মনফুলের জন্মদিন আজ। এক সময় এই দিন ছিল আনন্দের, হাসির, ভালোবাসায় ভরা পারিবারিক দিন ছিল। কিন্তু এবার, দিনটি এসেছে এক গভীর শূন্যতা নিয়ে। কারণ, মনফুলের বাবা-মা—সাংবাদিক শাকিল আহমেদ ও ফারজানা রুপা—এই মুহূর্তে কারাগারে।
বাবা-মাকে কাছে না পেয়ে, তাদের একটি ছবি জড়িয়ে ধরে বসে আছে; যেন ছবি হয়েই আজ তার জন্মদিনে সঙ্গী হয়েছে মা-বাবা। এ যেন মনফুলের অন্যরকম জন্মদিন।
মনফুলের জন্মদিন উপলক্ষে এই ছবিটি শনিবার সামাজিক মাধ্যমে পোস্ট করেছেন তার ভাই নভোনীল সরকার।
মনফুলকে উদ্দেশ করে তিনি লিখেছেন, “তুই অনেক শক্ত একটা মেয়ে—তোর ভেতরের সাহস, যুদ্ধ করার ইচ্ছে, ভালোবাসার গভীরতা, সবকিছুই আমাকে বারবার অবাক করে। তোর ছোট ছোট কথাগুলো, হাসির আড়ালে লুকানো ব্যথাগুলো—সব আমার হৃদয়ের গভীরে বাজে।”
বাবা-মা’র ছবি হাতে নিয়ে মনফুলের জন্মদিনের এই ছবি মধ্যে রয়েছে প্রতিবাদের ভাষা।
ছবিতে মনফুলকে দেখা যায় একটি কালো সোফায় বসে আছেন। হাতে একটি কাঠের ফ্রেমে বাঁধানো পারিবারিক ছবি। ছবির ভেতরে হাস্যোজ্জ্বল বাবা-মা এবং মনফুল। কিন্তু বাস্তবের মনফুলের মুখে নেই সে হাসি। যদিও সে শান্ত, কিন্তু তার দৃষ্টিতে স্পষ্ট এক নিঃশব্দ আর্তনাদ।
বাবা-মা কারাগারে বন্দী। এই মূহূর্তে কেবল একটি পারিবারিক ছবিই মনফুলের আশ্রয়। এই এক টুকরো কাগজেই সে খুঁজে নিচ্ছে স্পর্শহীন ভালোবাসার উত্তাপ।
সাংবাদিক শাকিল আহমেদ ও ফারজানা রুপা দীর্ঘদিন ধরে সাংবাদিকতায় যুক্ত। গত বছরের ২১ আগস্ট তাদের গ্রেপ্তার করা হয়। এরপর থেকে একের পর এক হত্যা মামলার আসামি করে রিমান্ডে নেওয়া হয়েছে তাদের।
দেশীয় ও আন্তর্জাতিক বিভিন্ন সাংবাদিক সংগঠন, মানবাধিকার সংস্থার পক্ষ থেকে তাদের আটক করা নিয়ে প্রশ্ন তোলা হলেও এখনো জামিন মেলেনি তাদের।

মনফুলের জন্মদিন তাই যেন এক রাজনৈতিক প্রশ্ন হয়ে উঠে এসেছে—গণমাধ্যমের স্বাধীনতা কি কেবল নীতিগত নাকি বাস্তবেও প্রযোজ্য?
মনফুলের এই ছবি শুধুই আবেগের নয়, এটি এক ধরনের নীরব প্রতিবাদও। মনফুল কথা বলেনি, কোনো বিবৃতি দেয়নি। কিন্তু তার চোখ, তার মুখ, তার বাবা-মার ছবির প্রতি নিবিষ্ট দৃষ্টি—সবই এক অনুচ্চারিত প্রতিবাদের ভাষা।
একটি রাষ্ট্র যখন সাংবাদিক বাবা-মাকে দীর্ঘদিন ধরে কারাগারে বন্দী রাখে, তখন সন্তানের এই ছবি হয়ে ওঠে রাজনৈতিক প্রতিচ্ছবি। ছবিতে কোনো স্লোগান নেই, ব্যানার নেই, কিন্তু গভীর বার্তা রয়েছে।
এই ঘটনা শুধু শাকিল-রুপা দম্পতির সাংবাদিক পরিচয়ের নয়, এটি একজন মেয়ের বাবা-মাকে ফিরে পাওয়ার আকাঙ্ক্ষার গল্পও। এটি সাংবাদিকতার মূল্য যে ব্যক্তিগত জীবনকে কতটা নাড়িয়ে দিতে পারে—তারও উদাহরণ।
শুধু খবর লেখাই নয়, সাংবাদিকের জীবন তার পরিবারকেও ছুঁয়ে যায়। মনফুলের জন্মদিনে এই ছবিটি তার জীবন্ত উদাহরণ।
এমন এক সময় এই ঘটনা ঘটছে যখন বাংলাদেশে সংবাদপত্রের স্বাধীনতা প্রশ্নবিদ্ধ। গত কয়েক মাসে একাধিক টিভি টকশো বন্ধ, সাংবাদিক ছাঁটাই, এবং সেন্সরশিপের অভিযোগ ঘিরে দেশজুড়ে বিতর্ক চলছে।
এই প্রেক্ষাপটে মনফুলের জন্মদিন যেন এক প্রতীকী ঘটনা হয়ে উঠেছে—যেখানে একটি কিশোরীর ব্যক্তিগত শোক মিলেছে জাতির বৃহত্তর সংকটের সঙ্গে।
এই ছবিটি শুধুমাত্র একটি পরিবারের নয়, এটি দেশের প্রতিটি বিবেকবান নাগরিকের। যারা বিশ্বাস করে—ভালোবাসা, অধিকার ও স্বাধীনতা কেবল শব্দ নয়, বাস্তবের চর্চা।