জামায়াত নেতারা কি এখন শেখ হাসিনার কথায় ভিত্তি দিচ্ছেন?

‘তুমি কে, আমি কে-রাজাকার, রাজাকার’ স্লোগান পরে জুলাই আন্দোলনের গ্রাফিতি হয়ে ওঠে।
‘তুমি কে, আমি কে-রাজাকার, রাজাকার’ স্লোগান পরে জুলাই আন্দোলনের গ্রাফিতি হয়ে ওঠে।

জুলাই আন্দোলনে হেরেছে কে? নিঃসংশয়ে বলা যায় আওয়ামী লীগ। কিন্তু জিতেছে কে? এই প্রশ্নের উত্তর চাইলে যে কাউকে দ্বিধায় পড়তে হবে। কারণ ভিন্ন ভিন্ন আদর্শের অনেকেই ছিলেন এই আন্দোলনে।

অভ্যুত্থানের বছর পূর্তির ঠিক আগে এই আন্দোলন সংগঠনের কৃতিত্ব নিতে চাইছেন অনেকে। সেই মিছিলে দাঁড়িয়ে জামায়াতে ইসলামীর নেতারাও যখন মূল কৃতিত্ব দাবি করছেন, তাতে শেখ হাসিনার এক বছর আগেই কথাই ফলে যাচ্ছে; যখন তিনি বলেছিলেন, আওয়ামী লীগকে ক্ষমতা থেকে হটাতে এটা জামায়াতের ষড়যন্ত্র।

সরকারি চাকরিতে কোটা সংস্কারের আন্দোলন থেকে গত বছরের মধ্য জুলাইয়ে শেখ হাসিনার এক বক্তব্যের প্রতিক্রিয়ায় যখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ‘তুমি কে, আমি কে-রাজাকার, রাজাকার’ স্লোগান উঠেছিল, তখনই অনেকের মনে সন্দেহ জেগেছিল।

আন্দোলনের পক্ষ থেকে তখন এমন ব্যাখ্যা দেওয়া হয়েছিল যে এই স্লোগান ছিল ক্ষমতাসীনদের প্রতি ক্ষোভের তাৎক্ষণিক বহিঃপ্রকাশ।

শেখ হাসিনাসহ আওয়ামী লীগ নেতারা কিন্তু শুরু থেকেই বলছিলেন, এই আন্দোলন বিএনপি-জামায়াতের ষড়যন্ত্র। আন্দোলন যখন তীব্র হচ্ছিল, সহিংসতা বাড়ছিল, তখন তাদের বক্তব্য জামায়াত-শিবিরের দিকে কেন্দ্রীভূত হয়। এক পর্যায়ে জামায়াতকে নিষিদ্ধও করা হয়।

কারফিউ জারির পর গত বছরের ২৪ জুলাই শেখ হাসিনা এডিটরস গিল্ডের নেতাদের সঙ্গে বৈঠকে বলেছিলেন, দেশের উন্নয়ন রুখে দিতে বিএনপি-জামায়াতের দিক থেকে এমন একটি আঘাত আসবে বলে আশঙ্কা তিনি আগে থেকে করছিলেন।

গত বছরের ২৪ জুলাই সাংবাদিকদের সঙ্গে আলোচনায় শেখ হাসিনা।

সেদিন তিনি বলেছিলেন, “বোধগম্য যে এটি (শিক্ষার্থীদের আন্দোলন) একটি গুরুতর ষড়যন্ত্র।”

শিক্ষার্থীদের সব দাবি মেনে নেওয়ার পরও আন্দোলন-সহিংসতা চলার দিকটি দেখিয়ে তিনি বলেছিলেন, “কোটামুক্ত আন্দোলনকারীদের একদিন জাতির কাছে জবাব দিতে হবে, কেন তারা তাদের (সন্ত্রাসী) এই ধ্বংসযজ্ঞের সুযোগ দিল।”

তার চার দিন পর ২৮ জুলাই শেখ হাসিনা বলেছিলেন, “জামায়াত-শিবিরের সন্ত্রাসীরা প্রাথমিকভাবে লো প্রোফাইল বজায় রেখে কোটা সংস্কার আন্দোলনে অংশগ্রহণকারীদের ছদ্মবেশে প্রবেশ করেছিল। কিন্তু পরে তারা বিপজ্জনকভাবে আন্দোলনের সামনের সারিতে চলে আসে।”

