প্রবাসী শ্রমিক সুরক্ষায় বাংলাদেশের ঘাটতি দেখছে আইএলও

বাংলাদেশের প্রবাসী শ্রমিকদের সুরক্ষায় কার্যকর পদক্ষেপ সময়ের দাবি। ছবি: আইএলও
বাংলাদেশের প্রবাসী শ্রমিকদের সুরক্ষায় কার্যকর পদক্ষেপ সময়ের দাবি। ছবি: আইএলও

প্রবাসে কর্মরত লাল লাখ বাংলাদেশি শ্রমিক শুধু বিভিন্ন দেশের অর্থনীতিতেই ভূমিকা রাখছেন তা নয়, পাশাপাশি নিজের দেশের উন্নয়নেও তাদের অবদান অপরিসীম।

তবে তাদের এই যাত্রাটা নানা চ্যালেঞ্জে ভরা থাকায় পদ্ধতিগত সংস্কার প্রয়োজন বলে মনে করে আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থা-আইএলও।

বাংলাদেশের শ্রমিকরা যাতে বিদেশের মাটিতে আরো ন্যায্যতার সাথে কাজ করতে পারেন, সেজন্য জনশক্তি রপ্তানির প্রক্রিয়া সংস্কারের বিষয়ে একটি সংলাপ আহ্বান করেছিল আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থা-আইএলও।

নীতিনির্ধারক, নিয়োগদাতাদের প্রতিনিধি, সিএসও এবং বিশেষজ্ঞদের সেই সংলাপে একটা বিষয়ে সবাই একমত হন, অভিবাসী শ্রমিকদের সুরক্ষায় বাংলাদেশে যথেষ্ট আইন, নীতিমালা এবং প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামো থাকলেও তাদের কল্যাণ এবং নিরাপত্তা নিশ্চিতের জায়গায় যথেষ্ট ফাঁক রয়ে গেছে।

সংলাপে বক্তারা বাংলাদেশ থেকে জনশক্তি রপ্তানিতে মাত্রাতিরিক্ত খরচ থেকে শুরু করে বিভিন্ন চ্যালেঞ্জের বিষয় তুলে ধরেন।

বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর ২০২০ সালে করা অভিবাসন ব্যয় বিষয়ক একটি জরিপের বরাতে আইএলও জানিয়েছে, বিদেশে কাজ পেতে বাংলাদেশি শ্রমিকরা যে অর্থ ব্যয় করেন, সেটি পুনরুদ্ধার করতে তাদের কমপক্ষে ১৭ মাস করে সময় লাগে।

ভিসা বাণিজ্য, নিয়োগে অনিয়ম, দালালচক্রের ওপর অতিরিক্ত নির্ভরশীলতার পাশাপাপশি অপ্রকাশ্য অনেক ব্যয় বাংলাদেশের জনশক্তি রপ্তানির বাজারকে নষ্ট করেছে, এসব কারণে বাংলাদেশি শ্রমিকদের বিদেশে কাজ নিয়ে যাওয়ার ব্যয়ও অনেক বেশি।

এর সঙ্গে রয়েছে শ্রমিক নিয়োগে অস্বচ্ছ প্রক্রিয়া। যেখানে একটি অসাধু সিন্ডিকেট এবং তাদের স্বার্থ জড়িত। জনশক্তি রপ্তানিতে বিভিন্ন দেশের সঙ্গে বাংলাদেশের দ্বিপক্ষীয় ব্যবস্থা থাকার পরও দীর্ঘদিন ধরেই এই অসাধু চর্চা চলে আসছে।

বাংলাদেশে ব্যাঙের ছাতার মতো গজিয়ে ওঠা রিক্রুটিং এজেন্সিও একটি সমস্যা। কঠোর তদারকি এবং কোনো পরিশ্রম ছাড়াই নিয়ন্ত্রণহীন সাব-এজেন্টদের সহযোগিতায় চলছে এসব রিক্রুটিং এজেন্সি। এতে একদিকে কর্মীদের শোষণ যেমন বাড়ছে অন্যদিকে কর্মী নিয়োগে আস্থাহীনতাও তৈরি হচ্ছে।

কঠোর জবাবদিহিমূলক ব্যবস্থা এবং সংস্কার ছাড়া এই সমস্যা শ্রমিকদের সুরক্ষা এবং কল্যাণ বাধাগ্রস্ত করতেই থাকবে বলে মনে করে আইএলও।

নারী অভিবাসী শ্রমিকদের ক্ষেত্রে পরিস্থিতি আরও ভয়ঙ্কর। প্রায়ই তারা কম ‘স্থিতিশীল’ প্রতিষ্ঠানে কাজ করতে বাধ্য হন। এছাড়া কম দক্ষ, কম বেতনে কোনো শ্রমঅধিকার ছাড়াই অনানুষ্ঠানিক কাজ করতে হয় তাদেরকে।

প্রায়ই বিনা নোটিসে তাদের কাজ বন্ধ করে দিয়ে বাংলাদেশে ফেরত পাঠানোর ঘটনাও ঘটে। সুনির্দিষ্ট নীতিমালা এবং সুরক্ষা দেওয়ার মতো শ্রমবাজার বিষয়ক কৌশল না থাকাটা নারীদের ভোগান্তি বাড়িয়ে তোলে।

আরেকটি চ্যালেঞ্জ হচ্ছে, রেমিটেন্সের সুব্যবস্থাপনা এবং স্বাভাবিক ব্যাংক ব্যবস্থার ওপর আস্থার ঘাটতি। যার ফলে বাংলাদেশি অভিবাসী কর্মীরা ঝূঁকিপূর্ণ এবং ব্যয়বহুল অবৈধ পথে রেমিটেন্স পাঠানোর দিকে ঝুঁকছেন।

