ভারতের সঙ্গে সম্পর্ক এখন ‘খুবই ভালো’- মুহাম্মদ ইউনূস এমন দাবি করার পর সপ্তাহ না গড়াতেই ভারতের পক্ষ থেকে যে বক্তব্য এল, তাতে আর যাই হোক, এটা বোঝা যাচ্ছে না যে দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কে অবনতির ধারায় কোনো পরিবর্তন এসেছে।
শুক্রবার ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সাপ্তাহিক সংবাদ সম্মেলনে মন্ত্রণালয়ে মুখপাত্র রণধীর জয়সওয়াল যেভাবে বাংলাদেশের অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের কাজ নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন, তাতে এই ইঙ্গিতই পাওয়া যায় যে গত সাত মাস ধরে সম্পর্কের যে শীতলতা, তা এখনও কাটেনি।
ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে গত বছরের আগস্টে শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান উপদেষ্টার দায়িত্ব নেওয়ার সময়ই ভারতকে প্রচ্ছন্ন হুমকি দিয়ে ইউনূস বলেছিলেন, বাংলাদেশ অস্থির থাকলে প্রতিবেশী দেশটির উত্তর-পূর্বাঞ্চলও স্থিতিশীল থাকবে না।
অন্তর্বর্তী সরকারের দায়িত্ব নেওয়ার পর থেকেই দিল্লির সঙ্গে ঢাকার সম্পর্ক শীতল। সেই বরফ আরও জমে হিন্দু ধর্মীয় নেতা চিন্ময় ব্রহ্মচারী গ্রেপ্তারের পর পাল্টাপাল্টি প্রতিক্রিয়ায়। মাঝে বন্যার জন্য ভারতকে দায়ী করে বক্তব্য, সীমান্তে সংঘাত, ভারতের অংশকে যুক্ত করে বাংলাদেশের মানচিত্র তৈরি করে একজন উপদেষ্টার ফেইসবুক পোস্ট, এমন নানা কিছু কূটনৈতিক টানাপড়েন বাড়িয়েই তোলে।
ডিসেম্বরে ভারতের পররাষ্ট্র সচিব বিক্রম মিস্ত্রি ঢাকা ঘুরে গেলেও পরিস্থিতির যে খুব উন্নতি হয়েছে, তার কোনো আঁচ পাওয়া যায়নি। বাংলাদেশিদের জন্য ভারতের ভিসা এখনও স্বাভাবিক নয়।
এরমধ্যে ভারতে আশ্রয় নেওয়া শেখ হাসিনাকে ফেরত চেয়ে কূটনৈতিক চিঠি চালাচালি এবং তানিয়ে নানা বক্তব্যও দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কে প্রভাব রেখে চলেছে।
বাংলাদেশ সরকারের আচরণে দৃশ্যত উষ্মা প্রকাশ করে সম্প্রতি ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী এস জয়শঙ্কর বলেছিলেন, দিল্লির সঙ্গে কেমন সম্পর্ক চায়, তা ঢাকাকেই ঠিক করতে হবে।
গত ২৩ ফেব্রুয়ারি দিল্লি ইউনিভার্সিটিতে এক অনুষ্ঠানে তিনি বলেছিলেন, “বাংলাদেশের অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের কোনো সদস্য যদি প্রতিদিন সবকিছুর দোষ ভারতের ওপর চাপাতে থাকেন… আমি যদি প্রতিদিন সকালে উঠেই আপনাকে দোষারোপ করতে থাকি, তখন আপনি একা একা বলতে পারবেন না যে আমি আপনার সাথে ভালো সম্পর্ক চাই।”
