সিন্ধুর জবাবে সিমলা, ভারত- পাকিস্তান উত্তেজনা কোথায় ঠেকবে?

ইলাস্ট্রেশন: দ্য সান ২৪
ইলাস্ট্রেশন: দ্য সান ২৪

ভারত ও পাকিস্তান পাল্টাপাল্টি পদক্ষেপের মাধ্যমে এক কৌশলগত অচলাবস্থায় পড়েছে। মঙ্গলবার ভারত নিয়ন্ত্রিত কাশ্মীরের পহেলগামে পর্যটকদের ওপর হামলায় অন্তত ২৬ জন নিহত হওয়ার পর এই উত্তেজনা এখন চরমে।

পরদিন বুধবার ভারত সরকার পাকিস্তানের সঙ্গে কূটনৈতিক সম্পর্কের লাগাম টেনে ধরে। এর অংশ হিসেবে ‘সিন্ধু নদীর পানি বন্টন চুক্তি‘ বাতিলের ঘোষণা দিয়েছে ভারত, যার কারণে পাকিস্তানের পানির সরবরাহ ব্যাহত হতে পারে মারাত্মকভাবে।

ভারত আরও জানায়, তারা পাকিস্তানের সঙ্গে প্রধান স্থলসীমান্ত বন্ধ করে দিয়েছে এবং বর্তমানে ভারতে অবস্থানরত কিছু পাকিস্তানি নাগরিককে ৪৮ ঘণ্টার মধ্যে দেশ ছাড়ার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।

অবম্য ভারতের কঠোর অবস্থানের জবাব একদিন বাদেই এসেছে পাকিস্তানের পক্ষ থেকে। তারাও ভারতের বিরুদ্ধে একই ধরনের পদক্ষেপের ঘোষণা দিয়েছে। সেই সঙ্গে হুমকি দেয়, দুই দেশের মধ্যে থাকা সব দ্বিপক্ষীয় চুক্তি থেকে তারা সরে আসতে পারে। এর মধ্যে রয়েছে ১৯৭২ সালের সিমলা চুক্তি, যা ১৯৭১ সালের বিরোধের প্রেক্ষিতে স্বাক্ষরিত হয় এবং যার পরিপ্রেক্ষিতে বাংলাদেশ রাষ্ট্র গঠিত হয়েছিল।

পাকিস্তান বিশেষভাবে ক্ষুব্ধ হয়েছে সিন্ধু নদীর পানি বন্টন চুক্তি নিয়ে ভারতের হুমকির কারণে। তারা বলছে, পানির সরবরাহে কোনো বিঘ্ন ঘটলে সেটিকে ‘যুদ্ধ ঘোষণার সমতুল্য’ হিসেবে বিবেচনা করা হবে। সেই সঙ্গে পাকিস্তান আরও জানায়, তারা ‘জাতীয় ক্ষমতার সর্বোচ্চ পর্যায় থেকে পূর্ণ শক্তি প্রয়োগের মাধ্যমে’ জবাব দিতে প্রস্তুত রয়েছে।

সিন্ধু নদীর পানি বন্টন চুক্তি একটি আন্তঃসীমান্ত চুক্তি। এর মাধ্যমে ভারত ও পাকিস্তান সিন্ধু অববাহিকার পানি ভাগ করে নেয়। এই চুক্তি গত ৬৫ বছরে দুই দেশের মধ্যে একাধিক যুদ্ধ ও প্রায় স্থায়ী উত্তেজনার মধ্যেও টিকে ছিল। ২০১৯ সালে ভারত এই চুক্তি স্থগিত করার খুব কাছাকাছি গিয়েও শেষ পর্যন্ত তা কার্যকর করেনি।

