খালেদা জিয়ার অসুস্থতা ও রুগ্ন রাজনীতি

বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া।
বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া।

বাংলাদেশের রাজনীতির এক দিকপাল বেগম খালেদা জিয়া গুরুতর অসুস্থ। এমন এক সময়ে তিনি হাসপাতালের আইসিইউতে আছেন যখন বাংলাদেশের রাজনীতিও অনেকটা আইসিইউতে। রঙিন বিপ্লবের বৈধতা উৎপাদনের জন্য যখন দেশে নানামুখী তৎপরতা চলছে। সংবিধান সংস্কারের নামে দেশের মৌলিক ভিত্তিমূলে যখন আঘাত আনা হচ্ছে। রঙিন ব্যালটে সাধারণ মানুষকে যখন গণভোটের নামে গণবিভ্রান্তিতে ফেলা হচ্ছে তখন ক্রিয়াশীল রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে দেখা দিয়েছে বিভাজন, বিভ্রম।

দেশের গণতান্ত্রিক উত্তরণের এই ক্রান্তিলগ্নে যখন অনির্বাচিত সরকার দেশের স্বার্থবিরোধী নানা সিদ্ধান্ত গ্রহণ করছে তখন রাজনৈতিক দলগুলোও অনেকটা নীরব, অনেকটা ভীতসন্ত্রস্ত। বলতে ইচ্ছে করছে- “কারা সুতা টানছে সে সম্পর্কে এই পুতুলেরা কত সামান্যই -না জানে!”

এমনি এক কঠিন মুহূর্তে দেশে অবস্থানরত রাষ্ট্রের প্রধান নির্বাহীর দায়িত্ব পালন করা একমাত্র রাজনীতিবিদ এখন বেগম খালেদা জিয়া। যদিও তিনি দীর্ঘদিন থেকে তিনি অসুস্থ। দলীয় নীতি নির্ধারনের ক্ষেত্রেও অনেক আগেই গুরুত্ব হারিয়েছেন। তবুও দেশের মানুষের কাছে তিনি শ্রদ্ধার পাত্র। বিগত সরকার নিষ্ঠুরতা চালিয়েছে এমন বিশ্বাস থেকে দেশের অধিকাংশ মানুষ তাঁর প্রতি সহানুভুতিশীল। দেশের রাজনীতিতে নিঃসন্দেহে তিনি এক গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিত্ব। বয়োবৃদ্ধ এই মানুষটির শারিরীক অসুস্থতা নিয়ে অনেক অপ রাজনীতি হয়েছে। সংবাদ মাধ্যমের তথ্য অনুযায়ী তিনি যখন সংকটাপন্ন অবস্থায় রয়েছেন। তখন বর্তমান অর্ন্তবর্তী সরকার তাঁকে অতি গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি হিসেবে গেজেট প্রকাশ করেছে। এটাও তো এক ধরনের রাজনীতির চাল ! এসব কি তাঁর নিরাপত্তা নিশ্চিতের জন্য না কারো অশুভ পরিকল্পনার অংশ। এ নিয়েও নানা কথা উঠছে। বেগম খালেদা জিয়াকে নিয়ে সরকারের এই সিদ্ধান্ত যদি তাঁর সুচিকিৎসার জন্য কার্যকর ভূমিকা রাখে। তবে তা অবশ্যই সাধুবাদ পাওয়ার যোগ্য। আর তা যদি অসৎ উদ্দেশ্যে রুগ্ন রাজনীতির আয়োজন হয় তা খুবই দুঃখজনক, ধৃষ্টতাপূর্ণ ভণ্ডামি।

