকারী বড় চুক্তি পাওয়া সহজ হয়। সামরিক ঘরানার আগ্নেয়াস্ত্র তৈরির প্রক্রিয়া যুক্তরাষ্ট্রের সামরিক ঘাঁটিতে তুলনামূলক কম নিয়ন্ত্রিত। আর এতে বাড়তি সুবিধা পায় ওই কোম্পানিগুলো।

এই ধরনের ‘অনশোরিং’ কৌশল শুধু আমদানির সংখ্যাকে কমিয়ে আনে না, বরং এর মাধ্যমে যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে উৎপন্ন রাজস্ব শেষ পর্যন্ত ফেরত যায় সেই বিদেশি কোম্পানির মূল দেশের জাতীয় প্রতিরক্ষা শিল্পে।

গত বছর এসওয়াইএস প্রায় ১৯০ মিলিয়ন ডলার আয় করেছে, যা যুক্তরাষ্ট্রের পক্ষ থেকে তুরস্ককে প্রদত্ত সর্বোচ্চ নিরাপত্তা সহায়তার চেয়েও তিনগুণ বেশি। ২০২০ সালে ওয়াশিংটন এই সহায়তা হ্রাস করে এবং তুরস্কের রাশিয়ার কাছ থেকে এস-৪০০ ক্ষেপণাস্ত্র কেনার কারণে অস্ত্র রপ্তানি নিষিদ্ধ করে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে। 

বর্তমানে এসব নিষেধাজ্ঞা চলমান থাকলেও, যুক্তরাষ্ট্রের আগ্নেয়াস্ত্র ক্রেতারা একভাবে হলেও তুরস্কের কোম্পানিগুলোর সামরিক অস্ত্র উৎপাদনে আর্থিক সহায়তা দিয়ে চলেছেন—যেমন এসওয়াইএসের কামান, টারেট বা সারসিলমাজের ড্রোন সিস্টেম ও ‘কিলার রোবট’ তৈরি।

জাতিসংঘ কর্তৃক নিষিদ্ধ দেশগুলোতে সাধারণ অস্ত্র বিক্রি করে না তুরস্ক। তবে কিছু ব্যতিক্রম যে হয় না, তা নয়। কারণ ছোট অস্ত্র বিক্রি সহজে নজরদারির আওতায় আসে না। যুক্তরাষ্ট্র ও জার্মানির মতো শীর্ষ আগ্নেয়াস্ত্র রপ্তানিকারক দেশগুলো নিয়মিতভাবে তাদের অস্ত্র বিক্রির তথ্য প্রকাশ করে এবং সেই অস্ত্র কোথায় গিয়ে পৌঁছায় তাও ট্র্যাক করে। 

কিন্তু তুরস্ক এই তথ্য প্রকাশ করে না। তাছাড়া তারা এখন জাতিসংঘের ‘আর্মস ট্রেড ট্রিটি’ অনুস্বাক্ষর করেনি। সেখানে বলা আছে—যেসব দেশে অস্ত্র ব্যবহারের মাধ্যমে মানবাধিকার লঙ্ঘনের ‘গুরুতর ঝুঁকি’ রয়েছে, সেখানে অস্ত্র বিক্রি নিষিদ্ধ।

ফলে তুরস্ক কি পরিমাণ আগ্নেয়াস্ত্র বিদেশে বিক্রি করে, তার পূর্ণ তথ্য পাওয়া যায় না। তবে এসওয়াইএস ও সারসিলমাজের প্রতিবেদনে দেখা যায়, তুরস্কের পিস্তল পাকিস্তান, মিশর, সুদান, ইরাক ও ফিলিপাইনের পুলিশ ও সেনাবাহিনী কিনেছে। আবার ইন্টারপোল ও জাতিসংঘের রিপোর্টে দেখা গেছে, এই পিস্তলগুলো অবৈধভাবে পাচার হয়ে সাদ, বুরকিনা ফাসো ও লিবিয়ার মতো নিষেধাজ্ঞাপ্রাপ্ত দেশগুলোতেও পৌঁছেছে।

