বাংলাদেশে যে কোনো দুর্ঘটনা কিংবা সহিংসতায় নিহতের সংখ্যা নিয়ে লুকোচুরির সন্দেহ বরাবরই ওঠে। ২০১৩ সালে মতিঝিলে শাপলা চত্বরে হেফাজতের সমাবেশে হাজার মানুষ নিহত হয় বলে তখন দাবি উঠেছিল। গত বছরের জুলাই অভ্যুত্থানের সময়ও দাবি উঠেছিল, নিহতের সংখ্যা কয়েক হাজার।
আগের দুটি ঘটনা ঘটেছিল আওয়ামী লীগ সরকার আমলে। গত বছরের অভ্যুত্থানে সেই সরকারের পতনের পর এখন যে অন্তর্বর্তী সরকার ক্ষমতায়, তাদের অনেকেও ওই দুটি ঘটনায় বহু হতাহতের ঘটনাকে সমর্থন করেন।
কিন্তু ঢাকার মাইলস্টোন স্কুল ও কলেজে বিমান বিধ্বস্তের পর এবার মুহাম্মদ ইউনূস নেতৃত্বাধীন অন্তর্বর্তী সরকারই এখন লাশ লুকানোর অভিযোগে বিদ্ধ।
সেই অভিযোগ প্রত্যাখ্যান করে সোমবারই প্রধান উপদেষ্টার দপ্তর থেকে বলা হয়, লাশ গোপন করার অপপ্রচার চলছে। এবার প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সচিব শফিকুল আলম বললেন, বাংলাদেশে লাশ গোপন করা অসম্ভব।
তিনি বুধবার এক ফেইসবুক পোস্টে লেখেন, “সাংবাদিক হিসেবে আমি ২০০২ থেকে ২০২৪ সাল পর্যন্ত অসংখ্য বড় ধরনের দুর্ঘটনা-দুর্যোগের ঘটনায় রিপোর্ট লিখেছি। আমি নিশ্চিতভাবে বলতে পারি যে বাংলাদেশে হতাহতের সংখ্যা গোপন করা কার্যত অসম্ভব।”
বিমানবাহিনীর একটি প্রশিক্ষণ বিমান গত সোমবার বিধ্বস্ত হয়ে পড়ে ঢাকার দিয়াবাড়ির মাইলস্টোন স্কুল ভবনে। তাতে বৈমানিক নিহত হওয়ার পাশাপাশি বহু হতাহত হয়।
নিহতের সর্বশেষ সংখ্যা প্রধান উপদেষ্টার কার্যালয় থেকে ২৯ বলা হলেও আইএসপিআর বলছে ৩১ জন। তবে শ খানেক নিহত হওয়ার দাবিও করছেন কেউ কেউ। বুধবার মাইলস্টোনের শিক্ষার্থীরা লাশের প্রকৃত হিসাব চেয়ে বিক্ষোভ করে, সেখানে ‘লাশের হিসাব চাই’ লেখা ফেস্টুনও ছিল।
দুই উপদেষ্টার সঙ্গে সেখানে গিয়ে বিক্ষোভে আটকে পড়েছিলেন প্রেস সচিব শফিকুলও। নয় ঘণ্টা পরে স্কুলের পেছনের গেইট দিয়ে তারা বেরিয়ে আসেন।
মাইলস্টোনে হতাহতের বিষয়ে স্বাস্থ্য মন্ত্রলালয়ের এক রকম তথ্য, আন্তঃবাহিনী জনসংযোগ পরিদপ্তরের (আইএসপিআর) আরেক রকম তথ্যে বিভ্রান্তি তৈরি হয়েছে। তাতে লাশের হিসাব লুকানোর সন্দেহও বাড়ছে, যা অন্তর্বর্তী সরকারকেও চাপে ফেলেছে।

মাইলস্টোনে গিয়ে মৃত্যুর সংখ্যা নিয়ে শিক্ষার্থীদের অভিযোগের মুখে পড়ার কথা স্বীকার করে প্রেস সচিব শফিকুল লিখেছেন, “প্রাথমিকভাবে, কেউ নিখোঁজ থাকলে পরিবারগুলো সেটা রিপোর্ট করে। হাসপাতাল ও কর্তৃপক্ষের কাছে তথ্য জানায় এবং সেখান থেকে তারা তাদের প্রিয়জনদের খুঁজে পায়। এই ঘটনায় মাইলস্টোন কলেজ নিখোঁজদের সনাক্ত করার জন্য সেদিনের শিক্ষার্থীদের উপস্থিতির রেকর্ড ক্রস-রেফারেন্স করতে পারে।”
স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়, সামরিক বাহিনীর কাজের পাশাপাশি মাইলস্টোন স্কুল কর্তৃপক্ষেরও একটি কমিটি করার কথা জানিয়ে শফিকুল বলেন, “আমি দ্ব্যর্থহীনভাবে বলতে পারি, হতাহতের সংখ্যা কম করে দেখানোর কোনো কারণ সরকারের নেই।”
