কয়েক বছর ধরে চলা রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ বন্ধ করতে চাইছেন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প। আর এজন্য যুক্তরাষ্ট্রের মিত্রদের মতামত উপেক্ষা করেই সৌদি আরবকে নিয়ে শান্তি চুক্তির চেষ্টা চালানো হচ্ছে। এমনকি এই চুক্তি আলোচনায় নেই যুদ্ধের একপক্ষ ইউক্রেন।
তবে শুধু ইউক্রেন ও ইউরোপ নয়, ট্রাম্পের রাশিয়াপন্থী নীতির প্রভাব অন্যান্য দেশেও পড়তে পারে। যুক্তরাষ্ট্রের দীর্ঘদিনের পররাষ্ট্রনীতিতে হঠাৎ পরিবর্তন এনে ট্রাম্প নতুন কূটনৈতিক পরিস্থিতি সৃষ্টি করেছেন।
চীনের উদ্বেগের কারণ এই পরিবর্তন। ট্রাম্পের শান্তি প্রচেষ্টা চীনা প্রেসিডেন্ট শি জিনপিং ও রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের সম্পর্ককে কীভাবে প্রভাবিত করবে, তা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। একই সঙ্গে, চীন ও ট্রাম্প প্রশাসনের মধ্যে ইতোমধ্যেই টালমাটাল সম্পর্ক আরও জটিল হয়ে উঠতে পারে।
কয়েক সপ্তাহ আগেও মনে হয়েছিল, ইউক্রেন সংকট সমাধানে চীন গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে। ট্রাম্প বলেছিলেন, শির সঙ্গে তিনি কাজ করতে পারেন এবং রাশিয়ার ওপর চীনের অর্থনৈতিক চাপ যুদ্ধ বন্ধে সহায়ক হতে পারে। চীনও বাণিজ্য যুদ্ধ এড়াতে এটি সুযোগ হিসেবে দেখেছিল।
এটি বেইজিংয়ের দীর্ঘদিনের প্রচেষ্টার সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ, যেখানে তারা নিজেকে একটি নিরপেক্ষ পক্ষ হিসেবে উপস্থাপন করতে চেয়েছিল। তারা গ্লোবাল সাউথের প্রতিনিধি হয়ে যুদ্ধ বন্ধে মধ্যস্থতা করতে চায়। তবে, ন্যাটো (ইউরোপীয় সামরিক জোট) তাদের প্রতিপক্ষ রাশিয়াকে সমরাস্ত্র সরবরাহের জন্য চীনের দিকেও অভিযোগ করেছে। তবে চীন তাদের ‘স্বাভাবিক বাণিজ্য’ চালিয়ে যাচ্ছে।

এখন বেইজিং মধ্যস্থতার ক্ষেত্রে রুশ মিত্র হিসেবে জড়িত নয়। বিশ্ব মঞ্চে এক্ষেত্রে তার গুরুত্বও নেই। তারা দ্রুত পরিবর্তন থেকে ছিটকে পড়েছে। আর এই পরিস্থিতিতে চীনের কর্মকর্তারা হতবাক হয়ে পড়েছেন এবং উপযুক্ত কিছু খুঁজে বের করায় ব্যস্ত রয়েছেন।
শি জিনপিংয়ের জন্য পরিস্থিতি গুরুতর। তিনি বছরের পর বছর ধরে রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট পুতিনের সঙ্গে ব্যক্তিগত সম্পর্ক তৈরি করেছেন। রাশিয়ার সঙ্গে চীনের সম্পর্ককে গুরুত্ব দিচ্ছেন। পশ্চিমের সঙ্গে একটি বৃহত্তর শক্তির লড়াইয়ে রাশিয়াকে গুরুত্বপূর্ণ অংশীদার হিসেবে দেখছেন তিনি।