তার তিন দিন পর ১ আগস্ট শেখ হাসিনা আবার বলেন, জামায়াত-শিবির তাদের সন্ত্রাসের রাজত্ব কায়েমের জন্য সরকারি চাকরিতে কোটা সংস্কারের দাবিতে আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের ঢাল হিসেবে ব্যবহার করেছে।

ওই দিনই জামায়াত এবং ইসলামী ছাত্রশিবিরসহ তাদের সহযোগী সংগঠনকে ‘সন্ত্রাসী গোষ্ঠী’ হিসেবে নিষিদ্ধ করে আওয়ামী লীগ সরকার। তার চার দিন বাদেই ক্ষমতা ছেড়ে ভারতে গিয়ে উঠতে হয় শেখ হাসিনাকে।

এরপর মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে অন্তর্বর্তী সরকার গঠিত হওয়ার পরপরই জামায়াত-শিবিরের ওপর নিষেধাজ্ঞা উঠে যায়। এরপর প্রথমে ছাত্রলীগ নিষিদ্ধ করা হয়, পরে আওয়ামী লীগের কার্যক্রমেও আসে নিষেধাজ্ঞা।

সেই অভ্যুত্থানের বছর না গড়াতেই এর পক্ষ শক্তিগুলোর মধ্যে নানা বিষয়ে বিভেদ দেখা যাচ্ছে। এক সময়ের মিত্র জামায়াতের সঙ্গে বিএনপির সম্পর্ক সাপে-নেইলে হয়ে দাঁড়িয়েছে।

বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নেতৃত্বে জুলাই আন্দোলন শুরু হলেও অভ্যুত্থানের কৃতিত্ব এখন বিএনপি, জামায়াতসহ সবাই নিতে চাইছে। অভ্যুত্থানকারীরাও এনসিপি নামে নতুন দল গড়ে রাজনীতির মঞ্চে সক্রিয় থেকে নিজেদের কৃতিত্ব জাহির করছেন।

এরই মধ্যে জামায়াতের নায়েবে আমির সৈয়দ আবদুল্লাহ মো. তাহের বিবিসি বাংলাকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে বলেন, তারাই এই অভ্যুত্থানে মূল ভূমিকা পালন করেছিলেন।

নিজেদের অপ্রকাশ্যে রাখার কৌশল অবলম্বনের কথা জানিয়ে তিনি বলেন, “আমরা সচেতন ছিলাম যে এটা যেন জামায়াত-শিবিরের আন্দোলন বলে প্রকাশিত না হয়। আমরা চেয়েছিলাম এটা সার্বজনীন রূপ দেয়ার জন্য। তখন যদি প্রকাশ হত যে ছাত্রশিবিরের মাধ্যমে জামায়াত এই আন্দোলনে আছে, তাহলে এতে অনেকের রিজার্ভেশন ছিল। আমরা সেজন্য কৌশল নিয়েছিলাম।”

ছাত্রশিবিরের সাবেক সভাপতি তাহের তার বক্তব্যের পক্ষে যুক্তি দেখিয়ে বলেন, “এটার পেছনে যে আমরা ছিলাম, এটা গোয়েন্দারা জানত, সরকার জানত। সেজন্যই তো জামায়াতে ইসলামীকে নিষিদ্ধ করেছিল, অন্য কোনো দলকে তো করে নাই।”

জুলাই আন্দোলনের সময় ছাত্রলীগের ছায়া থেকে বেরিয়ে এসে ছাত্রশিবিরের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শাখার সভাপতি হিসেবে প্রকাশ্যে আসা সাদিক কায়েমও এই আন্দোলন সংগঠনে নিজেদের কৃতিত্ব দাবি করছেন।

কোটা সংস্কারের আন্দোলনটি শুরু হয়েছিল গণতান্ত্রিক ছাত্রশক্তি নামে একটি সংগঠনের নেতাদের নেতৃত্বে। এই সংগঠনের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শাখার নেতা ছিলেন নাহিদ ইসলাম, আসিফ মাহমুদ সজীব ভূঁইয়া। ডাকসুর সাবেক সমাজসেবা সম্পাদক, বর্তমানে এনসিপির সদস্য সচিব আখতার হোসেন তার গুরু নুরুল হক নুরের ছাত্র পরিষদ থেকে বেরিয়ে এসে এই সংগঠন গড়ে তুলেছিলেন।

