বিশেষ ক্ষমতা আইন যে ব্যবহৃত হচ্ছে না, তা নয়: প্রধান উপদেষ্টার বিশেষ সহকারী

Special Act-01

বিতর্কিত ‘বিশেষ ক্ষমতা আইন’ অন্তর্বর্তী সরকার অনেক আগে থেকে প্রয়োগ করছে তা স্বীকার করেছেন প্রধান উপদেষ্টার বিশেষ সহকারী খোদা বখস চৌধুরী।

এ বিষয়ে গত ১৩ এপ্রিল অনুসন্ধানী প্রতিবেদন প্রকাশ করে দ্য সান ২৪। ‘বিশেষ ক্ষমতা আইনের নীরব প্রয়োগ চলছেই, আটক অনেকে‘ শিরোনামের প্রতিবেদনে বলা হয়, বিরোধী মত দমনে অন্তর্বর্তী সরকার ১৯৭৪ সালের বিশেষ ক্ষমতা আইনের ৩ (১) ধারা প্রয়োগ করে আসছে।

অবশ্য মিস আর্থ বাংলাদেশ-২০২০ বিজয়ী মডেল মেঘনা আলমকে গ্রেপ্তারের পর এই আইন প্রয়োগ নিয়ে শুরু হয় আলোচনা-সমালোচনা।

মঙ্গলবার সচিবালয়ে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সভাকক্ষে আইনশৃঙ্খলা–সংক্রান্ত কোর কমিটির সভা শেষে খোদা বখস চৌধুরী সাংবাদিকদের বলেন, “মেঘনা আলমের সঙ্গে এই আইন প্রথম ব্যবহৃত হচ্ছে, বিষয়টা তা নয়। তার বিরুদ্ধে একটি অভিযোগ এসেছে। বিষয়টি আদালতে গেছে। বিচারাধীন বিষয়ে কথা বলা ঠিক হবে না।”

মেঘনা আলমের গ্রেপ্তার প্রক্রিয়ায় ‘গলদের’ কথা স্বীকার করেছেন খোদ আইন উপদেষ্টা। এ বিষয়ে দৃষ্টি আকর্ষণ করা হলে খোদা বখস চৌধুরী বলেন, “আইন উপদেষ্টা কোন পরিপ্রেক্ষিতে এই কথা বলেছেন, তা আমরা জানি না। তিনি আমাদের কাছে এ বিষয়ে কিছু জানতেও চাননি। এখন বিষয়টি আদালতে চলে গেছে।”

এ সময় স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা লেফটেন্যান্ট জেনারেল (অব.) মো. জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরী উপস্থিত ছিলেন।

গত রোববার সচিবালয়ে এক সংবাদ সম্মেলনে আইন উপদেষ্টা আসিফ নজরুল বলেছিলেন, “মডেল মেঘনা আলমকে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ডিটেনশন দিয়েছিল। এ নিয়ে অনেক বিতর্ক তৈরি হয়েছে। আপনাদের শুধু একটি জিনিস বলতে চাই, আমরা সরকারের উচ্চপর্যায়ে এ নিয়ে মিটিং করেছি। ওনাকে যে প্রক্রিয়ায় গ্রেপ্তার করা হয়েছে, বিশেষ ক্ষমতা আইনে, সেটা সঠিক হয়নি।”

এর আগে বুধবার রাতে মডেল মেঘনা আলমকে রাজধানীর বসুন্ধরার বাসা থেকে আটক করে হেফাজতে নেয় ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) গোয়েন্দা শাখা (ডিবি)।

স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের আদেশ অনুযায়ী, পরদিন বৃহস্পতিবার রাত ১০টার দিকে বিশেষ ক্ষমতা আইনে মেঘনা আলমকে ৩০ দিনের আটকাদেশ দিয়ে কারাগারে পাঠানোর নির্দেশ দেন ঢাকার চিফ মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট (সিএমএম) আদালতের বিচারক সেফাতুল্লাহ।

আদালত বিশেষ ক্ষমতা আইনের ৩(১) ধারায় অর্পিত ক্ষমতাবলে তাকে ৩০ দিনের জন্য কারাগারে পাঠানোর নির্দেশ দেয়।

