শততম জন্মদিন পালন করার তিন মাসের মধ্যে মারা গেলেন যুক্তরাষ্ট্রের ৩৯তম প্রেসিডেন্ট জিমি কার্টার। নোবেল জয়ী জিমি ১৯৭৭ সাল থেকে ১৯৮১ সাল পর্যন্ত আমেরিকার প্রেসিডেন্ট ছিলেন।
রোববার তার মৃত্যুতে শোক প্রকাশ করেছেন বিশ্ব নেতারা।
রিচার্ড নিক্সনের ওয়াটারগেট কেলেঙ্কারি পরবর্তী টালমাটাল সময়ে জর্জিয়ার ‘চিনাবাদাম চাষি’ কার্টার ‘জনগণকে কখনও মিথ্যা না বলার’ প্রতিশ্রুতি দিয়ে ক্ষমতায় এসেছিলেন। তিনি সেই প্রেসিডেন্ট যিনি ভিয়েতনাম যুদ্ধ এড়িয়ে যাওয়া মার্কিন নাগরিকদের ক্ষমা করে দেওয়ার মতো সাহসী পদক্ষেপ নিয়েছিলেন।
এছাড়া কার্টার প্রথম মার্কিন নেতা যিনি জলবায়ু পরিবর্তনকে গুরুত্বের সঙ্গে দেখেছিলেন, হোয়াইট হাউজের ছাদে বসিয়েছিলেন সোলার প্যানেল।
কার্টার মিশর ও ইসরায়েলের মধ্যে ঐতিহাসিক শান্তি চুক্তিতে মধ্যস্থতাকারী। তাছাড়া ইরানের বন্দিসংকট ও আফগানিস্তানে সোভিয়েত আগ্রাসন বিষয়েও চুক্তির চেষ্টা করেছিলেন তার সরকারের সময়ে।
এক মেয়াদে ক্ষমতায় থাকার পর ১৯৮০ সালে রোনাল্ড রিগানের কাছে খুব বাজেভাবে পরাজিত হয় জিমি কার্টারের দল। ওই নির্বাচনে মাত্র ছয়টি রাজ্যে জয়ী হতে পেরেছিলেন কার্টার।
হোয়াইট হাউস ছাড়ার পর জিমি কার্টার শান্তি, পরিবেশ এবং মানবাধিকার নিয়ে কাজ শুরু করেন, যার স্বীকৃতি হিসেবে তিনি পান শান্তিতে নোবেল পুরস্কার।
যুক্তরাষ্ট্রের ইতিহাসে দীর্ঘজীবী প্রেসিডেন্ট কার্টার এবছর অক্টোবরে ১০০তম জন্মদিন উদযাপন করেছিলেন। তার ক্যান্সারের চিকিৎসা চলছিলো।
পুরো নাম জেমস আর্ল কার্টার জুনিয়র। ১৯২৪ সালের ১ অক্টোবর জর্জিয়ার ছোট্ট শহর প্লেইন্সে জন্ম নেন কার্টার। চার ভাই-বোনের মধ্যে তিনি ছিলেন সবার বড়।
বর্ণবিদ্বেষী হিসেবে পরিচিতি পাওয়া তার বাবার ছিল চিনা বাদামের ব্যবসা। আর মা লিলিয়ান ছিলেন নিবন্ধিত নার্স।
মহামন্দার অভিজ্ঞতা এবং দৃঢ় ব্যাপ্টিস্ট বিশ্বাস কার্টারের রাজনৈতিক দর্শনকেও প্রভাবিত করেছিল।
হাইস্কুলের তারকা বাস্কেটবল খেলোয়াড় কার্টার সাত বছর মার্কিন নৌবাহিনীতেও কাজ করেছেন। সেখানে তিনি সাবমেরিন অফিসার ছিলেন। নৌবাহিনীতে কর্মরত অবস্থায়ই বোনের বান্ধবী রোজালিনকে বিয়ে করেন তিনি।
