সেনাপ্রধানের কড়া বার্তার পর খলিল বললেন, করিডোর হচ্ছে না

সেনাপ্রধান ওয়াকার উজ জামান ও খলিলুর রহমান।
সেনাপ্রধান ওয়াকার উজ জামান ও খলিলুর রহমান।

বাংলাদেশে ক্ষমতার পেণ্ডুলাপ কেবল দুলছে; কয়েকদিন আগেও মনে হচ্ছিল, সেনাপ্রধান জেনারেল ওয়াকার-উজ-জামানের হাত থেকে নাটাই ছুটে গেছে। কিন্তু সর্বশেষ পরিস্থিতি তার কর্তৃত্ব ফিরে পাওয়ার ইঙ্গিত দিচ্ছে।

বুধবার ঢাকা সেনানিবাসে অফিসার্স অ্যাড্রেসে জেনারেল ওয়াকার ভাষণ দেন। সেখানে তিনি সাফ জানিয়ে দেন, নির্বাচিত সরকার আসার আগে মিয়ানমারের রাখাইনে মানবিক সহায়তা পৌঁছতে কোনো করিডোর প্রতিষ্ঠা করা যাবে না।

এদিন এই সভার পর ফরেন সার্ভিস একাডেমিতে সংবাদ সম্মেলন করে জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা খলিলুর রহমান বলেন, রাখাইনে ত্রাণ পাঠাতে কক্সবাজার থেকে করিডোর প্রতিষ্ঠার কোনো আলোচনা কারো সঙ্গেই সরকার করছে না। কেবল ত্রাণ পাঠানোর একটি চ্যানেল নিয়ে কথা হচ্ছে, তাও চূড়ান্ত হয়নি।

এর একদিন আগেই প্রধান উপদেষ্টা মুহাম্মদ দেশের আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ে একটি উচ্চ পর্যায়ের বৈঠক করেন। সেখানে জেনারেল ওয়াকারসহ তিন বাহিনী প্রধান ছিলেন। তাদের আপত্তির মুখে খলিলকে বৈঠক থেকে উঠে যেতে হয় বলে বিভিন্ন সাংবাদিক জানিয়েছেন।

গত বছর ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর গঠিত অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান উপদেষ্টার দায়িত্ব নিয়ে

মুহাম্মদ ইউনূস গত নভেম্বরে খলিলকে তার রোহিঙ্গা সমস্যা ও অগ্রাধিকারপ্রাপ্ত বিষয়াবলি সংক্রান্ত হাইরিপ্রেজেনটেটিভ পদে নিয়োগ দেন।

যুক্তরাষ্ট্রে বসবাসরত খলিলের নেতিবাচক নানা কাণ্ড-কীর্তির পরও গত মাসে তাকে জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টার পদে বসান ইউনূস। সেনাপ্রধান ওয়াকার দেশের বাইরে সফরে থাকার সময় তার এই নিয়োগ হয়।

এরপর পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়সহ নিরাপত্তার বিভিন্ন বিষয়ে খলিল একাই সিদ্ধান্ত নিতে থাকেন, যা সেনাপ্রধানের মনঃপুত হচ্ছিল না বরে খবর আসে।

এরমধ্যে সশস্ত্র বাহিনী বিভাগের পিএসও লেফটেন্যান্ট জেনারেল কামরুল হাসানকে সেনাপ্রধান সরাতে চাইলে খলিল তা আটকে দেন। পাশাপাশি সেনাপ্রধানের যুক্তরাষ্ট্র সফরও আটকে যায় খলিলের তৎপরতায়।

ভারতীয় সংবাদমাধ্যমসহ নানা সূত্রে খবর আসে, যুক্তরাষ্ট্রের চাওয়া অনুযায়ী খলিল রাখাইনে করিডোর প্রতিষ্ঠার দিকে এগিয়ে গেলে সেনাপ্রধান তাতে কড়া আপত্তি জানান। মিয়ানমারের গৃহযুদ্ধে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর জড়িয়ে পড়া ঠিক হবে না বলে অবস্থান জানান তিনি।

এনিয়ে গত কয়েকদিন ধরে বাংলাদেশে ক্যু এর গুঞ্জন চলার মধ্যে মঙ্গলবার রাষ্ট্রীয় অতিথি ভবন যমুনায় আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ে উচ্চ পর্যায়ের বৈঠক ডাকেন প্রধান উপদেষ্টা ইউনূস।