রুশ ট্যাঙ্ক ইউক্রেনের সীমান্তে প্রবেশ করার তিন বছর আগেই শি হিসেব নিকেশ করে ঝুঁকি নিয়েছিলেন। ওই আক্রমণকে নিন্দা না করার এবং রাশিয়ার পণ্য গ্রহণের মাধ্যমে পুতিনকে সহায়তা করার ফলে চীন ইউরোপের বিশ্বাস হারায়। এতে এশিয়ায় আমেরিকার মিত্ররা ন্যাটোর সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক গড়ে তোলে।
সম্প্রতি চীনা কর্মকর্তারা যুক্তরাষ্ট্র ও রাশিয়ার মধ্যস্থতায় শান্তি আলোচনা শুরুর ‘চুক্তি’র প্রতি সমর্থন জানিয়েছেন। জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদে শীর্ষ কূটনীতিক ওয়াং ই মঙ্গলবার বলেছেন, “চীন সব ধরনের শান্তি আলোচনা সমর্থন করে।” একই দিনে সৌদি আরবে রাশিয়া ও যুক্তরাষ্ট্রের শীর্ষ কর্মকর্তারা ইউক্রেনের যুদ্ধ শেষ করার জন্য আলোচনা শুরু করার ভিত্তি স্থাপন করতে মিলিত হন।
যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রমন্ত্রী মার্কো রুবিও রিয়াদে আলোচনা করা চারটি মূল পয়েন্টের মধ্যে ওয়াশিংটন ও মস্কোর মধ্যে ভবিষ্যৎ ‘ভূরাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক সহযোগিতার’ সম্ভাবনাকে উল্লেখ করেছেন।

এর কয়েক দিন আগে, ট্রাম্প প্রশাসনের রাশিয়া-ইউক্রেনের বিশেষ প্রতিনিধি কিথ কেলগ বলেন, যুক্তরাষ্ট্র সরকার পুতিনকে ‘অস্বস্তিকর’ কিছু পদক্ষেপ নিতে বাধ্য করতে চায়। এর মধ্যে ইরান, উত্তর কোরিয়া ও চীনের সঙ্গে রাশিয়ার সম্পর্ক ছেদ করার বিষয়টি অন্তর্ভুক্ত থাকতে পারে।
বিশ্লেষকরা মনে করেন, রাশিয়া-চীন সম্পর্ককে ভেঙে ফেলতে পারবে না ওয়াশিংটন। কারণ, উভয় দেশের মধ্যে গভীর সহযোগিতা রয়েছে। অর্থনৈতিকভাবে বেইজিংয়ের ওপর মস্কোর নির্ভরতা অনেক বেশি।
ট্রাম্পের সম্ভাব্য ভূমিকা নিয়ে চীনের উদ্বেগ থাকতে পারে। ১৯৬৯ সালে সোভিয়েত ইউনিয়ন ও চীনের মধ্যে দীর্ঘ সীমান্ত বিরোধ নিয়ে সংঘর্ষ ঘটে। এই সমস্যা ১৯৯০-এর দশকে এসে সমাধান হয়।
এরপর ছিল যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট রিচার্ড নিকসন ও তার উপদেষ্টা হেনরি কিসিঞ্জারের কূটনৈতিক কৌশল। তারা কমিউনিস্ট শাসিত প্রতিবেশীদের মধ্যে বিভাজনকে কাজে লাগিয়ে বেইজিংয়ের সঙ্গে সম্পর্ক প্রতিষ্ঠা করেন। এর ফলে স্নায়ু যুদ্ধের শক্তির ভারসাম্য যুক্তরাষ্ট্রের পক্ষে চলে আসে।
অবশ্য ইতিহাস পুনরাবৃত্তি হবে এমনটা আশা করা যায় না। বিশ্লেষকেরা বলেন, নতুন প্রতিশ্রুতি বদলের আভাসও ওয়াশিংটনের লক্ষ্যকে সহায়তা করবে।
স্টিমসন সেন্টারের চীন প্রোগ্রামের পরিচালক ইউন সান বলেন, “যদি এটি নিকসনের কৌশলের ৩০ শতাংশও হয়, তবুও এটি সন্দেহের বীজ বুনবে। এটি শি জিনপিংকে রাশিয়ার সঙ্গে গড়ে তোলা ১২ বছরের কৌশলগত সহযোগিতা নিয়ে প্রশ্ন করতে বাধ্য করবে। হয়তো এটি নির্ভরযোগ্য বা শক্তিশালী নয়। চীন তাইওয়ানে আক্রমণ করার সিদ্ধান্ত নিলে চীনারা পেছনে তাকাবে এবং ভাববে – রাশিয়া কী করবে?”