১৯৫৩ সালে বাবার মৃত্যুর পর পারিবারিক খামারটি চালাতে তিনি চাকরি ছেড়ে চলে আসেন। প্রথম বছর খরায় ফসল নষ্ট হলেও কার্টার ব্যবসা পুনরুদ্ধার করে সফল হয়েছিলেন।
তিনি একদম তৃণমূল থেকে রাজনীতি শুরু করা মার্কিন প্রেসিডেন্ট, যিনি প্রথমে স্থানীয় স্কুল এবং লাইব্রেরির বোর্ড নির্বাচিত হন। তারপর তিনি জর্জিয়া থেকে সিনেট নির্বাচন করেন।
নাগরিক অধিকার কর্মী
স্কুল থেকে বর্ণবৈষম্য বিলোপের পর দক্ষিণাঞ্চলের একজন কৃষক যার বাবার বর্ণবিদ্বেষী মনোভাব অজানা ছিল না, এমন একজন ব্যক্তির দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে সন্দেহ থাকলেও তিনি ছিলেন সম্পূর্ণ ভিন্ন।
সে সময়ে জর্জিয়ার দুই দফা সিনেটর থাকার সময় তিনি বর্ণবৈষম্যবাদীদের সঙ্গে দ্বন্দ্ব এড়িয়ে চলেছেন। এদের মধ্যে অনেকেই তার নিজ দল ডেমোক্রেটের সদস্য ছিলেন।
১৯৭০ সালে জর্জিয়া গভর্নর নির্বাচিত হওয়ার পর নাগরিক অধিকার নিয়ে তিনি আরও সোচ্চার হন।
অভিষেক ভাষণে তিনি বলেন, “আমি আপনাদের স্পষ্টভাবে বলতে চাই যে বর্ণবৈষম্যের দিন শেষ।”
তিনি ক্যাপিটল ভবনের দেওয়ালে মার্টিন লুথার কিংয়ের ছবি ঝুলিয়ে দিয়েছিলেন, যার প্রতিবাদ করেছিলেন কু ক্লুক্স ক্লান।
সরকারি কার্যালয়ে কৃষ্ণাঙ্গ আমেরিকানদের নিয়োগের বিষয়টিও তিনি নিশ্চিত করেছিলেন।
তবে গর্ভপাত আইন প্রণয়নের ক্ষেত্রে তার উদার মনোভাব এবং শক্তিশালী খ্রিস্টীয় বিশ্বাসের ভারসাম্য রাখা কঠিন হয়ে পড়েছিল। তিনি নারীদের গর্ভপাতের অধিকার সমর্থন করলেও তা বাস্তবায়নে তহবিল বাড়াতে অস্বীকৃতি জানান।
যুক্তরাষ্ট্র যখন ওয়াটারগেইট কেলেঙ্কারির ধাক্কা সামলানোর চেষ্টা করছে সেই সময়ে ১৯৭৪ সালে কার্টার প্রেসিডেন্ট প্রার্থী হিসেবে প্রচারণা শুরু করেন।
কার্টার নিজেকে একজন সাধারণ চিনাবাদাম চাষী হিসেবে সামনে আনেন, যিনি ক্যাপিটল হিলের পেশাদার রাজনীতিবিদদের মতো সন্দেহজনক নীতির দ্বারা কলুষিত নন।
চমৎকার ছিল তার সময়জ্ঞান। মার্কিনিরা বাইরের কাউকে চেয়েছিল এবং কার্টারের সঙ্গে সেটি মিলে গিয়েছিল সেসময়।
শুরুর দিকে জরিপগুলোতে তিনি মাত্র ৪ শতাংশ ডেমোক্রেটদের সমর্থন পান। তবে মাত্র নয় মাস পরেই তিনি রিপাবলিকান প্রেসিডেন্টে প্রার্থী জেরাল্ড ফোর্ডকে পরাজিত করেন।