দেশের গণতান্ত্রিক উত্তরণে খালেদা জিয়ার অনেক অবদান রয়েছে। একজন রাজনীতিবিদকে শুধু তাঁর বর্তমান দিয়ে বিচার করলে হবে না তাঁর অতীত কর্মকাণ্ড, কর্মস্পৃহা ও কর্মপরিকল্পনা দিয়ে তাঁকে বিচার করতে হয়। এক্ষেত্রে খালেদা জিয়ারও সফলতা ব্যর্থতার বিচার বিশ্লেষণ হবে। স্বল্পভাষী খালেদা জিয়ার বড় গুণ তিনি তাঁর সীমাবদ্ধতা জানতেন। দলীয় নেতাদের মতামতকে গুরুত্ব দিতেন। বাস্তবতার নিরিখে সিদ্ধান্ত নিতে গিয়ে ভাবাদর্শ বা অঙ্গিকারের দায়বদ্ধতার কাছে নিজেকে সমর্পণ করতেন না।

সময় ও পারিপার্শ্বিকতা একজন মানুষকে নন্দিত ও নিন্দিত করে খালেদা জিয়াও এক্ষেত্রে ব্যতিক্রম নন। ক্ষমতার রাজনীতির জন্য তিনি যেমন আলোচিত হয়েছেন। তেমনি হয়েছেন বিতর্কিত। একজন রাজনৈতিক নেতা হিসেবে সময় ও সুযোগ তাঁকে গুরুত্বপূর্ন করেছে। অনেক গুরুদায়িত্ব দিয়েছে। সময়কে ধারণ করে তিনি কতটুকু দায়িত্বশীল ভূমিকা পালন করেছেন। সেই বিচার ইতিহাস করবে। তাঁর দায়িত্বপালন কালীন ঘটনা পরম্পরাই নির্ধারন করবে একটি রাষ্ট্রের প্রধান নির্বাহী হিসেবে তিনি কতটা সফল, কতটা ব্যর্থ।

ভবিষ্যত নির্মাণের জন্য বর্তমান যেমন গুরুত্বপূর্ণ তেমনি অতীতও জানা জরুরি। বাংলাদেশের গণতন্ত্র কেন টেকসই হল না। কেন সৌহাদ্যপূর্ণ রাজনৈতিক পরিবেশ থেকে হিংসা আর ধ্বংসাত্বক রাজনীতি বাংলাদেশের নিয়ন্তা হয়ে উঠলো তারও একটা ধারাবাহিকতা আছে। আমাদের রাজনৈতিক নেতৃত্বের ব্যর্থতার কারণেই বার বার অপশক্তি সুযোগ নিয়েছে। অনির্বাচিত সরকার চেপে বসেছে। বর্তমান সংকট থেকে উত্তরণের জন্য দেশের ক্রিয়াশীল বৃহৎ রাজনৈতিক দলের প্রধানের অসুস্থতা অবশ্যই উদ্বেগের বিষয়। তাঁর সুস্থতা ও দীর্ঘায়ু কামনা করছি। বাংলাদেশের রাজনীতি থেকে দুই প্রধান নেত্রী ও তাঁদের পরিবারের সদস্যদের বিতাড়িত করার পুরনো অশুভ শক্তি বর্তমান বাস্তবতায় অধিক শক্তিশালী। দেশের এই সংকটজনক পরিস্থিতিতে বেগম খালেদা জিয়ার সংকটাপন্ন শারীরিক অবস্থা গভীর উৎকন্ঠার বিষয়।

সাম্প্রতিক রাষ্ট্রীয় আয়োজনে তাঁকে কতটুকু রাজনৈতিক কারণে ব্যবহার করা হয়েছে সেই প্রশ্ন সঙ্গত কারণেই তোলা যায়। তিনি সরকার পরিচালনায় ও তাঁর দলে কতটুকু কার্যকর ভূমিকা রাখতে পেরেছিলেন আর কতটুকু তাঁকে রাজনৈতিকভাবে ব্যবহার করে অশুভ উদ্দেশ্য বাস্তবায়নের হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করা হয়েছে বা হচ্ছে। তাও ইতিহাস একদিন মূল্যায়ন করবে। তিনি বাংলাদেশের রাজনীতিতে সংযম, সম্মান ও সম্মোহনীর যে দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন তা অনন্য। গৃহবধূ থেকে প্রধানমন্ত্রী হয়ে তিনি বিরল দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন। প্রায় চার দশক একটি বৃহৎ রাজনৈতিক দলকে নেতৃত্ব দেওয়া খুবই তাৎপর্যপূর্ণ ও মর্যাদাদায়ক।

