একটা সময় যে ক্রিপ্টোকে মূলধারা থেকে দূরে ঠেলে দেওয়া হয়েছিল, সেই ক্রিপ্টোই এখন আরও গভীরভাবে ব্যাংকিং ব্যবস্থার সঙ্গে যুক্ত হচ্ছে। বৈশ্বিক ব্যাংকিং জগতের নীতিনির্ধারকরা এখন ক্রিপ্টোকে ইতিবাচকভাবে নেওয়ার কৌশল খুঁজছেন।
এফটিএক্স (ক্রিপ্টোকারেন্সি এক্সচেঞ্জ) ও দুটি ক্রিপ্টোবান্ধব ব্যাংক ধসের পর নিয়ন্ত্রক সংস্থাগুলোর পক্ষ থেকে ক্রিপ্টো শিল্পের ওপর কঠোর পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছিল।
ফলে দুই বছর আগে প্রচলিত আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর অনেকে এই খাত থেকে সম্পর্ক ছিন্ন করে। এখন প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প “বিটকয়েন সুপারপাওয়ার” হিসেবে আমেরিকাকে গড়ে তোলার প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন। আর এতে ব্যাংকিং ব্যবস্থার সঙ্গে ক্রিপ্টো আরও নিবিড়ভাবে জড়িয়ে পড়ছে।
পরিস্থিতির সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের মতে, সার্কল ও বিটগোসহ একাধিক ক্রিপ্টো প্রতিষ্ঠান ব্যাংক চার্টার বা লাইসেন্স পাওয়ার জন্য আবেদন করার পরিকল্পনা করছে।
অন্যান্য সূত্র জানায়, ক্রিপ্টো এক্সচেঞ্জ কয়েনবেস গ্লোবাল ও স্টেবলকয়েন নির্মাতা প্যাক্সোস একই ধরনের পদক্ষেপ বিবেচনা করছে।
এমন এক সময়ে এটি ঘটছে, যখন ট্রাম্প প্রশাসন ক্রিপ্টোকে মূলধারার আর্থিক ব্যবস্থায় অন্তর্ভুক্ত করার উদ্যোগ নিচ্ছে এবং কংগ্রেস দুটি বিল নিয়ে এগোচ্ছে।
এই বিলগুলো একটি নিয়ন্ত্রিত কাঠামোর আওতায় স্টেবলকয়েনের ব্যবহার নিশ্চিত করবে। এই আইনের আওতায়, স্টেবলকয়েন ইস্যুকারীদের নিয়ন্ত্রক সংস্থা থেকে চার্টার বা লাইসেন্স গ্রহণ করতে হবে।
কিছু ক্রিপ্টো প্রতিষ্ঠান জাতীয় ট্রাস্ট ব্যাংক বা ইন্ডাস্ট্রিয়াল ব্যাংকের মতো চার্টার পেতে আগ্রহী, যাতে তারা প্রচলিত ব্যাংকের মতো আমানত গ্রহণ ও ঋণ দেওয়ার কাজ করতে পারে।
অন্যদিকে কিছু প্রতিষ্ঠান অপেক্ষাকৃত সীমিত পরিসরের লাইসেন্স চায়, যাতে তারা শুধু স্টেবলকয়েন ইস্যু করতে পারবে।
ট্রাম্প পরিবারের ক্রিপ্টো প্রকল্প ওয়ার্ল্ড লিবার্টি ফাইন্যান্সিয়াল সম্প্রতি ইউএসডি১ নামে একটি স্টেবলকয়েন চালুর পরিকল্পনা প্রকাশ করেছে।
জানা গেছে, এই স্টেবলকয়েনের রিজার্ভ নিরাপদে রাখবে বিটগো। আর এই বিটগো ব্যাংক চার্টার পাওয়ার জন্য আবেদন জমা দেওয়ার দ্বারপ্রান্তে রয়েছে।
ক্রিপ্টো প্রতিষ্ঠান ব্যাংক চার্টার পেলে সেটি কঠোর নিয়ন্ত্রক তদারকির আওতায় পড়বে। বর্তমানে যুক্তরাষ্ট্রে একমাত্র ক্রিপ্টো প্রতিষ্ঠান অ্যানকারেজ ডিজিটাল ফেডারেল ব্যাংক চার্টার পেয়েছে। প্রতিষ্ঠানটি জানিয়েছে, নিয়ম মেনে চলার জন্য তারা কয়েক কোটি ডলার ব্যয় করেছে।
২০২২ সালে একটি ব্যাংক নিয়ন্ত্রক সংস্থা অ্যানকারেজের বিরুদ্ধে সম্মতিপত্র জারি করেছিল। এতে অর্থপাচার বিরোধী কার্যক্রমে প্রতিষ্ঠানটির দুর্বলতা থাকার কথা বলা হয়।
অ্যানকারেজের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা নাথান ম্যাককলি বলেন, “এটি সহজ ছিল না। ব্যাংকগুলোর যে বিস্তৃত নিয়ন্ত্রক ও অনুবর্তনমূলক দায়িত্ব থাকে, তা ক্রিপ্টো শিল্পের সঙ্গে সংযুক্ত করা সম্ভব।”
