দুবাই ঘুরে ভারতের চাল বাংলাদেশে: ক্রেডেন্টওয়ান কারা? কীইবা তাদের ব্যবসা?

দুবাই থেকে চাল আমদানির সিদ্ধান্ত ঘিরে বাংলাদেশে শুরু হয়েছে ব্যাপক আলোচনা।
দুবাই থেকে চাল আমদানির সিদ্ধান্ত ঘিরে বাংলাদেশে শুরু হয়েছে ব্যাপক আলোচনা।

সংযুক্ত আরব আমিরাতভিত্তিক কোম্পানি ক্রেডেন্টওয়ান এফজেডসিও’র মাধ্যমে চাল আমদানির সিদ্ধান্তকে ঘিরে ব্যাপক আলোচনা শুরু হয়েছে বাংলাদেশে।

কারণ এই কোম্পানি মূলত বিজনেস কনসালটেন্সি, অফশোর কোম্পানি গঠন ও হীরার ব্যবসা নিয়ে কাজ করার অভিজ্ঞতা সম্পন্ন। কৃষিপণ্য, বিশেষ করে চাল বাণিজ্যে তাদের এমন কোনো অভিজ্ঞতার সন্ধান মেলেনি।

খাদ্য মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তাদের বরাতে জানা গেছে, এই চুক্তির আওতায় ভারত থেকে ক্রেডেন্টওয়ান এফজেডসিও’র আমদানি করা চাল পুনরায় আমদানি করবে বাংলাদেশ।

নতুন এই বাণিজ্যপথকে কেন্দ্র করে সমালোচনার মূল কারণ- ভারত বাংলাদেশের সর্ববৃহৎ চাল রপ্তানিকারক দেশ এবং দুই দেশের মধ্যে সরাসরি দ্বিপাক্ষিক বাণিজ্য সম্পর্ক বিদ্যমান।

ত্রিমুখী বাণিজ্যপথ

প্রথম দেখাতেই এই ব্যবস্থাটি অনেকের কাছে যেমন বিস্ময়কর লেগেছে, তেমনি তৈরি করেছে প্রশ্ন। কারণ, ভারতীয় রপ্তানিকারকদের কাছ থেকে সরাসরি চাল কেনার পরিবর্তে বাংলাদেশ বেছে নিয়েছে একটি সংযুক্ত আরব আমিরাতভিত্তিক মধ্যস্থতাকারী কোম্পানি, যারা কাজ করে নতুন ব্যবসা প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলার জন্য পরামর্শদাতা হিসেবে।

পাশাপাশি হীরা বাণিজ্যেও তাদের অভিজ্ঞতা আছে। তবে, কৃষিপণ্য বাণিজ্যে বাংলাদেশের চালানেই অভিষেক।

খাদ্য অধিদপ্তরের জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তা মো. মনিরুজ্জামান এর বরাতে সাম্প্রতিক দেশকাল এক প্রতিবেদনে লিখেছে, চালের প্রকৃত উৎস ভারত, যদিও সরবরাহকারীর অফিস দুবাইয়ে অবস্থিত।

মনিরুজ্জামান বলেছেন, “চাল সরবরাহকারীর অফিস দুবাই। এখন দুবাই থেকে চাল আমদানি যদি মিডিয়ায় আসে আমরা কী বলব? আসলে চালের সোর্স হলো ইন্ডিয়া।”

এই বক্তব্য থেকে স্পষ্ট হয় যে, কাগজে-কলমে চালটি সংযুক্ত আরব আমিরাত থেকে আমদানি করা হলেও আসলে তা ভারতের চাল, যা দুবাই ঘুরে বাংলাদেশে আসছে। ফলে এই নতুন বাণিজ্যপথে আমদানির কারণে স্বাভাবিকভাবেই লজিস্টিক জটিলতা ও ব্যয় উভয়ই বেড়ে যাওয়ার আশঙ্কা দেখা দিয়েছে।

কৌশলগত কারণ বাণিজ্য ঘাটতি

সরকারি সূত্রগুলো এই অস্বাভাবিক বাণিজ্যপথের একটি ব্যাখ্যা দিয়েছে। তাদের দাবি, বাংলাদেশ পদক্ষেপের মাধ্যমে ভারতের সঙ্গে বিদ্যমান বাণিজ্য ঘাটতি আরও না বাড়ানোর চেষ্টা করছেন তারা।

