মাইলস্টোন ট্র্যাজেডি: মৃত্যু সংখ্যায় গোলকধাঁধা, আসল চিত্র ঢাকা পড়ছে?

বৃহস্পতিবার মাইলস্টোন স্কুলের মূল ফটকে আটকে দেওয়া হয় অভিভাবকসহ সবাইকে। ছবি: বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমের সৌজন্যে।
বৃহস্পতিবার মাইলস্টোন স্কুলের মূল ফটকে আটকে দেওয়া হয় অভিভাবকসহ সবাইকে। ছবি: বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমের সৌজন্যে।

রাজধানীর উত্তরায় মাইলস্টোন স্কুল অ্যান্ড কলেজে বাংলাদেশ বিমান বাহিনীর একটি এফটি-৭ বিজিআই যুদ্ধবিমান বিধ্বস্ত হওয়ার মর্মান্তিক ঘটনাটি দেশকে স্তব্ধ করে দিয়েছে। এই ঘটনায় ব্যাপক হতাহতের খবর পাওয়া গেলেও, ঘটনার শুরু থেকেই নিহতের সংখ্যা নিয়ে বিভিন্ন উৎস থেকে আসা তথ্যের মধ্যে ব্যাপক বিভ্রান্তি দেখা গেছে।

প্রত্যক্ষদর্শী, হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ, সরকারি সংস্থা এবং আইএসপিআর-এর তথ্যে ভিন্নতা সাধারণ মানুষের মনে নানা প্রশ্ন সৃষ্টি করেছে, যা ২৪ জুলাই পর্যন্তও সম্পূর্ণ নিরসন হয়নি।

বাংলাদেশে যে কোনো দুর্ঘটনা কিংবা সহিংসতায় নিহতের সংখ্যা নিয়ে লুকোচুরির সন্দেহ বরাবরই ওঠে। ২০১৩ সালে মতিঝিলে শাপলা চত্বরে হেফাজতের সমাবেশে হাজার মানুষ নিহত হয় বলে তখন দাবি উঠেছিল। গত বছরের জুলাই অভ্যুত্থানের সময়ও দাবি উঠেছিল, নিহতের সংখ্যা কয়েক হাজার।

আগের দুটি ঘটনা ঘটেছিল আওয়ামী লীগ সরকার আমলে। গত বছরের অভ্যুত্থানে সেই সরকারের পতনের পর এখন যে অন্তর্বর্তী সরকার ক্ষমতায়, তাদের অনেকেও ওই দুটি ঘটনায় বহু হতাহতের ঘটনাকে সমর্থন করেন।

কিন্তু ঢাকার মাইলস্টোন স্কুল ও কলেজে বিমান বিধ্বস্তের পর এবার মুহাম্মদ ইউনূস নেতৃত্বাধীন অন্তর্বর্তী সরকারই এখন লাশ লুকানোর অভিযোগে বিদ্ধ।

বুধবার মাইলস্টোনের শিক্ষার্থীরা লাশের প্রকৃত হিসাব চেয়ে বিক্ষোভ করে, সেখানে ‘লাশের হিসাব চাই’ লেখা ফেস্টুনও ছিল।

এই প্রতিবেদনে সর্বশেষ তথ্যের ভিত্তিতে একটি বিশ্লেষণ তুলে ধরার চেষ্টা করা হলো।

প্রাথমিক চিত্র ও অসামঞ্জস্যতা

২১ জুলাই দুপুর ১টা ১২ মিনিট থেকে ১টা ১৪ মিনিটের মধ্যে বাংলাদেশ বিমান বাহিনীর ওই যুদ্ব বিমানটি মাইলস্টোন স্কুল অ্যান্ড কলেজের দিয়াবাড়ি ক্যাম্পাসের দোতলা ভবনে বিধ্বস্ত হয়। যেটি ছিল মূলত স্কুলের জুনিয়র শাখার একটি ভবন। দুর্ঘটনার সময় স্কুল ‘ছুটি হওয়ায়’ স্বল্পসংখ্যক শিক্ষার্থী ও অভিভাবক ক্যাম্পাসে ছিলেন বলে স্কুল কর্তৃপক্ষের ভাষ্য।

