মিক্সুয়ে: ম্যাকডোনাল্ডসকে হটিয়ে কীভাবে বিশ্বজয়ী হলো

Mixue

সস্তা, কার না পছন্দ। বিশেষ করে প্রচ্ছন্ন বৈশ্বিক অর্থমন্দার সময়ে সাধারণ মানুষ কেনাকাটার ক্ষেত্রে তুলনামূলক সস্তার দিকেই বেশি ঝোকে।

আর মানুষের এই প্রবণতাকেই কাজে লাগিয়েছে চীনা কোম্পানি ‘মিক্সুয়ে আইসক্রিম অ্যান্ড টি’। আরেক বৈশ্বিক ব্র্যান্ড ম্যাকডোনাল্ডকে পেছনে ফেলে এটি এখন বিশ্বের এক নম্বর ফাস্ট ফুড ও বেভারেজ চেইন। এক ডলারেরও কম দামের আইসক্রিম ও পানীয় রোজ দেদারসে বিক্রি হয় চেইনের দোকানগুলোতে। 

পণ্যের ব্র্যান্ডিংয়ের ক্ষেত্রে মিক্সুয়ের কৌশল অনন্য। এর মাসকট দেখতে অনেকটা ‘ফ্রস্টি দ্য স্নোম্যান’ ও ‘মিশেলিন ম্যানের’ মিলিত রূপের মতো। এছাড়া দোকানগুলোতে সবসময় “ওহ! সুজানা” গানের সুরে বাজানো একটি জিঙ্গেল শোনা যায়। ফলে সব বয়সী মানুষের আকর্ষণ কাড়তে পারে দোকানগুলো।

আকর্ষণীয় রেসিপির কারণে ‘মিক্সুয়ে আইসক্রিম অ্যান্ড টি’ বিশ্বের সবচেয়ে বেশি শাখা থাকা খাদ্য ও পানীয় প্রতিষ্ঠানের (ফুড অ্যান্ড বেভারেজ চেইন) স্বীকৃতি পেয়েছে। এটি ম্যাকডোনাল্ডস ও স্টারবাকসকেও ছাড়িয়ে গেছে।

‘মিক্সুয়ে’ নামে পরিচিত এই চীনা কোম্পানির শাখা এশিয়া ও অস্ট্রেলিয়ার বিভিন্ন দেশে রয়েছে। গবেষণা প্রতিষ্ঠান টেকনোমিকের তথ্য অনুযায়ী, তিন বছরে শাখা সংখ্যা দ্বিগুণের বেশি বাড়িয়ে এটি গত বছর ৪৫ হাজার দোকান নিয়ে বছর শেষ করে।

কোম্পানিটি এখন শেয়ারবাজারে প্রাথমিক শেয়ার ছেড়ে সর্বোচ্চ ৫১০ মিলিয়ন ডলার সংগ্রহ করতে চায়। এতে এর বাজারমূল্য প্রায় ১০ বিলিয়ন ডলার হবে। সোমবার থেকে এর শেয়ার হংকংয়ের বাজারে কেনাবেচা শুরু হচ্ছে।

প্রতিষ্ঠানটির সম্প্রসারণ এখনও শেষ হয়নি। মিক্সুয়ে আইপিও নথিতে জানিয়েছে, তারা আরও বড় হতে চায়। তবে নতুন শাখাগুলো পুরোনো শাখার ব্যবসায় প্রভাব ফেলতে পারে বলে স্বীকার করেছে।

মিক্সুয়ের সর্বাধিক বিক্রিত আইসক্রীম ও পানীয়ের দাম মাত্র ৬ চীনা ইউয়ান (প্রায় ৮৩ সেন্ট)। এটি অর্থমন্দায় থাকা চীনের মানুষের কাছে বেশ জনপ্রিয়। অস্থিরতার মধ্যে থাকা আবাসন বাজারসহ বিভিন্ন সমস্যার কারণে সেখানে খরচ কমে গেছে।

গবেষণা প্রতিষ্ঠান গাভেকাল ড্রাগোনোমিকসের বেইজিংভিত্তিক বিশ্লেষক এর্নান কুই বলেন, “মানুষ এখন সাশ্রয়ী পণ্যের দিকে ঝুঁকছে। মিক্সুয়ে মূলত ছোট শহরগুলোতে জনপ্রিয়। এজন্য কোম্পানিটি সেখানেই তাদের ব্যবসা সম্প্রসারণে বেশি গুরুত্ব দিয়েছে।”

