উদ্ভট উটের পিঠে চলছে স্বদেশ

কার্টুনিস্ট মেহেদি হকের তুলিতে ‘স্ট্রিক্ট রুল’। শিল্পীর ফেইসবুক থেকে নেওয়া।
কার্টুনিস্ট মেহেদি হকের তুলিতে ‘স্ট্রিক্ট রুল’। শিল্পীর ফেইসবুক থেকে নেওয়া।

জুলাই অভ্যুত্থানে আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর বাংলাদেশ যে অবস্থার মধ্য দিয়ে চলছে, তাতে শামসুর রাহমানের কবিতাটিই আবার সামনে ভাসবে সবার- ‘উদ্ভট উটের পিঠে চলেছে স্বদেশ’।

গত বছরের জুলাই থেকে আগস্টের ৫ তারিখ পর্যন্ত হত্যা-নির্যাতনের নিন্দা প্রতিবাদের মধ্যে আবার হারিয়ে যায় তার পরের হত্যা-নিপীড়নের ঘটনাগুলো।

ছয় মাস পর হঠাৎ করে ৫ আগস্ট ফিরিয়ে আনার প্রয়াস থেকে হঠাৎ উসকানি দিয়ে ঢাকায় বঙ্গবন্ধু ভবনসহ সারাদেশে আওয়ামী লীগ নেতাদের ওপর হামলা। সেই ঘটনাকে ন্যায্যতা দিতে আন্দোলনকারী এক পক্ষের চেষ্টা, আবার তার বিরোধিতা করে অন্য পক্ষের সন্দেহ।

জেলায় জেলায় ‘তৌহিদী’ জনতার মাজার ভাঙার নিয়ে ফরহাদ মজহারের বিরোধিতায় সযুর বেঁধে হামলাকারীদের হুঁশিয়ারি দিয়েছিলেন তারই ভাবশিষ্য, বর্তমানে অন্তর্বর্তী সরকারের উপদেষ্টা মাহফুজ আলম।

কিন্তু বইমেলায় তসলিমা নাসরিনের বইয়ের স্টলে হামলার পর মাহফুজ যখন একে মব জাস্টিস বলে তা সহ্য না করার হুঁশিয়ারি দিলেন, তখন আবার একে ‘তৌহিদী জনতার প্রতিরোধ ও রণধ্বনি’ বলে হামলাকারীদের পক্ষে দাঁড়িয়ে যান তার গুরু ফরহাদ মজহার।

একের পর এক ঘটনা মুহাম্মদ ইউনূসের সরকার ‘কঠোর নিন্দা’ জানিয়েই পাশ কাটিয়ে যাচ্ছে। তা দেখে অধ্যাপক আনু মুহাম্মদ বলে উঠলেন- “রহস্য এই যে, সরকারের কে সিদ্ধান্ত নিচ্ছেন, কী সিদ্ধান্ত নিচ্ছেন।”

২০০৯ সাল থেকে বাংলাদেশে চলছিল আওয়ামী লীগের সরকার। দেশে-বিদেশে কর্তৃত্ববাদী শাসন হিসাবেই পরিচিতি পায় শেখ হাসিনার দেড় দশকের এই আমল।

রাজনৈতিক নানা আন্দোলনে হটানো না গেলেও শেষে কোটা সংস্কারের আন্দোলনের মতো পচা শামুকে পা কাটে শেখ হাসিনার। আওয়ামী লীগ নেতারা অবশ্য বলছেন, এটা ‘মেটিকুলাস ডিজাইনের’ অংশই ছিল, যা পরে ইউনূসের মুখ থেকে বেরিয়ে এসেছে।

দমন-পীড়নের নীতি নিয়েও টিকতে না পেরে ৫ আগস্ট শেখ হাসিনা দেশ ছেড়ে ভারতে চলে যাওয়ার পরপরই সারাদেশে আওয়ামী লীগ নেতা ও সংশ্লিষ্ট স্থাপনার পাশাপাশি হিন্দু সম্প্রদায়ের বাড়ি-ঘর আক্রান্ত হয়।

