গ্রামীণ ব্যাংক কার? সাধারণ কাউকে জিজ্ঞাসা করলে উত্তর আসবে মুহাম্মদ ইউনূসের। এই ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক হিসাবেই ২০০৬ সালে শান্তিতে নোবেল পুরস্কার পেয়েছিলেন তিনি, গ্রামীণ ব্যাংকও যে যৌথভাবে সেবারের নোবেল পুরস্কারটি পেয়েছিল, তা অনেকটা চাপাই পড়ে থাকে।
গ্রামীণ ব্যাংকের ওয়েবসাইটে প্রতিষ্ঠাতা হিসাবে ইউনূসের ছবিই ঝোলে সবার ওপরে। ১৯৮৩ সালের ২ অক্টোবর প্রতিষ্ঠার শুরু থেকেই বিশেষায়িত ব্যাংকটির ব্যবস্থাপনা পরিচালক ছিলেন তিনি। ২০১১ সালে তাকে সেই পদ থেকে আওয়ামী লীগ সরকার সরানোর আগে বোঝারই উপায় ছিল না যে এই ব্যাংকের মালিকানায় সরকারও আছে।
সেই পদ ধরে রাখতে আইনি লড়াই চালিয়ে তাতে হেরে গ্রামীণ ব্যাংকের নিয়ন্ত্রণও হারান ইউনূস; যদিও তার অভিযোগ, তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ব্যক্তিগত রোষের শিকার হতে হয়েছিল তাকে। তারপর আওয়ামী লীগ সরকার আমলে একের পর এক মামলায় তাকে জেরবার হতে হচ্ছিল।
তবে এক যুগ পরে দিন বদলেছে; গত বছরের জানুয়ারির প্রথম দিনেই এক মামলায় আদালতের কাঠগড়ায় দাঁড়িয়ে ছয় মাস কারাদণ্ডের আদেশ শুনতে হয়েছিল তাকে; তার সাত মাস ৫ দিনের মধ্যে ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে শেখ হাসিনা দেশছাড়া হওয়ার পর আন্দোলনকারীদের পছন্দে সরকার প্রধানের দায়িত্বে আসেন ইউনূস।
এরপর তার বিরুদ্ধে মামলাগুলো দ্রুত উল্টো দিকে গড়াতে শুরু করে। গত ৮ আগস্ট অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান উপদেষ্টা হিসাবে তার শপথ নেওয়ার আগেই দণ্ড থেকে খালাস পেয়ে যান তিনি। অন্য মামলাগুলো থেকেও পান অব্যাহতি। গ্রামীণ ব্যাংকের ওয়েবসাইটে তার হারানো ছবিও পুনরায় উঠে পড়ে।
যে আইনের বলে সরকার তাকে গ্রামীণ ব্যাংক ছাড়া করতে পেরেছিল, এখন সেই আইন সংশোধন করে গ্রামীণ ব্যাংকে সরকারের কর্ত্বত্ব ছেঁটে ফেলতে চাইছেন তিনি। তার সভাপতিত্বে উপদেষ্টা পরিষদে আইন সংশোধনের সেই প্রস্তাব অনুমোদনের পর এখন তার খসড়া দেওয়া হয়েছে আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগের ওয়েবসাইটে। যেহেতু এখন সংসদ নেই, তাই রাষ্ট্রপতির অধ্যাদেশ জারির মাধ্যমে সংশোধিত হবে আইনটি।
গ্রামীণ ব্যাংকের আইনটি যখন হয়েছিল, তখনও সংসদ ছিল না। ১৯৮৩ সালে তখন সামরিক শাসন চলছিল, এইচ এম এরশাদ ছিলেন প্রধান সামরিক আইন প্রশাসক। তখনও অধ্যাদেশ জারি করে কার্যকর করা হয়েছিল গ্রামীণ ব্যাংক আইন। এরপর ইউনূসকে গ্রামীণ ব্যাংকছাড়া করার পর ২০১৩ সালে আওয়ামী লীগ সরকার স্বাভাবিক প্রক্রিয়ায় অর্থাৎ সংসদে আইনটি সংশোধন করেছিল। এখন আবার প্রথমবারের মতো অধ্যাদেশ হচ্ছে।