তুর্কি সেমি-অটোমেটিক শটগানও বিভিন্ন সংঘাতপূর্ণ অঞ্চলে বৈধ আগ্নেয়াস্ত্র বিক্রির বাজারে আধিপত্য বিস্তার করেছে। মধ্যপ্রাচ্যে ছোট অস্ত্র গবেষণায় নিয়োজিত সাবেক প্রতিরক্ষা পরামর্শক মাইলস ভাইনিং বলেন, তিনি আফগানিস্তান, ইরাক, মিয়ানমার ও সিরিয়ায় সর্বত্রই তুর্কি শটগান দেখেছেন। 

তিনি বলেন, অপরাধী চক্র ও বিদ্রোহীদের কাছে এসব অস্ত্র কেনা অত্যন্ত সহজ সিদ্ধান্ত। কারণ এগুলোর দাম কম, সহজলভ্য এবং এদের রয়েছে সামরিক বৈশিষ্ট্য—যেমন পিস্তল গ্রিপ ও ভাঁজযোগ্য বাট।

ভাইনিং বলেন, “এই বাজারের একটা বড় অংশ দখল করেছে তুর্কি অস্ত্র। কারণ অনেক সময় এগুলোই হলো সাধারণ মানুষের জন্য আইনি উপায়ে পাওয়া একমাত্র অস্ত্র।” এসব কর্তৃত্ববাদী দেশে সাধারণ মানুষের ওপর কঠোর আগ্নেয়াস্ত্র নিয়ন্ত্রণ আরোপ করা হয় এবং অস্ত্র নিষেধাজ্ঞার কারণে তারা বিদেশ থেকে আগ্নেয়াস্ত্র কিনতে পারে না। তবে শটগান বাদ পড়ে, কারণ প্রায় সর্বত্রই এগুলোর বিক্রি বৈধ।

সস্তা তুর্কি অস্ত্র বিশ্বের বিভিন্ন দেশের সেনাবাহিনী, বিদ্রোহী গোষ্ঠী এবং অপরাধী চক্রের হাতে ছড়িয়ে পড়েছে। এই বিস্তারের পেছনে যেমন যুক্তরাষ্ট্রের দুর্বল অস্ত্র নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা দায়ী, তেমনি দায়ী আন্তর্জাতিক অস্ত্র চোরাচালান প্রতিরোধে দুর্বল নজরদারি ব্যবস্থাও। 

তুর্কি অস্ত্র নির্মাতা কোম্পানিগুলোর খ্যাতি এবং মুনাফা বাড়াতে এই দুই কারণই সহায়ক হয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রের অভ্যন্তরীণ অস্ত্র আইন কঠোর করা আন্তর্জাতিক অস্ত্র নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থাকে কঠোর করার চেয়ে তুলনামূলকভাবে সহজ হলেও, বাস্তবে তা এখনও কঠিন ও অধরা রয়ে গেছে। এমনকি যুক্তরাষ্ট্রের যেসব রাজনৈতিক নেতা অস্ত্র নিয়ন্ত্রণে আগ্রহী, তারাও কার্যকর পরিবর্তন আনতে ব্যর্থ হচ্ছেন।

তবে ডোনাল্ড ট্রাম্পের প্রেসিডেন্সি এক্ষেত্রে একটি উল্লেখযোগ্য মোড় হতে পারে। গত তিন দশকে প্রথমবারের মতো তার প্রশাসন বিদেশি অস্ত্র আমদানির প্রবাহে বড় ধরনের পরিবর্তন আনতে পারে বলে ধারণা করা হচ্ছে। 

