আওয়ামী লীগ কি রাজনীতিতে ফিরছে?

ঢাকার বঙ্গবন্ধু ভবন ভাংচুর-অগ্নিসংযোগ করে পরে গুঁড়িয়ে দেওয়া হয়।
ঢাকার বঙ্গবন্ধু ভবন ভাংচুর-অগ্নিসংযোগ করে পরে গুঁড়িয়ে দেওয়া হয়।

সম্প্রতি আওয়ামী লীগকে নিষিদ্ধ করার দাবী আবার চাউর হয়েছে। দাবীটি তুলেছে বৈষম্য বিরোধী আন্দোলনের নেতারাই। তাদের কারো কারো কথায় ইঙ্গিত মেলে, সরকারি পর্যায়ে কেউ কেউ হয়তো আওয়ামী লীগকে রাজনীতিতে ফেরানোর চেষ্টায় রয়েছে।

এমন পরিস্থিতিতে সরকারি নীরবতার মধ্যে ৩২ নম্বরে ভাঙচুরের পাশাপাশি দেশের বিভিন্ন স্থানে বেশকিছু ভাঙচুর হয়েছে। নতুন করে শুরু হয়েছে ব্যাপক ধরপাকড়।

দুটি বিষয় বাংলাদেশের আগামী রাজনীতির রূপরেখায় প্রভাব ফেলছে— ১. মার্কিন-ভারত সম্পর্ক ২. বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক সক্ষমতা।

ডোনাল্ড ট্রাম্প-নরেন্দ্র মোদীর সংবাদ সম্মেলন নিয়ে নানা আলাপ চলছে। খ্যাপাটে হিসেবে পরিচিতি ট্রাম্পের কথা বিশ্লেষণ করলে তার পেছনের কারণ বোঝা যাবে। ঝানু ব্যাবসায়ী ট্রাম্প আসলে এলেবেলে কথা বলেন না। তার নিজস্ব স্টাইল রয়েছে যা কূটনৈতিক বা অন্য রাজনীতিবিদদের সঙ্গে মেলে না।

বাংলাদেশ প্রসঙ্গে ট্রাম্প যে সব শব্দ ব্যবহার করেছেন তার মধ্যে লুকিয়ে রয়েছে অনেক কথা। শত শত বছর ধরে মোদী যে বাংলাদেশ নিয়ে কাজ করছেন না তা বুঝতে কারো অসুবিধা হওয়ার কারণ নাই। তবে কেন শত শত বছর শব্দগুলো স্থান পেল? প্রভাব বলয়ের ভিত্তিতে বিশ্ব বিভাজনের আন্তর্জাতিক স্বীকৃত রূপরেখা কথার আভাস রয়েছে এতে। বাংলাদেশ ভারত অঞ্চলের স্বীকৃত প্রভাব বলয়ের অংশ কথাটি বলছেন মাত্র।

প্রয়াত আওয়ামী লীগ নেতা সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম একবার প্রেস কনফারেন্সে বলেছিলেন— ’ঐতিহাসিকভাবে বাংলাদেশ ভারতের সঙ্গে যুক্ত।’ ট্রাম্পও সৈয়দ আশরাফের আলাপ একই সুত্রে গ্রথিত। ইউক্রেন যেমন রুশ বলয়ের অঞ্চল ঠিক সেভাবেই এ বিষয়টি বিশ্বে দেখা হয়। বিশ্বনেতাদের কাছে কৌশল নির্ধারণে এর গুরুত্ব রয়েছে।

ট্রাম্প ভারতকে বিনা খরচায় বাংলাদেশ ছেড়ে দিচ্ছে না। বরং বাইডেন আমলে বাংলাদেশের রাজনৈতিক পট পরিবর্তনটি ট্রাম্পের জন্য বাড়তি মওকা। ট্রাম্পের বড় বিশ্ব কৌশল ট্যারিফকে কেন্দ্র করে। তিনি ঘোষণা দিয়েছেন, যে দেশ যুক্তরাষ্ট্রের পণ্যে যত ট্যারিফ বসাবে যুক্তরাষ্ট্রও তাদের ওপর তত শুল্ক বসাবে। এছাড়া ট্রাম্প ভারতকে বেশকিছু মার্কিন পণ্য কেনায় সম্মত করাতে চেষ্টা চালিয়ে এরই মধ্যে সফল হয়েছেন।

