সন্তানদের অভিভাবকত্ব, সম্পত্তির ভাগাভাগিসহ নানা বিষয়ের মতবিরোধকে সঙ্গী করে বিবাহবিচ্ছেদ প্রশ্নে দীর্ঘ ৮ বছর ধরে আইনি লড়াই চালিয়ে গেছেন হলিউডের অস্কারজয়ী দুই তারকাভিনেতা অ্যাঞ্জেলিনা জোলি ও ব্র্যাড পিট।
নতুন বছরের শুরুতে চমক তোলা খবর হল আনুষ্ঠানিক বিচ্ছেদ নিয়ে অবশেষে ‘সমঝোতায় পৌঁছেছেন’ তারা।
বিবিসি লিখেছে, বিচ্ছেদ সম্পর্কিত যাবতীয় হিসাব-নিকাশের মিমাংসাপত্রে সই করেছেন এই তারকা জুটি। এখন বিচ্ছেদ কেবল সময়ের বিষয়।
বিচ্ছেদ নিয়ে জোলি-পিটের সমঝোতায় পৌঁছানোর এই তথ্য নিশ্চিত করেছেন জোলির আইনজীবী জেমস সাইমন; তবে পিটের আইনজীবী তাৎক্ষনিকভাবে এ বিষয়ে কোনো মন্তব্য করেননি।
তবে পরস্পর থেকে কাগজে-কলমে আলাদা হতে কেন আট বছর সময় লাগল সেই উত্তর খোঁজার খোঁজার চেষ্টা করেছে বিবিসি।
বলা হচ্ছে, হলিউডে এক সময়ের ‘পাওয়ার কাপল’ খ্যাত দুই অভিনয় শিল্পীর ছয় সন্তানের অভিভাকত্ব নিয়ে তিক্ত লড়াই এবং তাদের যৌথ মালিকানার ফ্রান্সের এস্টেট ‘শ্যাঁতো মিরাভাল’ এবং ওয়াইনারি নিয়ে আইনি জটিলতা বিচ্ছেদ প্রক্রিয়াকে দীর্ঘায়িত করেছে।
ফলে হলিউডের ইতিহাসে অন্যতম এই দীর্ঘ বিবাহবিচ্ছেদ প্রক্রিয়ার অবশেষে ইতি হতে চলেছে।
বিখ্যাত আইনজীবী ক্রিস মেলচার বলেন, “বিবাহবিচ্ছেদ নিষ্পত্তিতে অন্য আর দশটি মামলার চাইতে অস্বাভাবিক সময় লেগেছে।”
৪৯ বছর বয়সী জোলি এবং ৬১ বছর বয়সী পিটের প্রথম পরিচয় ‘মিস্টার অ্যান্ড মিসেস স্মিথ’ সিনেমার সেটে। সিনেমাটি মুক্তি পেয়েছিল ২০০৫ সালে।
জোলি-পিটের সংসারে একে একে ছয় সন্তান আসে। তারা হলেন- ম্যাডক্স, প্যাক্স, জাহারা, শিলো এবং যমজ ভিভিয়েন ও নক্স।
ছয় জনের মধ্যে দত্তক নেওয়া সন্তান হলেন তিনজন। ম্যাডক্সকে ২০০২ সালে কম্বোডিয়া থেকে দত্তক নিয়েছেন জোলি, পরে তাকে দত্তক নেন পিটও।
ইথিওপিয়া থেকে জাহারাকে তারা দত্তক নিয়েছেন। আর প্যাক্সকে দত্তক নেওয়া হয় ভিয়েতনাম থেকে।
ছেলেমেয়েরা বর্তমানে জোলির অভিভাবকত্বে রয়েছে।
দীর্ঘ সময় প্রেম করে ২০১৪ সালে বিয়ে করে ঘর বাঁধেন জোলি ও পিট। এটি ছিল পিটের দ্বিতীয় বিয়ে। এর আগে তিনি ফ্রেন্ডস তারকা জেনিফার অ্যানিস্টনকে বিয়ে করেছিলেন।
অন্যদিকে জোলি এর আগে অভিনেতা বিলি বব থর্নটন এবং জনি লি মিলারকে বিয়ে করেছিলেন।
জোলি-পিটের সংসার জীবনের স্থায়ীত্বকাল মাত্র দুবছর।
যে কারণে ভাঙন ও বিচ্ছেদের সিদ্ধান্ত
২০১৬ সালে পিটের সঙ্গে সংসার ভাঙার পর বিচ্ছেদের আবেদন করেন জোলি। যে ঘটনা রীতিমত আলোড়ন তোলে ওই সময়।
একটি ব্যক্তিগত জেট বিমানে ঝগড়ার জেরে মূলত সম্পর্কের ভাঙন বিচ্ছেদে গড়ায়। তবে সন্তানের অভিভাবকত্ব, সম্পত্তির ভাগাভাগিসহ নানা বিষয়ের মতবিরোধে বিচ্ছেদ প্রক্রিয়া ঝুলে যায়।
জোলির আইনজীবী পল মারফির এক বিবৃবতিতে জানা গিয়েছিল, ২০১৬ সালে ব্যক্তিগত বিমানের ভেতরে জোলির ওপরে ‘মাতাল’ পিট চড়াও হয়েছিলেন। দুই সপ্তাহের ছুটি কাটিয়ে সেদিন ছয় বাচ্চাকে নিয়ে ব্যক্তিগত বিমানে চড়ে ফ্রান্স লস অ্যাঞ্জেলেসে ফিরছিলেন জোলি ও ব্র্যাড।