তাৎক্ষণিকভাবে শিক্ষক, শিক্ষার্থী, কর্মকর্তা-কর্মচারী এবং স্থানীয় এলাকাবাসী উদ্ধার কাজে ঝাঁপিয়ে পড়েন। পরে বাংলাদেশ সেনাবাহিনী, ফায়ার সার্ভিস, বিমান বাহিনী, নৌ বাহিনী, পুলিশ ও র‍্যাব সম্মিলিতভাবে উদ্ধার অভিযানে অংশ নেয়।

শুরু থেকেই এই মর্মান্তিক ঘটনায় হতাহতের সংখ্যা নিয়ে ভিন্ন ভিন্ন তথ্য উঠে আসতে শুরু করে।

প্রত্যক্ষদর্শীদের অনেকেই দুর্ঘটনায় ব্যাপক সংখ্যক হতাহতের কথা জানিয়েছিলেন। তাদের বর্ণনায় বিভীষিকাময় দৃশ্যের কথা উঠে আসে, যেখানে দগ্ধ দেহ এবং গুরুতর আহত মানুষের ভিড়ও দেখা যায়।

নিহতের প্রকৃত সংখ্যা প্রকাশের দাবিতে মঙ্গলবার শিক্ষা প্রতিষ্ঠানটিতে বিক্ষোভ দেখায় শিক্ষার্থী ও অভিভাবকরা। ছবি: বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমের সৌজন্যে।

সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়া অনেক ছবিতেও ব্যাপক ধ্বংসযজ্ঞের প্রমাণ পাওয়া যায়, যা থেকে অনেকেই বিপুল সংখ্যক শিক্ষার্থীর মৃত্যুর শঙ্কা করছিলেন।

প্রত্যক্ষদর্শী ও উদ্ধার অভিযানে অংশ নেওয়া শিক্ষার্থীদেরও অনেকেই গণমাধ্যমকে জানিয়েছেন, নিহতের সংখ্যা দেড়শ’র বেশি।

ঘটনার পর আহতদের উদ্ধার করে রাজধানীর বিভিন্ন হাসপাতালে, বিশেষত ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের বার্ন ইউনিট ও সম্মিলিত সামরিক হাসপাতালে (সিএমএইচ) নেওয়া হয়।

প্রাথমিক পর্যায়ে হাসপাতাল সূত্রগুলো আহত ও নিহতদের সংখ্যা জানায়, যা প্রত্যক্ষদর্শীদের ধারণার চেয়ে কম ছিল। যেমন, প্রথম আলো ও সময় টিভি’র ২৩ জুলাইয়ের প্রতিবেদন অনুযায়ী, বিভিন্ন হাসপাতালে ৫৭ জন চিকিৎসাধীন ছিলেন এবং মোট নিহতের সংখ্যা ২৯ জন। কিন্তু এই সংখ্যাও দিন গড়ানোর সাথে সাথে পরিবর্তিত হতে থাকে। বুধবার প্রথম আলো মৃত্যুর সংখ্যা ৩২ বলে জানিয়েছিল।

ঘটনার পরপরই সরকার পক্ষ থেকে শোক প্রকাশ করা হয় এবং উদ্ধার তৎপরতা জোরদার করার কথা বলা হয়। হতাহতের সংখ্যা গোপনের অভিযোগ উঠলেও সরকারের প্রধান উপদেষ্টার প্রেস উইং থেকে মঙ্গলবার বিবৃতি দিয়ে বলা হয়, “আমরা অত্যন্ত দৃঢ়ভাবে জানাতে চাই, এ দাবি সঠিক নয়।”

বৃহস্পতিবার শিক্ষা প্রতিষ্ঠানটির মূল ফটকে অপেক্ষারত অভিভাবক ও উৎসুক মানুষের ভিড়। ছবি: বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমের সৌজন্যে।

সরকার পক্ষ থেকে আরও বলা হয়, নিহত ও আহতদের প্রত্যেকের জন্য সব ধরনের সহায়তা প্রদান করা হবে এবং হতাহতের সংখ্যা কম করে দেখানোর কোনো কারণ সরকারের নেই।