ভারত কেন পাকিস্তানের বিরুদ্ধে পদক্ষেপ নিল

ভারত নিয়ন্ত্রিত কাশ্মীরের একটি জনপ্রিয় পর্যটন কেন্দ্র পহেলগামে মঙ্গলবারের হামলার দায় স্বীকার করেছে ‘দ্য রেজিস্ট্যান্স ফ্রন্ট’ (টিআরএফ) নামের একটি সশস্ত্র গোষ্ঠী। এই গোষ্ঠী কাশ্মীরের স্বাধীনতার দাবি করে। ভারতের কর্মকর্তারা আগে থেকেই বলে আসছেন, টিআরএফ আসলে পাকিস্তানভিত্তিক সশস্ত্র সংগঠন লস্কর-ই-তৈয়বার একটি উপশাখা।

ভারত দীর্ঘদিন ধরে অভিযোগ করে আসছে, পাকিস্তান কাশ্মীরে চলমান সশস্ত্র বিদ্রোহকে মদদ দেয়। যদিও ইসলামাবাদ এই অভিযোগ অস্বীকার করে। বুধবার ভারত দাবি করে, পহেলগামের এই হামলার সঙ্গে “সীমান্ত পেরিয়ে আসা” অর্থাৎ “ক্রস-বর্ডার” সংযোগ রয়েছে। আর তারা এই হামলার জন্য তাদের পশ্চিম প্রতিবেশী পাকিস্তানকে দায়ী করে।

বুধবার ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের এক বিশেষ ব্রিফিংয়ে পররাষ্ট্রসচিব বিক্রম মিশ্রি জানান, পহেলগামের হামলা নিয়ে আলোচনার জন্য ‘ক্যাবিনেট কমিটি অন সিকিউরিটি’ (সিসিএন) এর বৈঠক ডাকা হয়েছিল। এই হামলায় রাইফেলধারী ব্যক্তিরা ২৫ জন ভারতীয় ও একজন নেপালি পর্যটককে হত্যা করে। নিহতরা সবাই পুরুষ ছিলেন।

ব্রিফিংয়ে তিনি বলেন, “সিএসএসের বৈঠকে এই সন্ত্রাসী হামলার সীমান্তপারের সংযোগগুলোর বিষয়টি তুলে ধরা হয়েছে। ১৯৬০ সালের সিন্ধু নদীর পানি বন্টন চুক্তি অবিলম্বে স্থগিত করা হবে, যতক্ষণ না পাকিস্তান বিশ্বাসযোগ্য ও স্থায়ীভাবে সীমান্তপারের সন্ত্রাসবাদে সমর্থন দেওয়া বন্ধ করে।”

আর চুক্তি ‘স্থগিত’ থাকার অর্থ হলো, সেটিকে সাময়িকভাবে কার্যকর না রাখা বা বিরত রাখা।

এর আগে বৃহস্পতিবার ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী এক বিবৃতিতে বলেন, ভারত প্রতিটি ‘সন্ত্রাসবাদী‘ এবং তাদের যেসব ব্যক্তি বা গোষ্ঠী সমর্থন দেয়, তাদের শনাক্ত করবে। খুঁজে বের করবে ও শাস্তি দেবে।

সিন্ধু নদীর পানি বন্টন চুক্তি কী

সিন্ধু নদীর পানি বন্টন চুক্তি (আইডব্লিউটি) স্বাক্ষরিত হয় ১৯৬০ সালে। তবে এর পেছনের ইতিহাস শুরু হয়েছিল ১৯৪৭ সালের আগস্টে। তখন ব্রিটিশ উপনিবেশিক শাসনের অবসান ঘটে এবং ভারত ও পাকিস্তান দুটি স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়। ভৌগোলিক অবস্থানের কারণে ভারত উপরের দিকে অবস্থিত (প্রবাহের হিসেবে) এবং পাকিস্তান নিচের দিকে। ফলে নদীর প্রবাহ নিয়ন্ত্রণের ক্ষমতা ভারতের হাতে থাকে।