মিক্সুয়ে তার আইপিও নথিতে জানিয়েছে, এটি আন্তর্জাতিকভাবে আরও বিস্তৃত হতে চায়। তবে যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে প্রবেশের কোনও ইচ্ছা আপাতত নেই। এর প্রায় ৯০ শতাংশ দোকান চীনে। বাকি দোকান ১০টি অন্যান্য এশীয় দেশ ও অস্ট্রেলিয়ায় অবস্থিত।

মিক্সুয়ে ১৯৯৭ সালে ঝাং হোংচাও নামের এক ব্যবসায়ি প্রতিষ্ঠা করেন। তিনি চীনের হেনান প্রদেশে শেভড আইস বিক্রির একটি দোকান চালু করেছিলেন। তখন দোকানটির নাম ছিল ‘কোল্ডস্ন্যাপ’। দুই বছর পর দোকানের নাম পাল্টে রাখা হয় মিক্সুয়ে।

এই শেভড আইস হলো এক ধরনের বরফজাতীয় মিষ্টান্ন, যেখানে বরফকে খুব ছোট ছোট টুকরো বা সূক্ষ্মভাবে ঘষে নেওয়া হয়। এরপর এর ওপর সিরাপ, কন্ডেন্সড মিল্ক, ফল বা অন্য টপিং দেওয়া হয়। এটি অনেক দেশে জনপ্রিয়, যেমন জাপানে কাকিগোরি, হাওাইয়ে শেভ আইস, ফিলিপাইনে হালো-হালো ও দক্ষিণ কোরিয়ায় বিংসু নামে পরিচিত।

২০০৫ সালে কোম্পানিটি ১ ইউয়ান (প্রায় ১৫ সেন্ট) দামে সফট সার্ভ আইসক্রিম বিক্রি শুরু করে। এটি দ্রুত বিক্রির সফলতা অর্জন করে এবং প্রথম সিগনেচার পণ্য হয়ে ওঠে।

আজকের দিনেও চেইনটি তার পুরো মেনুতে কম দাম বজায় রেখেছে। অনেক পণ্য মাত্র ১ ডলারে বিক্রি হয়। এর সবচেয়ে বিক্রিত পণ্যগুলোর মধ্যে রয়েছে আইসক্রিম কন, লেবুর রস ও বাবল টি (স্থানীয় ভাষায় বোবা)। লেবুর রসের পানীয়টি চীনে তুমুল জনপ্রিয়। আর দেশটিতে তাই লেবুর সবচেয়ে বড় ক্রেতাও মিক্সুয়ে।

চীনে বাবল টি বাজার যথেষ্ট বড়। ২০২৩ সালে, চায়না চেইন স্টোর অ্যান্ড ফ্র্যাঞ্চাইজি অ্যাসোসিয়েশনের একটি রিপোর্ট অনুযায়ী, এই শিল্পের মূল্য ছিল ১৪৫ বিলিয়ন ইউয়ান (২০ দশমিক ৪ বিলিয়ন ডলার)।

মিক্সুয়ের দ্রুত সম্প্রসারণের কারণ হলো এর সরল ডিজাইনের উজ্জ্বল লাল রঙের দোকান। এসব দোকান সাধারণত ফোন মেরামতের কিয়স্ক বা ডাম্পলিং দোকানের পাশে ছোট স্টলের মতো থাকে।

মিক্সুয়ে আইসক্রিমের স্লোগান ‘একটুখানি ঠাণ্ডা, গরম ও মিষ্টি মৌসুম উপহার দেওয়া’,  মূলত গ্রাহকের মৌলিক চাহিদার সঙ্গে মিলে যায়। 

মিক্সুয়ের আরেকটি সুবিধা হলো, এটি কম ফ্র্যাঞ্চাইজি ফি নেয়। কোম্পানি মূলত ফ্র্যাঞ্চাইজিদের কাছে খাদ্য ও পানীয় বিক্রি করে অধিকাংশ আয় করে।