আওয়ামী লীগের শাসনকালে সত্তরোর্ধ্ব বয়সে আদালতের বারান্দায় দৌড়াদৌড়ির সময় ইউনূস এক সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন, আইনটি হওয়ার সময় সরকারকে বেশি ক্ষমতা দিয়ে তিনি ‘ভুল’ করেছিলেন।
গত এক যুগে সেই ‘ভুলের মাশুল’ দিয়ে যাওয়া ইউনূস এখন সরকার প্রধানের ক্ষমতা পেয়ে দৃশ্যত সেই ‘ভুল’ শোধরানোর প্রয়াস চালাচ্ছেন।
যেভাবে শুরু
গ্রামীণ ব্যাংকের মতো একটি প্রতিষ্ঠানের স্বপ্ন অবশ্য সরকার নয়, ইউনূসই দেখেছিলেন। স্বাধীনতার পর চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে অর্থনীতি বিভাগে শিক্ষকতা করার সময় ক্যাম্পাসের পাশের জোবরা গ্রামে পতিত কৃষি জমি আবাদে স্থানীয়দের সহযোহিতা করতে গিয়ে ওই গ্রামের নারীদের সঙ্গে কথা হয় তার। তখনই বিনা জামানতে ঋণ দেওয়ার একটি ব্যাংক প্রতিষ্ঠার ধারণাটি তার মাথায় আসে।
এই নারীদের ঋণের ব্যবস্থা করার জন্য তিনি প্রথাগত বিভিন্ন ব্যাংকে গিয়ে বিফল হয়ে কৃষি ব্যাংকের দ্বারস্থ হয়েছিলেন। তখন কৃষি ব্যাংকের প্রকল্প হিসাবে ‘বাংলাদেশ কৃষি ব্যাংক, পরীক্ষামূলক গ্রামীণ শাখা’ নামে কর্মসূচি শুরু করেছিলেন তিনি। কিন্তু তাতেও কাজ হচ্ছে না দেখে তার মনে হয়, আলাদা একটি ব্যাংক লাগবে।
১৯৮২ সালে এরশাদের সামরিক সরকারের তৎকালীন অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিতের কাছে নিজের স্বপ্নের কথা জানান ইউনূস। মুহিতও সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দেন।
এই ঘটনাগুলো ২০০৩ সালের ১৭ অক্টোবর প্রথম আলো সম্পাদক মতিউর রহমানকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে তুলে ধরেন ইউনূস। তিনি বলেন, “তার (মুহিত) নিজের চেষ্টায় প্রেসিডেন্ট এরশাদকে রাজি করিয়ে আমার কথা মতো আলাদা আইন বানিয়ে ১৯৮৩ সালের ২ অক্টোবর আমরা গ্রামীণ ব্যাংক হিসাবে জন্মগ্রহণ করলাম।”
তার পরদিন ৩ অক্টোবর টাঙ্গাইলের জামুর্কী গ্রামে ভূমিহীন নারীদের অংশগ্রহণে গ্রামীণ ব্যাংকের উদ্বোধন অনুষ্ঠান হয়, তাতে মুহিতও যোগ দিয়েছেলেন।
মালিকানা নিয়ে দ্বন্দ্ব শুরুতেই
ওই সাক্ষাৎকারে ইউনূস বলেন, গ্রামীণ ব্যাংক অধ্যাদেশে সরকারের মালিকানা ৬০ ভাগ এবং গ্রামীণ ব্যাংকের সদস্যদের মালিকানা ৪০ ভাগ করা হয়, যা তাকে ক্ষুব্ধ করেছিল।
“আমি বলেছিলাম, ১০০ ভাগ গরিবের মালিকানা। তিনি (মুহিত) বললেন, ‘১০০ ভাগ রাজি করানো যাবে না, সরকারকে কিছু শেয়ার দাও’। তখন আমি ড. কামাল হোসেনের সঙ্গে আলাপ করে ওটা উল্টালাম, সরকারের ৪০ ভাগ, গরিবের ৬০ ভাগ। সরকার আবার সেটা উল্টে দিয়ে ৬০ ভাগ নিজের জন্য রেখে দিল।”