সান ফ্রান্সিসকোভিত্তিক প্রতিষ্ঠান অ্যানকারেজ চলতি বছর ব্ল্যাকরকের আইশেয়ারস বিটকয়েন ট্রাস্টের জন্য কয়েনবেসের পাশাপাশি একটি কাস্টোডিয়ান হিসেবে কাজ শুরু করেছে।
এছাড়া অ্যানকারেজ ক্রিপ্টো কাস্টোডিয়ান কাপার ও ক্যান্টর ফিটজজেরাল্ড এর সঙ্গে অংশীদারত্ব গড়ে তুলেছে ২ বিলিয়ন ডলারের বিটকয়েন-সমর্থিত ঋণ কর্মসূচিতে।
ক্যান্টরের বড় ক্লায়েন্ট হলো টেথার। প্রসঙ্গত, যুক্তরাষ্ট্রের বর্তমান বাণিজ্যমন্ত্রী হাওয়ার্ড লুটনিক এক সময় ক্যান্টরের প্রধান ছিলেন।
স্টেবলকয়েনগুলো সাধারণত যুক্তরাষ্ট্রের ডলার বা অন্য কোনো সরকারি মুদ্রার সঙ্গে মূল্য সংযুক্ত রাখে। এই মুদ্রাগুলোর মান এক-এক অনুপাতে রাখার জন্য রিজার্ভ রাখা হয় নগদ অর্থ বা ট্রেজারির মতো নগদ-সদৃশ সম্পদে।
বর্তমানে টেথার হলো বিশ্বের সবচেয়ে বড় স্টেবলকয়েন। এর বাজারমূল্য ১৪৫ বিলিয়ন ডলার। এর পরেই রয়েছে সার্কলের ইউএসডি কয়েন। এর প্রায় ৬১ বিলিয়ন ডলারের টোকেন বর্তমানে চলমান রয়েছে।
মাত্র কয়েক বছর আগেও বড় বড় ব্যাংকগুলো ক্রিপ্টো শিল্পের সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন করেছিল। বিশেষ করে এফটিএক্স ধসের পর নিয়ন্ত্রকদের কঠোর নজরদারির কারণে।
সিলভারগেট ক্যাপিটাল ও সিগনেচার ব্যাংক পতনের পর, শিল্পের অনেক উদ্যোক্তা এমন ব্যাংক খুঁজে পেতে হিমশিম খেয়েছেন যারা তাদের জমা গ্রহণ করবে বা ঋণ দেবে।
ট্রাম্প পুনরায় হোয়াইট হাউসে ফিরে আসার পর নিয়ন্ত্রক সংস্থাগুলো ব্যাংকগুলোকে ক্রিপ্টো কার্যক্রম চালাতে হলে পূর্বানুমোদন নেওয়ার বাধ্যবাধকতা অনেকটা শিথীল করেছে।
এ বছরের শেষের দিকে ব্যাংকগুলো কীভাবে ক্রিপ্টোর সঙ্গে যুক্ত হতে পারবে সে বিষয়ে আরও দিকনির্দেশনা আসবে বলে সংশ্লিষ্ট একাধিক সূত্র জানিয়েছে।
এরই মধ্যে কিছু ব্যাংক ক্ষতি পুষিয়ে নিতে এবং এই খাতে অংশীদারত্ব গড়ে তুলতে আগ্রহ দেখাচ্ছে।
চলতি বছরের ফেব্রুয়ারিতে ব্যাংক অব আমেরিকার প্রধান নির্বাহী ব্রায়ান মইনিহ্যান বলেন, একটি আইনি কাঠামো প্রতিষ্ঠিত হলে তার ব্যাংক নিজস্ব স্টেবলকয়েন ইস্যু করতে পারে।
ইউ.এস. ব্যাংকর্প এ মাসে জানিয়েছে, তারা বিটকয়েন লেনদেন ও ব্যাংকিং প্রতিষ্ঠান এনওয়াইডিআইজির সঙ্গে অংশীদারত্বের মাধ্যমে তাদের ক্রিপ্টো কাস্টডি সেবা পুনরায় চালু করবে।
অন্যদিকে, একটি ব্যাংকভিত্তিক কনসোর্টিয়াম (এতে যুক্ত ডয়েচে ব্যাংক ও স্ট্যান্ডার্ড চার্টার্ড) যুক্তরাষ্ট্রে তাদের ক্রিপ্টো কার্যক্রম সম্প্রসারণের উপায় খতিয়ে দেখছে বলে জানা গেছে। ডয়েচে ব্যাংকের একজন মুখপাত্র এ বিষয়ে মন্তব্য করতে অস্বীকৃতি জানিয়েছেন। স্ট্যান্ডার্ড চার্টার্ডও এনিয়ে কিছু বলেনি।
তবে কিছু ব্যাংক এখনও সতর্ক অবস্থানে রয়েছে।
কি কর্প এর প্রধান নির্বাহী ক্রিস গোরম্যান বলেন, ক্রিপ্টো শিল্প ভবিষ্যতে ব্যাংকিং খাতের প্রতিদ্বন্দ্বী হয়ে উঠতে পারে। তার ব্যাংক এই খাতে সম্ভাবনা দেখছে। তবে প্রথমে এটি কীভাবে বিকশিত হয় তা পর্যবেক্ষণ করতে চায়।
তিনি ক্রিপ্টোর সঙ্গে সংশ্লিষ্ট নিয়ন্ত্রক চ্যালেঞ্জ, যেমন অর্থপাচার রোধ বিষয়ক সুরক্ষার দিকে ইঙ্গিত করেন। তিনি বলেন, “প্রথমে ব্যাংকগুলো পরিস্থিতি দেখতে পারে। কিন্তু এর বাইরে গিয়ে তা অনুসরণ করা কঠিন হয়ে যায়।”
তথ্যসূত্র : ব্লুমবার্গ ও ওয়াল স্ট্রিট জার্নাল।