আওয়ামী লীগের দেড় দশকের শাসনকালের বড় অভিযোগ ছিল গুম নিয়ে। ধরে নিয়ে গোয়েন্দা কার্যালয়ে আটকে রাখার ঘটনা এতটাই আলোচিত ছিল যে তা ডিবি কর্মকর্তা হারুন অর রশীদের ‘ভাতের হোটেল’ নামেও পরিচিতি কুড়িয়েছিল।
গত বছরের জুলাই মাসে আন্দোলনে নেতৃত্ব দেওয়া বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের ছয়জন সমন্বয়ককে ধরে নিয়ে ঢাকার মিন্টো রোডের ডিবি অফিসে আটকে রেখে খাইয়ে-দাইয়ে তার ভিডিও ছাড়ার ঘটনাকে ‘মশকরা’ তখনই বলেছিল উচ্চ আদালত।
পরে জুলাই আন্দোলনের গ্রাফিতিতে আসে ‘হাউন আংকেলের ভাতের হোটেল’ এর নাম। সেই আন্দোলন থেকে অভ্যুত্থানে আগস্টের ৫ তারিখে আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর থেকে ডিবির কর্মকর্তা হারুনের কোনো খোঁজ নেই।
এরপর অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গঠিত হয়েছে মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে; গুম-খুন দেশে আর থাকবে না বলেই ঘোষণা দেওয়া হয়েছে। আওয়ামী লীগ আমলের গুম-খুনের বিচারের উদ্যোগও নেওয়া হয়েছে।
কিন্তু সম্প্রতি অন্তর্বর্তী সরকারের তথ্য উপদেষ্টা মাহফুজ আলমের ওপর বোতল নিক্ষেপকারী জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী মোহাম্মদ হোসেনকে ধরে ডিবি কার্যালয়ে আটকে রাখার ঘটনা ফিরিয়ে আনছে হারুনের স্মৃতি।
গত বছর বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের ছয়জন সমন্বয়ককে ধরে নিয়ে আটকে রেখে হারুন বলেছিলেন, ‘নিরাপত্তার স্বার্থে’ তাদের ডিবি কার্যালয়ে এনে রাখা হয়েছে। একে তখন আদালত বলেছিল ‘মশকরা’।
এখন জগন্নাথ শিক্ষার্থী হোসেনকে ধরে নেওয়ার পর মাহফুজের ডিবি অফিসে গিয়ে তাকে ছাড়িয়ে আনা এবং তাকে নিজের বাসায় আমন্ত্রণ জানানোকে ‘নাটক’ বলছেন অনেকেই।
আবাসন সঙ্কটের অবসানসহ তিন দফা্ দাবিতে গত বুধবার প্রধান উপদেষ্টা ইউনূসের বাসভবন ঘেরাও করতে গিয়েছিল জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা। পুলিশ তাদের কাকরাইলে আটকে দিলে সেখানেই বসে পড়ে তারা।
রাতে তাদের সঙ্গে আলোচনা করতে গিয়েছিলেন তথ্য উপদেষ্টা মাহফুজ। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক এই শিক্ষার্থীকে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সমন্বয়কদের অনেকেই ‘গুরু’ মানেন।

মাহফুজ কথা বলার এক পর্যায়ে ক্ষিপ্ত জগন্নাথ শিক্ষার্থীদের মধ্যে থেকে একটি পানির বোতল ছুড়ে মারা হয়। তা গিয়ে আঘাত হানে মাহফুজের মাথায়। এতে ক্ষুব্ধ হয়ে মাহফুজ সেখান থেকে চলে যান। যাওয়ার আগে জগন্নাথের শিক্ষকদের বলে যান, বোতল নিক্ষেপকারীকে চিহ্নিত করে তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে হবে।
হাসনাত আব্দুল্লাহ, সারজিস আলমসহ বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সমন্বয়কদের অনেকেই মাহফুজের ওপর হামলাকারীকে গ্রেপ্তারের দাবি তোলেন।
গোয়েন্দা পুলিশও তৎপর হয়ে ওঠে। প্রথমে চিহ্নিত করা হয় বোতল নিক্ষেপকারীকে। জানা যায়, তার নাম হোসেন, তিনি জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের তিনি অর্থনীতি বিভাগের প্রথম বর্ষের শিক্ষার্থী।
পরদিন তাকে ধরে নিলেও ডিবি আনুষ্ঠানিকভাবে কিছু জানায়নি। তার একদিন বাদে শুক্রবার হোসেনকে ছেড়ে দেওয়া হয় পরিবারের জিম্মায়।
তখন সরকারি সংবাদ সংস্থা বাসস জানিয়েছিল, উপদেষ্টা মাহফুজ পুলিশকে অনুরোধ করে আটক হোসেনকে তার অভিভাবকদের কাছে হস্তান্তরের ব্যবস্থা করেন। তিনি ডিবি কার্যালয়ে ওই যুবক ও তার পরিবারের সঙ্গে দেখা করেন। নিজের বাসভবনে দেখা করার জন্য হোসেনকে ব্যক্তিগত আমন্ত্রণও জানান।