উভয় দেশই সিন্ধু অববাহিকার ছয়টি নদীর পানির ওপর কৃষিকাজ ও সেচের জন্য নির্ভর করে। তাই প্রথমে উভয় দেশ একটি ‘স্ট্যান্ডস্টিল অ্যাগ্রিমেন্ট’ স্বাক্ষর করে। এর ফলে সীমান্ত অতিক্রম করে পানি প্রবাহিত হওয়ার সুযোগ অব্যাহত থাকে। কিন্তু এই চুক্তির মেয়াদ শেষ হওয়ার পর ১৯৪৮ সালে ভারত পাকিস্তানের দিকে পানি সরবরাহ বন্ধ করে দেয়। তখন জরুরি ভিত্তিতে পানির বণ্টন নিয়ে নতুন আলোচনার প্রয়োজন দেখা দেয়।

এরপর টানা নয় বছর ধরে বিশ্বব্যাংকের মধ্যস্থতায় আলোচনা চলতে থাকে। অবশেষে ১৯৬০ সালের সেপ্টেম্বরে পাকিস্তানের তৎকালীন প্রেসিডেন্ট আইয়ুব খান ও ভারতের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহরু এই চুক্তি স্বাক্ষর করেন।

চুক্তি অনুযায়ী, ভারত তিনটি পূর্ব দিকের নদীর (রাভি, বিয়াস এবং শতদ্রু) পানি ব্যবহার করার অধিকার পায়। অন্যদিকে, পাকিস্তান তিনটি পশ্চিম দিকের নদী—সিন্ধু, ঝেলম ও চেনাব—এর পানির একচেটিয়া ব্যবহার পায়।

ভারত ওই পশ্চিম দিকের নদীগুলোর পানি বিদ্যুৎ উৎপাদন এবং সীমিত পরিসরে কৃষিকাজের জন্য ব্যবহার করতে পারে। তবে চুক্তি অনুযায়ী, ভারত এমন কোনো অবকাঠামো নির্মাণ করতে পারে না যা এই নদীগুলোর পানি প্রবাহে বাধা সৃষ্টি করে অথবা এই পানি অন্যদিকে মোড় ঘুরিয়ে দেয়।

চুক্তি স্থগিত হলে কী হবে পাকিস্তানের

একে একটি হুমকি হিসেবে দেখা হচ্ছে, যেখানে ভারত ইচ্ছা করলে সিন্ধু, ঝেলম ও চেনাব নদীর পানি পাকিস্তানের দিকে প্রবাহিত হওয়া সীমিত করতে পারে। তবে এর মানে এই নয় যে ভারত অবিলম্বে সেই প্রবাহ বন্ধ করে দেবে।

এমনকি ভারত চাইলেও এখনই পানি প্রবাহ বন্ধ করা সম্ভব নয়। যদিও তারা এই চুক্তি থেকে নিজেদের অংশগ্রহণ স্থগিত করেছে।

এর কারণ হলো, ভারতের পশ্চিম দিকের নদীগুলোর ওপর কিছু জলাধার রয়েছে, তবে সেগুলোর ধারণক্ষমতা সীমিত। এই জলাধারগুলো এত পরিমাণ পানি সংরক্ষণ করতে পারে না, যাতে পাকিস্তানে পানি যাওয়া পুরোপুরি বন্ধ করে দেওয়া যায়। এছাড়া এখন (মে থেকে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত) বরফ গলে প্রচুর পানি নদীতে নেমে আসে, যাকে উচ্চ প্রবাহের সময় বলা হয়।

আমেরিকার টাফটস ইউনিভার্সিটির নগর ও পরিবেশনীতি এবং পরিবেশ অধ্যয়ন বিভাগের সহকারী অধ্যাপক হাসসান এফ খান আল জাজিরাকে বলেন, “পাকিস্তানের জন্য বরাদ্দ থাকা পশ্চিম দিকের নদীগুলোতে মে থেকে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত অত্যন্ত উচ্চ প্রবাহ থাকে। ভারত এই প্রবাহের পুরোটা আটকে রাখার মতো বড় পরিসরের অবকাঠামো এখনো তৈরি করেনি।”