কিন্তু অন্যরা বলেন, বেইজিং রাশিয়ার সঙ্গে তার সম্পর্ক নিয়ে বেশি আত্মবিশ্বাসী।

সাংহাইয়ের ইস্ট চায়না নরমাল ইউনিভার্সিটির রাশিয়া স্টাডিজ সেন্টারের সিনিয়র ফেলো ইউ বিন বলেন, “চীন ও রাশিয়ার সম্পর্ক এক ধরনের আলাদা পর্যায়ে রয়েছে। গত কয়েক দশকে তাদের মধ্যে শক্তিশালী ভিত্তি ও প্রতিষ্ঠাগত সংযোগ তৈরি হয়েছে।”
তিনি উল্লেখ করেন, দুই দেশ বহুপাক্ষিকতা বাড়ানোর এবং ব্রিকস ও সাংহাই সহযোগিতা সংস্থার মতো আন্তর্জাতিক সংগঠন গড়ার জন্য চেষ্টা করছে। তারা নিজেদের সীমান্ত স্থিতিশীলতা বজায় রাখার প্রয়োজনও অনুভব করছে। তিনি বলেন, “আমি মনে করি, ট্রাম্প চার বছরের জন্য আছেন বলে কেউই এটি ছেড়ে দেবে না।”
বরং চীন উদ্বিগ্ন যে “যদি রাশিয়া ও যুক্তরাষ্ট্র তাদের পার্থক্য মিটিয়ে কিছুটা শান্তি অর্জন করে, তাহলে ট্রাম্প প্রশাসন চীনের দিকে মনোযোগ দিতে পারে।”
যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিরক্ষামন্ত্রী পিট হেগসেথ গত সপ্তাহে ইউরোপীয় প্রতিরক্ষামন্ত্রীদের জানান, যুক্তরাষ্ট্র তাদের মহাদেশে নিরাপত্তার উপর প্রধানত মনোযোগ দিতে পারবে না। কারণ তাদের ‘চীনের সঙ্গে যুদ্ধ প্রতিরোধে’ অগ্রাধিকার দিতে হবে।
ট্রাম্প যদি পুতিনের সঙ্গে সরাসরি যোগাযোগ করতে ব্যর্থ হতেন, তবে বেইজিং সম্ভবত রাশিয়ার নেতাকে আলোচনায় নিয়ে আসতে ওয়াশিংটনের সঙ্গে কাজ করার মাধ্যমে আমেরিকার সঙ্গে কিছু উত্তেজনা কমাতে চাইত। কিন্তু এখন এটি অস্পষ্ট যে, চীন ভবিষ্যতে ইউক্রেনে শান্তি আলোচনা চালানোর জন্য কোনো ভূমিকা নেবে কি না।
তবে বিশ্লেষকরা বলেন, একটি চুক্তি স্বাক্ষরিত হলে বেইজিং জাতিসংঘের মাধ্যমে ইউক্রেনে শান্তি রক্ষী বাহিনী পাঠাতে পারে এবং দেশের পুনর্গঠনে ভূমিকা নিতে আগ্রহী হবে।
এখন পর্যন্ত চীনা কর্মকর্তারা সম্প্রতি অনেক কূটনৈতিক প্রচেষ্টা করেছেন যাতে তারা ইউরোপের সঙ্গে হারানো সম্পর্ক পুনরুদ্ধার করতে পারেন। তারা জনসমক্ষে বলেছেন, “ইউক্রেন সংকটে জড়িত সব পক্ষকে শান্তি আলোচনা প্রক্রিয়ায় অংশগ্রহণ করতে হবে” যা ইউরোপের আলোচনার টেবিলে বসার অধিকারের প্রতি ইঙ্গিত করে।

একই সঙ্গে তারা তাদের সম্ভাব্য ভূমিকা বাড়াতে চায়। আবার ট্রাম্পের পুতিনের দিকে ঝোঁক প্রমাণ করে বেইজিংয়ের অবস্থান সব সময় সঠিক ছিল।
অন্যদিকে, ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জেলেনস্কি যুদ্ধ শুরুর পর থেকে বেইজিংয়ের কাছ থেকে তেমন সাড়া পাননি। সম্প্রতি জার্মানিতে শীর্ষ চীনা কূটনীতিক ওয়াংয়ের সঙ্গে ইউক্রেনের কর্মকর্তাদের বৈঠকের পর এ বিষয়ে কিছুটা অগ্রগতি হয়েছে বলে মনে হচ্ছে।
জেলেনস্কি গত মঙ্গলবার এক সংবাদ সম্মেলনে বলেন, “পুতিনকে যুদ্ধ শেষ করতে চাপ দিতে চীনের সঙ্গে আমাদের যোগাযোগ করা গুরুত্বপূর্ণ। এটি মূলত ঘটছে কারণ সব প্রক্রিয়া এখন দ্রুত হচ্ছে।”
আলোচনার টেবিলে যারা থাকবেন, সে বিষয়ে ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট বলেন, আলোচনার টেবিলে সেসব দেশেরই থাকা উচিত যারা নিরাপত্তা নিশ্চিত করার, সহায়তা দেওয়ার, পুতিনকে থামানোর ও ইউক্রেনের পুনরুদ্ধারে বিনিয়োগ করতে প্রস্তুত।
তথ্যসূত্র : সিএনএন, বিবিসি, নিউ ইয়র্ক টাইমস।