ডিবি অফিস থেকে ছাড়া পাওয়ার পর হোসেন সাংবািদকদের বলেন, “আমি প্রায় ২৬ ঘণ্টা ডিবি অফিসে ছিলাম। গতকাল (বৃহস্পতিবার) বিকাল সাড়ে ৪টা থেকে আজকে ৬টা পর্যন্ত।”
বাসা থেকে ধরে কোথায় নেওয়া হল, সে বিষয়ে পরিবারকে পুরোপুরি অন্ধকারে রাখা হয়েছিল বলে দাবি করেন হোসেন।
তিনি বলেন, “আমার বাসায় জানানো হয়েছে আজ (শুক্রবার) বিকালে। এই পুরো সময়টা আমি অজ্ঞাত ছিলাম।”
শারীরিক কোনো নির্যাতন চালানো না হলেও মানসিক চাপে রাখা হয়েছিল বলে অভিযোগ করেন হোসেন।
“অনেক প্রশ্ন করা হয়েছে। অনেক রাত পর্যন্ত সজাগ রাখা হয়। আসামিদের সঙ্গে হাজতে রাখার চেষ্টা হয়েছে।”
তার এই বক্তব্যের ভিডিও ফেইসবুকে শেয়ার করে একজন লিখেছেন, “দীর্ঘ ২৬ ঘণ্টা মানসিক নির্যাতন করে অজ্ঞাত স্থানে রেখে শেষে হিরো সাজতে চেয়েছিলো Mahfuj Alam … এই যেন আমাদের আওয়ামী আমলের ডিবি হারুনের কাহিনী … এটাই নতুন বন্দোবস্ত।”
আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর গঠিত অন্তর্বর্তী সরকারে যোগ দেওয়ার পর থেকে মাহফুজ রাষ্ট্র কাঠামোর আমূল বদলে দিতে নতুন বন্দোবস্তের কথা বলে আসছেন। শেখ হাসিনাকে ক্ষমতা থেকে হটানোর অভ্যুত্থানের ‘মাস্টারমাইন্ড’ও বলা হচ্ছে তাকে।
গত বছরের জুলাই মাসে সরকারি চাকরিতে কোটা সংস্কারের দাবিতে মাহফুজের শিষ্য নাহিদ ইসলামসহ অন্যরা যখন আন্দোলনে নামেন, তখন ১৯ জুলাই নাহিদকে তুলে নেওয়া হয়েছিল। মারধর করে পরদিন ছেড়ে দেওয়া হলেও তাকে আটকের খবর আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কেউ স্বীকার করেনি।
তার কয়েকদিন বাদে নাহিদসহ ছয়জন সমন্বয়ককে তুলে ডিবি অফিসে নিয়ে যান হারুন। তা নিয়ে সমালোচনা উঠলে তিনি বলেন, তাদের আটক করা হয়নি, তাদের পরিবার নিরাপত্তা নিয়ে শঙ্কা প্রকাশ করায় এখানে এনে রাখা হয়েছে।

তবে হারুনের এই কথা কেউ বিশ্বাস করেনি। তাদের সঙ্গে বসে হারুনের ভাত খাওয়া এবং তার ছবি ও ভিডিও প্রকাশ করা নিয়েও ওঠে সমালোচনা। ডিবি অফিস থেকে নাহিদের আন্দোলনের স্থগিতের ঘোষণা পাঠের একটি ভিডিও-ও ছড়ানো হয়েছিল, তাও কেউ বিশ্বাস করেনি, বরং আন্দোলন আরও জোরদার হয়।
তখন ছয় সমন্বয়ককে ছাড়ার আদেশ চেয়ে হাই কোর্টে একটি রিট আবেদন হয়েছিল। তার শুনানিতে রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবী বলেছিলেন, “কোটাবিরোধী আন্দোলনের ছয়জন সমন্বয়ককে ডিবি হেফাজতে তাদের নিরাপত্তার জন্য রাখা হয়েছে। মিডিয়ায় দেখা গেছে, তারা কাঁটা চামচ দিয়ে খাবার খাচ্ছেন।”
এটা শুনে তখন বিচারক উষ্মা প্রকাশ করে বলেছিলেন, “ডিবি অফিসে যাকে তাকে ধরে নিয়ে যাবেন, তারপর খাবার টেবিলে বসাবেন। এভাবে জাতির সঙ্গে মশকরা করবেন না।”
তারপর ১ আগস্ট ছয় সমন্বয়ককে ছেড়ে দেওয়া হয় ডিবি অফিস থেকে। তখন তারাও মানসিক চাপে থাকার কথা বলেছিলেন। তার চার দিন পর অভ্যুত্থানে পতন ঘটে আওয়ামী লীগ সরকারের।
তখন আটক থাকা সমন্বয়কদের মধ্যে নাহিদ ইসলাম ও আসিফ মাহমুদ সজীব ভূইয়া পরে অন্তর্বর্তী সরকারের উপদেষ্টার দায়িত্ব নিয়ে ডিবি অফিসে গিয়েছিলেন। সেখানে গোপন বন্দিশালা থাকার দাবিও তারা করেন।
ডিবি অফিসের পাশাপাশি প্রতিরক্ষা গোয়েন্দা পরিদপ্তর-ডিজিএফআই, র্যাব সদর দপ্তরসহ বিভিন্ন স্থানে গোপন বন্দিশালা পাওয়ার খবরও তখন প্রকাশ পায়, যেগুলো আয়না ঘর নামে পরিচিতি পেয়েছিল।
অন্তর্বর্তী সরকারের এক মাস পূর্তিতে জাতির উদ্দেশে দেওয়া ভাষণে ইউনূস বলেছিলেন, সব আয়না ঘর বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে।
তবে আওয়ামী লীগের ‘ফ্যাসিস্ট’ শাসন থেকে মুক্তির কথা অন্তর্বর্তী সরকারের কর্ণধাররা বলে এলেও ১০ মাস পর এখন নানা ঘটনার পুনরাবৃত্তিই দেখা যাচ্ছে।