২০২৩ সাল থেকে রেমিটেন্স প্রবৃদ্ধিতে ধীরগতি সেই আস্থাহনীতারই বড় প্রতিফলন বলে মনে করে আইএলও।

কী করছে শ্রম সংস্কার কমিশন

আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর বাংলাদেশের বিভিন্ন খাতের সংস্কারে যেসব কমিশন করা হয়েছে তার মধ্যে অন্যতম হচ্ছে শ্রম সংস্কার কমিশন। বিদেশে জনশক্তি রপ্তানিতে সুশাসন আনতে এই কমিশন বিভিন্ন উদ্যোগ নেওয়ার কথা বলছে।

আইএলও বলছে, আকাশচুম্বি অভিবাসন ব্যয়ের অনুঘটক ভিসা বাণিজ্য এবং একচেটিয়া ব্যবসার রাশ টানতে বাংলাদেশে একটি জবাবদিহিমূলক ব্যবস্থা গড়ে তোলা প্রয়োজন। এছাড়া অবশ্যই স্বচ্ছ নিয়োগ প্রক্রিয়ার পাশাপাশি সরকারের কঠোর নজরদারির মধ্যে বেসরকারি খাতের শক্তিশালী অংশগ্রহণও নিশ্চিত করতে হবে। 

সমন্বিত শ্রমিক রেজিস্ট্রার তৈরি এবং তথ্যভিত্তিক সিদ্ধান্ত গ্রহণে ডিজিটাইজেশনের মাধ্যমে অভিবাসন খাতের সুশাসন শক্তিশালী করা যেতে পারে বলে মনে করে আইএলও।

এক্ষেত্রে জবাবদিহিতা ও স্বচ্ছতা নিশ্চিতের প্রথম পদক্ষেপ হিসেবে বলা যেতে পারে অভিবাসন বিষয়ক তথ্যভাণ্ডারের সঙ্গে জনশক্তি কর্মসংস্থানও প্রশিক্ষণ ব্যুরোর (বিএমইটি) কার্ডের সংযোগ স্থাপনকে।

আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থা বলছে, বৈশ্বিক বাজারের চাহিদার সঙ্গে তাল মিলিয়ে প্রয়োজনীয় কারিগরি প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করে শ্রমিকদের দক্ষতা ও উৎপাদনশীলতা বাড়াতে পারে বাংলাদেশ সরকার। 

সরকারি-বেসরকারি অংশীদারত্বের মাধ্যমে অভিবাসী শ্রমিকদের দক্ষতা বাড়ানো যেতে পারে। ফলে দক্ষতাভিত্তিক প্রশিক্ষণ স্বল্প দক্ষ অভিবাসী কর্মীদেরকে উচ্চ পারিশ্রমিকের কর্মসংস্থানে সুযোগ পাওয়ার মতো করে গড়ে তুলবে। বাংলাদেশ অভিবাসী শ্রমিকদের জন্য সামাজিক সুরক্ষা স্কিম তৈরি করতে ইন্দোনেশিয়া এবং ফিলিপাইনের কাছ থেকেও শিক্ষা নিতে পারে।

আইএলওর ভাষ্য, প্রতিটি পর্যায়ে নিরবচ্ছিন্ন সেবা নিশ্চিতে মন্ত্রণালয় এবং বিভিন্ন বিভাগের জন্য সুস্পষ্ট নির্দেশনাসহ প্রাতিষ্ঠানিক সংস্কার অপরিহার্য। একইভাবে, ওয়েজ আর্নার্স ওয়েলফেয়ার বোর্ড এবং প্রবাসী কল্যাণ ব্যাংকের মাধ্যমে দেওয়া অভিবাসী কল্যাণ তহবিলের পরিচালনা আইনের শক্তিশালী প্রয়োগ এবং দুর্নীতিবিরোধী ব্যবস্থার মাধ্যমে অবশ্যই স্বচ্ছভাবে হতে হবে।

আইএলও বলছে, নারী অভিবাসী শ্রমিকদের নিরাপত্তা ও ক্ষমতায়ন নিশ্চিতে সব সংস্কার অবশ্যই লিঙ্গ সমতাভিত্তিক হতে হবে। আনুষ্ঠানিক এবং নিরাপদ অভিবাসন চ্যানেলে তাদের অংশগ্রহণ বাড়ানোর জন্য সময়পোযোগী, সুনির্দিষ্ট লক্ষ্য নির্ধারণ করা উচিত।

সবমিলিয়ে এসব চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় সরকার এবং সমাজের অঙ্গীকার প্রয়োজন। বিদেশে প্রতিবছর ১৩ লাখ কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা হয়। ফলে বাংলাদেশ ও তার অংশীদাররা অভিবাসী কর্মীদের ত্যাগ ও অবদানকে অবহেলা করতে পারে না।

অভিবাসী শ্রমিকদের সুরক্ষা দেওয়া এবং শ্রমিক হিসেবে তাদের অধিকার সমুন্নত রাখতে প্রশাসনিক সংস্কারের মাধ্যমে তাদের অধিকারকে সম্মান করা উচিত বলে মনে করে আইএলও।

টেকসই অর্থনৈতিক উন্নয়নের একটি শক্তিশালী ভিত্তি তৈরির জন্য, শ্রমিকদের আকাঙ্ক্ষাকে প্রতিফলিত করার জন্য অভিবাসনকে নিরাপদ, ন্যায্য এবং আরও মর্যাদাপূর্ণ করে তোলে এমন সংস্কারের প্রতি সবাইকে অঙ্গীকারাবদ্ধ হওয়ার জানিয়েছে আইএলও।

আরও পড়ুন