তবে ভারত যদি ভবিষ্যতে পানি প্রবাহ বন্ধ বা হ্রাস করার চেষ্টা করে, তাহলে পাকিস্তান বিশেষ করে শুষ্ক মৌসুমে এর প্রভাব টের পাবে। কারণ পাকিস্তান কৃষি ও বিদ্যুৎ উৎপাদনের জন্য এই পশ্চিম দিকের নদীগুলোর পানির ওপর অত্যন্ত নির্ভরশীল। তাদের কাছে পানির বিকল্প উৎসও নেই।

পাকিস্তানের অর্থনীতি মূলত কৃষিনির্ভর। ২০২৪ সালের অর্থনৈতিক জরিপ অনুযায়ী, কৃষি খাত দেশটির মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) ২৪ শতাংশ এবং মোট কর্মসংস্থানের ৩৭ দশমিক ৪ শতাংশ যোগান দেয়। পাকিস্তানের পরিসংখ্যান ব্যুরো বলছে, দেশের অধিকাংশ মানুষ প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে কৃষির ওপর নির্ভরশীল। বিশ্বব্যাংকের সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী, পাকিস্তানের বর্তমান জনসংখ্যা প্রায় ২৪৭ দশমিক ৫ মিলিয়ন।

ভারতের কি এই চুক্তি স্থগিত করার ক্ষমতা আছে

যদিও ভারত সিন্ধু পানিচুক্তি থেকে নিজেদের অংশগ্রহণ ‘স্থগিত’ বা ‘অব্যাহতি’ ঘোষণা করেছে, তবে আইনি বিশেষজ্ঞরা বলছেন—ভারত একতরফাভাবে এই চুক্তি স্থগিত করতে পারে না।

পাকিস্তানের আইনজীবী আহমের বিলাল সূফি আল জাজিরাকে বলেন, “ভারত ‘abeyance’ শব্দটি ব্যবহার করেছে, কিন্তু এই চুক্তিতে এমন কোনো ধারা নেই যা এইভাবে চুক্তিকে সাময়িকভাবে স্থগিত করার অনুমতি দেয়।” তিনি জানান, এই চুক্তি শুধুমাত্র উভয় পক্ষের সম্মতিক্রমেই সংশোধন বা পরিবর্তন করা যেতে পারে।

তিনি আরও বলেন, “এই সিদ্ধান্ত আন্তর্জাতিক প্রথাগত আইনেরও লঙ্ঘন। কারণ আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত নিয়ম অনুযায়ী, কোনো উপরবর্তী প্রবাহের দেশ (উপরের দিকের দেশ) নিম্ন প্রবাহের দেশের (নিচের দিকের দেশ) পানির প্রবাহ বন্ধ করতে পারে না।”

নয়া দিল্লিভিত্তিক রাজনৈতিক বিশ্লেষক অনুত্তমা ব্যানার্জি আল জাজিরাকে বলেন, চুক্তিটি হয়তো পুরোপুরি বাতিল হবে না, তবে বর্তমান রূপে তা চলতে পারবে না। 

তিনি বলেন, “এই চুক্তিকে এখন ‘পুনরীক্ষণ’, ‘পুনর্বিবেচনা’ এবং ‘পুনর্বিন্যাস’-এর জন্য তোলা হবে—যা তিনটি ভিন্নধর্মী প্রক্রিয়া। কারণ এই চুক্তির মূল কাঠামোতে যেমন ভূগর্ভস্থ পানির ঘাটতি বা জলবায়ু পরিবর্তনের মতো নতুন চ্যালেঞ্জগুলো বিবেচনায় নেওয়া হয়নি।”

আমেরিকার টাফটস ইউনিভার্সিটির সহকারী অধ্যাপক হাসসান এফ খান বলেন, “নীতিগতভাবে কোনও দ্বিপাক্ষিক চুক্তিকে একতরফাভাবে স্থগিত করা হলে, তা আন্তর্জাতিক আইনের লঙ্ঘন হিসেবে বিবেচিত হতে পারে।”