তবে মেঘনা প্রথম নন, আওয়ামী লীগের নেতাকর্মী থেকে শুরু করে পুলিশের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তার আটকাদেশের ক্ষেত্রেও ‘নীরবে’ প্রয়োগ হচ্ছে এই আইনটি।

বিশেষ ক্ষমতা আইনে আটকাদেশের সরকারি আদেশের একটি অনুলিপি নিয়ে দ্য সান ২৪ যে প্রতিবেদন প্রকাশ করেছিল তাতে উল্লেখ করা হয়, এই আইন প্রয়োগ করে চট্টগ্রামের একজন সাবেক নারী কাউন্সিলর, পুলিশের অতিরিক্ত উপমহাপরিদর্শকসহ বেশ কয়েকজনের বিরুদ্ধে আটকাদেশ দেওয়া হয়েছে মার্চ মাসের দ্বিতীয় সপ্তাহে।

সরকারের স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের ওই নথিতে স্পষ্ট উল্লেখ রয়েছে চট্টগ্রামের চারজনকে বিশেষ ক্ষমতা আইনে কারাবন্দি করে রাখা হয়েছে।

স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের জননিরাপত্তা বিভাগের রাজনৈতিক শাখা-২ গত ৮ এপ্রিল ওই আদেশ জারি করে, যেখানে ১১ মার্চ থেকে আটকাদেশ জারির কথা বলা হয়েছে।

৮ এপ্রিলের আদেশে মূলত আগের আটকাদেশের মেয়াদ বর্ধিত করার কথা জানানো হয়।

সিনিয়র সহকারী সচিব মো. জিয়াউল হক মীর স্বাক্ষরিত আদেশে বলা হয়েছে, ১৯৭৪ সালের বিশেষ ক্ষমতা আইনের ৩ (১) ধারার প্রদত্ত ক্ষমতাবলে আইনশৃঙ্খলা বিঘ্নকারী ক্ষতিকারক কাজ হতে বিরত রাখার জন্য বাংলাদেশ সরকার চারজনের আটককাদেশ বর্ধিত করা হলো।

এরমধ্যে এক নম্বরে রয়েছেন চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের (চসিক) সাবেক কাউন্সিলর রেখা আলম চৌধুরী।

গত ৮ ফেব্রুয়ারি ৫৪ ধারায় গ্রেপ্তার দেখিয়ে তাকে আদালতে সোপর্দ করা হলে আদালত কারাগারে পাঠানোর আদেশ দেয়। তখন থেকে সাবেক কাউন্সিলর রেখা আলম চৌধুরী কারান্তরীণ।

কোনো মামলা না থাকলেও বিশেষ ক্ষমতা আইনে আটকে রাখা এই নারী নেত্রীর আটকাদেশের মেয়াদ দ্বিতীয় দফায় ১০ এপ্রিল থেকে পরর্বর্তী ৬০ দিনের জন্য বাড়ানো হয়।

এ ছাড়া বাংলাদেশ পুলিশের চট্টগ্রাম রেঞ্জের অতিরিক্ত উপমহাপরিদর্শক (ডিআইজি) মশিউর রহমানকে গত ১৯ সেপ্টেম্বর ঢাকার বিমানবন্দর এলাকা গ্রেপ্তার করে পুলিশের গোয়েন্দা শাখার (ডিবি) সদস্যরা। পরে সাত দিনের হেফাজতে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করে কারাগারে পাঠানো হয়েছে।

এই পুলিশ কর্মকর্তার বিরুদ্ধেও বিশেষ ক্ষমতা আইনের ৩ (১) ধারা প্রয়োগ করে তার আটকাদেশের মেয়াদও গত ১০ এপ্রিল থেকে ৬০ দিন বাড়ানো হয়েছে।

চট্টগ্রাম মহানগর যুব মহিলা লীগের সদস্য জিন্নাত সুলতানা ঝুমার (৩৫) ক্ষেত্রেও প্রয়োগ করা হয়েছে একই আইন। তার আটকাদেশের মেয়াদও দুই মাসের জন্য বাড়ানো হয়েছে একই আইনের ক্ষমতাবলে।

