জুলাই অভ্যুত্থান যাদের নেতৃত্বে হয়েছে, তাদের বাদ রেখেই জুলাই সনদ সই হল। এই সনদ সইয়ের আগে পুলিশের সঙ্গে ‘জুলাই যোদ্ধা’দের সংঘর্ষে সংসদ ভবন এলাকা রূপ নিয়েছিল রণক্ষেত্রে।
শুক্রবার বিকালে জাতীয় সংসদ ভবনের দক্ষিণ প্লাজায় অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা মুহাম্মদ ইউনূসের উপস্থিতিতে জুলাই সনদে সই করে রাজনৈতিক দলগুলো।
জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের আলোচনায় অংশ নেওয়া ৩০টি দলের মধ্যে বিএনপি ও জামায়াতে ইসলামীসহ ২৪টি দল অনুষ্ঠানে যোগ দিয়ে সনদে সই করে।
গণফোরাম অনুষ্ঠানে অংশ নিলেও সনদে সই করেনি। সনদে প্রত্যাশিত আকাঙ্ক্ষার প্রতিফলন ঘটেনি অভিযোগ করে অনুষ্ঠানে যায়নি জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি)।
বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টি (সিপিবি)সহ চারটি বাম দল অনুষ্ঠানে যায়নি, সনদেও সই করেনি। তারা মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে অর্জিত সংবিধানের মূল প্রস্তাব বাদ দেয়ায় আপত্তি তুলে এই সিদ্ধান্ত নেয়।
জুলাই সনদে সই করার মাধ্যমে দলগুলো অঙ্গীকার করেছে, ক্ষমতায় গেলে সংবিধানসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে মৌলিক পরিবর্তন আনার। এই পরিবর্তনের মধ্যে জাতীয় পরিচয় বদলে বাঙালি থেকে বাংলাদেশি হওয়ার কথা রয়েছে, ১৯৭২ এর সংবিধানের মূলনীতি- ধর্ম নিরপেক্ষতা, জাতীয়তাবাদ, গণতন্ত্র ও সমাজতন্ত্রও বাদ পড়ার তালিকায় রয়েছে।
গত বছর জুলাই অভ্যুত্থানে আওয়ামী লীগ সরকার পতনের পর ইউনূস অন্তর্বর্তী সরকারের দায়িত্ব্ নিয়ে নানা সংস্কার কমিশন গঠন করেন। সেই কমিশনের সুপারিশমালা নিয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে আলোচনার ভিত্তিতে রচিত হল জুলাই সনদ। অনুষ্ঠানে সনদ স্বাক্ষরের পর ইউনূস বলেন, “এই সনদে স্বাক্ষরের মাধ্যমে আমরা নতুন বাংলাদেশের সূচনা করলাম।”

নানা মতানৈক্যের মধ্যে জুলাই সনদ সই হওয়ার বিষয়টিকে গুরুত্ব দিয়ে এই ঐক্য আগামী ফেব্রুয়ারিতে নির্বাচন অবধি ধরে রাখতে রাজনৈতিক দলগুলোর প্রতি আহ্বান জানান তিনি।
বক্তব্যে তিনি জুলাই অভ্যুত্থানে নিহত এবং আহতদের অবদান স্বীকার করে বলেন, তাদের কারণেই আজ এই পরিবর্তনের সূচনা করা গেছে।
তবে এদিন দুপুরে এই মঞ্চের সামনেই পিটুনির শিকার হন ‘জুলাই শহীদ পরিবার ও আহত যোদ্ধা’ ব্যানারে বিক্ষোভরত কয়েকশ জন। তারা জুলাই সনদ সংশোধন, সনদকে স্থায়ীভাবে সংবিধানে অন্তর্ভূক্ত এবং জুলাই যোদ্ধাদের স্বীকৃতি- এই তিন দাবিতে মূল মঞ্চের সামনেই অবস্থান নিয়েছিলেন সকালে।
দুপুর ১টার পর পুলিশ তাদের তুলে দিতে গেলে সংঘাত বাধে। সংসদ ভবনের সামনে মানিক মিয়া এভিনিউতে প্রায় দুই ঘণ্টা ধরে পুলিশের সঙ্গে তাদের ধাওয়া-পাল্টা ধাওয়া চলে। পুলিশ লাঠিপেটার পাশাপাশি কাঁদানে গ্যাস ছুড়ে ও সাউন্ড গ্রেনেড ফাটিয়ে তাদের ছ্ত্রভঙ্গ করে দেয়।
এরপর সেনা-পুলিশের পাহারায় হয় জুলাই সনদ স্বাক্ষর অনুষ্ঠান। এতে বিভিন্ন উপদেষ্টার পাশাপাশি সেনাপ্রধান জেনারেল ওয়াকার-উজ-জামানসহ তিন বাহিনী প্রধান উপস্থিত ছিলেন।
এদিকে এই বিক্ষোভের মুখে জুলাই জাতীয় সনদের অঙ্গীকারনামার পঞ্চম দফা সংশোধনের ঘোষণা দেয় জাতীয় ঐকমত্য কমিশন।

এই দফায় আগে ছিল- জুলাই-আগস্টের গণ-অভ্যুত্থানকালে সংঘটিত সকল হত্যাকাণ্ডের বিচার, শহীদদের রাষ্ট্রীয় মর্যাদা প্রদান ও শহীদ পরিবারগুলোকে যথোপযুক্ত সহায়তা প্রদান এবং আহতদের সুচিকিৎসা ও পুনর্বাসনের ব্যবস্থা নিশ্চিত করা হবে।
বিক্ষোভকারীদের আপত্তি তোলার কারণ ছিল এই কারণে যে এতে অভ্যুত্থানের সময় পুলিশসহ আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মী হত্যার ঘটনায় তাদের ফেঁসে যাওয়ার সুযোগ থেকে যায়।
পরে সেই দফায় সংশোধন করে লেখা হয়, ২০২৪ সালের জুলাই-আগস্ট গণ-অভ্যুত্থানকালে ‘ফ্যাসিস্ট’ আওয়ামী লীগ ও তার সহযোগী আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কতিপয় সদস্যদের দ্বারা সংঘটিত সকল হত্যাকাণ্ডের বিচার নিশ্চিত করা হবে।
এতে পুলিশ ও আওয়ামী লীগ নেতা-কর্মী হত্যার বিচারের বিষয়টি অঙ্গীকারনামা থেকে বাদ পড়ে।
অভ্যুত্থানকারীদের দল এনসিপি আগেই ইঙ্গিত দিয়েছিল, তারা জুলাই সনদে সই করবে না।
শুক্রবার অনুষ্ঠানের পর দলটির সদস্য সচিব আক্তার হোসেন বিবিসি বাংলাকে বলেন, তিন দফা দাবি বাস্তবায়নে শেষ পর্যন্ত ঐকমত্য কমিশনের সঙ্গে আলোচনা চালিয়ে যেতে চান তারা। দাবি আদায় না হলে জনগণকে নিয়ে কর্মসূচিতে নামবেন তারা।
সনদের বিষয়ে অমীমাংসিত দিকগুলোর সমাধানের দাবি জানিয়ে তিনি বলেন, “আমরা যে পরিবর্তনের আকাঙ্ক্ষা ব্যক্ত করেছি, সনদে যতটুকু অর্জিত হয়েছে সেটাকে টেকসইভাবে বাস্তবায়ন, এটার যে ড্রাফট আদেশের প্রাপ্তি, গণভোটের বিষয়ে ফয়সালা, নোট অফ ডিসেন্ট (আপত্তি) এর জায়গাগুলো পরিষ্কার করা- এই বিষয়গুলোতেই আমরা কমিশনের সাথে আলাপ জারি রাখব।”