বাংলাদেশের রাজনীতিতে সৌভাগ্যের প্রতিক বেগম খালেদা জিয়া। মাত্র দশ বছর রাজনীতি করে অনেকটা অপ্রত্যাশিত ভাবেই ১৯৯১ সালে তিনি দেশের প্রথম নারী প্রধানমন্ত্রী নির্বাচিত হয়েছিলেন। একজন নারী হিসেবে ব্যক্তিগত জীবনাচারে অনেকটা আধুনিক ও অগ্রসর হওয়ার পরও তিনি বাংলাদেশের ধর্মাশ্রয়ী রাজনৈতিক দলগুলোর সমর্থন পেয়েছিলেন। এবং তা সম্ভব হয়েছিল রাজনীতিতে ধর্মের ব্যবহার, ভারত বিরোধিতা ও আওয়ামী লীগ বিরোধী ভাবধারা প্রতিষ্ঠিত করার বয়ানকে অগ্রাধিকার দিয়ে। পাশাপাশি সামরিক বেসামরিক আমলা ও ব্যবসায়ীদের মনোনয়ন দিয়ে তিনি দ্রুততম সময়ে দলকে সংগঠিত করতে পেরেছিলেন। এক কথায় সময়ের চাহিদা পূরণে তিনি যোগ্যতার স্বাক্ষর রেখেছেন। অথবা সময়ের প্রয়োজনে অভিজ্ঞ ও ডিগবাজী খাওয়া রাজনীতিবিদরা তাঁকে কাজে লাগিয়েছেন।

স্বামী রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান হত্যাকাণ্ডের পর তিনি যখন রাজনীতিতে যুক্ত হন তখন তাঁর দল বিএনপি ক্ষমতায়। ১৯৮২ সালের ৩ জানুয়ারি তিনি বিএনপির প্রাথমিক সদস্যপদ গ্রহণ করেন। একই বছর ৭ই নভেম্বর জিয়াউর রহমানের সমাধিস্থলে শ্রদ্ধা নিবেদন করতে গিয়ে খালেদা জিয়া প্রথম বক্তব্য রাখেন।

লেখক মহিউদ্দিন আহমদের ‘বিএনপি: সময়-অসময়’ বই থেকে জানা যায়, বিএনপিতে যোগ দেবার পর থেকে খালেদা জিয়া বিভিন্ন রাষ্ট্রীয় অনুষ্ঠানে হাজির হওয়া শুরু করেন। ১৯৮২ সালের ২৮ জানুয়ারি শেরেবাংলা নগরে জাতীয় সংসদের নতুন ভবনের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে রাষ্ট্রপতি বিচারপতি আব্দুস সাত্তার এবং প্রধানমন্ত্রী শাহ আজিজুর রহমানের সাথে খালেদা জিয়াও উপস্থিত ছিলেন।

১৯৮২ সালের ২১ জানুয়ারি বিএনপি’র চেয়ারম্যান নির্বাচনের তারিখ ঘোষণা করা হলে দলের মধ্যে বিভক্তি দেখা দেয় । দলের অপেক্ষাকৃত তরুণ অংশ চেয়েছিল খালেদা জিয়াকে দলীয় প্রধান করতে। অন্যদিকে রাষ্ট্রপতি আব্দুস সাত্তারকে বিএনপি’র প্রধান হিসেবে দেখেতে আগ্রহী ছিল দলের আরেকটি প্রভাবশালী অংশ।

