মুক্তিযোদ্ধার সংজ্ঞা নিয়ে বিতর্কের মধ্যে দাঁড়িপাল্লা নিশ্চিত হলো জামায়াতের

নির্বাচনী প্রতীক দাঁড়িপাল্লাকে ফিরে পেল জামায়াতে ইসলামী।
নির্বাচনী প্রতীক দাঁড়িপাল্লাকে ফিরে পেল জামায়াতে ইসলামী।

অন্তর্বর্তী সরকার আমলে এত এত ঘটনা ঘটছে, তাতে একটির মধ্যে চাপা পড়ছে আরেকটি। এরমধ্যে একটি চাপা দিতে আরেকটি ঘটনা ঘটানো হচ্ছে কি না, সেই সন্দেহও আছে কারো কারো মধ্যে।

অন্তর্বর্তী সরকারের বাজেট কাউকে তুষ্ট করতে না পারার পরদিন রাতে হঠাৎ করেই মুক্তিযোদ্ধাদের নতুনভাবে সংজ্ঞায়িত করে জাতীয় মুক্তিযোদ্ধা কাউন্সিল আইন সংশোধনের অধ্যাদেশ জারি হয়।

মঙ্গলবার রাতে জারি করা এই অধ্যাদেশের অস্পষ্টতা নিয়ে বুধবার দিনভর আলোচনার মধ্যে জামায়াতে ইসলামীর নিবন্ধন ফিরিয়ে দেওয়ার পাশাপাশি নির্বাচনী প্রতীক হিসাবে দলটিতে দাঁড়িপাল্লা দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে নির্বাচন কমিশন (ইসি)।

আওয়ামী লীগ আমলে হাই কোর্টের এক রায়ের পর ২০১৮ সালে জামায়াতের নিবন্ধন বাতিল করেছিল ইসি।

সেই আওয়ামী লীগ আমলেই ২০১৬ সালে মুক্তিযোদ্ধার সংজ্ঞা নির্ধারণ করে তার আলোকে ২০২২ সালে জাতীয় মুক্তিযোদ্ধা কাউন্সিল আইন প্রণয়ন হয়েছিল।

সেই আইনটিই এখন সংশোধন করেছে অন্তর্বর্তী সরকার। তাতে মুক্তিযোদ্ধাদের পাশাপাশি সহযোগী মুক্তিযোদ্ধা নামে একটি শ্রেণী তৈরি করেছে। রণাঙ্গনের মুক্তিযোদ্ধা, বীরাঙ্গনা ও মুক্তিযুদ্ধকালীন ফিল্ড হাসপাতালের চিকিৎসক-নার্স রেখে অন্যদের মুক্তিযোদ্ধার তালিকা থেকে বাদ দিয়ে সহযোগী মুক্তিযোদ্ধার কাতারভুক্ত করা হয়েছে।

২০১৬ সালের সংজ্ঞায় মুজিবনগর সরকারে যুক্ত সবাই, তৎকালীন এমএনএ বা এমপিএ (যারা পরে গণপরিষদের সদস্য হয়েছিলেন), স্বাধীন বাংলা বেতারের শিল্পী-কলাকুশলী, স্বাধীন বাংলা ফুটবল দলের খেলোয়াড়, প্রবাসে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে সক্রিয় সবাই মুক্তিযোদ্ধা হিসাবে স্বীকৃতি পেয়েছিলেন।

সংশোধিত আইনের অধ্যাদেশ জারির পর প্রশ্ন উঠে- এখন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, জাতীয় চার নেতা সৈয়দ নজরুল ইসলাম, তাজউদ্দীন আহমদ, এম মনসুর আলী, এএইচএম কামারুজ্জামানের মুক্তিযোদ্ধা স্বীকৃতি কি আছে, নাকি নেই?

অধ্যাদেশে এক স্থানে লেখা আছে- প্রবাসী সরকার (মুজিবনগর সরকার) মুক্তিযোদ্ধার স্বীকৃতি পাচ্ছে; আবার অন্য স্থানে লেখা আছে- প্রবাসী বাংলাদেশ সরকারের (মুজিবনগর সরকার) অধীন কর্মকর্তা বা কর্মচারী বা দূত এবং ওই সরকারের নিয়োগ করা চিকিৎসক, নার্স বা অন্যান্য সহকারী পরিচিত হবেন সহযোগী মুক্তিযোদ্ধা হিসাবে। মুজিবনগর সরকারে সম্পৃক্ত সব এমএনএ বা এমপিএও হবেন সহযোগী মুক্তিযোদ্ধা।

আবার আইনের প্রস্তাবনা যেভাবে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের কথা দিয়ে শুরু হয়েছিল, তা দেওয়া হয়েছে অধ্যাদেশে।

এসব নিয়ে বিভ্রান্তির পর মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক উপদেষ্টা ফারুক ই আজম অবশ্য সাংবাদিকদের স্পষ্ট করেন, বঙ্গবন্ধুসহ জাতীয় চার নেতার মুক্তিযোদ্ধা স্বীকৃতি বহালই থাকছে।

খেতাবধারী মুক্তিযোদ্ধা ফারুক ই আজম মুজিবনগর সরকারের সবাইকে না রাখার ব্যাখ্যায় বলেন, মুক্তিযোদ্ধাদের তালিকা যাচাই–বাছাই করতে গিয়ে দেখা যায়, মুজিবনগর সরকারের কিছু কর্মচারী ‘বীর মুক্তিযোদ্ধা’ হিসেবে গণ্য হচ্ছেন। এখন থেকে তারা হবেন ‘মুক্তিযুদ্ধের সহযোগী’।

আগের আইনের মতো অধ্যাদেশেও জামায়াতকে স্বাধীনতাবিরোধী দল হিসেবেই চিহ্নিত করা হয়েছে। মুক্তিযুদ্ধের সংজ্ঞায় বলা হয়েছে, মুক্তিযোদ্ধাদের এই যুদ্ধ পাকিস্তানি বাহিনীর পাশাপাশি জামায়াতসহ রাজাকার, আল-বদর, আল-শামস, মুসলিম লীগ, নেজামে ইসলাম এবং দালাল ও শান্তি কমিটির বিরুদ্ধেও ছিল।

স্বাধীনতাবিরোধী জামায়াতের গঠনতন্ত্র বাংলাদেশের সংবিধানবিরোধী বলে হাই কোর্ট রায় দেওয়ার পরই জামায়াতের নিবন্ধন বাতিল করেছিল ইসি। ফলে ২০১৮ সাল থেকে জামায়াত দলীয়ভাবে নির্বাচনে অংশগ্রহণের যোগ্যতা হারিয়ে ফেলে।

গত বছর জুলাই আন্দোলন চলার মধ্যে জামায়াতকে ‘সন্ত্রাসী দল’ হিসেবে নিষিদ্ধও করেছিল শেখ হাসিনার সরকার। কিন্তু তার কয়েকদিন পরই ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে সেই সরকারের পতন ঘটে।

এরপর অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব নিয়েই জামায়াতের নিষেধাজ্ঞা তুলে নেয়। তবে ইসির নিবন্ধন না থাকায় জামায়াতের ভোটে অংশগ্রহণের পথ বন্ধই ছিল।

রাষ্ট্র ক্ষমতায় পালা বদলের পর জামায়াত নিয়ে সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগের রায়ও উল্টে যায়। গত ১ জুন আপিল বিভাগের রায়ে হাই কোর্টের রায় বাতিল হয়ে যায়। তাতে খুলে যায় জামায়াতের নিবন্ধন ফেরত পাওয়ার দরজা।

রায়ে আপিল বিভাগ অবশ্য বলেছিল, জামায়াত তাদের প্রতীক হিবেবে দাঁড়িপাল্লা ফেরত পাবে কি না, সেই সিদ্ধান্ত নেবে ইসি।

বুধবার মুক্তিযোদ্ধার সংজ্ঞা পরিবর্তন নিয়ে আলোচনা যখন তুঙ্গে, তখন ঢাকার আগারগাঁওয়ে নির্বাচন ভবনে নির্বাচন কমিশনের সভায় জামায়াতকে দাঁড়িপাল্লা ফেরত দেওয়ার সিদ্ধান্ত হয়ে যায়।

সভা শেষে নির্বাচন কমিশনার আবুল ফজল মো. সানাউল্লাহ সাংবাদিকদের এই সিদ্ধান্ত জানান বলে প্রথম আলোয় প্রকাশিত প্রতিবেদনে বলা হয়েছে।

তিনি আদালতের পর্যবেক্ষণের কথা উল্লেখ করে বলেন, সবকিছু বিবেচনায় নিয়ে নির্বাচন কমিশন নীতিগতভাবে সিদ্ধান্ত নিয়েছে, জামায়াতে ইসলামীর দাঁড়িপাল্লা প্রতীক ফেরত দেওয়া হবে।

কোন বিবেচনায় জামায়াতকে দাঁড়িপাল্লা দেওয়া হচ্ছে, সে বিষয়ে সানাউল্লাহ বলেন, ২০০৮ সালে নিবন্ধন চালুর সময় জামায়াতকে দাঁড়িপাল্লা প্রতীক বরাদ্দ দেওয়া হয়েছিল, এরপর এই প্রতীকে জামায়াতের নির্বাচনে অংশও নিয়েছিল।

সুপ্রিম কোর্টের অনুরোধ উপেক্ষার বিষয়ে তিনি বলেন, “এটি ছিল প্রশাসনিক পত্র, সুপ্রিম কোর্টের রেজিস্ট্রারের মাধ্যমে তৎকালীন ইসি এটি পেয়েছিল। সেটির আলোকে এই ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছিল।

“জামায়াতে ইসলামী ইসির কাছে যে আবেদন দিয়েছে, তার সঙ্গে একটি রিট পিটিশন এবং তার আদেশও ইসির সামনে এসেছে। দাঁড়িপাল্লা যাতে কোনো প্রতীক হতে না পারে, যেহেতু এটা ন্যায়বিচারের প্রতীক, এই মর্মে একটি আপিল করা হয়েছিল। সেই আপিল সে সময় আদালত খারিজ করে দেন এবং বলেন, এটি নির্বাচনে প্রতীক হিসেবে ব্যবহার করার কারণে কোনোভাবেই আদালতের মান ক্ষুণ্ন করবে না। ইসির জানামতে এই রায় এখনো বহাল রয়েছে।

এ সম্পর্কিত আরও খবর:

আরও পড়ুন