প্রেস সচিব এই ঘটনায় আরেকটি পোস্টও শেয়ার করেছেন, যেখানে দাবি করা হয়েছে, বিমান বিধ্বস্তের ঘটনাকে ঘিরে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে গুজব ও অপতথ্য ছড়াচ্ছে আওয়ামী লীগ। ‘লাশ গুম’-এর কোনো প্রমাণ না থাকলেও দলটির অফিসিয়াল ফেইসবুক পেইজ থেকে এ সংক্রান্ত অন্তত ২১টি পোস্ট করা হয়েছে।
এই আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনাকেই গণহত্যার অভিযোগে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে বিচারের আওতায় এনেছে অন্তর্বর্তী সরকার। এই ট্রাইব্যুনালে তার বিরুদ্ধে জুলাই গণহত্যা, ২০১৩ সালে হেফাজতের সমাবেশে গণহত্যা এবং ১৫ বছরে অসংখ্য গুম-খুনের অভিযোগ আনা হয়েছে।
গত বছর সরকারি চাকরিতে কোটা সংস্কারের দাবিতে আন্দোলন দমনে যখন আওয়ামী লীগ সরকার কঠোর হাতে দমনের দিকে গিয়েছিল, তখন সহিংসতায় অনেক মৃত্যু ঘটে। তবে মৃত্যুর তথ্য সরকার গোপন করছিল বলেও অভিযোগ রয়েছে।
অভ্যুত্থানের সমর্থকরা তখন হাজার হাজার মৃত্যু ঘটানোর জন্য আওয়ামী লীগ সরকারকে দায়ী করেছিল। আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর আন্দোলনকারীরা দেড় হাজারের বেশি মৃত্যুর একটি হিসাবও দিয়েছিল, যার ভিত্তিতে আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলোও সেই হিসাব লিখেছে।
কিন্তু ইউনূসের অভ্যুত্থানের সরকারের যাচাই-বাছাইয়ের পর অভ্যুত্থানে নিহতের সংখ্যা ৯০০ এর বেশি গড়ায়নি। সরকারি গেজেটে নিহতের সংখ্যা এখনও ৮৩৪।
২০১৩ সালের ৫ মে মতিঝিলে হেফাজতে ইসলামের সমাবেশ আওয়ামী লীগ সরকার সাঁড়াশি অভিযান চালিয়ে পণ্ড করে দেওয়ার পর নিহতের সংখ্যা কয়েকশ, এমনকি হাজার ছাড়িয়েছে বলে দাবি উঠেছিল।
দেশে-বিদেশে তখন এনিয়ে সরব ছিল ইসলামী সংগঠনগুলো। আওয়ামী লীগ সরকার তখন লাশের হিসাব দিয়ে বলেছিল, ওই দিন সব মিলিয়ে দুই ডজনের মতো নিহত হয়।
মানবাধিকার সংগঠন অধিকার, যার সম্পাদক আদিলুর রহমান খান শুভ্র এখন অন্তর্বর্তী সরকারের উপদেষ্টা, তখন নিহতের সংখ্যাটি ৬১ বলেছিল। তা অনেকের দাবি করা সংখ্যার চেয়ে অনেক কম হলেও এই ঘটনা ধরে আদিলুর রহমানকে জেলও খাটতে হয়েছিল।
আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর হেফাজত ট্রাইব্যুনালে গণহত্যার অভিযোগ আনার পাশাপাশি ২০১৩ সালে নিহতের একটি হিসাব দিয়েছে। তবে সেই হিসাবও তাদের আগের দাবির চেয়ে অনেক কম; সংখ্যাটি ৯৩ বলছে তারা।
বার্তা সংস্থা এএফপিতে কাজ করে আসা শফিকুল আলম মাইলস্টোনের ঘটনা ধরে বাংলাদেশে লাশের তথ্য গোপন অসম্ভব এখন বললেও ক’দিন আগেও অভিযোগ করেছিলেন, ২০১৩ সালে আওয়ামী লীগ লাশের তথ্য গোপন করেছিল।
গত ফেব্রুয়ারিতে এক সভায় তিনি বলেছিলেন, “আমার অফিস তখন মতিঝিলে ছিল। সেদিন আমরা সারারাত জেগে রিপোর্ট করেছি। সরকার প্রথমে সাতজন নিহত হওয়ার কথা জানায়, পরে সেই সংখ্যা ১৩, তারপর ২৩ জন বলে দাবি করা হয়। তবে প্রকৃত সংখ্যা প্রকাশ করা হয়নি। আমরা যে সংখ্যা প্রকাশ করেছিলাম, তা ছিল অনেক বেশি।
এ সংক্রান্ত আরও খবর: