ভাঙারি ব্যবসার নিয়ন্ত্রণ নিতেই পুরান ঢাকার মিটফোর্ড এলাকায় প্রকাশ্য দিবালোকে খুন করা হয় ব্যবসায়ীকে, যাতে অংশ নেওয়া সবাই বিএনপির সহযোগী সংগঠনের নেতাকর্মী।
বুধবার সন্ধ্যায় রজনী বোস লেনের ভাঙ্গারি ব্যবসায়ী লাল চাঁদ ওরফে মো. সোহাগকে যেভাবে খুন করা হয়েছে তা যেন মধ্যযুগীয় বর্বরতাকেও হার মানায়। কুপিয়ে অর্ধমৃত অবস্থায় টেনেহিঁচড়ে মাঝ রাস্তায় ফেলে বড় বড় পাথর দিয়ে আঘাত করে মৃত্য নিশ্চিত করা হয় সোহাগের।
ভিডিওতে দেখা যায়, ওই ব্যবসায়ীকে যখন নির্মমভাবে হত্যা করা হচ্ছিল তখনও আশেপাশে অসংখ্য মানুষের আনাগোনা ছিল। তবে কেউই তাকে বাঁচাতে এগিয়ে আসার সাহস দেখাননি। এ সময় তাদেরককে স্লোগানও দিতে দেখা যায়।
ঘটনার পরদিন সরেজমিনে স্থানীয়দের সঙ্গে কথা বলে ও সিসিটিভির ফুটেজ বিশ্লেষণ করে যাদের নাম পাওয়া গেছে তারা সবাই কোন না কোনভাবে বিএনপির সহযোগী সংগঠনের সক্রিয় নেতাকর্মী।
ভাঙারি ব্যবসায়ী সোহাগও ঢাকা দক্ষিণের ৩০ নং ওয়ার্ডের যুবদলের সক্রিয় কর্মী ছিলেন বলে জানা গেছে।
স্থানীয়রা জানিয়েছেন, সোহাগ কেরানীগঞ্জে থাকতেন, কিন্তু তার গ্রামের বাড়ি বরগুনা জেলায়। গত ১৫ বছর ধরে ভাঙ্গারি ও সাদা তারের ব্যবসা করে আসছিলেন সোহাগ।
এ ঘটনায় এরই মধ্যে একজনকে গ্রেপ্তার করার কথা জানিয়েছে পুলিশ।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে সোহাগের ঘনিষ্ঠ একজন দ্য সান ২৪কে জানিয়েছেন, মূলত আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পরে মঈন, টিটু, অপু দাস ওই এলাকার ব্যবসার নিয়ন্ত্রণ নিতে মরিয়া হয়ে ওঠে।
অনুসন্ধানে জানা গেছে, মঈন, টিটু ও অপু দাসের পেছনে মূলহোতা ছিলেন চকবাজার থানা বিএনপির সাবেক সাংগঠনিক সম্পাদক আনোয়ারুল হক রনি ওরফে ভাইয়া রনি এবং রজ্জব আলী পিন্টু ও চঞ্চল হোসেন।
এই তিন জনই যুবদলের কেন্দ্রীয় কমিটির সাবেক সাংগঠনিক সম্পাদক এবং সাবেক ছাত্রদল নেতা ইসহাক সরকারের ঘনিষ্ঠ হিসেবে পরিচিত।
মিটফোর্ড জরুরি গেট সংলগ্ন চঞ্চল হোসেনের বাসার নিচতলায় ছিল মঈনের ব্যক্তিগত অফিস, সে সূত্রে তাদের মধ্যে বেশ ঘনিষ্ঠতা রয়েছে বলে জানতে পেরেছে দ্য সান ২৪।
হত্যায় জড়িত যারা
প্রত্যক্ষদর্শীদের বক্তব্যের সঙ্গে সিসিটিভির ফুটেজ ও পথচারীদের ধারণ করা ভিডিও চিত্র মিলিয়ে দেখা গেছে মঈন, টিটু ও অপু দাস হত্যাকাণ্ডে সরাসরি অংশ নেয়।