সামরিক শাসক জেনারেল জিয়াউর রহমান প্রতিষ্ঠিত বিএনপির চেয়ারম্যান হবার জন্য একইসাথে প্রার্থী হয়েছিলেন বেগম খালেদা জিয়া এবং রাষ্ট্রপতি আব্দুস সাত্তার। এর ফলে এক বিব্রতকর অবস্থার সৃষ্টি হয়। বিচারপতি সাত্তার দু‘বার বেগম খালেদা জিয়ার বাসায় যান। বেগম খালেদা জিয়া তাঁকে তরুণ নেতৃত্বের মনোভাবে কথা জানান। এসময় বিচারপতি সাত্তার বেগম খালেদা জিয়াকে দলের সহ-সভাপতির পদ এবং দেশের ভাইস-প্রেসিডেন্ট হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণের অনুরোধ জানান। কিন্তু বেগম জিয়া ব্যক্তিগত কারণে তা গ্রহণ করেননি। অবশেষে বিচারপতি সাত্তারের সাথে দীর্ঘ আলোচনার পর বেগম খালেদা জিয়া চেয়ারম্যান পদ থেকে তাঁর প্রার্থীপদ প্রত্যাহার করেন।

বিবিসি বাংলার এক প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, ১৯৮২ সালের ২৪শে মার্চ তৎকালীন সেনাপ্রধান এইচএম এরশাদ এক সামরিক অভ্যুত্থানের মাধ্যমে রাষ্ট্রপতি আব্দুস সাত্তারকে ক্ষমতাচ্যুত করেন। তখন রাজনীতিতে বিচারপতি সাত্তারের আর কোন মূল্য থাকেনি। তাঁর বার্ধক্য, অসুস্থতা এবং নিষ্ক্রিয়তার কারণে দল থেকে তিনি আড়ালে পড়ে যান।

সাত্তার আনুষ্ঠানিকভাবে বিএনপির চেয়ারম্যান থাকলেও দল পরিচালনায় খালেদা জিয়ার প্রভাব বাড়তে থাকে। ১৯৮৩ সালের মার্চ মাসে খালেদা জিয়া দলের সিনিয়র ভাইস-চেয়ারম্যান হন এবং এপ্রিল মাসের প্রথমে বিএনপির এক বর্ধিত সভায় তিনি ভাষণ দেন। কিন্তু তৎকালীন বিএনপির কিছু নেতা সেটি পছন্দ করেননি। সিনিয়র ভাইস-চেয়ারম্যান হিসেবে দায়িত্ব পালনের কয়েকমাস পরেই খালেদা জিয়া দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান হন। এরপর ১৯৮৪ সালের ১০ই মে খালেদা জিয়া বিএনপির চেয়ারম্যান নির্বাচিত হন।

রাজনীতিবিদ ও লেখক ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদ তাঁর এক লেখায় লিখেছেন, ‘খালেদা জিয়া দলের চেয়ারম্যান হোন এটি সামরিক নেতারা, দুই গোয়েন্দা বিভাগ এবং মন্ত্রীসভার দুই গ্রুপ- কেউ চায়নি। প্রভুদের এবং নিজেদের স্বার্থরক্ষার জন্য প্রধানমন্ত্রী শাহ আজিজ অনেকটা জোর করেই বিচারপতি সাত্তারকে দিয়ে মনোনয়নপত্রে সই করান।

উল্লেখ্য স্বাধীনতা বিরোধী এই শাহ আজিজুর রহমানকে তাঁর স্বামী বীর মুক্তিযোদ্ধা জিয়াউর রহমান প্রধানমন্ত্রী করেন।

এরশাদবিরোধী আন্দোলন যখন ধীরে ধীরে জোরালো হচ্ছিল তখন বিএনপির বাইরে অন্য রাজনৈতিক দল থেকে খালেদা জিয়াকে দলের নেতৃত্ব গ্রহণের অনুরোধ জানানো হয়েছিল। এক্ষেত্রে বামপন্থী নেতা হায়দার আকবর খান রনো এবং রাশেদ খান মেনন ছিলেন অন্যতম। খালেদা জিয়ার সাথে আলোচনার জন্য তাঁরা দুইজন তাঁর তৎকালীন ক্যান্টনমেন্টের বাসায় গিয়েছিলেন।

