ইয়াহিয়ার ‘বিচ্ছিন্নতাবাদী দল’ ইউনূসের জমানায় কাঠগড়ায়

যমুনার সামনে ব্রিফিং করেন আইন উপদেষ্টা আসিফ নজরুল।
যমুনার সামনে ব্রিফিং করেন আইন উপদেষ্টা আসিফ নজরুল।

একাত্তরের ২৫ মার্চ কালো রাতে ‘বিচ্ছিন্নতাবাদী’ আখ্যা দিয়ে যে দলকে নিষিদ্ধ করেছিল পাকিস্তানের সামরিক শাসক ইয়াহিয়া খান, ৫৪ বছর পর একই ঘটনার পুনরাবৃত্তি ঘটলো অন্তর্বর্তী শাসক ইউনূসের জমানায়।

শনিবার ১০ মে রাতে সাপ্তাহিক ছুটির দিনে অন্তর্বর্তী সরকারের উপদেষ্টা পরিষদের এক নজিরবিহীন বিশেষ সভায় এ সিদ্ধান্ত হয়েছে বলে সরকারের তরফে জানানো হয়েছে।

সাবেক রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদের দেশত্যাগের খবর সামনে আসার পর এ নিয়ে টানা তিন দিন বিক্ষোভের মুখে উপদেষ্টা পরিষদ এ সিদ্ধান্ত নিল।

এর মধ্য দিয়ে বাংলাদেশের স্বাধীনতা আন্দোলনে নেতৃত্ব দেওয়া দলটি তাদের ৭৫ বছরের ইতিহাসে দ্বিতীয়বারের মতো অনিশ্চয়তার মধ্যে পড়ল।

১৯৭৫ সালে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের হত্যাকাণ্ডের পর আওয়ামী লীগকে রাজনৈতিকভাবে কোণঠাসা করে রাখা হলেও সেসময়ও দলটিকে আনুষ্ঠানিকভাবে নিষিদ্ধ করা হয়নি। দেশে না থাকায় সৌভাগ্যক্রমে বেঁচে যাওয়া তার মেয়ে শেখ হাসিনা প্রায় ছয় বছর পর নির্বাসিত জীবনের ইতি টেনে ১৯৮১ সালের ১৭ মে দেশে ফেরেন। মূলত তার ফিরে আসার মধ্য দিয়েই আওয়ামী লীগের পুনর্গঠন ও রাজনৈতিক জীবনে নতুন এক অধ্যায় সূচিত হয়েছিল।

এরপর থেকে চারবার ক্ষমতার স্বাদ পেয়েছে আওয়ামী লীগ। ২০২৪ সালের ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে ক্ষমতা হারানোর আগে টানা ১৫ বছরের বেশি সময় শাসনভার সামলেছে দলটি।

অভ্যুত্থানের পর ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কার্যালয় জ্বালিয়ে দেওয়া হয়।

অভ্যুত্থানের ছাত্রনেতাদের দল জাতীয় নাগরিক পার্টি, জামায়াতে ইসলামীসহ ধর্মভিত্তিক কয়েকটি দল বুধবার রাতে হঠাৎ করেই আওয়ামী লীগকে নিষিদ্ধের দাবিতে বিক্ষোভ কর্মসূচির ডাক দেয়।

শুরুতে ইউনূসের সরকারি বাসা যমুনার সামনে অবস্থান নিলেও পরবর্তীতে তারা শাহবাগে সরে গিয়ে সড়ক অবরোধ করে।

উদ্ভূত পরিস্থিতিতে বিশেষ সভা করে উপদেষ্টা পরিষদ সিদ্ধান্ত নেয় আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ ও তার নেতাদের বিচার কার্যসম্পন্ন না হওয়া পর্যন্ত দলটির যাবতীয় কার্যক্রম নিষিদ্ধ করার।

একই সঙ্গে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল আইনের সংশোধনী প্রস্তাবও অনুমোদন দিয়েছে। যাতে ট্রাইব্যুনাল কোনো রাজনৈতিক দল, তার অঙ্গসংগঠন বা সমর্থক গোষ্ঠীকে শাস্তি দিতে পারবে।

