মাত্র দুই মাস আগের ঘটনা, সাফজয়ী নারী ফুটবলারদের সংবর্ধনা দিয়েছিলেন অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান উপদেষ্টা মুহাম্মদ ইউনূস। সেদিন এই নারীদের ফুটবলার হয়ে ওঠার সংগ্রামের গল্প শুনেছিলেন তিনি; বলেছিলেন তিনি তাদের সমস্যা সমাধানে পাশে থাকবেন।
কিন্তু জয়পুরহাটে যে ঘটনা ঘটে গেল, তাতে নারীরা দেশে আর ফুটবল খেলতে পারবে কি না, সেই প্রশ্ন বড় হয়ে দেখা দিয়েছে। সেখানে নারীদের একটি প্রীতি ফুটবল ম্যাচের আয়োজন করা হয়েছিল, যে মাঠে খেলা হওয়ার কথা, আগের দিন সেখানে হামলা করে স্থানীয় মুসল্লিসহ মাদ্রাসার শিক্ষার্থীরা।
তারা বলেই দিয়েছেন, নারীদের ‘বেপর্দা’ হয়ে ফুটবল খেলা চলবে না। আর তাদের সেই ঘোষণা আর হামলার ভিডিও ছড়িয়ে পড়েছে সোশাল মিডিয়ায়। যা নিয়ে চলছে তুমুল আলোচনা-সমালোচনা।
গত বছরের আগস্টে ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর দেশে সাম্প্রদায়িক গোষ্ঠীর অতি সক্রিয়তা দেখা যাচ্ছে। অভ্যুত্থানের ছাত্রনেতারা ‘ইনক্লুসিভ (অন্তর্ভুক্তিমূলক)’ বাংলাদেশের যে কথা বলেছেন, তার ফাঁক গলে আগস্টের পর মাজারে হামলা হচ্ছে সারাদেশে, হাসন রাজার জেলা সুনামগঞ্জে গান-বাজনা বন্ধ করতে বলা হয়েছে, নাটক বন্ধের ঘটনা ঘটেছে খোদ রাজধানীতে।

এর আগে পাঠ্যবই পরিমার্জনের কমিটি গঠনের পর তা আবার বাতিল করাকে ‘মৌলবাদী হুমকির কাছে অন্তর্বর্তী সরকার আপস’ হিসাবে দেখিয়ে তা নিয়ে উদ্বেগ জানিয়েছিল ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ (টিআইবি)। বাংলাদেশে উগ্র ইসলামি গোষ্ঠীর মাথা চাড়া দেওয়া নিয়ে বিদেশি বিভিন্ন সংগঠনও উদ্বেগ জানাচ্ছে।
মাজারে হামলা বন্ধে ইউনূস সরকারের কঠোর হুঁশিয়ারিও কোনো কাজে আসছে না। সোমবারই ঢাকার ফার্মগেইটে কুতুববাগ পীরের ওরসের প্রস্তুতির আয়োজনে হামলা হয়েছে ‘তৌহিদী জনতা’ ব্যানারে। তার একদিন বাদেই নারীদের ফুটবল খেলা বন্ধে জয়পুরহাটের আক্কেলপুর উপজেলার তিলকপুর উচ্চ বিদ্যালয় মাঠে হামলা হল।
বাংলাদেশের জাতীয় সংবাদপত্রগুলোর প্রতিবেদনে বলা হয়, টি স্টার ক্লাব নামে স্থানীয় একটি ক্লাব তিলকপুর উচ্চ বিদ্যালয় মাঠে আন্তঃজেলা ফুটবল টুর্নামেন্ট আয়োজন করে। টুর্নামেন্টের ফাইনালে উঠেছে পার্বতীপুর ও জয়পুরহাট ফুটবল দল। ফাইনাল ম্যাচের আগে বুধবার জয়পুরহাট ও রংপুর নারী ফুটবল দলের প্রীতি ম্যাচ আয়োজনের ঘোষণা দেওয়া হয়।
ওই খেলার প্রচারের পর থেকে স্থানীয়দের একটি অংশ ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠে। মঙ্গলবার আসরের নামাজের পর তিলকপুর রেল স্টেশনের সামনে স্বাধীনতা চত্বরে জড়ো হন তারা। সেখান থেকে গিয়ে খেলার মাঠের টিনের বেড়া ভাংচুর করেন। এই ঘটনা একজন ফেইসবুকে লাইভ করেন। সেখানে দেখা যায়, রেল স্টেশনের সামনে জড়ো হওয়া মানুষের মধ্যে বড় অংশ মাদ্রাসার শিক্ষার্থী। সেখানে কয়েকজন মাওলানাও বক্তব্য দেন।

ভিডিওতে একজনকে বলতে শোনা যায়, “যারা মেয়েদের লেলিয়ে দিয়ে অর্থ উপার্জন করতে চান, আমি তাদের সতর্ক করতে চাই, আপনারা সাবধান হন। আগামী দিনে মেয়েদের খেলা বন্ধ করুন। যদি বন্ধ না করেন, তাহলে প্রতিরোধ গড়ে তোলা হবে।” অন্য বক্তারাও নারীদের পর্দার মধ্যে রাখার কথা বলেন। তারপর মেয়েদের ফুটবল ম্যাচ বন্ধের দাবিতে স্লোগান দিতে দিতে মাঠের দিকে মিছিল নিয়ে যায়।
টি স্টার ক্লাবের সভাপতি সামিউল হাসান ইমন উপজেলা বিএনপির সাংগঠনিক সম্পাদক। তিনি সাংবাদিকদের বলেন, “ওই মাঠে ছেলেদের খেলা হচ্ছিল। আগামীকাল বুধবার বিকালে জয়পুরহাট-রংপুর নারী ফুটবল দলের খেলা ছিল। আজ আসরের নামাজের পর মাদ্রাসার ছাত্রসহ মুসল্লিরা খেলার মাঠে হামলা চালিয়ে টিনের বেড়া ভেঙে দিয়েছে।”
এদিকে প্রথম আলোর প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, এই টুর্নামেন্টের টিকেট নিয়ে স্থানীয়দের মধ্যে আগে থেকে অসন্তোষ ছিল। টুর্নামেন্টের প্রতিটি ম্যাচে মাটিতে বসে খেলা দেখার জন্য ৩০ টাকা ও চেয়ার বসে খেলা দেখার জন্য ৭০ টাকা টিকেটের দাম ঠিক করে আয়োজকরা। এর বাইরে কেউ যেন খেলা দেখতে না পারে, সেজন্য মাঠের চার পাশে টিনের বেড়া দিয়ে দেয়।
ওই টিনের বেড়া নিয়ে স্থানীয়দের অভিযোগে পেয়ে সম্প্রতি সেখানে গিয়েছিলেন উপজেলা সহকারী কমিশনার (ভূমি) মনিরা সুলতানা। তবে টিনের বেড়া খুলতে গিয়ে তিনি দর্শক ও আয়োজকদের রোষানলে পড়েছিলেন বলে প্রথম আলো জানায়।
তবে সোশাল মিডিয়ায় আসা ভিডিওতে হামলাকারীদের মেয়েদের ফুটবল নিয়ে বিরোধিতার কথাই বলতে শোনা গেছে।
তিলকপুর মাঠে মেয়েদের খেলার আয়োজন এবং তার বিরোধিতায় ভাংচুরের বিষয়টি জানেন না বলে প্রথম আলোর জিজ্ঞাসায় দাবি করেন আক্কেলপুর থানার ওসি আনিছুর রহমান। তিনি বলেন, “ইউএনও স্যার আজকে বিকালে আমাকে জানিয়েছেন, আগামীকাল বুধবার খেলার আয়োজকদের ও বিরোধিতাকারীদের সঙ্গে বৈঠকে বসবেন।”
ইউএনও মনজুরুল আলমও বলেন, টুর্নামেন্ট নিয়ে আয়োজক ও স্থানীয় বাসিন্দাদের মধ্যে অসন্তোষ বিরাজের কথা জানতে পেরে বুধবার তিনি দুই পক্ষকে নিয়ে বসবেন।