মীনাক্ষির মোটরসাইকেলে ভ্রমণের গল্প, ঘুরলেন ৬৪ দেশ

নিজের ইয়ামাহা আর ফিফটিন মডেলের মোটরসাইকেলের সঙ্গে অকুতোভয় মীনাক্ষি।
নিজের ইয়ামাহা আর ফিফটিন মডেলের মোটরসাইকেলের সঙ্গে অকুতোভয় মীনাক্ষি।

ছোট্ট শহরে বেড়ে ওঠা। আর পাঁচটা সাধারণ পরিবারের মেয়ের মতোই কেটেছে ছোটবেলা। ছোট শহরের মেয়ে তাই বলে স্বপ্ন ছোট হবে তা কেমন করে হয়। বড় হওয়ার পর থেকেই স্বপ্ন দেখতে শুরু করেন মোটরবাইকে পৃথিবীটা ঘুরে দেখবেন।

বলছি আসামের গুয়াহাটির মেয়ে মীনাক্ষি দাসের কথা। স্বপ্ন ভেলায় চড়ে নয়, মোটরসাইকেলে এক বছরে ভ্রমণ করেছেন ৬৪টি দেশ।

মাত্র ১৬ বছর বয়সে প্রথম মোটরসাইকেলে ওঠা মীনাক্ষির। তবে স্বপ্ন পূরণের পথে হেঁটেছেন ২০১৯ সালে ফিটনেস ট্রেনার হিসেবে কাজ শুরু করার পর। সে সময়ে নিজের জমানো টাকায় কেনেন ইয়ামাহা ব্যান্ডের একটি মোটরসাইকেল। সেই বাইকে তিনি প্রথম ছুঁলেন বিশ্বের সর্বোচ্চ মোটরযোগ্য রাস্তা, লাদাখের উমলিং লা। তারপর একা বাইকে ঘুরলেন নেপালও। কিন্তু সেখানে থেমে থাকেননি মীনাক্ষি।

ধীরে ধীরে, বাইকে করে বিশ্ব ভ্রমণের পরিকল্পনা করেন তিনি। প্রাথমিক পরিকল্পনায় ৬৭টি দেশ ভ্রমণের পথনকশা তৈরি করে স্বপ্ন পূরণের জন্য তারা ছোটা শুরু। তখন প্রয়োজন ছিল প্রায় ৫৪ লাখ টাকা। স্পন্সরের সব দরজা যখন বন্ধ হয়ে গেল তখন নিজের কৃষিজমি বন্ধক রেখে, আর খানিকটা ক্রাউডফান্ডিং করে শুরু করেন রোমাঞ্চকর পথচলা। হাতে তখন মাত্র ২০ লাখ টাকা।

নেপাল দিয়ে যাত্রা শুরু, এরপর মুম্বাই হয়ে ওমান যাওয়ার কথা ছিল মীনাক্ষির। কিন্তু প্রথমেই বিপত্তি। রাজনৈতিক অস্থিরতায় রুট বন্ধ হয়ে যায়। বাধ্য হয়ে কাতার উড়ে যান বাইকসহ। অতিরিক্ত খরচ দাঁড়ায় প্রায় ২.৮ লাখ। এরপর অবশ্য বাহরাইন, সৌদি আরব, জর্ডান, সব দেশই পার করেন অকুতোভয়ে।

ইসরায়েলে আটকা ছিলেন ১৩ দিন। সেসময় প্রিয়াঙ্কা নামে এক মালয়ালি নারী তার সাহায্যে এগিয়ে আসেন। খাওয়াদাওয়া, থাকার জায়গা তো দিলেনই, সেই সঙ্গে হাতে ধরিয়ে দিলেন ৫০০ ডলারও। বললেন, ‘তুমি আমার অনুপ্রেরণা। তুমি সফল হলে আমারও আনন্দ হবে।’

জর্জিয়া থেকে তুরস্কে ঢুকতে ভিসা নিয়ে বিপদে পড়েন মীনাক্ষি। প্রচণ্ড ঠান্ডায় কাবু হয়ে পরের দিন সৌভাগ্যক্রমে আর এক অফিসারের কাছে দেন দরবার করে, পেয়ে যান ভিসা। এরপর একে একে পাড়ি দেন ইউরোপের ৪০টিরও বেশি দেশ।

তবে এই রোমাঞ্চের গল্পের পরতে পরতে ছিল অভাবের কালো পাতা। দিনের পর দিন না খেয়ে চলেছেন খরচ বাঁচাতে। কোথাও রাত কাটিয়েছেন রাস্তার ধারে, কোথাও হোস্টেলের বেসমেন্টে। একবার শরীর এতটাই ভেঙে পড়ে যে, ভাবেন এবার বুঝি শেষ।

একবার আচমকা মেয়াদ ফুরিয়ে গেল শেনজেন ভিসার। ফলে ম্যাসিডোনিয়া থেকে ৮৫০ কিমি একটানা বাইক চালিয়ে পৌঁছতে হল গ্রিসে। কিন্তু সেখানেও ভিসা মেলে না। তবুও লড়াই থামে না।

যাত্রার শেষে যখন ইউকে ঢোকার কথা, তখন ফের বাতিল হল তার ভিসার আবেদন। দমে না গিয়ে, কলকাতায় ফিরে গিয়ে নতুন করে আবেদন করেন তিনি। ১০ দিনের মধ্যে ভিসা হাতে নিয়ে আবার ফিরে যান ইউরোপে। অনেকেই বলেছিলেন, এটা সম্ভবই না। কিন্তু অসম্ভবকে সম্ভব করবেন বলেই তো ঘর ছেড়েছেন!

এসবের মাঝে মত ছোট ছোট গল্প জুড়ে গিয়েছে জীবনে! নরওয়ের এক প্রৌঢ় নিজের প্রয়াত স্ত্রীর জুতো উপহার হিসেবে দেন মীনাক্ষিকে। বলেন, এটি এক ‘সহযাত্রী আত্মা’র প্রতীক। চিনের কয়েকজন ভারতীয় মহিলা মিলে পাঠান চার হাজার ডলার। এভাবেই প্রতিটি দেশে তিনি পেয়েছেন মানবিকতার সাড়া। ভাষা মেলেনি, পথ মেলেনি, কিন্তু মিলে গিয়েছে হৃদয়।

২০২৪ সালের ২২ ডিসেম্বর যাত্রা শেষে বাড়ি ফেরেন মীনাক্ষি। পরিবার, সন্তান, মা— সবাইকে জড়িয়ে ধরেন। হু হু করে কেঁদে ওঠেন

এখন নতুন করে স্বপ্ন দেখছেন যাবেন রাশিয়া ও আমেরিকা। বাকি থাকা তিন দেশ, ওমান, ইরাক ও মিয়ানমারে ভ্রমণের ইচ্ছাও মলিন হয়নি তার। হয়তো অচিরেই দেখা মিলবে নতুন কোনো শহরে, অকুতোভয় মীনাক্ষির।

দ্য ওয়াল অবলম্বনে

আরও পড়ুন