“এখানে ট্রান্সপোর্টেশন না, প্রাইস না, দুই দেশের যে অসম বাণিজ্য ঘাটতি, সেই বিষয়গুলো এখানে জড়িত। হয়তো ভারত থেকে বাংলাদেশ আমদানি আর বাড়াতে চাচ্ছে না,” বলেছেন কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের অতিরিক্ত পরিচালক মো. জামাল উদ্দীন।

তার মন্তব্য থেকে এটি স্পষ্ট, সরকারের সিদ্ধান্তের পেছনে ক্রয় প্রক্রিয়ার দক্ষতার চেয়ে বরং সামষ্টিক অর্থনৈতিক কূটনীতির ভাবনা বেশি কাজ করেছে। এটি সম্ভবত বাণিজ্যিক রুট ও অংশীদারদের বৈচিত্র্য আনার একটি প্রচেষ্টা, যাতে ভারতের ওপর নির্ভরশীলতা কিছুটা কমানো যায়। তবে বিশেষজ্ঞদের মতে, এই পদক্ষেপের ফলে অতিরিক্ত অর্থনৈতিক চাপ ও ব্যয়ের বোঝা শেষ পর্যন্ত জনগণের ওপরই পড়তে পারে।

অর্থনীতিবিদ এবং বাণিজ্য বিশ্লেষকরা এই সিদ্ধান্তের সমালোচনা করেছেন। তাদের মতে, চালের বাণিজ্যে পূর্ব অভিজ্ঞতা নেই এমন একটি মধ্যস্থতাকারী কোম্পানিকে সম্পৃক্ত করা স্বচ্ছতা ও বিশ্বাসযোগ্যতার প্রশ্ন তোলে।

বিশ্বাসযোগ্যতার প্রশ্ন

ক্রেডেন্টওয়ান এফজেডসিওকে ঘিরে বিতর্ক মূলত এর ব্যবসায়িক পটভূমি থেকে উদ্ভূত।

সংযুক্ত আরব আমিরাতের অফিসিয়াল কর্পোরেট রেকর্ড এবং কোম্পানির নিজস্ব অনলাইন থেকে জানা যাচ্ছে যে এটি মূলত দুবাইয়ের ফ্রি জোনে উদ্যোক্তাদের জন্য কর্পোরেট সেটআপ ও পরামর্শ সেবা প্রদান করে। কৃষিপণ্য বাণিজ্য, কমোডিটি ব্রোকারেজ বা খাদ্য আমদানি/রপ্তানি কার্যক্রমে এর পূর্ব অভিজ্ঞতার কোন প্রমাণ নেই।

সে কারণেই প্রশ্ন কেন এমন একটি কোম্পানিকে সংবেদনশীল জাতীয় ক্রয়-চুক্তিতে বেছে নেওয়া হয়েছে, যেখানে প্রয়োজনীয় খাদ্যশস্য জড়িত?

ক্রেডেন্টওয়ানের ওয়েবসাইট থেকে নেওয়া।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, অসংশ্লিষ্ট ব্যবসায়িক প্রোফাইলের কোম্পানি ব্যবহার করলে দায়িত্ব ও জবাবদিহিতার ক্ষেত্রে ফাঁক তৈরি হতে পারে, বিশেষ করে যখন সার্বজনীন অর্থ ও খাদ্য নিরাপত্তা জড়িত। উদ্বেগ শুধুমাত্র কার্যকারিতার নয়, বরং অতিরিক্ত দাম, সীমিত তদারকি এবং অফশোর লেনদেনের ঝুঁকি নিয়েও।

অফশোর বাণিজ্য ঝুঁকি

বিশ্লেষকরা মনে করেন, প্রয়োজনীয় পণ্য আমদানিতে অফশোর মধ্যস্থতাকারী ব্যবহার প্রায়ই খরচ বৃদ্ধি করে। প্রতিটি অতিরিক্ত ধাপ, যেমন এখানে ভারত থেকে দুবাই এবং তারপর বাংলাদেশে চাল পাঠানো- হ্যান্ডলিং, ডকুমেন্টেশন সব মিলিয়ে খরচ অনেক বেড়ে যায়।

যেহেতু বাংলাদেশ এবং ভারত উভয়ই প্রতিষ্ঠিত বাণিজ্য পথের অংশ, তাই এই ঘুরপথটি অর্থনৈতিকের চেয়ে রাজনৈতিক কারণে বেশি প্রযোজ্য মনে হচ্ছে।