তবে তিনি আরও বলেন, “এই আইনের প্রয়োগ বাস্তবে জটিল। সিন্ধু পানিচুক্তি একটি দ্বিপাক্ষিক চুক্তি। এর কোনো নির্দিষ্ট বলবৎকারী কর্তৃপক্ষ নেই। বিশ্বব্যাংকের একটি ভূমিকা আছে নিরপেক্ষ বিশেষজ্ঞ বা সালিস নিযুক্ত করার বিষয়ে। কিন্তু তারা এই চুক্তি বাস্তবায়নের জন্য চূড়ান্ত কর্তৃপক্ষ নয়।”

হাসসান এফ খান ব্যাখ্যা করে বলেন, পাকিস্তান আইনি প্রতিকার চাইলে তাদের সম্ভবত আন্তর্জাতিক ফোরাম, যেমন আন্তর্জাতিক বিচার আদালত (আইসিজের) দ্বারস্থ হতে হবে। বাস্তবিক দৃষ্টিকোণ থেকে দেখলে, ভারতের জন্য সবচেয়ে বড় ক্ষতি হবে কূটনৈতিক ও কৌশলগত। কারণ এই ধরনের আচরণ আন্তর্জাতিক আইন মেনে চলা একটি রাষ্ট্র হিসেবে ভারতের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন করতে পারে। বিশেষ করে যখন ভারত নিজেও অন্যান্য আন্তঃসীমান্ত নদীর ক্ষেত্রে নিম্ন প্রবাহের দেশ হিসেবে অবস্থান করে।

হাসসান এফ খান মনে করেন, এই চুক্তি স্থগিত করার মূল কৌশলগত উদ্দেশ্য হলো চুক্তির নতুন করে আলোচনার মাধ্যমে পুনঃসিদ্ধান্ত। তিনি বলেন, “ভারত অনেক দিন ধরেই এই চুক্তি পুনরায় আলোচনার ইচ্ছা প্রকাশ করে আসছে। ২০২৩ সালের জানুয়ারিতে এবং ২০২৪ সালের সেপ্টেম্বরেও ভারত এই চুক্তি পুনঃআলোচনার প্রস্তাব দেয়। সেখানে তারা জলবায়ু পরিবর্তন ও বাস্তবায়নজনিত সমস্যার কথা তুলে ধরে। তবে পাকিস্তান এখনও ওই প্রস্তাবে রাজি হয়নি।”

ভারতের সাম্প্রতিক ঘোষণা মূলত পাকিস্তানের ওপর চাপ প্রয়োগের একটি কৌশল হতে পারে, যাতে চুক্তিটি ভারতের জন্য আরও অনুকূল শর্তে পুনরায় আলোচিত হয়। এই কৌশল সফল হবে কিনা, তা এখনই বলা যায় না। তবে এটা নিশ্চিতভাবে বলা যায়, এটি গত ছয় দশকের স্থিতিশীলতা থেকে একটি বড় পরিবর্তনের সূচনা করেছে।

কাশ্মীর হামলার পর ভারতের পদক্ষেপ

সিন্ধু পানিচুক্তি স্থগিত রাখার ঘোষণা ছাড়াও, ভারতের পররাষ্ট্র সচিব বিক্রম মিশ্রি আরও কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপের কথা জানান।

দুই দেশের মধ্যে প্রধান স্থলসীমান্ত পথ—আটারী ইন্টিগ্রেটেড চেকপোস্ট, যাকে আটারী-ওয়াহগা সীমান্ত নামেও ডাকা হয়—তা তাৎক্ষণিকভাবে বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। যারা বৈধ অনুমোদন নিয়ে এই সীমান্ত অতিক্রম করেছেন, তাদের ১ মে’র মধ্যে একই পথ দিয়ে ফিরে যেতে হবে।