হায়দার আকবর খান রনো তাঁর আত্মজীবনী ‘শতাব্দী পেরিয়ে’ বইতে একথা তুলে ধরেছেন। বেগম খালেদা জিয়ার সাক্ষাতের কথা উল্লেখ করে রনো তাঁর বইয়ে লিখেছেন, “আমরা খালেদা জিয়ার কাছে প্রস্তাব করলাম, আপনি রাজনীতিতে আসুন, বিএনপির হাল ধরুন, একত্রে এরশাদের বিরুদ্ধে লড়ব। এরশাদ সম্পর্কে তার ঘৃণা ও ক্ষোভ প্রকাশ পেয়েছিল। কিন্তু সরাসরি রাজনীতি করবেন কী-না সে সম্পর্কে কিছু বললেন না। দেখলাম, তিনি স্বল্পভাষী, তবে আমাদের কথা খুব মনোযোগ দিয়ে শুনছিলেন। কোন কথা ঠিক মতো বুঝতে না পারলে, প্রশ্ন করে ভালো করে বুঝে নিচ্ছিলেন। সবশেষে তিনি বললেন, ভেবে দেখব।”

সাংবাদিক মাহফুজউল্লাহর তথ্য অনুযায়ী, খালেদা জিয়াকে রাজনীতিতে আসার ব্যাপারে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছিলেন কর্নেল (অবসরপ্রাপ্ত) আকবর হোসেন, সাবেক সামরিক কর্মকর্তা নুরুল ইসলাম শিশু এবং একিউএম বদরুদ্দোজা চৌধুরী। এছাড়া নজরুল ইসলাম খান এবং ব্যারিস্টার জমির উদ্দিন সরকারের ভূমিকাও গুরুত্বপূর্ণ ছিল। খালেদা জিয়া যদি তখন বিএনপির হাল না ধরতেন তাহলে বিএনপি নিঃসন্দেহে গভীর সংকটে পতিত হতো বলে সাংবাদিক মাহফুজউল্লাহ তাঁর বইয়ে উল্লেখ করেন।

দীর্ঘ সামরিক শাসন শেষে দেশের গণতান্ত্রিক উত্তরণে বেগম খালেদা জিয়ার গুরুত্বপূর্ণ অবদান রয়েছে। ১৯৯০ সালের গণ অভ্যুত্থানের পর পূর্ব প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী কথা ছিল তিন জোটের রূপরেখা বাস্তবায়ন হবে। কিন্তু খালেদা জিয়ার নেতৃত্বে বিএনপি সরকার গঠনের পর তিন জোটের রূপরেখা বাস্তবায়ন হয়নি। এতে করে বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক অভিযাত্রার যে নতুন যাত্রা শুরু হয়েছিল তা শুরুতেই হোঁচট খায়। কার্যকর হয়নি সংসদীয় গণতন্ত্র। তবুও দীর্ঘ স্বৈরশাসনের আবহ থেকে দেশে গণতান্ত্রিক পরিবেশ ফিরে আসায় মানুষ স্বস্তি খোঁজে। কিন্তু শিক্ষাঙ্গন গুলোতে শুরু হয় হল দখল ও সন্ত্রাসের দৌরাত্ম্য। দেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে ছাত্র সংসদ নির্বাচন বন্ধ হয়ে যায়। প্রতিটি কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়ে সন্ত্রাস নৈরাজ্য দেখা দেয়। ১৯৯১ সালের নির্বাচনে অবসরপ্রাপ্ত সরকারি কর্মকর্তা ও ব্যবসায়ীদের মনোনয়ন দেওয়ার যে ধারা বিএনপি সূচনা করে তা পরবর্তীতে বাংলাদেশের রাজনীতির জন্য গভীর ক্ষত সৃস্টি করে। কালো টাকার মালিকদের রাজনীতিতে আসার পথ সুগম হয়।

সরকার গঠন করে স্বাধীনতা বিরোধী আব্দুর রহমান বিশ্বাসকে রাষ্ট্রপতি নির্বাচিত করে বিএনপি। মুক্তিযুদ্ধ বিরোধী গোলাম আযমকে নাগরিকত্ব প্রদান করা হয়। পতিত স্বৈরাচারের অনেকেই আশ্রয় গ্রহণ করেন বিএনপিতে। এতে করে নব্বইয়ের আকাঙ্ক্ষা নস্যাত হয়।