বাংলাদেশকে নিয়ে জয়শঙ্করের ওই বক্তব্যের এক সপ্তাহ বাদেই গত ৩ মার্চ বিবিসি বাংলাকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে ইউনূস বলেন, ভারতের সঙ্গে সম্পর্ক এখনও ভালো আছে, ভবিষ্যতেও ভালো থাকবে।
“বাংলাদেশ-ভারতের সম্পর্ক ভালো না থেকে উপায় নেই। আমাদের সম্পর্ক ঘনিষ্ঠ, আমাদের পরস্পরের ওপর নির্ভরশীলতা এত বেশি এবং ঐতিহাসিকভাবে, রাজনৈতিকভাবে, অর্থনৈতিকভাবে আমাদের এত ক্লোজ সম্পর্ক, সেটা থেকে আমরা বিচ্যুত হতে পারব না।”
এই সম্পর্কের আকাশে মাঝে মেঘ দেখা দিলেও তা কেটে গেছে দাবি করে তিনি বলেছিলেন, “মাঝখানে কিছু কিছু দ্বন্দ্ব দেখা দিয়েছে, আমি বলেছি মেঘ দেখা দিয়েছে। এই মেঘগুলো মোটামুটি এসেছে অপপ্রচার থেকে। অপপ্রচারের সূত্র কারা সেটা অন্যরা বিচার করবে। কিন্তু এই অপপ্রচারের ফলে আমাদের সঙ্গে একটা ভুল বোঝাবুঝি হয়ে গেছে। সেই ভুল বোঝাবুঝি থেকে আমরা উত্তরণের চেষ্টা করছি।”
প্রধান উপদেষ্টার দায়িত্ব নেওয়ার পর পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে দুবার বৈঠক করলেও ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর দেখা এখনও পাননি ইউনূস। যদিও মোদী যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের সঙ্গে বাংলাদেশ প্রসঙ্গেও কথা বলে এসেছেন গত মাসে।
অন্যদিকে সাক্ষাৎকারে ইউনূস ভারতের সঙ্গে যোগাযোগ থাকার কথা জানিয়ে বলেছিলেন, “সবসময় যোগাযোগ হচ্ছে। তারা এখানে আসছে, আমাদের লোকজন সেখানে যাচ্ছে। প্রাইম মিনিস্টার মোদীর সঙ্গে আমার প্রথম সপ্তাহেই কথাবার্তা হয়ে গেছে।”
তার সেই বক্তব্যে যখন সম্পর্কে উষ্ণতা ফেরার আঁচ পাওয়া যাচ্ছিল, তা শীতল হয়ে গেল চার দিন পর শুক্রবার জয়সওয়ালের সংবাদ সম্মেলনে।
বাংলাদেশে হিন্দুদের ওপর নির্যাতন নিয়ে ভারত এতদিন ধরে যে অসন্তোষ জানিয়ে আসছিল, সেই একই বয়ান এসেছে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্রের কাছ থেকে।
সেই সঙ্গে তিনি আরও বলেছেন, বাংলাদেশের আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ে তাদের উদ্বেগ তো কাটেইনি, বরং তা আরও বাড়িয়ে তুলেছে কারাগার থেকে পালানো জঙ্গিরা এখনও ধরা না পড়ায়।
ভারতে অবস্থানরত শেখ হাসিনার প্রশ্নেও দিল্লির অবস্থান বদলানোর কোনো কথা আসেনি জয়সওয়ালের কাছে থেকে।
তার সংবাদ সম্মেলন নিয়ে বিবিসি বাংলার শুভজ্যোতি ঘোষের দিল্লি থেকে পাঠানো প্রতিবেদনে বলা হয়, “ভারতের পক্ষ থেকে আজ কার্যত স্পষ্ট করে দেওয়া হয়েছে, গত কয়েক মাস ধরে দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কের যে গতিপ্রকৃতি, তাতে ভারতের দৃষ্টিতে অন্তত কোনও পরিবর্তন আসেনি।
“এদিন ভারত সরকারের অন্তত তিন-চারটি বক্তব্য থেকে তাদের এই মনোভাব পরিষ্কার হয়ে গেছে। কয়েক মাস আগেও তারা এই প্রশ্নগুলোতে যে সুরে কথা বলেছিলেন, আজও অবিকল সেই ভাষা ও ভঙ্গিতেই অভিযোগগুলোর পুনরাবৃত্তি করেছেন।”
রণধীর জয়সওয়াল এদিনও বাংলাদেশে হিন্দুসহ ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের ওপর নির্যাতনের ঘটনায় ভারত চিন্তিত থাকার কথা জানান।
তিনি বলেন, “গত বছরের ৬ অগাস্ট থেকে এ বছরের ১৬ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত সংখ্যালঘুদের ওপর সে দেশে যে ২৩৭৪টি হামলার ঘটনা ঘটেছে, তার মধ্যে মাত্র ১২৫৪টি পুলিশ যাচাই করেছে এবং এর মধ্যেও ৯৮ শতাংশ হামলাই রাজনৈতিক চরিত্রের বলে খারিজ করে দেওয়া হয়েছে।”
বাংলাদেশে হিন্দু ও অন্য সংখ্যালঘুদের জীবন, সম্পত্তি ও ধর্মীয় উপাসনালয় রক্ষার দায়িত্ব পালনে যে অন্তর্বর্তী সরকার ব্যর্থ হচ্ছে, তা-ই বুঝিয়েছেন তিনি।
বাংলাদেশে আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতির ক্রমাবনতির কথাও বলেছেন জয়সওয়াল। তিনি আরও উদ্বিগ্ন হয়ে বলেছেন, “সেখানে গুরুতর অপরাধে সাজাপ্রাপ্ত উগ্রপন্থী লোকজনকেও যেভাবে জেল থেকে ছেড়ে দেওয়া হচ্ছে, তাতে পরিস্থিতি আরও খারাপের দিকে যাচ্ছে।”
বাংলাদেশে পরবর্তী নির্বাচন সবার অংশগ্রহণে হওয়া উচিৎ বলে মন্তব্য করেছেন তিনি। এর মধ্য দিয়ে আওয়ামী লীগকেও নির্বাচনে অংশ নেওয়ার সুযোগ দেওয়ার বিষয়টি ফুটে উঠেছে, যেখানে ইউনূস সরকারের নেপথ্যে থাকা অভ্যুত্থানকারীরা আওয়ামী লীগকে রাজনীতিতে ফিরতে দিতে নারাজ।
সাক্ষাৎকারে বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্কে ভুল বোঝাবুঝি তৈরিতে তৃতীয় পক্ষের অপপ্রচারের যে কথা ইউনূস বলেছেন, সেই বিষয়ে দিল্লির কূটনীতিকরা একমত নয় বলে বিবিসি বাংলার শুক্রবারের প্রতিবেদনে বলা হয়।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের উচ্চ পর্যায়ের একটি সূত্র বিবিসি বাংলাকে বলেছে, “উনি (ইউনূস) কি শেখ হাসিনার কথা বলতে চাইছেন? তাহলে নাম করে পরিষ্কার বলছেন না কেন?
“আর শেখ হাসিনাকে তো ওনারা বিচারের জন্য ফেরত পাঠানোর অনুরোধ করেছেন। আমরা আগেই বলেছি সেই চিঠি পেয়েছি, চিঠির বক্তব্য খতিয়ে দেখা হচ্ছে। আমাদের সেই আগের অবস্থানই বহাল আছে। ফলে এখন আর সেটা নিয়ে কথা বলা সমীচীন নয়।”
তাহলে ভারত ও বাংলাদেশের সম্পর্ক স্বাভাবিকই আছে- ইউনূসের এই বক্তব্যের প্রতিক্রিয়ায় ওই কর্মকর্তা বলেন, “আমরা কী ধরনের বাংলাদেশ দেখতে চাই, কেন চাই- বাংলাদেশ স্থিতিশীল, শান্তিপূর্ণ, অন্তর্ভুক্তিমূলক ও প্রগতিশীল হোক, তা আগেও অজস্রবার বলেছি, এখনও তাই বলছি। এ বিষয়ে নতুন করে আমাদের আর কিছু বলার আছে বলে মনে করি না।”