রাজনৈতিক পট পরিবর্তনে বাংলাদেশে একটি নতুন অন্তর্বর্তী সরকার এলেও ধর্মীয় সংখ্যালঘুরা দেশটিতে এখনও সহিংসতার শিকার হচ্ছে বলে যুক্তরাষ্ট্রের এক প্রতিবেদনে উঠে এসেছে।
২১ জুলাই ওই প্রতিবেদনটি প্রকাশ করে ইউএস কমিশন অন ইন্টারন্যাশনাল রিলিজিয়াস ফ্রিডম বা ইউএসসিআইআরএফ, বাংলা করলে যা দাঁড়ায় যুক্তরাষ্ট্রের আন্তর্জাতিক ধর্মীয় স্বাধীনতা কমিশন।
প্রতিবেদনের শুরুতেই বলা হয়, গেল বছরের জুলাইয়ে ছাত্রদের নেতৃত্বাধীন বিক্ষোভ বাংলাদেশে একটি নতুন রাজনৈতিক আন্দোলনের সূচনা করে এবং এরই ধারাবাহিকতায় একটি তত্ত্বাবধায়ক সরকার গঠন করা হয়। এরপর থেকে তত্ত্বাবধায়ক সরকার সংশোধনী, সংস্কার এবং সংবিধান পরিবর্তনের মতো বেশ কিছু প্রস্তাব এনেছে। তবে তাতে ধর্মীয় সম্প্রদায়গুলোর উদ্বেগ দূর হয়নি।
এরই প্রেক্ষাপটে মে মাসে ধর্মীয় স্বাধীনতা নিয়ে আলোচনায় সংস্থাটির এক প্রতিনিধি দল ঢাকা সফর করে। ওই সফরে ধর্মীয় স্বাধীনতা নিয়ে সুশীল সমাজ ও সরকারি কর্মকর্তাদের সঙ্গে তারা আলোচনা করেন।
প্রতিবেদনে বলা হয়, অন্তর্বর্তী সরকার ধর্মীয় সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের ওপর সংঘটিত দুই হাজার ৯২৪টি হামলার নিন্দা করলেও আইন প্রয়োগকারী ব্যবস্থা ভেঙে পড়ার কারণে জবাবদিহির অভাব রয়েছে। তাছাড়া হিন্দু, ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী, আহমদিয়া ও সুফি মুসলমান সম্প্রদায়ের সদস্যরাও বৈষম্যের শিকার হওয়ার তথ্য দিয়েছেন।
বাংলাদেশে চলমান সংস্কার প্রসঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, এই সংস্কারপ্রক্রিয়ায় ধর্মীয় সংখ্যালঘু সম্প্রদায় কতটা যুক্ত তা এখনো স্পষ্ট নয়।
সংস্কারপ্রক্রিয়ায় অন্তর্ভুক্ত না করা বা পরামর্শ নেওয়া হয়নি বলে অভিযোগ এসেছে ধর্মীয় সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের অনেকের মুখ থেকে। একইসঙ্গে রাজনীতিতে ও রাষ্ট্রীয় সংস্থাগুলোতেও আনুপাতিক হারে তাদের প্রতিনিধিত্ব কম থাকার কথাও এসেছে।
এক্ষেত্রে অন্তর্বর্তী সরকারের উপদেষ্টা পরিষদের উদাহরণ দিয়ে বলা হয়, সেখানে একজন হিন্দু এবং অন্য একজন পার্বত্য চট্টগ্রামের বৌদ্ধ সম্প্রদায়ের সদস্য।
বাংলাদেশে অন্তর্বর্তী সরকার গঠিত নারীবিষয়ক সংস্কার কমিশনের প্রতিবেদন নিয়ে বিভিন্ন গোষ্ঠীর বিরোধিতার প্রসঙ্গও স্থান পেয়েছে ওই প্রতিবেদনে।
হেফাজতে ইসলামসহ বেশ কিছু গোষ্ঠী ওই প্রতিবেদনের সুপারিশগুলোকে অনৈসলামিক বলে আখ্যায়িত করে এর বিরোধিতা করে আসছেন।
কিছু নারী শিক্ষাঙ্গনে রক্ষণশীল ইসলামী দৃষ্টিভঙ্গির কথাও বলা হয়েছে। হেফাজতে ইসলামের আল্টিমেটামের পর কলেজ শিক্ষক নাদিরা ইসলামকে অন্যত্র বদলি করা, ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশের চাপে গত ফেব্রুয়ারিতে নারী ফুটবল ম্যাচ বাতিল করার মতো ঘটনারও উল্লেখ রয়েছে যুক্তরাষ্ট্রের ধর্মীয় স্বাধীনতা কমিশনের প্রতিবেদনে।
সাইবার নিরাপত্তা অর্ডিন্যান্স প্রসঙ্গে প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, অন্তর্বর্তী সরকারের আমলে ওই আইনে ব্লাসফেমির অভিযোগে কয়েকটি গ্রেপ্তারের ঘটনা ঘটেছে। ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাতের অভিযোগে গত ফেব্রুয়ারিতে সোহেল হাসান গালিবকে গ্রেপ্তার, পাঠ্যপুস্তক পর্যালোচনা কমিটির সদস্য রাখাল রাহার বিরুদ্ধে তদন্ত করতে সিআইডিকে সাইবার ট্রাইব্যুনালের আদেশের প্রসঙ্গও সেখানে স্থান পেয়েছে।