রাষ্ট্রীয় অতিথি ভবন যমুনায় প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূসের সভাপতিত্বে রাত সাড়ে আটটা থেকে পৌনে ১১টা পর্যন্ত ওই বিশেষ সভা হয়, যেখানে উপস্থিত ছিলেন উপদেষ্টা আদিলুর রহমান খান, সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান, আসিফ মাহমুদ সজীব ভূঁইয়া ও মো. মাহফুজ আলম।

পরে যমুনার সামনে আয়োজিত সংবাদ ব্রিফিংয়ে সভার সিদ্ধান্ত জানান আইন বিষয়ক উপদেষ্টা আসিফ নজরুল।

একাত্তরেও যে কারণে নিষিদ্ধ

১৯৭০ সালের ৭ ডিসেম্বর পাকিস্তানে অনুষ্ঠিত সাধারণ নির্বাচনে শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বাধীন আওয়ামী লীগ নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা লাভ করে। সেসময় ৩১৩টি আসনের মধ্যে আওয়ামী লীগ এককভাবে ১৬০টির বেশি আসন পায়, যা কেন্দ্রীয় সরকার গঠনের জন্য যথেষ্ট ছিল।

কিন্তু পশ্চিম পাকিস্তানভিত্তিক রাজনৈতিক ও সামরিক নেতৃত্ব এই ফলাফল মেনে না নিয়ে জুলফিকার আলী ভুট্টো ও তৎকালীন প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান আওয়ামী লীগের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তরে গড়িমসি করতে থাকে। এই গড়িমসি পূর্ব পাকিস্তানে উত্তেজনা বাড়িয়ে তোলে এবং জনগণ ব্যাপক আন্দোলনে নামে।

এই রাজনৈতিক অচলাবস্থার প্রেক্ষিতে ১৯৭১ সালের মার্চ মাসে দেশজুড়ে অসহযোগ আন্দোলন শুরু হয়। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে জনগণ কর প্রদান, সরকারি নির্দেশ মানা এবং পশ্চিম পাকিস্তান থেকে আসা পণ্য বয়কট শুরু করে।

পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী এসব ঘটনাকে “বিদ্রোহ” হিসেবে আখ্যায়িত করে আওয়ামী লীগের আন্দোলনকে বিচ্ছিন্নতাবাদী তৎপরতা হিসেবে চিহ্নিত করে। ফলে ২৫ মার্চ রাতে পাকিস্তান সেনাবাহিনী “অপারেশন সার্চলাইট” চালায়, যার মূল লক্ষ্য ছিল ঢাকা শহরসহ সারা দেশে আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মী, ছাত্র ও সাধারণ মানুষকে হত্যা এবং আন্দোলন দমন।

ওই অভিযানের দিনই পাকিস্তান সরকার আনুষ্ঠানিকভাবে আওয়ামী লীগকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করে, দলটিকে রাষ্ট্রবিরোধী এবং পাকিস্তানের সংহতির জন্য হুমকি হিসেবে বিবেচনা করে।

নিষিদ্ধের পর রাজপথে উল্লাস

এদিকে আইন উপদেষ্টার ঘোষণার পর রাজধানীর হোটেল ইন্টারকনটিনেন্টালের সামনে রাজসিক মোড়ে অবস্থানরত আন্দোলনকারীরা উচ্ছ্বাস প্রকাশ করে নানা স্লোগান দিতে থাকেন।

জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) দক্ষিণাঞ্চলের মুখ্য সংগঠক হাসনাত আবদুল্লাহ রাত ১১টা ১০ মিনিটে ফেসবুকে লিখেন, “আপনারা কেউ রাজপথ ছাড়বেন না। সরকারের সিদ্ধান্ত নিয়ে আমরা আমাদের মতামত আনুষ্ঠানিকভাবে জানাব। সে পর্যন্ত অবস্থান ত্যাগ করবেন না।”

রাত সাড়ে ১২টার দিকে রাজু ভাস্কর্য, ভিসি চত্বর ও রোকেয়া হলের সামনে শিক্ষার্থীদের মিছিল নিয়ে এসে নানা স্লোগান দিতেও দেখা গেছে।