দক্ষিণ এশীয় আঞ্চলিক সহযোগিতা সংস্থা (সার্ক) ভিসা অব্যাহতি প্রকল্প (এসভিইএস) এর আওতায় পাকিস্তানিদের দেওয়া সকল ভিসা বাতিল করা হয়েছে। বর্তমানে ভারতে অবস্থানরত পাকিস্তানি নাগরিকদের, যারা এই প্রকল্পের আওতায় এসেছেন, তাদের মিশ্রির বিবৃতি প্রকাশের ৪৮ ঘণ্টার মধ্যে ভারত ত্যাগ করতে বলা হয়েছে।

ভারতের নয়াদিল্লিতে পাকিস্তানের হাই কমিশনে কর্মরত সেনাবাহিনী, নৌবাহিনী ও বিমানবাহিনীর উপদেষ্টাদের ‘অবাঞ্ছিত’ ঘোষণা করা হয়েছে। তাদের এক সপ্তাহের মধ্যে ভারত ছাড়তে হবে। একইভাবে ভারতের সামরিক উপদেষ্টাদের ইসলামাবাদে ভারতীয় হাই কমিশন থেকে ফিরিয়ে নেওয়া হবে।

উভয় দেশের হাই কমিশন থেকে পাঁচজন করে সহায়ক কর্মী প্রত্যাহার করা হবে।

উভয় হাই কমিশনের কর্মীসংখ্যা ৫৫ থেকে কমিয়ে ৩০-এ নামিয়ে আনার পরিকল্পনা নেওয়া হয়েছে। এটি ১ মে’র মধ্যে কার্যকর হবে।

ভারতের পদক্ষেপের জবাবে পাকিস্তান কী বলেছে

বৃহস্পতিবার পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী শাহবাজ শরিফ ন্যাশনাল সিকিউরিটি কমিটির (এনএসসি) এক উচ্চপর্যায়ের বৈঠক ডাকেন। বৈঠক শেষে তার কার্যালয় থেকে দেওয়া এক বিবৃতিতে বলা হয়, “২৩ এপ্রিল ২০২৫-এ ভারতের ঘোষিত পদক্ষেপগুলো একতরফা, অন্যায্য, রাজনৈতিকভাবে উদ্দেশ্যপ্রণোদিত, চরমভাবে দায়িত্বজ্ঞানহীন এবং আইনগত ভিত্তিহীন।”

বিবৃতিতে আরও বলা হয়: ভারতের সিন্ধু পানিচুক্তি স্থগিত রাখার ঘোষণা পাকিস্তান দৃঢ়ভাবে প্রত্যাখ্যান করছে… পাকিস্তানের অংশের পানির প্রবাহ থামানোর বা তা ঘুরিয়ে দেওয়ার যেকোনো প্রচেষ্টা ‘যুদ্ধ ঘোষণা’ হিসেবে বিবেচিত হবে এবং তার জবাব দেওয়া হবে দেশের সর্বশক্তি দিয়ে।

পাকিস্তান আরও বলেছে, ভারতের সঙ্গে সব দ্বিপাক্ষিক চুক্তি, যার মধ্যে ১৯৭২ সালের সিমলা চুক্তিও রয়েছে, তা স্থগিত রাখার অধিকার তারা সংরক্ষণ করে। যতক্ষণ না ভারত পাকিস্তানের অভ্যন্তরে সন্ত্রাস ছড়ানো, সীমান্তের বাইরে হত্যা, আন্তর্জাতিক আইন ও জাতিসংঘের কাশ্মীর সংক্রান্ত প্রস্তাবের লঙ্ঘন বন্ধ করে।

সিমলা চুক্তি ১৯৭১ সালে ভারত-পাকিস্তান বিরোধের প্রেক্ষিতে ১৯৭২ সালে স্বাক্ষরিত হয়। এতে বলা হয়েছিল, দুই দেশ যেকোনো বিরোধ শান্তিপূর্ণভাবে ও দ্বিপাক্ষিক আলোচনার মাধ্যমে সমাধান করবে।

