কারাবন্দি মেঘনা: ‘আইন লঙ্ঘনের’ দায় কার?

megla saudi

বিশেষ ক্ষমতা আইন ব্যবহার করে মডেল মেঘনা আলমকে আটকের পর কারাগারে পাঠানোর পুরো ঘটনা ‘আইনের লঙ্ঘন’ হিসেবে দেখছেন বিশিষ্ট আইনজীবীরা। পাশাপাশি ঢাকা মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট সেফাতুল্লাহ ৩০ দিনের যে আটকাদেশ দিয়েছেন সেখানে আইনের ব্যত্যয় হয়েছে। ঢাকা মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেটের সেই ক্ষমতা নেই বলে জানিয়েছেন আইন বিশেষজ্ঞরা। মেঘনা আলমকে আটকের পর কারাগারে পাঠানোর ঘটনায় গভীর উদ্বেগ জানিয়েছে অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল।

বৃহস্পতিবার রাত ১০টার দিকে বিশেষ ক্ষমতা আইনে মেঘনা আলমকে ৩০ দিনের আটকাদেশ দিয়ে কারাগারে পাঠানোর নির্দেশ দেন ঢাকার চিফ মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট (সিএমএম) আদালতের বিচারক সেফাতুল্লাহ।

আদালত বিশেষ ক্ষমতা আইনের ৩(১) ধারায় অর্পিত ক্ষমতাবলে তাকে ৩০ দিনের জন্য কারাগারে পাঠানোর নির্দেশ দেন।

আদেশে উল্লেখ করা হয়, ১৯৭৪ সালের বিশেষ ক্ষমতা আইনের ২(এফ) ধারায় জননিরাপত্তা ও আইন-শৃঙ্খলার পরিপন্থি ক্ষতিকর কার্য থেকে নিবৃত্ত করার জন্য এবং আইন-শৃঙ্খলা বজায় রাখার স্বার্থে এই আটকাদেশ দেয়া হয়েছে। পরবর্তীতে মেঘনা আলমকে কাশিমপুর কারাগারে পাঠানো হয়।

সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী ইশরাত হাসান জানান, একজন নারীকে ধরার জন্য রাতের বেলা অর্ডার দিচ্ছে, বিষয়টি খুবই উদ্বেগজনক। তার থেকে বড় কথা, জেলা ম্যাজিস্ট্রেট বা অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রেট এটি করতে পারবে। ম্যাজিস্ট্রেটের কথা আইনে বলা নাই। তাহলে সিএমএম কোর্ট এটি কিভাবে করলো?

আইনে সিএমএম কোর্টের এই অনুমতি দেওয়ার কোনও সুযোগ নাই, বলেন তিনি।

ইশরাত হাসান বলেন, “আইন ব্যত্যয় করে যদি কাউকে অ্যারেস্ট করে, তাহলে তা সম্পূর্ণ অবৈধ।”

“বিস্তারিত অর্ডারে যদি দেখা যায় যে আইন বহির্ভূতভাবে তারা এটা করছে, তাহলে ইমিডিয়েটলি তাকে রিলিজ করা উচিৎ। দ্বিতীয়ত, অবৈধ ডিটেনশনের জন্য জড়িতদের তখন আইন বহির্ভূতভাবে একজনকে ধরায় প্রফেশনাল মিসকন্ডাক্টের আওতায় আনা উচিৎ” বলে মন্তব্য করেন আইনজীবী ইশরাত হাসান।

এর আগে, গত বুধবার সন্ধ্যায় ফেসবুক লাইভে থাকার সময় মেঘনা অভিযোগ করেন, পুলিশ পরিচয়ধারীরা তার বাসার দরজা ভেঙে ভেতরে প্রবেশ করে। লাইভটি প্রায় ১২ মিনিট চলার পর বন্ধ হয়ে যায় এবং পরবর্তীতে সেটি ডিলিটও হয়ে যায়।

সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী ইশরাত হাসান বলেন, “মেঘনা আলমকে আটকের সময় নারী কনস্টেবল ছিল কিনা বা তাকে আটকের আগে তার মেডিকেল টেস্ট হয়েছে কিনা, এগুলোও এখানে গুরুত্বপূর্ণ।”

ডিএমপি’র বিবৃতির বিষয়ে তিনি এও বলেন, “এই জিনিসটা হয়েছে অস্বাভাবিকভাবে। অস্বাভাবিক কোনও ঘটনা ঘটলে এটার সুস্পষ্ট ব্যাখ্যা থাকতে হবে। এটা নিয়ে কোনও লুকোচুরি করা যাবে না। এই বিবৃতি পর্যাপ্ত না… প্রিডিটেনশনের সময় বলছেন যে বাংলাদশের জন্য হুমকিস্বরূপ। পরে অন্য কোনও মামলা দিয়ে দিলে তো হবে না।”

বাংলাদেশে এই বিশেষ ক্ষমতা আইনকে ‘কালো আইন’ হিসেবেও অভিহিত করা হয়। এর আগে বিভিন্ন সময় এই আইনটি অপসারণের দাবি উঠলেও কোনো সরকারই তা করেনি।

মূলত, পাকিস্তানের নিরাপত্তা আইন ১৯৫২, জন নিরাপত্তা অর্ডিন্যান্স ১৯৫৮ এবং ১৯৭২ সালের বাংলাদেশ তফসিলি অপরাধ (বিশেষ ট্রাইব্যুনাল) আদেশকে প্রতিস্থাপনের জন্য বাংলাদেশের স্বাধীনতার পর ১৯৭৪ সালের নয়ই ফেব্রুয়ারি এই আইনটি পাস করা হয়েছিলো।