সাদিক কায়েম সম্প্রতি এক টিভি টকশোতে দাবি করেন, ছাত্রশক্তি গড়ে তোলাসহ জুলাই আন্দোলন সংগঠনে ছাত্রশিবিরের ছিল মূল ভূমিকা।

বিএনপি সমর্থক চিকিৎসক চিকিৎসক সাখাওয়াত হোসেন সায়ন্তের এক বক্তব্যেও এমন ইঙ্গিত পাওয়া যাচ্ছে। তিনি এক টিভি টকশোতে বলেন, জামায়াতের নায়েবে আমির তাহের তাকে বলেছিলেন যে নাহিদকে তারাই তৈরি করছেন। নাহিদ তাদেরই একজন।

এই কথাগুলো যখন সামনে আসছে, তখন প্রতিবাদ জানিয়ে ফেইসবুকে একটি পোস্ট দিয়েছেন এনসিপির আহ্বায়ক নাহিদ; যিনি জুলাই আন্দোলনের মুখপাত্র হিসেবে সারাদেশে পরিচিত হয়ে ওঠেন। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সমন্বয়ক থেকে উপদেষ্টাও হন তিনি; পরে পদত্যাগ করে এখন এনসিপির আহ্বায়ক হয়েছেন।

জামায়াত আমির শফিকুর রহমানকে দেখতে হাসপাতালে নাহিদ ইসলাম।

সাদিক কায়েম মিথ্যাচার করছেন দাবি করে নাহিদ লিখেছেন, মূলত ছাত্র পরিষদের একটি অংশ এবং ‘গুরুবার আড্ডা’ নামে একটি পাঠচক্রের সদস্যদের নিয়ে ছাত্রশক্তি গঠিত হয়। ছাত্রশিবিরের নেতাদের সঙ্গে যোগাযোগ থাকলেও সংগঠন গড়ার ক্ষেত্রে তাদের কোনো ভূমিকা ছিল না।

তার ভাষ্যে, “আমরা ক্যাম্পাসে আট বছর রাজনীতি করছি। ফলে প্রকাশ্য অপ্রকাশ্য সব সংগঠন ও নেতৃত্বকে আমরা চিনতাম এবং সকল পক্ষের সাথেই আমাদের যোগাযোগ ও সম্পর্ক ছিল। সেই কারণে ঢাবি শিবিরের সাথেও যোগাযোগ ছিল। যোগাযোগ, সম্পর্ক বা কখনো সহযোগিতা করা মানে এই না যে তারা আমাদের রাজনৈতিক প্রক্রিয়ায় যুক্ত ছিল।”

সাদিক কায়েমকে অনেকে এই অভ্যুত্থানের ‘হিরো’ হিসেবে দেখানোর প্রতিক্রিয়ায় নাহিদ লিখেছেন, “সাদিক কায়েম বৈষম্যেবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের কোনো সমন্বয়ক ছিল না। কিন্তু ৫ই অগাস্ট থেকে এই পরিচয় সে ব্যবহার করেছে।

“অভ্যুত্থানে শিবিরের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকার কারণে সাদিক কাইয়ুমকে প্রেস ব্রিফিং এ বসার ব্যবস্থা করা হয়। কিন্তু সাদিক কাইয়ুমরা অভ্যুত্থান পরবর্তী সময়ে ঢালাও প্রচারণা করেছে এই অভ্যুত্থান ঢাবি শিবিরই নেতৃত্ব দিসে, আমরা সামনে শুধু পোস্টার ছিলাম।”

নাহিদ ফেইসবুকে যাই লিখুন না কেন, জামায়াতের সঙ্গে তাদের ঘনিষ্ঠতা অপ্রকাশ্য থাকছে না। সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে জামায়াতের সমাবেশে যেমন এনসিপি নেতা সারজিস আলম বক্তব্য দিয়েছেন, তেমনি জুলাই পদযাত্রা শেষ করে ঢাকায় ফিরেই বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায় ঢাকার ইউনাইটেড হাসপাতালে চিকিৎসাধীন জামায়াত আমির শফিকুর রহমানকে দেখতে গেছেন নাহিদ।

আরও পড়ুন