এসময় তারা ‘একটা একটা লীগ ধর, ধইরা ধইরা জেলে ভর’, ’এইমাত্র খবর এলো, আওয়ামী লীগ ব্যান হলো’, ‘হৈই হৈই রই রই, আওয়ামী লীগ তুই গেলি কই‘, ’বাংলাদেশ জিন্দাবাদ, আওয়ামী লীগ মুর্দাবাদ’ স্লোগান দিচ্ছিলেন।

আওয়ামী লীগের বিবৃতি

অন্তর্বর্তী সরকারের ঘোষণার প্রায় চার ঘণ্টা পর বিবৃতি দিয়ে প্রতিবাদ জানিয়েছে দলটি, যেখানে ইউনূসের সরকারকে অবৈধ ও ফ্যাসিস্ট সরকার হিসাবে উল্লেখ করা হয়।

আওয়ামী লীগের ভেরিফাইড ফেইসবুক পেইজে দেওয়া ওই বিৃবতিতে বলা হয়, অবৈধ ও অসাংবিধানিক দখলদার ফ্যাসিস্ট ইউনূস সরকার আওয়ামী লীগের কার্যক্রম নিষিদ্ধের যে ঘোষণা দিয়েছে তাতে বাংলার জনগণ হতবাক ও ক্ষুব্ধ। আজকের দিনটি বাংলাদেশের ইতিহাসে কালো দিবস হিসেবে চিহ্নিত থাকবে। যে দলের নেতৃত্বে বাংলাদেশ স্বাধীন ও সার্বভৌম রাষ্ট্র হিসেবে প্রতিষ্ঠা লাভ করেছে, আজ স্বাধীন দেশে সেই আওয়ামী লীগের কার্যক্রম নিষিদ্ধ করেছে জনগণের ম্যান্ডেটহীন অগণতান্ত্রিক ফ্যাসিস্ট ইউনূস সরকার। এর মাধ্যমে প্রমাণিত হয়েছে ফ্যাসিস্ট ইউনূস সরকার বাংলার মাটিকে স্বাধীনতাবিরোধী অপশক্তি ও উগ্রবাদী গোষ্ঠীর উর্বর ভূমিতে পরিণত করতে চায়।

নিষিদ্ধের সিদ্ধান্তকে প্রত্যাখ্যান করে বিবৃতিতে উল্লেখ করা হয়, “আমরা ফ্যাসিস্ট স্বৈরাচার ইউনূস সরকারের এই সিদ্ধান্তকে ঘৃণা ভরে প্রত্যাখ্যান করছি এবং এটার বিরুদ্ধে তীব্র নিন্দা ও প্রতিবাদ জানাচ্ছি। একইসাথে দৃঢ় অঙ্গীকার ব্যক্ত করছি যে, ফ্যাসিস্ট ইউনূস সরকারের এই সিদ্ধান্তকে অগ্রাহ্য করে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ যথোচিতভাবে তার কার্যক্রম পরিচালনা করে যাবে।”

“অবৈধভাবে ক্ষমতা দখলের পর থেকে ফ্যাসিস্ট ইউনূস সরকার গায়ের জোরে একের পর একে গণবিরোধী সিদ্ধান্ত নিয়ে আসছে,” বিবৃতিতে দাবি করা হয়েছে।

পাশাপাশি নেতাকর্মীদের এই সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে সর্বাত্মক প্রতিরোধ গড়ে তোলার আহ্বান জানানো হয়েছে দলটির পক্ষ থেকে।

দলীয় ফেইসবুক পেইজে ওই বিবৃতি প্রকাশ করা হলেও কারো নাম ব্যবহার করা হয়নি, সবার নিচে লেখা রয়েছে ‘প্রেস বিজ্ঞপ্তি’, তারিখ: ১০ মে ২০২৫।

এ সংক্রান্ত আরও খবর:

বাংলাদেশের স্বাধীনতার নেতৃত্ব দেওয়া আওয়ামী লীগের কার্যক্রম নিষিদ্ধ

আরও পড়ুন

সর্বশেষ

ads