ভারতের রুশ নির্ভরতা কমানোই মার্কিন ডিপ স্টেটের স্ট্র্যাটেজির প্রধান লক্ষ্য। এতে সাড়া দিলে ভারতের প্রতি মার্কিন চাপ কমে যাবে। ট্রাম্প সফলভাবেই রুশ তেল ছেড়ে মার্কিন তেল কিনতে ভারতকে রাজি করাতে পারছেন বলেই মনে হচ্ছে। সেক্ষেত্রে ইলনের সঙ্গে ছোটখাটো ব্যবসার প্রস্তাব দিয়ে আশান্বিত হওয়াটা শিশুসুলভ আচরণ।

এরই মধ্যে জাতিসংঘের তদন্ত দলের রিপোর্ট প্রকাশ হয়েছে। সেখানে আওয়ামী লীগ সরকার আমলের হত্যাসহ পরবর্তী সরকার আমলের হত্যার বিবরণ এসেছে। এবং দুটো ক্ষেত্রেই এইসব হত্যাকাণ্ডের অভিযোগ গুরুতর। এতসব বলার পরও জাতিসংঘের অবস্থান— আওয়ামী লীগকে রাজনীতি করার অধিকার দিতে হবে।

তদন্ত প্রতিবেদনকে যারা শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে হত্যাকাণ্ডের অভিযোগের আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি ভাবছেন, তাদের আওয়ামী লীগকে রাজনীতি করতে দেওয়ার জাতিসংঘের প্রস্তাবও আমলে নিতে হবে। বিচার ও রাজনীতির অধিকার একে অপরের উপর নির্ভরশীল নয়। ফলে দুটোই সমান্তরাল চলতে বাধা নেই।

আগস্টে শেখ হাসিনার পতনের পর জামাতে ইসলামীর আমিরের বক্তব্য ছিল সুচিন্তিত। যদিও তার বক্তব্য নিয়ে তার দলের ভেতরেই সম্ভবত প্রশ্ন উঠেছিল। তিনি রাজনৈতিকভাবে আওয়ামী লীগকে ক্ষমা করার ঘোষণা দিয়েছিলেন। এছাড়া রাষ্ট্র পরিচালনার নীতি হিসেবে ইসলামী নয় বরং লিবারেল ডেমোক্রেসির সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ প্রস্তাবনা উপস্থাপন করে জামাত। তার ব্যাখ্যায় আমিরের বক্তব্য ছিল— ইসলামী নীতি তারা জনগণের কাছে উপস্থাপন করবেন আর অন্তর্বর্তী সরকারের কাছে উপস্থাপিত নীতিমালা সেটি নয়। আমার ধারণা তিনি তাদের দলের সর্বোচ্চ ফোরামের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী এসব বলেছিলেন। এদিকে বিএনপিও দলীয়ভাবে আওয়ামী লীগকে নিষিদ্ধের দাবীতে সায় দেয়নি।

তবে ওয়ান ইলেভেনের সময় ‘মাইনাস টু’ ফরমুলার কথা আমরা শুনেছি। এটিকে অনেকে বাংলাদেশের ডিপ স্টেটের কর্মসূচি ভাবেন। তাতে কিন্তু বড় বড় দলগুলোর অনেক নেতার সায় ছিল। স্মৃতি ঘাটলে দেখবেন সেনা সমর্থনের সেই সরকারের সময়ও জামায়াতে ইসলামী সুবিধাজনক অবস্থানে ছিল। এখনও রয়েছে।

তবে ওয়ান ইলেভেনের সময় ‘মাইনাস টু’ ফরমুলার কথা আমরা শুনেছি। এটিকে অনেকে বাংলাদেশের ডিপ স্টেটের কর্মসূচি ভাবেন। তাতে কিন্তু বড় বড় দলগুলোর অনেক নেতার সায় ছিল। স্মৃতি ঘাটলে দেখবেন সেনা সমর্থনের সেই সরকারের সময়ও জামায়াতে ইসলামী সুবিধাজনক অবস্থানে ছিল। এখনও রয়েছে।

ডিপ স্টেট কেন ‘মাইনাস টু’ চায় তার বিশ্লেষণ সেভাবে আলোচিত হয়নি। এটা কি তারাই আবিস্কার করেছিল নাকি সক্ষমতায় খাটো কোনো রাজনৈতিক শক্তির প্ররোচনা ছিল? নাকি বিদেশী শক্তির প্রেসক্রিপশন এটি? যেটাই হোক, ইজি টু হ্যান্ডেল, এটাই হয়তো গুরুত্বপূর্ণ।