নব্বইয়ের অভ্যুত্থানের পর মানুষ আশায় বুক বেঁধেছিল দেশে নিয়মতান্ত্রিক রাজনীতি প্রতিষ্ঠিত হবে। সকল নির্বাচন সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ হবে। স্থানীয় সরকার শক্তিশালী হবে। স্বাধীন বিচার বিভাগ প্রতিষ্ঠিত হবে। সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানগুলো শক্তিশালী হবে। কিন্তু বাস্তবে উপজেলা পদ্ধতি বিলুপ্তসহ সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানগুলোকে দুর্বল ও প্রশাসনে দলীয়করণ শুরু হয়। এক পর্যায়ে বিএনপি ক্ষমতায় থাকা অবস্থায় ১৯৯৪ সালে মাগুরা-২ আসনে উপনির্বাচনে ব্যাপক কারচুপির অভিযোগ ওঠে। এরপর আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে সকল বিরোধী দল তত্ত্বাবধায়ক সরকার সংবিধানে অর্ন্তভুক্তির দাবিতে আন্দোলন শুরু করে। আন্দোলনের মধ্যেই খালেদা জিয়ার নেতৃত্বে বিএনপি সরকার ১৯৯৬ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি এক তরফা জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আয়োজন করে। সকল বিরোধীদলের বর্জনের মুখে ৪৬টি আসনে বিএনপির একক প্রার্থী বিনা ভোটে বিজয়ী হন।বিতর্কিত সেই নির্বাচনে ৩০০টি আসনের মধ্যে বিএনপি পেয়েছিল ২৮৯টি আসন। ওই সংসদে আনুষ্ঠানিক কোন বিরোধীদল ছিল না, কিন্ত একটি আসন পেয়ে বিরোধী নেতার চেয়ারে বসানো হয় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের স্বঘোষিত হত্যাকারীদের অন্যতম ফ্রিডম পার্টির সৈয়দ ফারুক রহমানকে। এভাবেই গঠিত জাতীয় সংসদের মাধ্যমে খালেদা জিয়া আবার প্রধানমন্ত্রী নির্বাচিত হন। পরবর্তীতে তীব্র গণ আন্দোলনের মুখে ১২ দিনের মাথায় সংসদ বিলুপ্ত করেন রাষ্ট্রপতি।

তারপর প্রথমবারের মতো ১৯৯৬ সালের ১২ জুন সাংবিধানিক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। এই নির্বাচনে জয়ী হয়ে আওয়ামী লীগ সরকার গঠন করলে বিএনপি বিরোধীদলে স্থান পায়। বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়া জাতীয় সংসদে বিরোধী দলের নেতার দায়িত্ব গ্রহণ করেন। এই সংসদে সংসদীয় গণতন্ত্র কার্যকর করতে অনেক যুগান্তকারী সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয়। চালু করা হয় প্রধানমন্ত্রীর প্রশ্নোত্তর পর্ব। সংসদীয় কমিটিগুলো গতিশীল করা হয়। দেশের সংসদীয় ইতিহাসে ৭ম সংসদই মেয়াদশেষে শান্তিপূর্ণভাবে ক্ষমতা হস্তান্তর করে।