সরকারি সংবাদ সংস্থা বাসসের প্রতিবেদন অনুযায়ী, বৈঠকে সেনাবাহিনী প্রধান জেনারেল ওয়াকার-উজ-জামান, নৌবাহিনী প্রধান অ্যাডমিরাল মোহাম্মদ নাজমুল হাসান এবং বিমানবাহিনী প্রধান এয়ার মার্শাল হাসান মাহমুদ খান অংশ নেন।

এছাড়াও ছিলেন স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরী, পররাষ্ট্র উপদেষ্টা মো. তৌহিদ হোসেন, জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা খলিলুর রহমানসহ ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা।

তবে খলিল শেষ অবধি বৈঠকে ছিলেন না বলে একাধিক সূত্র দ্য সান ২৪কে নিশ্চিত করেছে।

মিরর এশিয়ার সম্পাদক, প্রবাসী সাংবাদিক মারুফ মল্লিকও এক ফেইসবুক পোস্টে লিখেছেন, “প্রধান উপদেষ্টা ড. ইউনূসের সঙ্গে তিন বাহিনীর প্রধানের বৈঠকে এক আলোচিত গুরুত্বপূর্ণ কর্মকর্তাকে বের করে দেয়া হয়। তার বিষয়ে আপত্তি জানিয়ে তিন বাহিনীর প্রধান বলেন, ওই কর্মকর্তার উপস্থিতিতে তারা কথা বলতে আগ্রহী না।

“বৈঠকে তিন বাহিনীর প্রধানের পক্ষ থেকে দ্রুত নির্বাচন দিয়ে ক্ষমতা হস্তান্তরের পরামর্শ দেয়া হয়। পাশাপাশি নিরাপত্তা উপদেষ্টা নিয়েও প্রশ্ন করা হয়। করিডর নিয়ে বলা হয়, এ ধরনের কৌশলগত বিষয়ে নির্বাচিত সরকার ও সামরিক বাহিনী বিচার বিশ্লেষণ করে সিদ্ধান্ত নেবে।”

এরপর বুধবার ঢাকায় অবস্থানরত সেনাবাহিনীর বিভিন্ন পর্যায়ের কর্মকর্তাদের অংশগ্রহণে অফিসার্স অ্যাড্রেসে সেনাপ্রধান ওয়াকার একই বক্তব্য দেন বলে প্রথম আলোর এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে।

প্রতিবেদন অনুযায়ী করিডোর নিয়ে সেনাপ্রধান বলেছেন, রাখাইন রাজ্যে মানবিক করিডোর বিষয়ে সিদ্ধান্ত একটি নির্বাচিত সরকার থেকেই আসতে হবে এবং তা বৈধ প্রক্রিয়া অনুসরণ করেই হতে হবে। এখানে জাতীয় স্বার্থ দেখতে হবে। যা করার জাতীয় স্বার্থ রক্ষা করেই করতে হবে। যা-ই করা হোক না কেন, পলিটিক্যাল কনসেনসাসের মাধ্যমে সেটা হতে হবে।

চট্টগ্রাম বন্দরের নিউমুরিং কনটেইনার টার্মিনাল (এনসিটি) পরিচালনার দায়িত্ব বিদেশি কোম্পানির হাতে দিতে হলেও রাজনৈতিক সরকারের মাধ্যমে তা করতে হবে বলে জানিয়ে দেন তিনি।

আগামী ডিসেম্বরের মধ্যে নির্বাচন শেষে ১ জানুয়ারি নির্বাচিত সরকার আসবে বলেও আশাবাদ প্রকাশ করেন সেনাপ্রধান, যেখানে প্রধান উপদেষ্টা ইউনূস বারবার ডিসেম্বর থেকে জুনের মধ্যে ভোট আয়োজনের কথা বলছেন।

আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ে সেনাবাহিনী এখন আরো কঠোর অবস্থানে যাচ্ছে জানিয়ে জেনারেল ওয়াকার বলেন, সংঘবদ্ধ জনতার নামে বিশৃঙ্খলা বা সহিংসতা আর সহ্য করা হবে না।

এরপর বিকালে প্রেস সচিব ও উপ প্রেস সচিবকে সঙ্গে নিয়ে সংবাদ সম্মেলনে আসেন জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা খলিল।