বিশেষজ্ঞদের তথ্য অনুযায়ী, মিক্সুয়ের ২০ শতাংশ ফ্র্যাঞ্চাইজি মালিকের কাছে পাঁচটির বেশি দোকান আছে। আর তারা মোট ১৬ হাজার আউটলেট পরিচালনা করেন। এই ‘এ ক্লাস’ ফ্র্যাঞ্চাইজিগুলো থেকে মিক্সুয়ের অর্ধেক আয় আসে। আর বাকি ১৩ হাজার ‘বি ক্লাস’ ফ্র্যাঞ্চাইজিরা সাধারণত ১-২টি করে দোকান থেকে ২০ হাজার আউটলেট চালায়।

শুধুমাত্র কম দামের কারণে মিক্সুয়ে চীনের পপ সংস্কৃতিতে প্রতিষ্ঠা পায়নি। এর সফলতার পেছনে রয়েছে ‘স্নো কিং’ ও জিঙ্গেল। মিক্সুয়েকে দেশটির জাতীয় আইকন বানিয়েছে এর গোলগাল মাসকট ‘স্নো কিং’। আইকনটি এখন রোনাল্ড ম্যাকডোনাল্ড ও কর্নেল স্যান্ডার্সের সমকক্ষ।

একইভাবে মিক্সুয়ের থিম সঙ্গীতটি দোকানে বাজে সবসময়। ইংরেজি সংস্করণের গানের কথা: “আমি তোমাকে ভালোবাসি। তুমি আমাকে ভালোবাসো। মিক্সুয়ে আইসক্রিম ও টি।”

সিঙ্গাপুরে প্রায়ই যেতে হয় আমেরিকান ব্যবসায়ি জুলিয়ান আইম্যানকে। সম্প্রতি তিনি সিঙ্গাপুর সিটিতে মিক্সুয়ের একটি শাখায় যান। সেখান থেকে বের হয়ে তিনি স্থানীয় এক সাংবাদিকের প্রশ্নের পরিপ্রেক্ষিতে জানান, মিক্সুয়ের আইসক্রিম ম্যাকডোনাল্ডসের চেয়ে ভালো। তবে তিনি মনে করেন, দোকানে সার্বক্ষণিক বাজানো জিঙ্গেলটি বন্ধ করা উচিত। কারণ এটি ওই দোকানের কর্মীদের জন্য অত্যাচার হয়ে যায়।

ইন্দোনেশিয়ায় সোশাল মিডিয়া প্লাটফর্মগুলোতে মিক্সুয়ে ট্রেন্ড হয়ে উঠেছে। মানুষ তাদের দৈনন্দিন মিক্সুয়ে পণ্য চাহিদা নিয়ে পোস্ট করছে ও মীম বানাচ্ছে। টুইটারে এটি সাধারণত ট্রেন্ডিং টপিকের মধ্যে থাকে। ইন্দোনেশিয়ায় মিক্সুয়ের সফলতার পেছনে তিনটি প্রধান কারণ রয়েছে: সরবরাহ চেইনের দক্ষতা, সাশ্রয়ী পণ্যের দাম ও সহজে ফ্র্যাঞ্চাইজি শুরু করার সুবিধা।

আন্তর্জাতিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে খাবার জাতীয় দূত হিসেবে কাজ করতে পারে। এমনকি কূটনীতিতেও প্রভাব ফেলতে পারে। একটি দেশ খাবারকে ‘সফট পাওয়ার’ হিসেবে ব্যবহার করতে পারে, যা তার সাংস্কৃতিক বৈশিষ্ট্য ও প্রতীকে তুলে ধরে।

২০১২ সালের একটি গবেষণায় দেখা গেছে যে, একটি ব্র্যান্ডের উৎপত্তি দেশ সম্পর্কে জনসাধারণের জ্ঞান ওই দেশের ইমেজ উন্নত করতে সাহায্য করে। যুক্তরাষ্ট্রে প্রায় ৫০০ জনের ওপর করা জরিপে এই গবেষণা, সেরা সুইডিশ প্রতিষ্ঠান আইকিয়ার বিষয়ে করা ওলে ওয়াস্টবার্গের দাবি সমর্থন করে যে, আইকিয়া সুইডেনের ইমেজের জন্য সরকারের চেয়ে বেশি কাজ করে। গবেষণাটি আরও খুঁজে পায়, জনপ্রিয় এনার্জি ড্রিংক রেড বুল অস্ট্রিয়ার ইমেজও উন্নত করেছে।

আরও পড়ুন

সর্বশেষ

ads