এছাড়া চট্টগ্রামের হালিশহরের মিয়াখান নগর এলাকার দস্তগীর আহমদ সুমনের (৪৭) বিরুদ্ধে বিশেষ ক্ষমতা আইন প্রয়োগ করেছে সরকার, বাড়ানো হয়েছে আটকাদেশের মেয়াদ।

নথি থেকে এটি স্পষ্ট বিশেষ ক্ষমতা আইনের প্রয়োগ মডেল মেঘনা আলমের আটকের অনেক আগে থেকেই প্রয়োগ করে আসছে অন্তর্বর্তী সরকার।

এ বিষয়ে সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী ইশরাত হাসান বলেন, “এই আইনের অনেক অপপ্রয়োগ হয়। এই আইন বিচারবহির্ভূতভাবে ব্যক্তি স্বাধীনতা হরণ করে থাকে। এটি সংবিধানের ৩২ অনুচ্ছেদে বর্ণিত ‘জীবন ও ব্যক্তি-স্বাধীনতার অধিকার’- এর পরিপন্থী।”

আইনটির প্রয়োগ নিয়ে প্রশ্ন তুলে তিনি বলেন, আইনে সিএমএম কোর্টের এ ধরনের অনুমতি দেওয়ার কোনও সুযোগ নাই। আইন ব্যত্যয় করে যদি কাউকে অ্যারেস্ট করে, তাহলে তা সম্পূর্ণ অবৈধ।”

বিশেষ ক্ষমতা আইনের ব্যবহার নিয়ে অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল গভীরভাবে উদ্বিগ্ন। এই দমনমূলক আইনটি অস্পষ্ট ও অতিরিক্ত বিস্তৃত বিধানের মাধ্যমে অতীতে দীর্ঘ সময় ধরে বিচার ছাড়াই এবং কোনো আদালতের নজরদারি ছাড়াই মানুষকে স্বেচ্ছাচারভাবে আটক করতে ব্যবহৃত হয়েছে।

দক্ষিণ এশীয় আঞ্চলিক কার্যালয় থেকে অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালের ভেরিফায়েড এক্স (সাবেক টুইটার) হ্যান্ডলে এক পোস্টে সংস্থাটি জানায়, “এসব ঘটনাকে যথাযথ প্রক্রিয়াগত নিরাপত্তা এবং আন্তর্জাতিক মানবাধিকার মান ও সর্বোত্তম চর্চার চরম লঙ্ঘন হিসেবে বিবেচনা করা হয়,” যোগ করা হয় ওই পোস্টে।

বাংলাদেশে এই বিশেষ ক্ষমতা আইনকে ‘কালো আইন’ হিসেবেও অভিহিত করা হয়। এর আগেও বিভিন্ন সময় এই আইনটি অপসারণের দাবি ওঠেছে, তবে কোনও সরকারই তা করেনি।

মূলত, পাকিস্তানের নিরাপত্তা আইন ১৯৫২, জন নিরাপত্তা অর্ডিন্যান্স ১৯৫৮ এবং ১৯৭২ সালের বাংলাদেশ তফসিলি অপরাধ (বিশেষ ট্রাইব্যুনাল) আদেশকে প্রতিস্থাপনের জন্য বাংলাদেশের স্বাধীনতার পর ১৯৭৪ সালের নয়ই ফেব্রুয়ারি এই আইনটি পাস করা হয়েছিলো।

এর উদ্দেশ্য ছিল, বিশেষ ব্যবস্থার মাধ্যমে রাষ্ট্রবিরোধী কিছু কার্যকলাপ প্রতিহত করা। একই সাথে কিছু গুরুতর অপরাধের দ্রুত বিচার এবং কঠোর শাস্তির ব্যবস্থা করা।

বিশেষ ক্ষমতা আইন, ১৯৭৪’ বা ডিটেনশন আইন প্রয়োগ করে সরকার কোনও ব্যক্তিকে আদালতের আনুষ্ঠানিক বিচার ছাড়াই জননিরাপত্তা, রাষ্ট্রের নিরাপত্তা ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষার স্বার্থে সন্দেহভাজন হিসাবে নির্দিষ্ট সময়ের জন্য আটক বা বন্দি করতে পারে।

আরও পড়ুন

সর্বশেষ

ads