সরকারের কৌশলগত প্রতিরক্ষা

খাদ্য মন্ত্রণালয়ের সূত্র জানিয়েছেন, এই ক্রয় সিদ্ধান্তটি আন্তর্জাতিক ক্রয় আইন অনুযায়ী খোলা দরপত্র প্রক্রিয়ার মাধ্যমে গৃহীত হয়েছে। কর্মকর্তারা জোর দিয়ে বলছেন, ক্রেডেন্টওয়ান এফজেডসিও-কে বেছে নেওয়া বৈধ, কারণ তারা দরপত্রের সব প্রযুক্তিগত ও আর্থিক শর্তাবলী পূরণ করেছে।

তবে সমালোচকরা মনে করছেন, দরপত্রের আনুষ্ঠানিকতা মেনে চলা নীতি-সিদ্ধান্তের বৈধতা নিশ্চিত করে না। যখন মূলত পরামর্শ সেবা দিয়ে আসা একটি কোম্পানি হঠাৎ করে চাল সরবরাহে যুক্ত হয়, তখন স্বাভাবিকভাবেই মূল্যায়ন মানদণ্ড এবং তদারকি প্রক্রিয়া নিয়ে প্রশ্ন ওঠে।

নীতিগত প্রভাব

এই ঘটনাটি বাংলাদেশের সরকারি ক্রয় ব্যবস্থার গভীর ত্রুটি তুলে ধরে। প্রায়ই দরপত্রে মূল্য প্রতিযোগিতাকে বেশি গুরুত্ব দেওয়া হয়, কিন্তু সরবরাহকারীর মূল দক্ষতা ও বাণিজ্যিক প্রেক্ষাপট অবহেলা করা হয়। খাদ্য নিরাপত্তার ক্ষেত্রে, যেখানে গুণমান ও নির্ভরযোগ্যতা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ, এমন ত্রুটি দীর্ঘমেয়াদে প্রতিকূল প্রভাব ফেলতে পারে।

তার পাশাপাশি, যখন চাল আমদানিকে তৃতীয় দেশ হয়ে ঘুরিয়ে আনা হয়, বাংলাদেশ তার সবচেয়ে বড় প্রতিবেশী এবং বাণিজ্যিক অংশীদারকে মিশ্র বার্তা পাঠাতে পারে। যদিও বাণিজ্য ঘাটতি কমানো একটি বৈধ অর্থনৈতিক লক্ষ্য, কৃত্রিম পথ ব্যবহার করে তা করা স্বচ্ছতা এবং কার্যকারিতা কমাতে পারে, এবং ফলশ্রুতিতে রাষ্ট্রীয় অর্থের ওপর অতিরিক্ত চাপ তৈরি হতে পারে।

স্বচ্ছতার আহ্বান

অর্থনীতিবিদ এবং নাগরিক সমাজের প্রতিনিধিরা সরকারি ক্রয় নীতিমালার পুনর্মূল্যায়ন এবং সরবরাহকারীর প্রোফাইল সম্পর্কে আরও স্বচ্ছ তথ্য প্রকাশ করার আহ্বান জানাচ্ছেন। তাদের মতে, জনগণ জানতে প্রাপ্য যে, এই ধরনের চুক্তি বাস্তবেই জাতীয় অর্থনৈতিক স্বার্থে করা হয়েছে নাকি কেবল মধ্যস্থতাকারীদের জন্য নতুন চ্যানেল তৈরি করেছে।

জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপকড. শফিকুল ইসলাম বলেছেন, “যারা এসব সিদ্ধান্ত নেন, তারা তো ভেবেচিন্তে নেয় না। আর এখানে যারা যুক্ত আছে তাদের ইন্টারেস্ট আছে। সোর্স থেকে যদি কেনা যায়, সেখানে অবশ্যই মূল্য কম পড়ে। এখন পলিসি মেকাররা কেন এভাবে না করে ভিন্ন পথ অবলম্বন করছে তা মূলত তাদের ব্যাখ্যায় জানা যাবে। তবে ইনডিরেক্টলি বা ভায়া হয়ে চাল নিয়ে আসার কোনো প্রয়োজন ছিল না।”

সরকার এই পদক্ষেপকে ভারতের সঙ্গে বাণিজ্য ঘাটতির একটি কৌশলগত প্রতিক্রিয়া হিসেবে দেখা হলেও বিশেষজ্ঞরা এটিকে একটি প্রশাসনিক ভুল হিসেবে দেখছেন, যা সরল আমদানির লেনদেনে অপ্রয়োজনীয় মধ্যস্থতাকারী যোগ করেছে।

আরও পড়ুন