গভীর রাতে প্রজ্ঞাপন জারি করে বিতর্ক সৃষ্টির উদ্দেশ্য কি?

সিনিয়র সাংবাদিক আরশাদ মাহমুদ।
সিনিয়র সাংবাদিক আরশাদ মাহমুদ।

গতকাল দুটো সংবাদ আমার চোখে পড়েছে। প্রথমটি, মুক্তিযোদ্ধার সংজ্ঞা কি হবে সেটা বলেছে অন্তর্বর্তী সরকার। আর দ্বিতীয়টি, গ্রামীণ টেলিকম ডিজিটাল ওয়ালেটের লাইসেন্স নিয়েছে। এটা করা হয়েছে নির্বাহী আদেশের মাধ্যমে।

প্রথম খবরটা দেখলাম নতুন সংজ্ঞা অনুসারে জাতির জনক শেখ মুজিবুর রহমান, সৈয়দ নজরুল ইসলাম, তাজউদ্দিন আহমেদ, মনসুর আলী, কামরুজ্জামান, খন্দকার মোস্তাক সহ অনেককে মুক্তিযুদ্ধের সহযোগী হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়েছে। আর প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধারা হলো যারা অস্ত্র হাতে শত্রুর বিরুদ্ধে যুদ্ধ করেছে।

স্বাভাবিকভাবে এটা নিয়ে তোলপাড় শুরু হয়ে যায় এবং পরে মুক্তিযোদ্ধা বিষয়ক উপদেষ্টা ফারুক ই আজম এর ব্যাখ্যা দিয়ে বলেন খবরটি সঠিক নয়। তার ভাষ্য অনুযায়ী মুজিবনগর সরকারের যারা নেতৃস্থানীয় ছিলেন তারা সবাই মুক্তিযোদ্ধা। এরপর বলা হলো সাংবাদিকরা না জেনে বা বুঝে এই বিভ্রান্তি ছড়িয়েছে। এরপর বলা হলো পতিত হাসিনার সরকারের দোসররা এই দূরভীসন্ধিমূলক কাজটি করেছে। যাহোক পক্ষে-বিপক্ষে নানান কথাবার্তা আপনারা নিশ্চয়ই শুনছেন।

আমার প্রশ্ন হল দেশের জরুরি যে সমস্যাগুলো, অর্থাৎ সংস্কার- বিচার বিভাগ, নির্বাচন ব্যবস্থা, প্রশাসন, পুলিশ, সংবিধান এগুলো বাদ দিয়ে হঠাৎ করে প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধাকে হবে এটা নিয়ে প্রজ্ঞাপন জারি করার বিষয়টি কেন উঠলো? এটাতো অন্তর্বর্তী সরকার বা ইউনূসের প্রায়রোটির মধ্যে পড়ে না।

আমার ধারণা এটা খুব ডেলিবারেটলি করা হচ্ছে। এই সন্দেহ এজন্যই হয় যে এইসব প্রজ্ঞাপনগুলো গভীর রাতে জারি করা হয়? এতে যে সমস্যাটা হয় সেটা হলো অনেক সময় ডেডলাইনের কারণে সাংবাদিকরা ঠিকমতো প্রজ্ঞাপন গুলো এনালাইসিস করতে পারে না; বা দেখতে পারে না। এতে করে নানান ভুল-ভ্রান্তি হওয়ার সম্ভাবনা থেকে যায়। তবে যেমনটা আগেই বলছিলাম, এগুলো করা হচ্ছে কূটকৌশলের আশ্রয় নিয়ে এবং ইউনূসের অপকর্মগুলোকে ঢাকা দেওয়ার জন্য।

গতকাল দেখলাম নির্বাহী আদেশে গ্রামীণ টেলিকমকে ডিজিটাল ওয়ালেটের লাইসেন্স দেওয়া হয়েছে। ইউনূস সাহেবের বিশেষ সহকারী আইসিটি মন্ত্রণালয়ের ভারপ্রাপ্ত ফয়েজ আহমেদ তৈয়বের মাধ্যমে নির্বাহী আদেশে এটা করা হয়েছে। আপনারা ইতিমধ্যে জেনেছেন ফয়েজ সাহেবের ব্যক্তিগত সহকারী নগদে কাজ নিয়ে ইতিমধ্যে কয়েকশ কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছে। এটা যখন ফয়েজ সাহেবকে জিজ্ঞেস করা হলো তিনি বললেন “এটা কনফ্লিক্ট অফ ইন্টারেস্ট, ওকে বকাবকি করব।” আমি ভাবছি দুর্নীতি দমন কমিশন এখনো ফয়েজের বিরুদ্ধে অনুসন্ধান শুরু করে না কেন? (এগুলো নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করেছি গতকাল সাংবাদিক মাসুদ কামালের সঙ্গে। নিচে লিঙ্ক দিলাম। সময় পেলে দেখবেন)।