তখন নিজের ক্ষোভের কথা মুহিতকে বলেছিলেন ইউনূস। কিন্তু ‘মুহিত ভাই’ তাকে শান্ত করে বলেছিলেন, “দেখ, এছাড়া তো আমি পাস করাতে পারতাম না, গোটা কেবিনেটকে আমার রাজি করাতে হয়েছে, তুমি এটা করতে পারলে আস্তে আস্তে আমি পরিবর্তন করিয়ে দেব।”
সরকারের অংশ যেভাবে কমল
আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগের ওয়েবসাইটে ব্যাংক ও অ-ব্যাংক সংক্রান্ত আইনগুলো সব আছে পিডিএফ ফাইল আকারে। সেখানে গ্রামীণ ব্যাংক অধ্যাদেশ-১৯৮৩ এর শিরোনাম থাকলেও তা এখন খোলা যাচ্ছে না। তবে অন্য আইনগুলোর ফাইল ঠিকই খোলা যাচ্ছে।
আইন মন্ত্রণালয়ের ওয়েবসাইটে গিয়ে গ্রামীণ ব্যাংক অধ্যাদেশ-১৯৮৩ এর ইংরেজি ভার্সনটি খুঁজে পাওয়া যায়। সেখানে এই জলছাপও দেওয়া আছে যে অধ্যাদেশটি পরে বাতিল হয়েছে। অর্থাৎ এটি সংশোধন হয়েছে।
সেই অধ্যাদেশের ৭ নম্বর ধারায় আছে, গ্রামীণ ব্যাংকের পরিশোধিত মূলধন ৭ কোটি ২০ লাখ টাকা। এতে সরকারের অংশ ২৫ শতাংশ, আর ব্যাংকের ঋণগ্রহীতারা এর ৭৫ শতাংশের মালিক।
মতিউর রহমানকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে ইউনূস বলেছিলেন, শুরুতে সরকারের মালিকানা ৬০ শতাংশ হয়েছিল।
এটা পরিবর্তনে তিনি দেন-দরবার করেছিলেন মুহিতের সঙ্গে। মুহিত তাকে আশ্বাসও দিয়েছিলেন যে মালিকানার অংশ এক বছরের মধ্যে পরিবর্তন করে দেবেন। তবে এর মধ্যে মুহিত মন্ত্রিত্ব হারালে অর্থমন্ত্রী হন এম সাইদুজ্জামান। তখন তিনি তার কাছে গেলে সমস্যার সুরাহা হয়।
“তিনি পুরো বিষয়টি জানতেন। তিনি রাজি হলেন এবং করেও দিলেন। তিনি ব্যবস্থা করে না দিলে সব ভেস্তে যেত।”
তখন মালিকানার পরিবর্তনটি কী হয়েছিল, তা স্পষ্ট করে বলেননি ইউনূস। তবে তিনি আগেই বলেছিলেন, সরকারের ৪০% শরিকানায় তিনি রাজি ছিলেন।
২০০৩ সালে দেওয়া ওই সাক্ষাৎকারে আবার ইউনূস বলেছিলেন, তখন গ্রামীণ ব্যাংকের ৯৩% মালিকানা ঋণগ্রহীতাদের, আর সরকারের মালিকানা ৭ শতাংশ।
এরপর আওয়ামী লীগ সরকার যখন ২০১৩ সালে গ্রামীণ ব্যাংক আইন সংশোধন করে, তখন সরকারের মালিকানা আবার ২৫% এ ফিরিয়ে আনে, যা অধ্যাদেশে লেখা ছিল।
সংশোধনের পর ৭ নম্বর ধারায় লেখা হয়, ব্যাংকের পরিশোধিত শেয়ার মূলধন হবে ৩০০ কোটি টাকা। ২৫% সরকার বা তদ্কর্তৃক পরিচালিত বা নিয়ন্ত্রিত কোনও সংস্থা বা সংগঠনের; ৭৫% ব্যাংকের ঋণ গ্রহীতাদের।
এখন ইউনূস সরকার সেই ৭ ধারায় পরিবর্তন এনে লিখছে- ৫% মালিকানা হবে সরকার কিংবা তার অধীন কোনো সংস্থার, ৯৭% মালিকানা হবে ঋণ গ্রহীতাদের।
অর্থাৎ ২০০৩ সালে ইউনূসের (তখন তিনি ব্যবস্থাপনা পরিচালক) ভাষ্য অনুযায়ী যখন সরকারের অংশীদারি ৭% ছিল, এখন তা থেকেও কমে যাচ্ছে।
আর ব্যবস্থাপনা পরিচালকের চাকরিতে থাকলেও গ্রামীণ ব্যাংকের মালিকানায় ইউনূস কখনোই ছিলেন না।
সরকারের কর্তৃত্বও সঙ্কুচিত হচ্ছে