গত বছর জুলাই আন্দোলন ও এরপর ধর্মীয় উত্তেজনা বৃদ্ধিতে ‘ভুল ও বিভ্রান্তিকর’ তথ্যের ভূমিকার কথাও বলা হয়েছে যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিবেদনে।
প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ধর্মীয় সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের ওপর হামলা সম্পর্কে ভুল ও বিভ্রান্তিকর তথ্য ভয়ের পরিবেশ সৃষ্টি করেছিল। বাংলাদেশ সরকারের কর্মকর্তারা ভারতীয় গণমাধ্যমের বিভ্রান্তিকর তথ্যকে দেশে ধর্মীয় স্বাধীনতার প্রতিবন্ধকতা হিসেবে উল্লেখ করেছেন। কিছু হিন্দু মন্দিরে হামলা হয়েছে, অগ্নিসংযোগ বা হিন্দু মহিলাদের ওপর আক্রমণের বানোয়াট ভিডিও দিয়ে সাম্প্রদায়িক হামলার তথ্য প্রচার করা হয়েছে।
মানবাধিকার সংস্থাগুলোও বলেছে, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম এবং বিভ্রান্তিকর তথ্য ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের ওপর আক্রমণে ভূমিকা রেখেছে।
প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বাংলাদেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলের হিন্দু সম্প্রদায়ের সদস্যরা বিভ্রান্তিকর তথ্যের ব্যাপারে বেশি সংবেদনশীল। বিভ্রান্তিকর তথ্য তাদের মধ্যে ভীতির সঞ্চার করেছিল।
এ ছাড়া বাংলাদেশের সাংবাদিকরা যারা ধর্মীয় স্বাধীনতার বিষয়ে রিপোর্ট করছেন তারাও ‘মব’ ও রক্ষণশীল গোষ্ঠীর দ্বারা হয়রানি নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন। ইসলামবিরোধী অবস্থান নেওয়ার অভিযোগ তুলে একটি গোষ্ঠী গত নভেম্বরে শীর্ষ স্থানীয় একটি ইংরেজি দৈনিক পত্রিকা বন্ধের দাবি তুলেছিলেন বলে প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়।
মুহাম্মদ ইউনূস আগামী বছরের “জুনের মধ্যে নির্বাচন” আয়োজনের কথা বলেছেন।
যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, আগামী নির্বাচনের সময় ধর্মভিত্তিক সহিংসতার আশঙ্কা করছে ধর্মীয় সংখ্যালঘু সম্প্রদায় এবং মানবাধিকার সংস্থাগুলো। বাংলাদেশ কর্তৃপক্ষ পুলিশ মোতায়েনের বাইরে সাম্প্রদায়িক সহিংসতা মোকাবেলায় কোনো নির্দিষ্ট পরিকল্পনা তৈরি করেনি।
প্রতিবেদনে বলা হয়, ধর্মীয় সংখ্যালঘু সম্প্রদায়গুলো তাদের উপাসনালয় থেকে কার্যক্রম পরিচালনায় অতিরিক্ত চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হওয়ার কথা উল্লেখ না করলেও, কিছু সম্প্রদায় এখনও ভূমি দখলকে একটি সমস্যা হিসাবে চিহ্নিত করেছে।
ধর্ম বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের মতে, ধর্মীয় সম্প্রদায়গুলোকে তাদের উপাসনালয় নিবন্ধন করার প্রয়োজন নেই। তবে, একাধিক উপাসনালয় নিয়ে সমিতি গঠন করতে ইচ্ছুক ধর্মীয় গোষ্ঠীগুলিকে বেসরকারি সংস্থা হিসাবে নিবন্ধন করতে হয়।
বাংলাদেশের মানবাধিকার সংস্থা আইন ও সালিশ কেন্দ্রের একটি পরিসংখ্যা তুলে ধরে ওই প্রতিবেদনে বলা হয়, ২০২৫ সালের জানুয়ারি থেকে এপ্রিল পর্যন্ত ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের বিরুদ্ধে মোট ৪৮টি হামলার ঘটনা তারা রেকর্ড করেছেন, যার মধ্যে হিন্দু প্রতিমার ভাঙচুরের ঘটনা ২৫টি।
হিন্দু ধর্মীয় নেতারা ইউএসসিআইআরএফকে তাদের সম্প্রদায়ের সদস্যদের মধ্যে ভয়ের অনুভূতি সম্পর্কেও জানিয়েছেন, জোর দিয়ে বলেছেন যে কিছু এলাকায় হিন্দু নারীরা হয়রানি এড়াতে চুড়ি ও টিপ পরা বন্ধ করে দিয়েছেন।
যুক্তরাষ্ট্রের আন্তর্জাতিক ধর্মীয় স্বাধীনতা কমিশন যুক্তরাষ্ট্রের আইনসভা কংগ্রেস প্রতিষ্ঠিত একটি প্রতিষ্ঠান। এর কাজ বিদেশে ধর্মীয় স্বাধীনতা পর্যবেক্ষণ, বিশ্লেষণ ও প্রতিবেদন তৈরি করা।