আমার দৃঢ় বিশ্বাস এর মূল উদ্দেশ্য হলো বিতর্ক সৃষ্টি করা এবং দেশের মূল ইস্যু বা সমস্যাগুলো থেকে মানুষের দৃষ্টি অন্যদিকে ফেরানো। তার চেয়েও বড় কথা আমি লক্ষ্য করেছি যখন এই নির্বাচনের ডেট দেওয়া বা ইউনূস সাহেবের দুর্নীতির অভিযোগ জোরেশোরে শোনা যায়, তখনই এই বিতর্কগুলো সৃষ্টি করা হয়।

যেমন কিছুদিন আগে দেখলাম রাখাইনে মানবিক করিডোর দেওয়া এবং চট্টগ্রাম বন্দর ডিপি ওয়ার্ল্ডের হাতে দেওয়া। আরো বড় প্রশ্ন বা বিতর্ক শুরু হয় যখন দেখা যায় ইউনূস সাহেব কোন আইন কানুনের তোয়াক্কা না করে প্রায় প্রতি মাসেই একবার বিদেশে যাচ্ছেন। সবচেয়ে আশ্চর্য ব্যাপার, এগুলো সবই তার ব্যক্তিগত সফর এবং কোনটাই দ্বিপাক্ষিক না।

স্বাভাবিকভাবে এই সফরের খরচ হোস্ট কান্ট্রি দেয় না; দিতে হয় বাংলাদেশের জনগণের ট্যাক্সের টাকায়। আপনারা ইতিমধ্যে জেনেছেন এই এক একটা সফরে তিনি ৫০ থেকে ৬০ জন লোক সঙ্গে নিয়ে যান। আরো বলে রাখি আগামী ১০ জুন তিনি লন্ডন যাচ্ছেন কি যেন একটা পুরস্কার আনার জন্য। এটাও সম্পূর্ণ তার ব্যক্তিগত সফর।

এই সফরকে যেকোনোভাবে দ্বিপাক্ষিক দেখানোর জন্য তিনি আবারও এক কুট কৌশলের আশ্রয় নিয়েছেন। আজ দেখলাম এই সফরে তিনি বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর আহসান মনসুর এবং দুর্নীতি দমন কমিশনের চেয়ারম্যান আব্দুল মোমেনকে সঙ্গে নিয়ে যাবেন। উদ্দেশ্য পাচার করা অর্থ ফেরত আনা। এই সরকার বারবার বলছে এটা একটা জটিল ব্যাপার এবং কয়েকদিন আগে গভর্নর সাহেব বললেন যে পাঁচ বছরের আগে খুব একটা ফল আসবে বলে মনে হয় না। আহসান মনসুর ইতিমধ্যে এই টাকা ফেরতের ধান্দায় ৬৫ দিন বিদেশে অবস্থান করেছেন। ব্যাপারটা চিন্তা করে দেখেন এরা কীভাবে এই দেশের গরিবের টাকা নষ্ট করছে।

গত ২৫ মে আমার একটা পোষ্টের উপর গ্রামীণ ব্যাংকের একজন অবসরপ্রাপ্ত কর্মকর্তা আমার ইনবক্সে একটা মেসেজ দিয়েছে। সেটা আপনাদের সঙ্গে শেয়ার করছি নিচে। আমি তার অনুমতি নিয়েই আপনাদের সঙ্গে এটা শেয়ার করছি।

‘আসসালামু আলাইকুম ।

ইউনূস সাহেব সম্পর্কে একটা মিথ রয়েছে সমাজে যে উনি খুব ভাল মানুষ,দক্ষ, সৎ ইত্যাদি ।কিন্তু উনি তা নন । উনার প্রতিষ্ঠানগুলির একটাও ঠিকমতো চালাতে পারেন নি উনি ।উনাকে পশ্চিমাবিশ্ব তৈরি করেছে গর্বাচেভ এর মতো করে তাদের পক্ষে কাজ করার জন্য ।

আমি গ্রামীণ এ ৩৯ বছর কাজ করেছি অনেক গুরুত্বপূর্ণ জায়গায় । অনেক কিছু দেখেছি, জেনেছি । আমার দৃষ্টিতে উনি নিজ স্বার্থ ছাড়া কিছু বুঝেন না । আপনাকে এসব বলার অর্থ হচ্ছে আপনার লিখা থেকে মনে হয়েছে আপনি একজন ভালো মনের মানুষ, এজন্যে । কোনদিন আপনার সাথে দেখা হলে অনেক কিছুই বলতে পারি।”

আরশাদ মাহমুদ: সিনিয়র সাংবাদিক, লেখক ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক

এ সম্পর্কিত আরও খবর:

আরও পড়ুন