করিডোর নিয়ে আলোচনার খবরটি গুজব আখ্যায়িত করে তিনি বলেন, “জাতিসংঘের সাহায্য নিয়ে বাংলাদেশে একটি করিডোর দেওয়ার যে গুজব তৈরি হয়েছে, আমি দ্ব্যর্থহীনভাবে বলে দিচ্ছি, করিডোর নিয়ে আমাদের সাথে কারও কোনও কথা হয়নি এবং কারও সাথে কোনও কথা হবে না। আমরা কাউকে করিডোর দিচ্ছি না।”

সেখানে করিডোর প্রতিষ্ঠার আদৌ কোনও প্রয়োজন নেই বলেও মত জানিয়ে খলিল বলেন, “রাখাইনের যে অবস্থা, তাতে করিডোরের কোনও প্রয়োজন নেই। করিডোর সৃষ্টি করে লোকজনের যাতায়াতের ব্যবস্থা করার কোনও প্রয়োজনীয়তা এখন নেই। যেটা প্রয়োজন আছে, সেটা হলো সেখান ত্রাণ সরবরাহ করা।”

সেই ত্রাণ পৌঁছনোর জন্যই একটি চ্যানেলের আলোচনা চলছে বলে জানান খলিলুর। তবে তাও চূড়ান্ত হয়নি বলে জানান তিনি।

একই সময়ে প্রধান উপদেষ্টার ফেইসবুক পেইজে এক পোস্টেও বলা হয়, “রাখাইনে সাহায্য প্রদানের ব্যাপারে এখনো কোনো চুক্তি হয়নি, কারণ এর জন্য সংশ্লিষ্ট সকল পক্ষের সম্মতি এবং সহায়তা প্রদানের জন্য বেশকিছু পূর্বশর্ত পূরণের প্রয়োজন, যা বিশ্বের সবখানেই মানবিক সহায়তা প্রদানের ক্ষেত্রে একইভাবে পূরণযোগ্য।”

এই বিষয়টি নিয়ে সরকারের সঙ্গে সেনাবাহিনীর কোনও মতপার্থক্য তৈরি হয়নি দাবি করে খলিল সংবাদ সম্মেলনে বলেন, “সেনাপ্রধানের সাথে বিস্তারিত আলোচনা হয়েছে। এনিয়ে আমরা এক সমতলে অবস্থান করছি, কোনও ফাঁক-ফোকর নেই। সেনাবাহিনীর সাথে আমি খুব ক্লোজলি (ঘনিষ্ঠভাবে) কাজ করছি।”

করিডোর প্রতিষ্ঠায় ওয়াশিংটনের চাপ রয়েছে কি না- সেই প্রশ্নে তিনি বলেন, “আমেরিকা কেন, আমরা কারও চাপের মুখে নেই। কেউ চাপ দিচ্ছে না।”

মিয়ানমারে সরকারি বাহিনীর বিরুদ্ধে বিদ্রোহীদের সংঘাতের মধ্যে যুক্তরাষ্ট্রের হয়ে প্রক্সি ওয়ার বা ছায়া যুদ্ধে বাংলাদেশকে জড়ানোর অপপ্রচার চলছে বলে দাবি করেন খলিলুর। এই প্রসঙ্গে নিজের আমেরিকান পাসপোর্ট থাকার খবরটিও ভিত্তিহীন বলে উড়িয়ে দেন তিনি।

বুধবারে ঘটনাবলি দেখে মারুফ মল্লিক লিখেছেন, “শেষ পর্যন্ত ডিসেম্বর-জানুয়ারিতে নির্বাচন হয়ে গেলে সেনাপ্রধান জেনারেল ওয়াকারের নাম ইতিহাসে ভিন্নভাবে লেখা থাকবে। তার উপর নানাদিক থেকে চাপ ও প্রলোভন ছিল। কিন্তু এখন পর্যন্ত তাকে টলানো যায়নি। দ্রুত নির্বাচিত সরকারের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তরের বিষয়ে তিনি অনড়।”

এ সম্পর্কিত আরও খবর:

কোন পথে এগোচ্ছে ‘করিডোর আলোচনা’, সেনাবাহিনী যে ভূমিকায়

আরও পড়ুন

সর্বশেষ

ads