এদের মধ্যে মঈন ৩০ নং ওয়ার্ড ছাত্রদলের সাবেক সভাপতি এবং চকবাজার থানা ছাত্রদলের সাবেক সাধারণ সম্পাদক। প্রত্যক্ষদর্শীদের ভাষ্য, পাথর এবং ইট দিয়ে সোহাগের মাথায় মধ্যযুগীয় কায়দায় আঘাত করতে দেখা গেছে মঈনকে, যা ভিডিওতেও স্পষ্ট।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, পদ-পদবী না থাকলেও টিটু ৩১ নং ওয়ার্ড যুবদলের রাজনীতিতে যুক্ত। তিনি চকবাজার থানা যুবদলের সাবেক আহ্বায়ক এবং ঢাকা মহানগর দক্ষিণ যুবদলের যুগ্ম আহ্বায়ক সাবা করীম লাকি ও দক্ষিণ যুবদলের সদস্য সচিব রবিউল ইসলাম নয়নের বিশ্বস্ত সহযোগী।
টিটু সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডে ব্যবহারের জন্য পিস্তল ও গুলি সরবারহ করেন বলেও অভিযোগ পাওয়া গেছে। এছাড়া তার বিরুদ্ধে ছিনতাই, চাঁদাবাজিসহ অসংখ্য অভিযোগ রয়েছে।
টিটুর আপন বড় ভাই ১৫ বছর আগে নয়াবাজার এলাকায় প্রতিপক্ষের হাতে খুন হন।
হত্যাকাণ্ডে সরাসরি অংশ নেওয়া অপু দাস, মঈনের রাজনৈতিক ‘ছোট ভাই’ হিসেবে পরিচিত। তিনি ৩০ নং ওয়ার্ড ছাত্রদলের সাবেক সভাপতি এবং বর্তমান চকবাজার থানা ছাত্রদলের সদস্য সচিব হিসেবে দ্বায়িত্ব পালন করছেন।
অপু দাসের বিরুদ্ধে মিটফোর্ড এলাকায় চাঁদাবাজির অসংখ্য অভিযোগ রয়েছে। অপু দাসও ইসহাক সরকারের অনুসারী এবং মিটফোর্ড এলাকায় চঞ্চলের ছত্রছায়ায় প্রভাব বিস্তার করে আসছে।
যেভাবে হত্যাকাণ্ড
হত্যাকাণ্ডের একদিন আগে মঙ্গলবার বিকেলে মঈন, টিটু, অপু দাসসহ ৪০/৫০ জন সোহাগের ব্যাবসায়িক প্রতিষ্ঠান ৪নং রজনীবোস লেনের দোকানে যায় এবং সোহাগকে খুঁজতে থাকে। সোহাগকে না পেয়ে তারা গোডাউনে তালা ঝুলিয়ে দেয়। এ সময় অন্যান্য ব্যবসায়ীদের শাসিয়ে যায় এই বলে- “তারের ব্যীবসা শুধু আমরাই করবো।” এ সময় টিটু ৪/৫ রাউন্ড ফাঁকা গুলি চালিয়ে সবাইকে নিয়ে ঘটনাস্থল থেকে চলে যায়।
পরে সেখানে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী গিয়ে খোঁজ-খবর নেয় এবং সিসিটিভির ফুটেজ সংগ্রহ করে।
বুধবার সকাল থেকেই মঈন, টিটু ও অপু দাস সোহাগের দোকানের আশেপাশে অবস্থান নিয়ে তার অপেক্ষা করতে থাকে। ‘সোহাগ দোকানে এসেছে’- এমন খবর পেয়েই তারা ৭০/৮০ জনকে সঙ্গে নিয়ে সোহাগকে পাকড়াও করে তারা। পরে সেখান থেকে টেনেহিঁচড়ে মিটফোর্ড হাসপাতালের ৩ নং গেইটে নিয়ে যায়।
প্রথমে লোহার রড দিয়ে মাথায় আঘাত করলে সোহাগ মাটিতে পড়ে যায়। এরপর চলে পাশবিক অত্যাচার। এসময় তার পরনের কাপড়ও ছিঁড়ে ফেলে তারা। সোহাগকে উলঙ্গ করে মৃত্যু নিশ্চিত করার জন্য পাথর দিয়ে মাথা থেতলে দেয় তারা। মারা যাওয়ার পর সোহাগের শরীরের উপর লাফাতে দেখা যায় অপু দাসকে।
কোতোয়ালি থানার ওসি মো. মনিরুজ্জামান জানিয়েছেন, ওই ঘটনায় এ পর্যন্ত মঈন নামে এক জনকে আটক করতে পেরেছেন তারা। এ সময় তার সঙ্গে পিস্তল এবং ধারালো অস্ত্র পাওয়া গেছে।
অন্যদের গ্রেপ্তারে অভিযান চলছে বলে জানালেও এখনও কাউকে গ্রেপ্তার করতে পারেনি পুলিশ।