ট্রাম্পের প্রথম মেয়াদকালে যুক্তরাষ্ট্রের ব্যুরো অব অ্যালকোহল, টোব্যাকো, ফায়ারআর্মস অ্যান্ড এক্সপ্লোসিভসের একজন সহকারী উপপরিচালক প্রস্তাব করেছিলেন যে, অস্ত্র আমদানিতে “স্পোর্টিং পারপাসেস” বা খেলার উদ্দেশ্যে ব্যবহারের সংজ্ঞা আধুনিকায়ন করা হোক। 

ওই প্রস্তাবে বলা হয়েছিল, বর্তমানে খেলার জন্য ব্যবহৃত আগ্নেয়াস্ত্রের তালিকায় যেমন এআর-১৫ ও একে-৪৭ আছে। এগুলোকে নতুন সংজ্ঞার আওতায় আনা উচিত।

তবে এই মেয়াদে ট্রাম্পের প্রশাসন অস্ত্র প্রস্তুতকারকদের উপকারের চেয়ে ক্ষতি বেশি করে ফেলতে পারে। এটিএফের বাজেট, কর্মী সংখ্যা এবং কার্যক্ষমতা ব্যাপকভাবে কমিয়ে দেওয়ার প্রক্রিয়া চলছে। এমনকি সংস্থাটি বন্ধ হয়ে যাওয়ারও সম্ভাবনা তৈরি হয়েছে। এর ফলে অস্ত্র আমদানির ক্ষেত্রে কার্যত কোনও বাধা না থাকলেও, বাস্তবে দেখা দিতে পারে বিশৃঙ্খলা, বিলম্ব ও অনিশ্চয়তা।

দুবাইয়ে অনুষ্ঠিত এক সমরাস্ত্র মেলা।

এছাড়া চলমান বাণিজ্যিক অনিশ্চয়তা বৈশ্বিক অস্ত্র উৎপাদন ও সরবরাহের শৃঙ্খলকে জটিল করে তুলেছে। অনেক কোম্পানি এখন কানাডা, চীন এবং মেক্সিকোর মতো গুরুত্বপূর্ণ ইস্পাত ও যন্ত্রাংশ সরবরাহকারী দেশগুলো থেকে আলাদা হওয়ার চেষ্টা করছে। এর ফলে অস্ত্র উৎপাদনের খরচ বাড়বে এবং বিক্রি কমে যাবে বলে ধারণা করা হচ্ছে। 

বিশ্বজুড়ে অসম ট্যারিফ আরোপের আশঙ্কায় ইউরোপীয় ও আমেরিকান অস্ত্রের দাম বাড়তে পারে। বিপরীতে তুরস্কে তৈরি অস্ত্রের ওপর যুক্তরাষ্ট্রে মাত্র ১০ শতাংশ ট্যারিফ কার্যকর হয় এবং এসব অস্ত্র স্থানীয়ভাবে উৎপাদিত ইস্পাত দিয়ে তৈরি হয়। ফলে তুর্কি অস্ত্রের দাম তুলনামূলকভাবে কমই থাকবে।

ট্রাম্প প্রশাসনের প্রত্যাশা ছিল যে, এই ট্যারিফ নীতির মাধ্যমে বিদেশি অস্ত্র নির্মাতারা যুক্তরাষ্ট্রে উৎপাদন স্থাপন করতে উৎসাহিত হবে। কিন্তু বাস্তবে এর ফলে হয়তো এমন সব অস্ত্র প্রস্তুতকারকই লাভবান হবে, যাদের উৎপাদন খরচ বাড়েনি এবং যারা স্থান পরিবর্তনের কারণে ক্ষতিগ্রস্ত হয়নি। 

পরিস্থিতি এমন হলে তুর্কি অস্ত্র কোম্পানিগুলো কেবল বাণিজ্য যুদ্ধই টিকিয়ে রাখবে না, বরং এই পরিস্থিতি থেকে আরও শক্তিশালী হয়ে উঠবে।

আরও পড়ুন

সর্বশেষ

ads