এদিকে আন্তঃবাহিনী জনসংযোগ পরিদপ্তর (আইএসপিআর) থেকে প্রাথমিক বিবৃতিতে ১৯ জন নিহত এবং শতাধিক আহত হওয়ার কথা জানানো হয়েছিল। পরবর্তীতে ২২ জুলাই নিহতের সংখ্যা বেড়ে ৩১ জনে দাঁড়িয়েছে এবং ১৬৫ জনকে ১০টি ভিন্ন হাসপাতালে ভর্তি করার কথা জানানো হয়। এ ঘটনায় আহত আরও তিনজনের মৃত্যুর যোগ করলে নিহতের সংখ্যা দাঁড়ায় ৩৪।

জাতীয় বার্ন ও প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউট জানিয়েছে, বর্তমানে চিকিৎসাধীন ৪২ জন রয়েছে। তাদের মধ্যে আশঙ্কাজনক অবস্থায়আছে ছয়জন।

রাত আটটার পর এক সংবাদ ব্রিফিংয়য়ে এ তথ্য জানান জাতীয় বার্ন ও প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউটের পরিচালক অধ্যাপক চিকিৎসক মোহম্মদ নাসির উদ্দিন।

মোহম্মদ নাসির উদ্দিন বলেন, গত দুই দিনে ইন্টারমিডিয়েট ক্যাটাগরিতে থাকা ২৩ রোগীর মধ্যে ১৩ জনের অবস্থার উন্নতি ঘটেছে। তাঁদের মধ্যে অনেককেই দু–এক দিনের মধ্যে রিলিজ দেওয়া হতে পারে।

হালনাগাদ তথ্য ও বিভ্রান্তি

এদিকে ২৪ জুলাই মাইলস্টোন স্কুল অ্যান্ড কলেজ কর্তৃপক্ষ তাদের আনুষ্ঠানিক বিবৃতি প্রকাশ করেছে।

শিক্ষা প্রতিষ্ঠানটির বিবৃতি অনুযায়ী, গত ২১ জুলাইয়ের ঘটনায় মাইলস্টোন স্কুল শাখার ১৯ জন শিক্ষার্থী, ২ জন শিক্ষক এবং ২ জন অভিভাবক মোট ২২ জন মৃত্যুবরণ করেছেন। গুরুতর আহত হয়েছেন ৫১ জন, যাদের মধ্যে ৪০ জন শিক্ষার্থী, ৭ জন শিক্ষক, ১ জন অভিভাবক, ১ জন আয়া ও ১ জন পিয়ন রয়েছেন।

দুর্ঘটনার পর ঘটনাস্থলে পড়ে থাকা পুড়ে যাওয়া স্কুল ব্যাগ।

এখনও ৫ জন নিখোঁজ রয়েছেন, যার মধ্যে ৩ জন শিক্ষার্থী ও ২ জন অভিভাবক।

তবে মাইলস্টোন কর্তৃপক্ষের এই ২২ জনের সংখ্যা আইএসপিআর-এর ৩২ জনের তথ্য (২৩শে জুলাই) এবং দ্য ডেইলি স্টার বাংলায় ২৪ জুলাইয়ের প্রতিবেদন অনুযায়ী ৩৪ জনের মৃত্যুর খবরের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়।

২৪ জুলাই ‘দ্য ডেইলি স্টার বাংলা’ জানায়, বার্ন ইনস্টিটিউটে মাহিয়া নামের এক শিশুর মৃত্যু হওয়ায় মোট নিহত বেড়ে ৩৪ জনে দাঁড়িয়েছে। এছাড়া ‘আজকের পত্রিকা’ মাহিয়া তাসনিম নামের আরও এক শিক্ষার্থীর মৃত্যুর খবর দিয়ে বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায় লিখেছে এনিয়ে মোট সংখ্যা দাঁড়াল ৩১।

বিভ্রান্তির কী কারণ?

