কাজী নজরুল এখন আনুষ্ঠানিকভাবে বাংলাদেশের জাতীয় কবি

জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম
জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম

জানতো সবাই, মানতও, কবি নজরুল ইসলাম বাংলাদেশের জাতীয় কবি। তবে এতদিন তার আনুষ্ঠানিক কোনও স্বীকৃতি ছিল না। স্বাধীনতার ৫৩ বছর পর এসে বিষয়টি নজরে আসার পর সারা হলো সেই আনুষ্ঠানিকতা।

বিদ্রোহের এই কবিকে জাতীয় কবির স্বীকৃতি দিতে অভ্যুত্থানের সরকার বৃহস্পতিবার প্রজ্ঞাপন প্রকাশ করেছে। তাতে বলা হয়েছে, ১৯৭২ সালের ৪ই মে তারিখ থেকে কবি নজরুলকে বাংলাদেশের ‘জাতীয় কবি’ হিসাবে স্বীকৃত হবেন।

দ্রোহের কবি নজরুলের কবিতা-গান বাংলাদেশের স্বাধিকার আন্দোলনের লড়াই থেকে শুরু করে মুক্তিযুদ্ধেও প্রেরণা জুগিয়েছিল। বাংলাদেশের রণসঙ্গীতও তার লেখা। এবারের জুলাই অভ্যুত্থানেও নজরুলের লেখার ছিল সদর্প উপস্থিতি।

অভ্যুত্থানের পর গঠিত অন্তর্বর্তী সরকারের উপদেষ্টা পরিষদ গত ৫ ডিসেম্বর কবি নজরুলকে জাতীয় কবি ঘোষণার প্রস্তাব অনুমোদন করে। তারপর এখন প্রজ্ঞাপন হলো।

কবি নজরুল জাতীয় কবি- কথাটি সবার মুখে মুখে চলতে থাকায় আসলে যে কোনও আনুষ্ঠানিক স্বীকৃতি ছিল না, তা খুঁজে দেখার অবকাশ কেউ পায়নি।

আওয়ামী লীগ আমলে একবার কেউ কথাটি তুলেছিল, তখন বলা হয়েছিল, কবি নজরুলের নামে করা বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের আইনেই জাতীয় কবি বলা রয়েছে, ফলে আলাদা করে প্রজ্ঞাপনের প্রয়োজন নেই।

সম্প্রতি কবি নজরুল ইনস্টিটিউট আয়োজিত এক আলোচনা সভায় কবি নজরুলকে আনুষ্ঠানিকভাবে জাতীয় কবি ঘোষণার দাবি ওঠে।

তার আগে সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী মো. আসাদ উদ্দিনসহ ১০ জন কাজী নজরুল ইসলামকে ‘জাতীয় কবি’ ঘোষণা করে গেজেট প্রকাশের নির্দেশনা চেয়ে হাই কোর্টে রিট আবেদন করেছিলেন।

সেই রিট আবেদনে কাজী নজরুলকে জাতীয় কবি ঘোষণার পক্ষে তারা যুক্তি দেখিয়েছিলেন, “আজকের শিশু জানলেও যুগ যুগ পরের কোনও এক প্রজন্মের শিশুটি জানার সুযোগ নাও পেতে পারে। দূর ভবিষ্যতে কেউ চাইলে এটি চ্যালেঞ্জও করতে পারবে। কর্তৃপক্ষ মনে করলে আবার অন্য কাউকে জাতীয় কবি হিসাবে ঘোষণাও দিয়ে দিতে পারবে।”

নজরুল যে জাতীয় কবি, সেই কথাটি প্রথম যখন ওঠে, তখন বাংলাদেশ তো দূরের কথা ভারতও স্বাধীন হয়নি। ১৯২৯ সালের ১৫ ডিসেম্বর কলকাতার আলবার্ট হলে একটি সংবর্ধনার আয়োজন করা হয়, যার উদ্যোক্তা ছিলেন ‘সওগাত’ সম্পাদক মোহাম্মদ নাসির উদ্দীন, আবুল কালাম শামসুদ্দীন, আবুল মনসুর আহমদ, এস ওয়াজেদ আলী, হাবীবুল্লাহ বাহার প্রমুখ।

সর্বভারতীয় বাঙালিদের পক্ষ থেকে দেওয়া সেই সংবর্ধনা সভায় সভাপতিত্ব করেছিলেন স্যার আচার্য প্রফুল্ল চন্দ্র রায়। উপস্থিত ছিলেন নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসু, ব্যারিস্টার ওয়াজেদ আলী এবং শেরেবাংলা এ কে ফজলুল হকসহ বিশিষ্টজন।

সেই অনুষ্ঠানেই কবি নজরুলকে বাঙালির ‘জাতীয় কবি’ ঘোষণা দেওয়া হয়। সেই থেকে নজরুল মুখে মুখে হয়ে যান জাতীয় কবি।

কবি নজরুলের জন্ম ভারতের পশ্চিমবঙ্গের বর্ধমান জেলার চুরুলিয়া গ্রামে ১৮৯৯ সালের ২৪ মে (১৩০৬ বঙ্গাব্দের ১১ জ্যৈষ্ঠ)। শৈশবে বাবা-মা হারা নজরুলের জীবনের একটি অংশ বাংলাদেশের ময়মনসিংহে কেটেছে। তিনি বিয়েও করেন বাংলাদেশের কুমিল্লার প্রমীলা দেবীকে।

স্বাধীনতার পর বঙ্গবন্ধু সরকারের উদ্যোগে অসুস্থ ও নির্বাক কবিকে ১৯৭২ সালের ২৪ মে সপরিবারে বাংলাদেশে আনা হয়। তাকে রাখা হয়েছিল ধানমণ্ডির এক বাড়িতে রাষ্ট্রীয় মর্যাদায়। ভবনটির নাম দেওয়া হয়েছিল কবি ভবন, প্রতিদিন সেখানে জাতীয় পতাকা উড্ডীন থাকত। সেই ভবনটিই এখন নজরুল ইসস্টিটিউট।

বাংলা সাহিত্য ও সংস্কৃতিতে কবির অবদানের স্বীকৃতিস্বরূপ ১৯৭৪ সালের ৯ ডিসেম্বর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এক বিশেষ সমাবর্তনে কবিকে সম্মানসূচক ডি লিট উপাধিতে ভূষিত করে। ১৯৭৬ সালের জানুয়ারি মাসে নজরুলকে বাংলাদেশের নাগরিকত্ব দেওয়া হয়। সে বছরই তাকে একুশে পদকে ভূষিত করা হয়।

১৯৭৬ সালের ২৯ আগস্ট মারা যাওয়ার পর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় মসজিদের উত্তর পাশে রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় সমাহিত করা হয় কবি নজরুলকে। তারপর থেকে তার জন্ম ও মৃত্যু দিনে জাতীয় কবি হিসাবেই তাকে সরকারিভাবে শ্রদ্ধা জানানো হয়ে আসছে।

আরও পড়ুন