তারেক রহমানের দেশত্যাগের পেছনে যারা সিদ্ধান্ত নিয়েছিল শেখ হাসিনার দেশত্যাগেও তারা ভূমিকা রেখেছেন। সব মামলা উঠে গেলেও তারেক দেশে এখনও ফেরেননি। এ ঘটনায় আমাদের শিক্ষা কী? আমরা এতটুকু অন্তত আঁচ করতে পারি যে ডিপ স্টেট তাদের কাজের স্বাচ্ছন্দ্যর জন্য রাজনৈতিক দলের নেতৃত্বের পরিবর্তনের পক্ষে।

তবে আওয়ামী লীগ বা বিএনপির কর্মীরা এই দুই পরিবারের বাইরের নেতৃত্ব ভাবতেই পারেন না। হয়তো তারা রাজনীতিতে থাকলে বিকল্প নেতা তৈরিও সম্ভব নয়। তবে রামের জুতা সিংহাসনে রেখে নেতৃত্ব দেওয়া সম্ভব। বিএনপি একবার তাদের জনসভায় বেগম খালেদা জিয়ার জন্য আসন ফাঁকা রেখেছিল।

অনেকে মনে করেন জুলাই ঘটনার পর মুসলিম লীগের মতো আওয়ামী লীগ শেষ হয়ে গেছে। আবার প্রতিপক্ষদের আচরণে মনে হচ্ছে আওয়ামী লীগের সক্রিয়তা তাদের ভীতির কারণ। এদুটো তো পরস্পর বিরোধী চিন্তা।

জুলাইয়ে জনগণের ভেতর ভীষণভাবে আওয়ামী লীগ বিরোধী মনোভাব প্রকাশ পায়। তার প্রকাশ ঘটে টিএসসিতে মানুষের অকাতরে চাঁদা দান। মানুষের সেই সমর্থনে কুঠারাঘাতটা ওখানেই ঘটে—রিলিফ না দিয়ে জমিয়ে রাখায়। এছাড়া বাজার ব্যবস্থাপনাসহ নানা কারণে চাউর হয়—’আগেই ভালো ছিলাম।’ তারসঙ্গে যুক্ত হয়েছে শীর্ষ ছাত্রনেতাদের ভারসাম্যহীন তত্ত্বায়ন। অনেকের লাগামহীন কর্মকাণ্ড। ফলে বিনা পরিশ্রমে আওয়ামী লীগ কিছু স্পেস পেয়ে গেছে। আর জুলাইয়ে গনিমতের মালে পরিণত হওয়া আওয়ামী ভোটার আত্মসাতে কারো কোনো কর্মসূচি না থাকাও আরেকটি কারণ।

ফলে বর্তমানে আওয়ামী লীগ নিষিদ্ধের বর্তমান আওয়াজ অন্তর্বর্তী সরকারের সময় বাড়াতে কাজে দিতে পারে। এর বেশি নয়। আওয়ামী লীগের ভোট ব্যাংক তরুণদের দিকে যাবে না। বরং তাদের মনোযোগ থাকা দরকার ছিল অভ্যুত্থানের পক্ষশক্তির জনসমর্থনকে নিজেদের দিকে টেনে আনা— নতুন দল গঠনে সেটাই কাম্য ছিল। প্রতিষ্ঠিত দলগুলোকে তোয়াজ করে যা মোটেও সম্ভব নয়। দিন যত গড়াবে ততই তরুণরা বি-টিম হয়ে পড়তে থাকবে। স্বতন্ত্র রাজনৈতিক শক্তি হয়ে ওঠা কঠিন হবে।

প্রফেটিক ভবিষ্যৎ বাণী দিয়ে শেষ করি— বর্তমান সরকারের অধীনে আগামী নির্বাচন হচ্ছে না। তত্ত্বাবধায়ক সরকারের পক্ষে আদালত রায় দেবে এবং সরকার পুনর্বিন্যাস হবে। তবে এখনও মাইনাস টু ফরমুলা সফল হওয়ার পথ খোলা রয়েছে। দেশে মানুষ নির্বিঘ্নে ঈদ পালন শেষ করতে পারবে।

মুজতবা হাকিম প্লেটো, সাংবাদিক

আরও পড়ুন