তবে অন্তর্বর্তী সরকার জুলাই আন্দোলন দমনে আওয়ামী লীগ সরকারের হত্যা-হামলার বিচারের উদ্যোগ নিলেও ৫ আগস্টের পরের ঘটনায় ছিল প্রতিক্রিয়াহীন। বরং এমনও দাবি করা হয়, কোনো ধরনের সাম্প্রদায়িক হামলা ঘটেনি, যা বলা হচ্ছে, তা অতিরঞ্জিত।

ঢাকার বঙ্গবন্ধু ভবন ভাংচুর-অগ্নিসংযোগ করে পরে গুঁড়িয়ে দেওয়া হয়।

৫ আগস্টের পর উগ্র ইসলামী গোষ্ঠীর বাড় বাড়ন্তের মধ্যে একের পর এক মাজারে হামলা হতে থাকে। সরকারের পক্ষ থেকেই ৫ মাসে ৪০টি মাজারে হামলার স্বীকারোক্তি আসে।

মাজারে হামলার বিষয়ে উচ্চ কণ্ঠ ছিলেন ফরহাদত মজহার, যার শিষ্যদের অনেকে হাসিনাবিরোধী জুলাই আন্দোলনে ছিলেন নেতৃত্বে। ‘আওয়ামী ফ্যাসিবাদের’ বিরোধিতাকারী এই চিন্তাবিদ মাজারে হামলাকেও বলেছিলেন ‘ফ্যাসিবাদী’ আচরণ। 

এই আন্দোলনের ‘মাস্টারমাইন্ড’ থেকে উপদেষ্টা হওয়া মাহফুজ আলমও তখন হুঁশিয়ারি দিয়েছিলেন, মাজারে হামলা করদাশত করা হবে না। তারপরও মাজারে হামলা থামেনি।

তারমধ্যে আবার নারী ফুটবল দলের খেলা বন্ধের তৎপরতাও ঘটেছে বিভিন্ন স্থানে, বন্ধ হয়েছে গানের অনুষ্ঠান। এসব ‘মব জাস্টিস’ দেখে সরকার নিন্দা জানিয়েছে।

সবশেষ সম্প্রতি একুশের বইমেলায় ভারতে নির্বাসিত লেখক তসলিমা নাসরিনের বই রাখায় ‘তৌহিদী জনতার’ রোষানলে পড়েন প্রকাশক। পুিলশ গিয়ে তাকে আটকও করে।

এই আক্রমণকেও যখন অনেকে ‘ফ্যাসিবাদী’ রূপ হিসাবে দেখলেন, তখন উপদেষ্টা সাহফুজ এক ফেইসবুক পোস্টে নিজের অবস্থান তুলে ধরে বলেন, “অভ্যুত্থানের পক্ষে হলে মব করা বন্ধ করেন, আর যদি মব করেন, তাইলে আপনাদেরও ডেভিল হিসেবে ট্রিট করা হবে। আজকের ঘটনার পর আর কোনো অনুরোধ করা হবে না। আপনাদের কাজ না আইন নিজের হাতে তুলে নেওয়া।”

‘তৌহিদী জনতা’কে হুঁশিয়ার করে তিনি বলেন, “আপনারা দেড় দশক পর শান্তিতে ধর্ম ও সংস্কৃতি পালনের সুযোগ পেয়েছেন। আপনাদের আহমকি কিংবা উগ্রতা আপনাদের সে শান্তি বিনষ্টের কারণ হতে যাচ্ছে। জুলুম করা থেকে বিরত থাকেন, নইলে আপনাদের ওপর জুলুম অবধারিত হবে।”

মাহফুজ যখন কড়া ভাষায় হুঁশিয়ারি দিলেন, তখন ‘তৌহিদী জনতা’র পক্ষে দাঁড়িয়ে গেলেন মাজারে হামলার বিরোধিতাকারী ফরহাদ মজহার।

তিনি ফেইসবুকে লিখলেন, “তৌহিদী জনতা হিসেবে নিজের পরিচয় দিতে অনেককে খুব শরমিন্দা ও অপরাধী মনে হচ্ছে। অন্যদিকে যারা নিজেদের বাম ও প্রগতিশীল দাবি করেন, তারা তৌহিদী জনতার রণধ্বনিকে ‘মব ও সন্ত্রাস’ গণ্য করেন এবং আইনের শাসনের নামে মূর্ছা যান।