ব্যবস্থাপনা পরিচালকের পদ থেকে ইউনূসকে যে ক্ষমতায় সরিয়েছিল আওয়ামী লীগ সরকার, এখন সেই ক্ষমতাও ছেঁটে দেওয়া হচ্ছে।
ইউনূস এক সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন, “সরকার আমাকে বাধ্য করেছে পদটি ছেড়ে দিতে। সরকার যুক্তি দেখিয়েছে, ১১ বছর আগেই আমার রিটায়ার করার বয়স পেরিয়ে গিয়েছিল। যে আইনের দ্বারা ব্যাংকটি প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল তাতে রাজি হবার সময়ে আমাদের ম্যানেজিং ডিরেক্টর (যে পদে আমি আগে অধিষ্ঠিত ছিলাম) নিয়োগের কর্তৃত্ব দিয়েছিলাম সরকারকে। এটা ছিল আমার আরেকটি বড় ভুল।”
সেই ‘ভুল সংশোধনে’ এখন গ্রামীণ ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদের গঠনেও পরিবর্তন আসছে। প্রতিষ্ঠাকাল থেকেই ১২ সদস্যের পরিচালনা পর্ষদে চেয়ারম্যানসহ সরকারের মনোনীত তিনজন পরিচালক এবং ঋণগ্রহীতাদের নির্বাচিত নয়জন পরিচালক ছিলেন। এবার সংশোধনে বোর্ডে ১১ জন পরিচালক নির্বাচনের সুযোগ পাবেন ঋণগ্রহীতারা।
বর্তমান আইনে বোর্ডের চেয়ারম্যান নিয়োগের ক্ষমতা সরকারের হাতে থাকলেও প্রস্তাবিত খসড়ায় চেয়ারম্যান নির্বাচন বোর্ডের সদস্যদের মধ্য থেকেই করার বিধান রাখা হয়েছে।
এছাড়া প্রস্তাবে চেয়ারম্যান অক্ষম হলে, বোর্ডের সদস্যরা অন্য কোনো পরিচালককে ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান হিসেবে দায়িত্ব পালনের অনুমোদন দিতে পারবেন বলে বলা হয়েছে, যা এতদিন সরকারের হাতেই ছিল।
বর্তমান আইনে গ্রামীণ ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা সর্বোচ্চ ৬০ বছর বয়স পর্যন্ত দায়িত্ব পালন করতে পারতেন। তবে প্রস্তাবিত খসড়ায় নতুন একটি শর্ত যুক্ত করা হয়েছে— বোর্ডের অনুমোদনের ভিত্তিতে ব্যবস্থাপনা পরিচালকের মেয়াদ সর্বোচ্চ ৬৫ বছর পর্যন্ত বাড়ানো যেতে পারে।
ক্ষুদ্র একটি উদ্যোগ দিয়ে ক্ষুদ্র ঋণদাতা গ্রামীণ ব্যাংকের যাত্রা শুরু হলেও এখন তা রয়েছে বাংলাদেশের ৯৪ শতাংশ গ্রামে। এর ঋণগ্রহীতা সদস্য এক কোটির বেশি।
গ্রামীণ ব্যাংকের মোট ৪০টি জোনাল অফিস, ৪০টি জোনাল অডিট অফিস, ২৪০টি এরিয়া অফিস ও আড়াই হাজারের বেশি শাখা অফিসে মোট কর্মী ২৩ হাজার ৩১৯ জন।
গ্রামীণ ব্যাংক ২০২৪ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত ৩ লাখ ২২ হাজার কোটি টাকা ঋণ বিতরণ করেছে। আর এই ঋণগ্রহীতাদের ৯৭ শতাংশই নারী। এদের দুই-তৃতীয়াংশ ক্ষুদ্র ঋণ নিয়ে দারিদ্র্য ঘুচিয়েছেন বলে গ্রামীণ ব্যাংকের দাবি, যদিও টেকসই দারিদ্র্য বিমোচনে গ্রামীণ ব্যাংকসহ এনজিওগুলোর অবদান নিয়ে প্রশ্ন যেমন রয়েছে, তেমনি ঋণ আদায়ে তাদের কঠোরতা নিয়েও রয়েছে সমালোচনা।
এ সম্পর্কিত খবর: