তৎকালীন আওয়ামী লীগ নেত্রী আইভি রহমানসহ যারা ২১ আগস্টের গ্রেনেড হামলায় প্রাণ হারিয়েছেন, তাদের ন্যায়বিচার সম্পূর্ণভাবে উপেক্ষিত হয়েছে বলে পূর্ণাঙ্গ রায়ের পর্যবেক্ষণে বলেছে হাইকোর্ট।
একইসঙ্গে হাইকোর্ট ওই ঘটনার যথাযথ তদন্তের জন্য প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে তা স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে পাঠানোর তাগিদ দিয়েছে।
বৃহস্পতিবার মামলার পূর্ণাঙ্গ রায় প্রকাশিত হয়, যা নিয়ে প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে বাংলাদেশের বিভিন্ন গণমাধ্যম।
দুই দশক আগে আওয়ামী লীগের সমাবেশে গ্রেনেড হামলার ঘটনায় করা এই মামলায় বিচারিক আদালতের দেওয়া সাজার রায় বাতিল করে ১ ডিসেম্বর রায় দেন হাইকোর্ট।
ওই রায়ের পূর্ণাঙ্গ অনুলিপি বৃহস্পতিবার সুপ্রিম কোর্টের ওয়েবসাইটে প্রকাশ করা হয়েছে।
রায়ে বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান, সাবেক স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী লুৎফুজ্জামান বাবরসহ গ্রেনেড হামলা মামলার আসামিরা খালাস পান, এর আগের রায়ে যাদের বিভিন্ন মেয়াদে সাজা হয়েছিল।
দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ড প্রতিবেদনে বলা হয়, দোষীদের খালাসের রায়ের ভিত্তিতে আদালত মন্তব্য করেছে, ‘এ মামলার বাস্তবিক দিকগুলো বিবেচনা করলে বলা যায় যে, অভিযুক্তদের দোষী সাব্যস্ত করা হয়েছে মূলত অনুমানের ভিত্তিতে, কোনো আইনি বা প্রমাণসাপেক্ষ ভিত্তি ছাড়াই।’
আদালত আরও বলেছেন, আলোচনার পর দেখা গেছে, প্রসিকিউশন এ মামলায় কোনো আসামির উপস্থিতি বা অংশগ্রহণের মাধ্যমে অপরাধ সংঘটনের অভিযোগ প্রমাণে পুরোপুরি ব্যর্থ হয়েছে। ফলে, দণ্ডবিধির ৩০২/৩৪ ধারার অধীনে তাদের দোষী সাব্যস্ত করার ভিত্তি নেই।
একইভাবে বিস্ফোরক পদার্থ আইনের ৩, ৪ এবং ৬ ধারার অধীনে আনা অভিযোগও প্রমাণ করা সম্ভব হয়নি।
রায়ে আরও বলা হয়েছে, ‘দ্বিতীয় তদন্ত সঠিকভাবে সম্পন্ন না হওয়ায় এখতিয়ার ছাড়াই বেআইনিভাবে বিচার অনুষ্ঠিত হয়েছে এবং মামলার যথাযথ বিশ্লেষণ ছাড়াই রায় দেওয়া হয়েছে।’
রায়ে আদালত মন্তব্য করেছে, বিষয়টির সব দিক বিবেচনা করে আমরা এ সিদ্ধান্তে উপনীত হয়েছি যে, অভিযুক্তদের দোষী সাব্যস্ত করা এবং তাদের দেওয়া সাজা বেআইনি এবং আইনি ভিত্তিতে টেকসই নয়। তাই এ রায় বাতিল করা হলো।
আদালত মনে করে, আইনি ভিত্তি ও বাস্তব প্রমাণের অভাবে অভিযুক্তদের দোষী সাব্যস্ত করা যায় না। সে অনুযায়ী, ফৌজদারি কার্যবিধির ৩৭৪ ধারার অধীনে ডেথ রেফারেন্স প্রত্যাখ্যান করা হলো এবং আপিল গ্রহণ করা হলো।
রায়ে আরও উল্লেখ করা হয়, ‘যেসব আসামির বিরুদ্ধে আপিল করা হয়নি, তাদের ক্ষেত্রেও এ রায় প্রযোজ্য হবে। কারণ, অভিযুক্তদের দোষী সাব্যস্ত করা অবৈধ এবং আইনি ভিত্তিতে টেকসই নয়। তাই রায় ও দণ্ড বাতিল করা হলো এবং যারা কারাগারে রয়েছেন, তাদের অবিলম্বে মুক্তি দেওয়ার নির্দেশ দেওয়া হলো।’
আদালত আরও বলেছে, আমাদের সর্বোচ্চ আদালতের অনেক সিদ্ধান্তে বলা হয়েছে, চার্জশিট গৃহীত হওয়ার পর মামলা পুনরায় খোলা বা নতুন করে তদন্তের জন্য পাঠানো যায় না। তবে, যদি নতুন কোনো প্রমাণ পাওয়া যায়, তদন্ত কর্মকর্তা সম্পূরক চার্জশিট দাখিল করতে পারেন। তবে আদালতের অনুমতি ছাড়া প্রসিকিউশনকে মামলাটি পুনঃতদন্তের জন্য পাঠানো বেআইনি। এর ফলে বেআইনি ভিত্তিতে মামলার কার্যক্রম এবং পরবর্তী তদন্তের চার্জশিটও আইনি ভিত্তিতে টেকসই নয়।
২০০৪ সালের ২১ আগস্ট রাজধানীর বঙ্গবন্ধু অ্যাভিনিউয়ে আওয়ামী লীগের সভাপতি শেখ হাসিনার সমাবেশে গ্রেনেড হামলা হয়। এতে ২৪ জন নিহত হন। আহত হন শতাধিক নেতা-কর্মী। তখন ক্ষমতায় ছিল বিএনপি–জামায়াত জোট সরকার। গ্রেনেড হামলার ঘটনায় মামলা হয় মতিঝিল থানায়।
মামলার তদন্ত ভিন্ন খাতে নিতে তৎকালীন সরকার নানা তৎপরতা চালায় বলে আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে অভিযোগ করা হয়েছিল বলে দৈনিক প্রথম আলোর প্রতিবেদনে উঠে এসেছে।
এরপর ২০০৭ সালে তৎকালীন তত্ত্বাবধায়ক সরকার মামলার তদন্ত নতুনভাবে শুরু করে। ২০০৮ সালে এ মামলায় প্রথমে ২২ জনকে আসামি করে আদালতে অভিযোগপত্র দেয় পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ (সিআইডি)।
পরে আওয়ামী লীগ সরকার আমলে এ মামলার (হত্যা ও বিস্ফোরক) অধিকতর তদন্ত হয়। এরপর তারেক রহমানসহ আরও ৩০ জনকে আসামি করে সম্পূরক অভিযোগপত্র দেওয়া হয়।
এ মামলায় ২০১৮ সালের ১০ অক্টোবর ঢাকার দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনাল-১ রায় দেন। রায়ে সাবেক স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী লুৎফুজ্জামান বাবর, সাবেক শিক্ষা উপমন্ত্রী আবদুস সালাম পিন্টুসহ ১৯ জনকে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয়। বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানসহ ১৯ জনকে দেওয়া হয় যাবজ্জীবন কারাদণ্ড। এ ছাড়া সেনাবাহিনী ও পুলিশের সাবেক ১১ জনকে বিভিন্ন মেয়াদে কারাদণ্ড ও অর্থদণ্ড দেওয়া হয়। সব মিলিয়ে ৪৯ জনকে সাজা দেওয়া হয়েছিল।
গ্রেনেড হামলা মামলায় বিচারিক আদালতের রায়ের আগে অন্য একটি মামলায় মুফতি হান্নানের ফাঁসি কার্যকর হয়।
এর আগে গ্রেনেড হামলা মামলায় ২০১১ সালে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়েছিলেন তিনি। অবশ্য পরে তা আদালতে প্রত্যাহার করেন বলে জানান আসামিপক্ষের আইনজীবীরা।
তারা বলছেন, জবানবন্দি প্রত্যাহারের বিষয়টি বিবেচনায় নিয়েছে হাইকোর্ট।
বিচারিক আদালতের রায়ের পর ২০১৮ সালে মামলার সব নথিপত্র হাইকোর্টে এসে পৌঁছায়। এটি হাইকোর্টের সংশ্লিষ্ট শাখায় ‘ডেথ রেফারেন্স’ মামলা হিসেবে নথিভুক্ত হয়।
কোনো ফৌজদারি মামলায় বিচারিক আদালতের রায়ে কোনো আসামির মৃত্যুদণ্ড হলে তা কার্যকরে হাইকোর্টের অনুমোদন লাগে, যা ডেথ রেফারেন্স মামলা হিসেবে পরিচিত।