“ইনসাফ হবে যদি গণহত্যা ও মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধের জন্য তৌহিদী জনতাও ‘গণ আদালত’ কায়েম করে। কিন্তু তারা সেটা করেনি। শুধু একুশের বই মেলায় গণঅভ্যুত্থান বিরোধী একজন লেখিকার বই প্রত্যাহারের দাবি করেছে। তাতেই তৌহিদী জনতাকে মব ডাকা এবং মব জাস্টিসের ভীতি দেখানো শুরু হয়ে গেছে।

এর সঙ্গে শ্লেষ যুক্ত করে ফরহাদ মজহার লিখেছেন, “ভালো।”

পঞ্জাবী-টুপি পরা দাড়িওয়ালা কিছু লোকজন সব্যসাচী স্টলে গিয়ে জানতে চায় তারা কেন তসলিমা নাসরীনের ‘চুম্বন’ বই প্রকাশ করেছে।

ভারতে নির্বাসিত তসলিমা নাসরিনকে জুলাই গণঅভ্যুত্থানের বিরোধী এবং ‘দিল্লির আগ্রাসী স্বার্থ এবং হিন্দুত্ববাদের প্রপাগান্ডিস্ট’ হিসেবে দেখার কথাও বলেন তিনি।

ভারতে থাকা শেখ হাসিনার ভার্চুয়াল অনুষ্ঠানে যুক্ত হয়ে ভাষণ দেওয়ার কর্মসূচি আসার পর গত ৫ ফেব্রুয়ারি ঘোষণা দিয়ে বঙ্গবন্ধু ভবন ভাঙা হয়েছিল।

তখন বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের আহ্বায়ক হাসনাত আব্দুল্লাহ এর সপক্ষে বলেছিলেন, তারা ‘ফ্যাসিবাদের শেষ চিহ্ন’ টুকু বাংলা্দেশ থেকে মুছে দিতে চান। তার সেই কর্মসূচিতে ‘বুলডোজার মিছিলে’ রূপ দিয়েছিলেন প্রবাসী দুই ইউটিউবার পিনাকী ভট্টাচার্য এবং ইলিয়াস হোসেন। এই দুজনই জুলাই আন্দোলনে বিদেশে থেকে অনলাইনে সরব থেকে নানা নির্দেশনা দিচ্ছিলেন।

বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সমন্বয়ক থেকে দুজন নাহিদ ইসলাম ও আসিফ মাহমুদ সজীব ভূঁইয়া এবং লিয়াজোঁ কমিটির সমন্বয়কারী মাহফুজ সরকারের উপদেষ্টা হলেও বাইরে রয়েছেন হাসনাত আব্দুল্লাহ ও সারজিস।

বঙ্গবন্ধু ভবন গুঁড়িয়ে দেওয়ার পাশাপাশি বিভিন্ন স্থানে আওয়ামী লীগ নেতাদের পাড়িতে হামলার ক্ষেত্রে হাসনাত ও সারজিসকে সক্রিয় দেখা গেছে।

ইউনূস সরকার প্রথমে বিষয়টি নিয়ে নীরব হলেও টনক নড়ে তখন, যখন তার মনে হয়, গোটা বিষয়টি আওয়ামী লীগকে সুবিধা করে দিচ্ছে। কারণ তাতে আওয়ামী লীগ দমনকারী থেকে এখন আক্রান্ত হিসাবে নিজেকে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে তুলে ধরার সুযোগ পাবে। তাই দুদিন বাদে সরকারের পক্ষ থেকে বিবৃতি আসে, “রক্তক্ষয়ী আন্দোলনের মাধ্যমে অর্জিত নতুন বাংলাদেশের বিজয়ীদের নিশ্চয়ই এমন কিছু করা উচিৎ হবে না, যা দেশের বর্তমান গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানগুলোকে প্রশ্নবিদ্ধ করে এবং স্বৈরাচারী হাসিনার আমলের সঙ্গে তুলনা করার সুযোগ সৃষ্টি হয়।