একই দিনে পাকিস্তানও ওয়াহগা সীমান্ত বন্ধ করে দেয়, ভারতীয়দের সার্ক ভিসা অব্যাহতি প্রকল্প স্থগিত করে। এছাড়া ইসলামাবাদে ভারতীয় সেনাবাহিনী ও নৌবাহিনীর উপদেষ্টাদের অবাঞ্ছিত ঘোষণা করে। পাকিস্তান ‘তাৎক্ষণিকভাবে’ ভারতের মালিকানাধীন বা পরিচালিত সব এয়ারলাইনের জন্য আকাশসীমা বন্ধ করে দেয়।

তারা আরও ঘোষণা করে, ভারতের সঙ্গে সব ধরনের বাণিজ্য স্থগিত করা হয়েছে। এমনকি কোনও তৃতীয় দেশের সঙ্গে পাকিস্তানের ভেতর দিয়ে ভারতীয় পণ্য পরিবহণ—যেমন ভারতের আফগানিস্তান রপ্তানি—তাও বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে।

আগে একাধিকবার পাকিস্তানি কর্মকর্তারা সতর্ক করে বলেছিলেন, ভারত পাকিস্তানের পানি সরবরাহে হস্তক্ষেপ করলে তা যুদ্ধ ঘোষণার সমতুল্য হবে। সেই অনুযায়ী কঠোর প্রতিক্রিয়া জানানো হবে।

২০১৬ সালে পাকিস্তানের সেনেট চেয়ারম্যান রাজা রব্বানি বলেছিলেন, “পাকিস্তানের পানি সরবরাহে হস্তক্ষেপ করলে, তা হবে আগ্রাসনের সমান। আর আগ্রাসনের জবাব দেওয়া হবে আগ্রাসন দিয়ে।”

ভারত-পাকিস্তান সম্পর্কে বড় ধরনের উত্তেজনা

সিন্ধু পানিচুক্তি স্থগিত রাখার সিদ্ধান্তটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। আগে ভারত একাধিকবার এই চুক্তি স্থগিত রাখার হুমকি দিলেও, কখনও তা কার্যকর করেনি।

২০১৬ সালে ভারতের নিয়ন্ত্রিত কাশ্মীরের উরি এলাকায় সন্দেহভাজন বিদ্রোহীরা এক হামলায় ১৭ জন ভারতীয় সেনাকে হত্যা করে। এই হামলায় ভারতীয় সেনাবাহিনীও ৪ জন বিদ্রোহীকে হত্যা করে। হামলার পর প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী সরকারি কর্মকর্তাদের সঙ্গে আলোচনায় বলেছিলেন, “রক্ত আর পানি একসঙ্গে প্রবাহিত হতে পারে না।” তবে তখনও সিন্ধু পানিচুক্তি স্থগিত করা হয়নি।

২০১৯ সালে কাশ্মীরের পুলওয়ামায় এক আত্মঘাতী বোমা হামলায় ভারতের আধাসামরিক বাহিনীর ৪০ জন সদস্য নিহত হন। এই হামলার দায় স্বীকার করে পাকিস্তানভিত্তিক জঙ্গি সংগঠন জইশ-ই-মোহাম্মদ। ওই ঘটনার পর ভারতের পানি সম্পদমন্ত্রী নিতিন গড়কড়ি পাকিস্তানে পানির প্রবাহ বন্ধ করে দেওয়ার হুমকি দেন। তবে সেটিও শেষ পর্যন্ত বাস্তবায়িত হয়নি।

ফলে এবারের পরিস্থিতিতে সিন্ধু পানিচুক্তি কার্যত স্থগিত রাখা—হিন্দুকুশ-পাহাড়বেষ্টিত সিন্ধু অববাহিকার পানির রাজনীতিতে এখন পর্যন্ত সবচেয়ে বড় উত্তেজনাকর পদক্ষেপ।

আরও পড়ুন