‘বিচারিক প্রহসনের’ শিকার চিন্ময় দাশ?

চিন্ময় দাশ

বাংলাদেশ সম্মিলিত সনাতনী জাগরণ জোটের মুখপাত্র, ইসকনের সাবেক নেতা চিন্ময় কৃষ্ণ দাশ ব্রহ্মচারীর জামিন ফের নাকচ হয়ে যাওয়ায় নতুন করে ক্ষোভের জন্ম দিয়েছে ভারতে।

প্রতিবেশী দেশটির কূটনীতিক অঙ্গনেও সমালোচনা শুরু হয়েছে।

চিন্ময় জামিন না পাওয়ায় চরম হতাশা প্রকাশ করেছেন একসময় ঢাকায় হাই কমিশনারের দায়িত্ব পালন করে আসা বীণা সিক্রি।

তিনি বলেই ফেলেছেন, এটি এক ধরনের ‘বিচারিক প্রতারণা’। 

চিন্ময়ের বিরুদ্ধে চলা রাষ্ট্রদ্রোহ মামলায় যথেষ্ট তথ্যপ্রমাণ না থাকারও অভিযোগ করেছেন সাবেক এই কূটনীতিক। 

রাষ্ট্রদ্রোহ মামলায় বৃহস্পতিবার চট্টগ্রামের জজ আদালতে চিন্ময় কৃষ্ণ দাশ ব্রহ্মচারীর জামিন আবেদন নাকচ করা হয়।

জজ আদালতের এই আদেশের বিরুদ্ধে উচ্চ আদালতে যাওয়ার কথা বলেছেন চিন্ময় দাশের আইনজীবী অপূর্ব ভট্টাচার্য।

এর আগে ২৬ নভেম্বর জামিন নাকচ করে চিন্ময় দাশকে কারাগারে পাঠানোর আদেশ দেন চট্টগ্রামের ষষ্ঠ মহানগর হাকিম কাজী শরীফুল ইসলাম।

ওইদিন আদালতের আদেশের পর ব্যাপক হাঙ্গামার ঘটনা ঘটে। হাঙ্গামার মধ্যে সাইফুল ইসলাম আলিফ নামের একজন আইনজীবীকে হত্যার ঘটনা ঘটে।

এরপর থেকে আদালতের শুনানিতে হাজিরে বাধা দেওয়ার অভিযোগ করে আসছিলেন চিন্ময়ের আইনজীবীরা।

এর মধ্যে বৃহস্পতিবার সনাতনী এই ধর্মগুরুর জামিন আবেদন নাকচ হওয়ায় তৈরি হয়েছে হতাশা-ক্ষোভ।

সাবেক কূটনীতিক বীণা সিক্রি এএনআইকে বলেছেন, “এটি দুঃখজনক। চিন্ময় কৃষ্ণ দাশের জামিন আবেদন নাকচ করে দেওয়াটা ন্যায়বিচারের নামে প্রহসন। রাষ্ট্রদ্রোহের অভিযোগে তাকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে, কিন্তু তার কোনো প্রমাণও নেই।

“তারা (কর্তৃপক্ষ) ২৫ অক্টোবরের একটি সমাবেশের কথা বলছে, কিন্তু কোনো প্রমাণ দেখাতে পারেনি…চট্টগ্রাম আদালতে একটি মামলা হলো, তারপর চিন্ময় দাশকে ঢাকা বিমানবন্দর থেকে গ্রেপ্তার করে চট্টগ্রাম নিয়ে যাওয়া হলো। ওই সময় তার জামিন নাকচ করা হলো, যা খুবই অস্বাভাবিক এবং আদালত প্রাঙ্গণে আইনজীবী ও তার সমর্থকদের মধ্যে সংঘর্ষ ঘটে এবং একজন আইনজীবী মারা যায়।”

সিক্রি আরও বলেন, “…চিন্ময় দাশের বিষয় নিয়ে অধ্যাপক ইউনূস কোনো কথাই বলছেন না। তিনি শুধু নিহত আইনজীবীর বিষয়ে বলেছেন এবং সেই ঘটনা নিয়েই উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন। ফলে ন্যায়বিচার ও মানবিকতার সকল দৃষ্টিকোণ থেকেই এটি দুঃখজনক ও দুর্ভাগ্যজনক। আজকে বাংলাদেশে সংখ্যালঘুদের সঙ্গে যা হচ্ছে, তা অবিশ্বাস্য।”

চিন্ময় দাশের মামলার আইনি প্রক্রিয়া, বিশেষ করে শুনানিতে তার আইনজীবীদের অংশ নিতে না দেওয়ার কঠোর সমালোচনাও করেছেন বীণা সিক্রি। একইসঙ্গে সংখ্যালঘুদের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন মামলার বিচারপ্রক্রিয়ার স্বচ্ছতা নিয়েও প্রশ্ন তুলেছেন।   

“২ জানুয়ারি যখন প্রথম জামিন শুনানি হলো, সেদিন চিন্ময় দাশের পক্ষে কোনো আইনজীবী ছিল না, ফলে শুনানি সেদিন মুলতবি হয়ে যায়। কিন্তু একটি স্বাভাবিক বিচারপ্রক্রিয়ায় এবং বাংলাদেশ ও ভারতসহ অনেক দেশের আইনি ব্যবস্থা অনুযায়ী, চিন্ময় দাশের পক্ষে আইনজীবী দেওয়ার কথা রাষ্ট্রের। শুনানি অবশ্যই হওয়ার কথা ছিল, কিন্তু তারা (আইনজীবী) দিতে পারেনি। এরপর এবার সুপ্রিম কোর্টের ১১ জন আইনজীবী তার পক্ষে দাঁড়ালেও জামিন নাকচ করা হয়েছে, কেন জামিন আবেদন বাতিল করা হলো, তার কোনো কারণ আমরা খুঁজে পাচ্ছি না,” বলেন বীণা সিক্রি।

চিন্ময় কৃষ্ণর জামিনের আবেদন প্রত্যাখ্যানের সমালোচনা করেছেন ভারতের পররাষ্ট্র বিষয়ক বিশেষজ্ঞ রবিন্দর শচিদেবও। তার ভাষ্য, বাংলাদেশের বিচার বিভাগ হয়তো সরকারি প্রভাব বা হিন্দু সংখ্যালঘুদের সম্পর্কে পক্ষপাতদুষ্ট হয়ে কাজ করছে।

তার যুক্তি, চিন্ময়ের বিরুদ্ধে আনা অভিযোগ তেমন গুরুতর নয় এবং জামিন তার প্রাপ্য।

রবিন্দর বলেন, বিচারের পদক্ষেপগুলো দেশটিতে ‘ইসলামকে মূল ধর্ম এবং সংস্কৃতি’ হিসেবে প্রতিষ্ঠার প্রচেষ্টাকেই প্রতিফলিত করে।

“অবস্থা দেখে মনে হচ্ছে, বাংলাদেশে বিচার প্রক্রিয়া সরকারের নির্দেশনায় চলছে অথবা এমন ধারণা রয়েছে যে, সংখ্যালঘু হিন্দুদের বিরুদ্ধে মামলাগুলো একটি নির্দিষ্ট উপায়ে চালানো হবে। চিন্ময় দাসের বিরুদ্ধে অভিযোগ গুরুতর নয়। তিনি জামিন পাওয়ার যোগ্য। … মনে হচ্ছে বিচার বিভাগ একটি নতুন বাংলাদেশের মতাদর্শকে মেনে চলছে যেখানে তারা ইসলামকে দেশের প্রাথমিক ধর্ম, প্রাথমিক সংস্কৃতিতে পরিণত করতে চায়,” বলেন রবিন্দর শচিদেব।

চিন্ময়ের পর বাংলাদেশে কয়েকজন ধর্মীয়গুরুকে আটকের পর পরিস্থিতি আরও খারাপ হয়।

কলকাতার ইসকনের মতে, কারাগারে চিন্ময় কুষ্ণের সঙ্গে দেখা করার পর আদিপুরুষ শ্যাম দাস এবং রঙ্গনাথ দাস ব্রহ্মচারীকে আটক করা হয়েছিল।

সংগঠনের ভাইস প্রেসিডেন্ট রাধা রমন দাবি করেছেন, দাঙ্গাবাজরা অস্থিরতার সময় বাংলাদেশে একটি ইসকন কেন্দ্র ভাঙচুরও করেছে।

ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ও বাংলাদেশে ক্রমবর্ধমান সহিংসতা এবং চরমপন্থীদের মতো কথাবার্তায় উদ্বেগ প্রকাশ করে আসছিল।

শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর থেকে সংখ্যালঘুদের উপর হামলার ঘটনা বেড়ে যাওয়ায় ভারত সরকার নিয়মিতভাবেই ঢাকার কাছে উদ্বেগ জানিয়ে আসছে।

আরও পড়ুন