“তাদের সম্পত্তিতে যেকোনো আক্রমণকে তারা আন্তর্জাতিক দৃষ্টি আকর্ষণ করার এবং তাদের বানোয়াট গল্প প্রচার করার সুযোগ হিসেবে নেবে। এই মুহূর্তে আইনশৃঙ্খলার যেকোনো অবনতি বিশ্বকে ভুল বার্তা দেবে।”

এরমধ্যে আন্দোলনকারীদের মধ্য থেকেই প্রশ্ন আসে, পিনাকী কিংবা ইলিয়াস এই হামলায় ইন্ধন দিয়ে আসলে তার স্বার্থ হাসিল করতে চাইছেন।

জুলাই আন্দোলনে সরব সাবেক ছাত্রনেতা বাকী বিল্লাহ ফেইসবুকে লিখেছেন- “বিপ্লবের গোলোযোগ শেষ করে একজন নেপোলিয়ন হবেন— আরেকজন আয়াতুল্লাহ হতে মোটেও দেরি করতে রাজী নন। এদিকে বিপ্লবের তাড়িতে গাজন উঠে গেছে— কাসেমীরা এসে ভনভন করতেছে।”

আবার সারজিস ও হাসনাতকে নিয়ে জুলাই আন্দোলনে সক্রিয় থাকা মইন আহমেদ নামে এক ছাত্রনেতা লিখেছেন, “৮ দফার কারিগরদের ভুলে যায়েন না। ছাত্রলীগের সাবেক দুই নেতার কারসাজি ভুলে যায়েন না।”

তিনি লেখেন, “আটক হওয়ার কিছুক্ষণ আগে নাহিদ ইসলাম নেত্র নিউজকে একটি সাক্ষাৎকার দিয়েছিলেন। সেখানে তিনি বলেছেন, আন্দোলনের সমন্বয়ক পদ থেকে সারজিস আলমকে অব্যাহতি দেওয়া হয়েছে। এর আগে সাবেক ছাত্রলীগ নেতা সারজিস আলমসহ তিন জন ছাত্র একটি সরকারি প্রতিনিধি দলের সঙ্গে সাক্ষাৎ করে আট দফা দাবি উপস্থাপন করেছিলেন।”

এই সব দেখে আনু মুহাম্মদের মনে প্রশ্ন জেগেছে, কোনোভাবে কি আওয়ামী লীগের ফেরার পথ তৈরি করে দেওয়া হচ্ছে?

বৈষম্যবিরোধী আন্দোলন এক দফা দাবি তোলার আগেই ২ আগস্ট দ্রোহযাত্রার নেতৃতত্ব দিয়ে আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের ডাক দিয়েছিলেন অবসরপ্রাপ্ত এই অধ্যাপক।

তিনি সম্প্রতি প্রথম আলোয় প্রকাশিত এক কলামে লিখেছেন, “যারা ভাংচুরের আহ্বান জানাল, তাদের অনেকে সরকারের সঙ্গে সম্পর্কিত বিভিন্ন সংগঠনের অংশ। ভাংচুরের পরে প্রধান উপদেষ্টা বিবৃতিতে ভাংচুর বন্ধ করতে বলেছেন। পুরো বিষয়টিতেই তিনটি ঘটনা দেখা যাচ্ছে। একদিকে অমনোযোগ, সেই সঙ্গে আলস্য বা নিষ্ক্রিয়তা, আরেক দিকে রহস্য। রহস্য এই যে আসলে সরকারের সিদ্ধান্তটা কে নিচ্ছেন, কীভাবে নিচ্ছেন এবং কেন নিচ্ছেন?

“ফেইসবুকে সরকারের সমর্থক হিসেবে পরিচিত লোকজন নানাভাবে যে ধরনের যুক্তিগুলো দিচ্ছেন, উপদেষ্টারা যে ভাষায় কথা বলছেন, কোনো কোনো সময়ে সেসবের মধ্যে বিরোধ তৈরি হচ্ছে। এর পরিণতি হলো আওয়ামী লীগকে বাংলাদেশ থেকে নিশ্চিহ্ন করার ঘোষণা দিয়ে করা এই কাজগুলো আসলে আওয়ামী লীগের পুনর্বাসন কিংবা প্রত্যাবর্তনের পথ সুগম করছে।”

আরও পড়ুন