আয় বাড়াতে ভ্যাটে নজর ইউনূসের, বাড়ছে থাকা-খাওয়া-পরার খরচ

উপদেষ্টা পরিষদের সঙ্গে মুহাম্মদ ইউনূসের বৈঠক। ফাইল ছবি।
উপদেষ্টা পরিষদের সঙ্গে মুহাম্মদ ইউনূসের বৈঠক। ফাইল ছবি।

চলতি অর্থবছরে এনবিআরের মাধ্যমে ৪ লাখ ৮০ হাজার কোটি টাকা রাজস্ব আহরণের লক্ষ্য ধরে বাজেট পাসের ৩৬ দিনের মধ্যে বিদায় নিয়েছে আওয়ামী লীগ সরকার। টালমাটাল পরিস্থিতির মধ্যে দায়িত্ব নেওয়া অন্তর্বর্তী সরকারের জন্য বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে উঠেছে বাজেট বাস্তবায়ন। নানা দাবি-দাওয়া পূরণ করতে গিয়ে খরচাও যাচ্ছে বেড়ে। অন্যদিকে এনবিআরের ওই লক্ষ্যমাত্রা পূরণও কঠিন হয়ে যাচ্ছে।

এই সংকটে দাওয়াই হিসাবে ভ্যাটকে বেছে নিলেন অর্থনীতিবিদ মুহাম্মদ ইউনূস। তার নেতৃত্বাধীন অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের উপদেষ্টা পরিষদ বুধবার মূল্য সংযোজন কর ও সম্পূরক শুল্ক আইন সংশোধনের প্রস্তাব অনুমোদন করেছে।

সংশোধনের কথা জানালেও কোন কোন পণ্য কিংবা সেবায় ভ্যাট বাড়ছে, সে বিষয়ে সরকারের পক্ষ থেকে কিছু বলা হয়নি। তবে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) কর্মকর্তাদের বরাতে সংবাদপত্রগুলোতে খবর এসেছে, বাড়তি ভ্যাটের কারণে রেস্তোরাঁর খাবার, মিষ্টি, আবাসিক হোটেলে থাকা, পোশাকের খরচ বাড়বে। বাড়বে আকাশ পথে ভ্রমণের খরচও।

অর্থ উপদেষ্টা সালেহ উদ্দিন আহমেদ অবশ্য দাবি করেছেন, অত্যাবশ্যকীয় পণ্যের খরচ বাড়বে না। ফলে সাধারণ মানুষের সমস্যা হবে না।

তবে মধ্যবিত্ত ও উচ্চ মধ্যবিত্তের ওপর খরচের চাপ কিছুটা বাড়বে, বলেছেন সিপিডির সম্মানীয় ফেলো মোস্তাফিজুর রহমান।

এনবিআর সূত্রের উদ্ধৃতি দিয়ে দৈনিক প্রথম আলোয় প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে বলা হয়, প্রাথমিকভাবে ৪৩ ধরনের পণ্য ও সেবার ওপর ১৫ শতাংশ ভ্যাট আরোপ করা হবে।

রেস্তোরাঁয় খেতে গেলে খাবারের বিলের ওপর ১৫ শতাংশ ভ্যাট দিতে হবে। এতদিন শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত রেস্তোরাঁয় খাবারের বিলের ওপর ৫ শতাংশ হারে ভ্যাট নেওয়া হতো। তা এখন ১৫ শতাংশ হবে। মিষ্টির ওপর ভ্যাট এখন সাড়ে ৭ শতাংশ রয়েছে, তাও ১৫ শতাংশ হবে।

বর্তমানে তৈরি পোশাকের আউটলেটের বিলের ওপর সাড়ে ৭ শতাংশ ভ্যাট রয়েছে। তাও বাড়িয়ে ১৫ শতাংশ করা হচ্ছে। তাতে পোশাক কেনার খরচও বাড়বে মানুষের।

নন-এসি হোটেল ভাড়ার সাড়ে ৭ শতাংশ ভ্যাটও ১৫ শতাংশ হবে। দেশে আকাশপথে ভ্রমণেও আবগারি শুল্ক ৫০০ টাকা থেকে বাড়িয়ে ৭০০ টাকা করা হতে পারে।

প্রথম আলোর প্রতিবেদন অনুযায়ী, রেস্তোরাঁ, পোশাক, হোটেল ছাড়াও অন্য যেসব খাতে ১৫ শতাংশ ভ্যাট বসতে যাচ্ছে, তার মধ্যে অন্যতম হলো উৎপাদন পর্যায়ে বিস্কুট, আচার, সিআর কয়েল, ম্যাট্রেস, ট্রান্সফরমার, টিস্যু পেপার ইত্যাদি।

আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় থাকার সময়ই ঋণ দেওয়ার সময় আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ) ভ্যাটের হার ১৫ শতাংশ করার শর্ত দিয়েছিল। তা পূরণই এখন করতে যাচ্ছে অন্তর্বর্তী সরকার।  

মূলত অর্থায়নের চাপ সামাল দিতেই ভ্যাটের হার বাড়াতে হচ্ছে বলে মনে করেন সিপিডির সম্মানীয় ফেলো মোস্তাফিজুর রহমান।

তিনি প্রথম আলোকে বলেন, “অর্থনীতির সামগ্রিক বাস্তবতায় সরকারের ওপর দায়-দেনার চাপ বাড়ছে। সরকারের অর্থ দরকার। তাই বিভিন্ন পণ্য–সেবার ওপর ভ্যাট ও শুল্ক বাড়িয়ে রাজস্ব বাড়ানোর উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে।”

বাংলাদেশে কর-জিডিপি অনুপাত যেমন কম, তেমনি পরোক্ষ করের ওপর নির্ভরতা অনেক বেশি। এটা অর্থনীতির দুর্বলতার পরিচায়ক। মোস্তাফিজুর প্রত্যক্ষ কর বাড়াতে মধ্যমেয়াদি উদ্যোগ নেওয়া উচিৎ বলে মনে করেন।

বুধবার উপদেষ্টা পরিষদে আইন সংশোধনের প্রস্তাব অনুমোদনের পর বৃহস্পতিবার সচিবালয়ে গিয়ে সাংবাদিকদের প্রশ্নের ‍মুখে পড়েন অর্থ উপদেষ্টা সালেহউদ্দিন। তখন তিনি বলেন, ভ্যাট বাড়লেও নিত্যপণ্যের দামের ওপর তেমন প্রভাব পড়বে না।

“অত্যাবশ্যকীয় জিনিসপত্রের ওপর আমরা শুল্ক জিরো করে দিয়েছি। সেটার দিকে নজর দিন। ইনফ্ল্যাশনের মূল ইন্ডিকেটর চাল-ডাল এগুলো। আমরা যেসব জিনিসপত্রের দাম বাড়িয়েছি, ওগুলো ভেরি ইনসিগনিফিকেন্ট পার্ট অব আওয়ার বাজেট।”

রেস্তোরাঁয় ভ্যাট বাড়ানোর নিয়ে তিনি বলেন, “রেস্টুরেন্টে খাবারের দাম বাড়িয়েছি তিন তারকার ওপরে যেগুলো। কেউ যদি মনে করে ফিক্সড অ্যামাউন্টের একটা টাকা খেতে হবে, সেখানে ১০ টাকা যোগ হবে। আমার মনে হয়, এটা কারও মাথাব্যথার কারণ হওয়া উচিৎ না।”

অনির্বাচিত একটি সরকার এভাবে কর কিংবা শুল্ক বাড়াতে পারে কি না, তা নিয়ে প্রশ্নও রয়েছে। তবে উপদেষ্টা পরিষদ এরই মধ্যে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার অধ্যাদেশ অনুমোদন করেছে।

তাতে বলা হয়েছে, পরবর্তী প্রধানমন্ত্রী কার্যভার না নেওয়া পর্যন্ত অন্তর্বর্তী সরকারের প্রয়োগ করা সব ক্ষমতা, অধ্যাদেশ, বিধিমালা, প্রবিধানমালা, জারি করা প্রজ্ঞাপন, আদেশ, কর্মকাণ্ড আইনানুযায়ী যথাযথভাবে প্রয়োগ করা হয়েছে বলে গণ্য হবে। এনিয়ে আদালতেও কোনও প্রশ্ন তোলা যাবে না।

বাজেটের সময় দাম বাড়ে, কিন্তু এখন কেন ৪৩টি পণ্যের দাম বাড়ানো হচ্ছে- এই প্রশ্ন সাংবাদিকরা করলে সালাহউদ্দিন সরাসরি উত্তর না দিয়ে বলেন, “আমরা ১৫ পার্সেন্ট ইউনিফর্ম ভ্যাট করেছি।”

বাংলাদেশের অর্থনীতির এখন যে অবস্থা, তাতে এই বাড়তি ভ্যাটে জনগণের সমস্যা হওয়ার কারণ দেখছেন না অর্থ উপদেষ্টা।

আরও পড়ুন