এর উদ্দেশ্য ছিল, বিশেষ ব্যবস্থার মাধ্যমে রাষ্ট্রবিরোধী কিছু কার্যকলাপ প্রতিহত করা। একই সাথে কিছু গুরুতর অপরাধের দ্রুত বিচার এবং কঠোর শাস্তির ব্যবস্থা করা।

বিশেষ ক্ষমতা আইন, ১৯৭৪’ বা ডিটেনশন আইন প্রয়োগ করে সরকার কোনও ব্যক্তিকে আদালতের আনুষ্ঠানিক বিচার ছাড়াই জননিরাপত্তা, রাষ্ট্রের নিরাপত্তা ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষার স্বার্থে সন্দেহভাজন হিসাবে নির্দিষ্ট সময়ের জন্য আটক বা বন্দি করতে পারে।

তবে, বাংলাদেশ সংবিধানের ৩৩ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী, গ্রেপ্তার ব্যক্তিকে ২৪ ঘণ্টার মধ্যে ম্যাজিস্ট্রেটের সামনে হাজির করতে হবে এবং তাকে তার বিরুদ্ধে আনা অভিযোগ জানাতে হবে।

সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী ইশরাত হাসান বলেন “এখানে স্পষ্টভাবে বলা নেই যে উনি দেশের বিরুদ্ধে কী করছেন। এগুলোর মানুষের সামনে স্পষ্টভাবে আনতে হবে যে, কেন তিনি দেশের জন্য এত হুমকিস্বরূপ হয়ে গেল–ডিটেনশন একটি অনেক বড় বিষয়।”

বিশেষ ক্ষমতা আইন ব্যবহার করে মডেল মেঘনা আলমকে গ্রেপ্তারের পর কারাগারে পাঠানোর ঘটনায় গভীর উদ্বেগ জানিয়েছে অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল। শুক্রবার অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল দক্ষিণ এশিয়ার আঞ্চলিক অফিস নিজেদের ভেরিফায়েড ফেসবুক পেজে দেওয়া এক পোস্টে এ উদ্বেগ প্রকাশ করে।

পোস্টে বলা হয়েছে, এ কালো আইন ঐতিহাসিকভাবে দীর্ঘদিন ধরে মানুষকে অভিযোগ ও বিচারিক তত্ত্বাবধান ছাড়াই নির্বিচার আটকের জন্য ব্যবহার করা হয়ে আসছে। এসব কাজের মধ্য দিয়ে প্রক্রিয়াগত সুরক্ষা এবং আন্তর্জাতিক মানবাধিকারের মান ও প্রয়োগ গুরুতরভাবে লঙ্ঘিত হচ্ছে।

ঢাকায় নিযুক্ত সৌদি রাষ্ট্রদূত ঈসা বিন ইউসুফ আল দুহাইলানের একটি অনানুষ্ঠানিক অভিযোগের ভিত্তিতে মেঘনাকে রাজধানীর বসুন্ধরা এলাকা থেকে আটক করে পুলিশ। তবে মেঘনা আলমকে গ্রেপ্তারের দিন রাতেই বাংলাদেশ ছেড়েছেন তিনি।

সৌদি ও বাংলাদেশ সরকারের কয়েকটি সূত্র জানিয়েছে, রাষ্ট্রদূত ঈসা বাংলাদেশে তার দায়িত্বের মেয়াদ প্রায় শেষ করে চলতি এপ্রিলে ঢাকা ত্যাগের প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন।

সম্প্রতি তিনি পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়কে অনানুষ্ঠানিকভাবে জানান, একজন নারী ‘আর্থিক সুবিধা নেওয়ার জন্য’ তার সঙ্গে প্রতারণার চেষ্টা করছেন। তাকে বিভিন্ন হুমকি দিচ্ছেন। রাষ্ট্রদূতের অভিযোগটি আমলে নিয়ে বিষয়টি গুরুত্বের সঙ্গে দেখার জন্য পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়কে অনুরোধ করা হয়।

স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের নির্দেশে পুলিশ বিষয়টি খতিয়ে দেখতে গিয়ে রাষ্ট্রদূতের সঙ্গে মেঘনা আলমের যোগাযোগ থাকার বিষয়টি জানতে পারে। পুলিশ মেঘনা আলমের পরিবারের মাধ্যমে বিষয়টি সুরাহা করার চেষ্টা করে। তবে এ উদ্যোগ ব্যর্থ হয়।

একপর্যায়ে মেঘনা এক ফেসবুক পোস্টে দাবি করেন, কয়েকজন লোককে রাষ্ট্রদূত ঈসা পুলিশ দিয়ে তুলে নিয়েছেন। তাকে হুমকি দেওয়া হয়, সরকার রাষ্ট্রদূতের পক্ষে থাকবেন। তিনি যেন রাষ্ট্রদূতকে জড়িয়ে ফেসবুকে কিছু পোস্ট না করেন।

স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের এক বিজ্ঞপ্তি অনুযায়ী, সৌদি রাষ্ট্রদূত গত বুধবার সচিবালয়ে স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরীর সঙ্গে বিদায়ী সাক্ষাৎ করেন।

সরকার কর্মী পাঠানোসহ সৌদি আরবের সঙ্গে সম্পর্ক উন্নয়নে অবদান রাখার জন্য গত জানুয়ারিতে রাষ্ট্রদূত ঈসাকে ‘বাংলাদেশ ডিপ্লোমেটিক এক্সিলেন্স মেডেল’ প্রদান করে।

আরও পড়ুন

সর্বশেষ

ads