তার প্রথম কার্যদিবসে ভিয়েতনাম যুদ্ধ এড়িয়ে যাওয়া এবং বিদেশে পালিয়ে যাওয়া মার্কিনিদের ক্ষমা করে দেন কার্টার।
ওই সিদ্ধান্তকে যুক্তরাষ্ট্রের ইতিহাসে ‘কোনো প্রেসিডেন্টের করা সবচেয়ে লজ্জাজনক কাজ’ বলে সমালোচনা করেছিলেন রিপাবলিকান সিনেটর ব্যারি গোল্ডওয়াটার।
প্রেসিডেন্ট হিসেবে এটা তার সবচেয়ে কঠিন সিদ্ধান্ত ছিল বলে পরে কার্টারও স্বীকার করেছেন।
তিনি নারীদের তার প্রশাসনে গুরুত্বপূর্ণ পদে নিয়োগ দিয়েছিলেন এবং রোজালিনকে ফার্স্ট লেডি প্রোফাইল মেনে চলতে উৎসাহিত করেছিলেন।
লিঙ্গ বৈষম্যের বিরুদ্ধে আইন করতে যুক্তরাষ্ট্রের সংবিধান সংশোধনের মাধ্যমে সমানাধিকারের প্রচারও করেন কার্টার।
কার্টার প্রথম বিশ্বনেতা যিনি জলবায়ু পরিবর্তনকে গুরুত্বের সঙ্গে। হোয়াইট হাউসে জিন্স এবং সোয়েটার পরতেন এবং শক্তি সাশ্রয়ের জন্য হিটিং বন্ধ করে দেন তিনি।
পরিবেশ রক্ষায় তিনি হোয়াইট হাউসের ছাদে সোলার প্যানেল স্থাপন করলেও পরবর্তীতে প্রেসিডেন্ট রোনাল্ড রিগান সরিয়ে দিয়েছিলেন।
বিপর্যয়কর উদ্ধার অভিযান
অর্থনীতি মন্দার মধ্যে পড়ার সঙ্গে সঙ্গে কার্টারের জনপ্রিয়তা কমতে শুরু করে। তিনি দেশের এনার্জি সংকট শক্তভাবে মোকাবেলা করতে চেয়েছিলেন আর এ জন্য গ্যাসোলিন রেশনিংয়ের পদক্ষেপ নেন। যার জন্য কংগ্রেসের তীব্র বিরোধিতার মুখে পড়েন কার্টার।
দেশের বেকারত্ব ও সুদের উচ্চহারের মধ্যে তার সার্বজনীন স্বাস্থ্যসেবা ব্যবস্থা চালুর পরিকল্পনাও আইনসভায় বাধাপ্রাপ্ত হয়।
তবে ১৯৭৮ সালে মিশরের প্রেসিডেন্ট সাদত ও ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেগিনের ক্যাম্প ডেভিড চুক্তি সাক্ষর করলে তার মধ্যপ্রাচ্য নীতি বিজয়ের মুখ দেখে।
তবে তার এ সাফল্য দীর্ঘস্থায়ী হয়নি। ইরানে বিপ্লবের ফলে মার্কিন জিম্মি সংকট এবং আফগানিস্তানে সোভিয়েত আক্রমণ ছিল তার জন্য কঠিন পরীক্ষা।
তিনি তেহরানের সঙ্গে কূটনৈতিক সম্পর্ক ছিন্ন এবং জিম্মি মার্কিনিদের মুক্তির জন্য বেপরোয়া হয়ে বাণিজ্য নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেন। শক্তিপ্রয়োগ করে তাদের মুক্তির চেষ্টা বিপর্যয় ডেকে আনে। এতে প্রাণ হারায় ৮ মার্কিন।
এ ঘটনায় নিশ্চিতভাবে তার পুনর্নির্বাচিত হওয়ার আশা শেষ হয়ে যায়।