২০০১ সালের ১ অক্টোবর দেশে ৮ম জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। বেগম খালেদা জিয়ার নেতৃত্বে বিএনপি – জামাত জোট সরকার গঠন করে। তিনি তৃতীয় বারের মতো প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব গ্রহণ করেন। আওয়ামী লীগ বিরোধীদলে স্থান পায়। যুদ্ধাপরাধী মতিউর রহমান নিজামী ও আলী আহসান মুজাহিদ স্থান পান খালেদা জিয়ার মন্ত্রিসভায়। দেশে ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের ওপর নেমে আসে ভয়াবহ নির্যাতন। সারের জন্য আন্দোলন করতে গিয়ে কৃষকরা আত্মাহুতি দেন। বিদ্যুতের দাবিতে আন্দোলন করতে গিয়ে নির্যাতনের শিকার হন আন্দোলনকারীরা। লোমমর্ষক নারী নির্যাতনের ঘটনায় তীব্র আন্দোলন দানা বাঁধে। দেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতি ক্রমশ উত্তপ্ত হয়। নিজেদের দল থেকে নির্বাচিত রাষ্ট্রপতি বদরুদ্দোজা চৌধুরীকে পদত্যাগে বাধ্য করা হয়। দেশে বোমা হামলা, সন্ত্রাস ও জঙ্গি তৎপরতা বৃদ্ধি পায়। বাংলা ভাইর মতো জঙ্গি, সন্ত্রাসীরা ধরা পড়ে। একযোগে দেশের ৬৪ টি আদালতে জঙ্গি হামলার ঘটনা ঘটে। সাবেক অর্থমন্ত্রী শাহ এ এম এস কিবরিয়াসহ বিরোধীদলের অনেক গুরুত্বপূর্ণ নেতা নিষ্ঠুর হত্যাকাণ্ডের শিকার হন। বিভিন্ন পেশাজীবীরাও হত্যাকাণ্ডের শিকার হন। ২০০৪ সালের ২১ আগস্ট আওয়ামী লীগের জনসভায় বর্বরোচিত গ্রেনেড হামলা চালানো হয়। আওয়ামী লীগ নেত্রী আইভি রহমানসহ মারা যান ২৪ জন। অল্পের জন্য বেঁচে যান আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনা। দেশে বিদেশে তীব্র প্রতিক্রিয়া দেখা দেয়। এই ঘটনার তদন্ত নিয়ে শুরু হয় নানা টালবাহানা। মঞ্চস্থ হয় জজ মিয়া নাটক। উত্তপ্ত রাজনৈতিক অস্থিরতার মধ্যে বিচারপতিতের বয়স বাড়ানোর আইন করে কে এম হাসান কে পরবর্তী তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান করার উদ্যোগ নেওয়া হয়। শুরু হয় তীব্র আন্দোলন। বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলোর আপত্তির মুখে কে এম হাসান তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান হতে অস্বীকৃতি জানান। এক পর্যায়ে অন্যান্য সাংবিধানিক বিকল্প ব্যাতিরেকে রাষ্ট্রপতি ইয়াজ উদ্দিন আহমেদ নিজেই তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান হন। পরে তত্ত্বাবধায়ক সরকার থেকে চার উপদেষ্টা পদত্যাগ করেন। দেশে তৈরি হয় গভীর অনিশ্চয়তা। এক পর্যায়ে দেশে জরুরি অবস্থা জারি করা হয়। দেশের রাজনৈতিক ইতিহাসে ভয়াবহ সংকট দেখা দেয়।