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এরকম একটি বড় আকারের দুর্ঘটনার পর বিভিন্ন সরকারি সংস্থা, হাসপাতাল, এবং সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানের মধ্যে তথ্যের আদান-প্রদানে সমন্বয়হীনতা দেখা গেছে।

একদিকে মাইলস্টোন কর্তৃপক্ষ শুধু তাদের প্রতিষ্ঠানের হতাহতের তথ্য প্রকাশ করেছে, অন্যদিকে আইএসপিআরের হিসেবে উঠে এসেছে সামগ্রিক হতাহতের সংখ্যা।

তাছাড়া দুর্ঘটনার প্রথম দিকে উদ্ধার কাজ চলার সময় অনেক মরদেহ শনাক্ত করা সম্ভব হয়নি বা হাসপাতালে আনার পর অনেকে মারা গেছেন। এর ফলে প্রাথমিক হিসেবে ভুল হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে।

অন্যদিকে দুর্ঘটনার ভয়াবহতা এবং তথ্যের অসামঞ্জস্যতার সুযোগ নিয়ে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে অনেক অপ্রমাণিত তথ্য ও গুজব ছড়িয়ে পড়ে, যা বিভ্রান্তি আরও বাড়ায়। আইএসপিআর নিজেও এই গুজবের বিষয়ে সতর্ক করেছে।

সরকারের অবস্থান

ঘটনার পর একদিনের মধ্যে অনুদানের আহ্বান জানানো হলেও তীব্র প্রতিক্রিয়ার মুখে প্রধান উপদেষ্টা ফেইসবুকে দেওয়া ওই পোস্ট সরিয়ে ফেলেন। অবশ্য সরকারের পক্ষ থেকে হতাহতদের পরিবারকে সব ধরনের সহায়তা দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়েছে।

বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ড (বিসিবি) মাইলস্টোন দুর্ঘটনায় ক্ষতিগ্রস্তদের সহায়তায় বাংলাদেশ-পাকিস্তান তৃতীয় টি-টোয়েন্টি ম্যাচের টিকিটের অর্থ দেওয়ার ঘোষণা দিয়েছে।

মাইলস্টোন স্কুল অ্যান্ড কলেজ কর্তৃপক্ষও একটি তদন্ত কমিটি গঠন করেছে।

নিহতের সংখ্যা গোপন করার অভিযোগও প্রত্যাখ্যান করেছে প্রধান উপদেষ্টার দপ্তর। প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সচিব শফিকুল আলম দাবি করেছেন, বাংলাদেশে লাশ গোপন করা অসম্ভব।

তিনি বুধবার এক ফেইসবুক পোস্টে লেখেন, “সাংবাদিক হিসেবে আমি ২০০২ থেকে ২০২৪ সাল পর্যন্ত অসংখ্য বড় ধরনের দুর্ঘটনা-দুর্যোগের ঘটনায় রিপোর্ট লিখেছি। আমি নিশ্চিতভাবে বলতে পারি যে বাংলাদেশে হতাহতের সংখ্যা গোপন করা কার্যত অসম্ভব।”

বার্তা সংস্থা এএফপিতে কাজ করে আসা শফিকুল আলম মাইলস্টোনের ঘটনা ধরে বাংলাদেশে লাশের তথ্য গোপন অসম্ভব এখন বললেও ক’দিন আগেও তার অভিযোগ ছিল, ২০১৩ সালে আওয়ামী লীগ লাশের তথ্য গোপন করেছিল।

গত ফেব্রুয়ারিতে এক সভায় তিনি বলেছিলেন, “আমার অফিস তখন মতিঝিলে ছিল। সেদিন আমরা সারারাত জেগে রিপোর্ট করেছি। সরকার প্রথমে সাতজন নিহত হওয়ার কথা জানায়, পরে সেই সংখ্যা ১৩, তারপর ২৩ জন বলে দাবি করা হয়। তবে প্রকৃত সংখ্যা প্রকাশ করা হয়নি। আমরা যে সংখ্যা প্রকাশ করেছিলাম, তা ছিল অনেক বেশি।

এ সম্পর্কিত আরও খবর:

আরও পড়ুন