রিগানের কাছে হার
১৯৮০ সালের ডেমোক্রেটিক দলের প্রেসিডেনশিয়াল মনোনয়ন দৌড়ে সিনেটর এডওয়ার্ড কেনেডিকে পরাজিত করলেও নির্বাচনে রিপাবলিকান প্রার্থী রোনাল্ড রিগ্যানের কাছে হেরে যান।
বিপুল সংখ্যক ইলেক্টোরাল ভোট পেয়ে হোয়াই হাউজের পথে এগিয়ে যান সাবেক অভিনেতা রিগ্যান।
মেয়াদের শেষদিন কার্টার বন্দি চুক্তির সফল সমাপ্তি ঘোষণা করলেও ইরান জিম্মি হস্তান্তর রিগ্যানের শপথের পর পর্যন্ত পিছিয়ে দেয়।
মার্কিন প্রেসিডেন্টদের মধ্যে সবচেয়ে ‘অজনপ্রিয়’ হয়ে ক্ষমতা ছাড়লেও পরে তা পুনরুদ্ধারে নিজেকে নিয়োজিত করেন কার্টার।
তার গ্রন্থাগার কার্টার প্রেসিডেন্সিয়াল সেন্টার আন্তর্জাতিক সমস্যা ও সংকট সমাধানে ভাবনা ও কর্মসূচির একটি প্রভাবশালী জায়গা হয়ে ওঠে।
থিওডর রুজভেল্ট ও উইড্রো উইলসনের পর তৃতীয় মার্কিন প্রেসিডেন্ট হিসেবে ২০০২ সালে শান্তিতে নোবেল পুরস্কার পান। তিনিই একমাত্র প্রেসিডেন্টে যিনি ক্ষমতা ছাড়ার পরের কাজের জন্য এ স্বীকৃতি পান।
তিনি তার নোবেল বক্তৃতায় পৃথিবীর সবচেয়ে ধনী এবং সবচেয়ে দরিদ্রব্যক্তির মধ্যকার ক্রমবর্ধমান ফাঁককে গুরুতর ও সার্বজনীন সমস্যা বলে উল্লেখ করেন।
শান্তি ও মানবাধিকার নিয়ে কাজ করার লক্ষ্যে বিশ্ব নেতাদের নিয়ে নেলসন ম্যান্ডেলার সাথে ‘দ্য এল্ডার্স’ নামে একটি সংগঠন করেন।
সাদাসিধা জীবন
অবসরের পর কার্টার একটি সাধারন জীবনধারা বেছে নিয়েছিলেন। বক্তৃতা অনুষ্ঠানের আকর্ষণীয় আমন্ত্রণ এবং কর্পোরেট বোর্ডের সদস্যপদ ছেড়ে রোজালিনের সঙ্গে প্লেইন্সে একটি সাধারণ জীবন বেছে নেন। যেটা তাদের দুজনেরই জন্মস্থান।
২০২৩ সালের নভেম্বরে মারা যান তার স্ত্রী রোজালিন কার্টার।
ওভাল অফিসে থাকার সময়ও তিনি অর্থ উপার্জন করতে চাননি।
তিনি একবার ওয়াশিংটন পোস্টকে বলেছিলেন, “আমি এর মধ্যে ভুল কিছু দেখি না। যারা করছে তাদেরও দোষ দেই না। আমার কখনোই ধনী হওয়ার উচ্চাকাঙ্ক্ষা ছিল না।”
তিনিই যুক্তরাষ্ট্রের একমাত্র প্রেসিডেন্ট যিনি রাজনীতিতে আসার আগে যে বাড়িতে বাস করতেন সেই একতলা বাড়িতেই ফিরে গিয়েছিলেন।
ক্যান্সারের চিকিৎসা নিচ্ছেন বলে ২০১৫ সালে জানান কার্টার। এই রোগেই তার বাবা-মা এবং তিন বোনের মৃত্যু হয়েছিল।
সূত্র: বিবিসি