দেশে প্রতিষ্ঠিত হয় ‘ওয়ান ইলেভেন’ সরকার। রাজনৈতিক দলগুলোর উপর নেমে আসে নিপীড়ন নির্যাতন। দুই নেত্রীকে গ্রেপ্তার করা হয়। আলোচনায় আসে মাইনাস টু ফর্মুলা। এক পর্যায়ে ২০০৮ সালের ২৯ ডিসেম্বর দেশে নবম ৮ম জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। আওয়ামী লীগ নিরঙ্কুশ সংখ্যা ঘরিষ্ঠতা নিয়ে সরকার গঠন করে। বিরোধী দলের দায়িত্ব গ্রহণ করে বিএনপি। বিরোধী দলের নেতা হন বেগম খালেদা জিয়া। তিনি সংসদের চেয়ে রাজপথের আন্দোলনে বেশি সক্রিয় হন। বিভিন্ন ইস্যুতে সরকার ও বিরোধী দলের দ্বন্দ্ব বাড়তে থাকে। দেশে নিয়মতান্ত্রিক সংসদীয় গণতন্ত্র চর্চা ব্যাহত হয়। জাতীয় সংসদে বিরোধী দল সংবিধান সংশোধন বিষয়ক আলোচনায় অংশ না নিয়ে আওয়ামী লীগ কে একতরফা সংবিধান সংশোধনের সুযোগ করে দেয়। আওয়ামী লীগ আদালতের পরামর্শে তত্ত্বাবধায়ক সরকার পদ্ধতি সংবিধান থেকে বিলুপ্ত ঘোষণা করে। বিএনপির নেতৃত্বে শুরু হয় জ্বালাও পোড়াও আন্দোলন। সাংবিধানিক বাধ্য বাধকতা অনুযায়ী পরবর্তী জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। বিএনপি জাতীয় সংসদ নির্বাচন বর্জন করে। এই সুযোগে আওয়ামী লীগ হয়ে ওঠে একক শক্তিশালী রাজনৈতিক দল। সুযোগসন্ধানীরা আওয়ামী লীগ প্রধান শেখ হাসিনার উপর নানাভাবে প্রভাব বিস্তার করতে থাকেন। বিরোধী দলের সঠিক ও কার্যকর রাজনীতি চর্চার শূন্যতায় সরকারি দল বেপরোয়া হয়ে উঠে। আওয়ামী লীগে শেখ হাসিনার একক কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠিত হতে থাকে। সরকারে আমলাতান্ত্রিক প্রভাব বৃদ্ধি পায়।

বিরোধী দলের নেতা হিসেবে বেগম খালেদা জিয়া যথাযথ কার্যকর ভূমিকা রাখতে ব্যর্থ হওয়ায় দেশের সংসদীয় রাজনীতির বিকাশ বাধাগ্রস্থ হয়। যা দেশের গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া ও নির্বাচন ব্যবস্থার জন্য সংকট তৈরি করে। এই সুযোগে অশুভ আমলাতন্ত্র ও লুটেরা ব্যবসায়ীরা রাষ্ট্রশক্তির ওপর প্রভাব বিস্তার করায় দুর্বল হয় রাজনৈতিক নেতৃত্ব। বিতর্কিত হয় রাজনৈতিক প্রক্রিয়া। রাজনৈতিক সংকট ধীরে ধীরে দুর্যোগে পরিণত হয়। যার ফলশ্রুতিতে দেশ আজ ভয়াবহ সাংবিধানিক সংকটের মুখে পড়েছে। বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক আন্দোলন সংগ্রাম থেকে ওঠে আসা দুই নেত্রী গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া ধ্বংসের জন্য কে কতটুকু দায়ী। ইতিহাসই তা একদিন নির্ধারণ করবে।

বাংলাদেশের কোটি কোটি মানুষের রাজনৈতিক আস্থা ও নির্ভরতার প্রতীক দুই নেত্রী বা তাদের উত্তরাধিকার রাজনীতি থেকে হারিয়ে গেলে কেমন হবে দেশের ভবিষ্যত রাজনীতি। একজন খালেদা জিয়ার অসুস্থতা কেবল ব্যক্তির অসুস্থতা নয়। এর সঙ্গে দেশের মানুষের আবেগ অনুভূতির সম্পর্ক। দেশের প্রতিক্রিয়াশীল গোষ্ঠীর আস্ফালনের মধ্যে তাঁর মতো একজন ধৈর্য্যশীল ও সহনশীল রাজনীতিবিদের এই মুহূর্তে বড় বেশি প্রয়োজন। যতই দূরত্ব আর ভুল ত্রুটি থাকুক দুই প্রধান রাজনৈতিক দল আওয়ামী লীগ ও বিএনপি একে অপরের পরিপূরক। বর্তমান বাস্তবতায় দল দুটির নেতৃত্ব সঠিক ও কার্যকর কর্মকৌশল নির্ধারণ করতে না পারলে দেশের গণতান্ত্রিক উত্তরণে ভয়াবহ সংকট দেখা দিতে পারে।

লেখক : সাংবাদিক ও সমাজকর্মী

মুক্তাদীর আহমদের আগের লেখা:

আরও পড়ুন

সর্বশেষ

ads