হঠাৎই জোলির উপর ক্ষেপে যান পিট। শুরুতে ছেলে ম্যাডক্সকে পিট আঘাত করেন।
সে সময় পিটকে থামানোর চেষ্টা করে শারীরিকভাবে ‘হেনস্তার শিকার’ হন বলে জোলির অভিযোগ।
এছাড়া লস অ্যাঞ্জেলসে পৌঁছানোর পরও পিট তার স্ত্রী জোলি এবং বাচ্চাদের বিমান থেকে নামতে দেননি, সেখানে বাচ্চাদের নিয়ে জোলি অন্তত ২০ মিনিট আটকে ছিলেন।
জোলির অভিযোগ, পিট সেসময় তাকে ‘গালাগাল’ করেন এবং তার এবং সন্তানদের শরীরে অ্যালকোহল ঢেলে দেন।
ওই ঘটনার পর পিটের বিরুদ্ধে এফবিআইয়ের কাছে অভিযোগ করেন জোলি; এফবিআইয়ের কাছে সাবেক স্ত্রীকে নির্যাতনের কথা অস্বীকার করলেও মদ্যপানের অভ্যাসের কথা স্বীকার করেন পিট।
মামলার পর ছয় সন্তানের অভিভাকত্ব পেতে জোলি ও পিটের আইনি লড়াই সময়ের সাথে তীব্র হয়েছে। যা মামলা প্রক্রিয়াকে করেছে তরান্বিত।
২০১৮ সালে সন্তানের অভিভাকত্ব নিয়ে জোলি ও পিট একটি সমঝোতা চুক্তিতে পৌঁছালেও, পরবর্তীতে সেটি কার্যকর হয়নি।
২০১৯ সালে মামলার এক বিচারক বলেছিলেন, এই দম্পতি আনুষ্ঠানিকভাবে অবিবাহিত কিন্তু বিবাহবিচ্ছেদ হয়নি, যা চূড়ান্ত করা দরকার।
২০২১ সালে, আদালত তাদের সন্তানের যৌথ অভিভাবকত্বের সিদ্ধান্ত দেয়। পরে মামলাটি তত্ত্বাবধানকারী ব্যক্তিগত বিচারককে সরিয়ে দেওয়া হয়। কারণ পিটের আইনজীবীর সঙ্গে ওই বিচারকের লেনদেনের সম্পর্ক সামনে আসে।
পরে সন্তানের অভিভাকত্ব ফের এককভাবে জোলির ওপর বর্তায়।
এরপর সামনে আসে ফ্রান্সের এস্টেট ‘শ্যাঁতো মিরাভাল’ এবং ওয়াইনারি নিয়ে নতুন করে আইনি জটিলতা। যে সম্পত্তি জোলি-পিটের যৌথভাবে কিনেছিলেন ২০০৮ সালে।
২০২২ সালে ফেব্রুয়ারিতে পিট তার সাবেক স্ত্রীর বিরুদ্ধে ‘শ্যাঁতো মিরাভাল’ নিয়ে মামলা করেন।
পিটের ভাষ্য ছিল, যখন তারা দুজনে মিলে এই সম্পত্তিটি কিনেছিলেন, তখন তারা ঠিক করেছিলেন, একে অপরের সম্মতি ছাড়া কেউ এটি বিক্রি করতে পারবে না। কিন্তু জোলি ‘বেআইনিভাবে’ ‘শ্যাঁতো মিরাভাল’র নিজের অংশ বিক্রি করেছেন।
পিটের ওই মামলার জবাবে ওই বছরের সেপ্টেম্বরে একটি পাল্টা মামলা করেন জোলি। যেখানে তিনি বলেন, এ ধরনের কোনো চুক্তি তাদের মধ্যে হয়নি। তিনি আর্থিক ‘স্বাধীনতা পেতে এবং তার সন্তানদের জীবনে কিছুটা ‘নিশ্চয়তা ও শান্তি ফিরিয়ে’ আনতে তার অংশটি বিক্রি করেছেন।
এছাড়া পিটের বিরুদ্ধে শ্যাঁতো মিরাভালের ওয়াইন ব্যবসার নিয়ন্ত্রণ ‘ছিনিয়ে নেওয়ার চেষ্টা ‘ অভিযোগ আনা হয় ওই মামলায়। পিট ও তার সহযোগীদের কাছে ৩৫ কোটি ডলার ক্ষতিপূরণ দাবি করা হয় মামলায়।
এই অভিনেত্রীর মামলার অভিযোগে বলা হয়েছে, পিট শ্যাঁতো মিরাভালের সম্পদ নষ্ট করেছেন। সুইমিং পুল সংস্কার, চারবার সিঁড়ি নির্মাণ ও পুনর্নির্মাণ এবং রেকর্ডিং স্টুডিও সংস্কারের কাজে লাখ লাখ ডলার অপচয় করেছেন।
তবে বিবাহবিচ্ছেদের চুক্তি শ্যাঁতো মিরাভালের মামলাকে কোনোভাবে প্রভাবিত করবে কিনা তা এখনও স্পষ্ট না।